আমাদের গ্রামে মাঠের আলে বসে দেখেছি একটি সমান্তরাল কাঠের পাটাতনের পিছনে ফুটো করে তাতে শক্ত দড়ি বেঁধে বলদ দিয়ে সেটি টানা হচ্ছে। এর আগে লাঙল চলেছে, মাটির গভীরে আঁচড় কেটেছে কিন্তু জমি এবড়ো খেবড়ো। সেই পাটাতনের ওপরে পা দিয়ে দাঁড়িয়ে আমাদের নারান কাকা জমি সমান করার দুর্বার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে আমাদের গ্রামে এর নাম মই।
যে কাঠামোর ধাপে ধাপে পা দিয়ে মানুষ বাড়ির চালে ওঠে সেটাকেও তো বলে মই? সেই মই দিয়ে মাঠের অসমতল জমিকে সমান করা যায় না! নতুন গজিয়ে ওঠা ধানের ওপরে সেটি চালিয়ে দিয়ে ফসল বরবাদ বা অন্যের ক্ষতি করার জন্য তার ব্যবহার হয় না সেখানে লাগে আমাদের সেই কাঠের পাটাতন আর অন্তত দুটো বলদ!
ক্রিস্টিয়ানটির পবিত্রতম গিরজে, চার্চ অফ দি হোলি সেপালকারের সদর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে এই প্রকার অসংলগ্ন প্রশ্ন মাথায় এলো। গেটের ওপরে ডান দিকের জানলায় পাঁচ ধাপ ওলা একটা মই লাগানো রয়েছে। মাটি থেকে তার উচ্চতা অন্তত তিন মিটার। এ মই বেয়ে উঠতে গেলে প্রথমত তাতে চড়তে হবে, সেটি কি প্রকারে সম্ভব? ঝরিয়ায় স্কুলে পড়ার সময় সাধারণ জ্ঞান অর্জনের সহায়তার জন্য একটি বই কিনেছিলাম, তার নাম ‘কি, কোথায়, কেন?’ সেই বই আমার সর্বনাশ করেছে। বাকি জীবন নানা এঁড়ে প্রশ্ন করে গেলাম। উত্তর পেয়েছি অনেক কিন্তু তাতে কার কি লাভ হলো জানি না।
সেবার মলদোভার একটি ছেলে নিকো আমার সঙ্গে ইসরায়েলে দু দিন ঘুরেছে, অনেক খোঁজ খবর রাখে। সে আমার বিস্ময় দেখে বললে ও সিঁড়ি দিয়ে কেউ ওঠে বা নামে না গত আড়াইশ বছর, মই আছে জানলায় লাগানো তার ব্যবহার নেই তাহলে এটা সরিয়ে নেয় না কেন? নিকো বললে, তা হবার নয়। তুর্কি সুলতানের এক ফরমান মোতাবেক একে সরানো যাবে না। সেই ফরমান বা আদেশের সরকারি নাম স্থিতাবস্থা (status quo)।
এই জেরুসালেমে? যেখানে অটোমান সাম্রাজ্যের শেষ ঘণ্টি বেজেছে একশ বছর আগে? ক্রিস্টিয়ানদের গিরজেতে তুর্কি সুলতানের ফরমান বা ফিরমান?
প্রশ্নের উত্তরে নিকো বললে শুনলে হয়তো আরও অবাক হবেন, অন্তত আটশো বছর যাবত ক্রিস্টিয়ানদের এই পবিত্রতম গিরজের চাবি ও তার রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব বংশানুক্রমে আছে নুসাইবা ও ইউদে নামের দুই মুসলিম পরিবারের হাতে।
জানি আলি সাহেব জেরুসালেমকে ধর্মের ত্রিবেণী সঙ্গম বলেছিলেন। কিন্তু তার ভেতরে দুটো তরফের মধ্যে এমন ধারা গলাগলি যে এক ধর্মাবলম্বী মানুষ আরেক ধর্মের লোকের হাতে আপন মন্দিরের চাবিটি দিয়ে বলেছে, ভালো করে দেখাশোনা কোরো বাপু, তোমার ভরসায় রইলেন আমাদের গৃহ দেবতা?
হাজার বছরের বেশি এই পবিত্র ভূমি ছিল মুসলিম শাসনে। ১০০৯ সালে আল হাকিম (‘পাগল খলিফা’) চার্চ অফ দি হোলি সেপালকারে অগ্নি সংযোগ করেন। বিশ বছর বাদে অনুতপ্ত ফাতিমিদ আল জাহির তার পুনর্নির্মাণ করেছিলেন। ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধের কাহিনি আমরা শুনেছি। পবিত্র ভূমি জেরুসালেম থেকে মুসলিম শাসকদের উচ্ছেদ করার অভিলাষে বারে বারে ইউরোপ থেকে ক্রিস্টিয়ান সৈন্য বাহিনী এসেছে সমুদ্র পেরিয়ে, কখনও জিতেছে কখনও হেরেছে। একসময় টানা দুশ বছর (১০৯৯-১২৯১) জেরুসালেম শাসন করেছেন ক্রুসেডার, রাজা সাজেন নি। নিজেদের তাঁরা বলতেন গিরজের রক্ষক। পরের সাতশ বছরের মুসলিম শাসনে কোন গিরজে বা সিনাগগ ধ্বংস হয় নি, শাসকরা বরং ভাঙা চোরা ধর্মস্থান সারিয়ে দিয়েছেন, যে যার ধর্ম তার আচরণ করো নিজেদের মতন বাস করো। জেরুসালেমের চারটে পাড়া, মুসলিম মহল্লা শুক্রবারে বন্ধ, ইহুদি পাড়া শনিবারে বন্ধ, আরমেনিয়ান ও ক্রিস্টিয়ান পাড়ায় রবিবারে ছুটি। মুসলিম শাসক কারো ধর্ম আচরণে মাথা না গলানোর প্রচলিত প্রথাটি ভাঙতে বাধ্য হলেন যখন এক ধর্মের মানুষ তাদের নিজেদের মধ্যেই বিবাদ বাধাল।
সাফ সুতরো পবিত্র সমাধির গিরজেতে দেখা দিলো এক ধর্ম সঙ্কট। যিশুকে ঈশ্বরের সন্তান জ্ঞানে বন্দনা করার অধিকার সকল ক্রিস্টিয়ানের। কিন্তু তাদের মধ্যে গণ্ডগোল বাধল সেই বন্দনার আচরণ প্রক্রিয়া নিয়ে - কে কোথায় কি ভাবে কোন ঘণ্টা বাজিয়ে কোন ধুনো দিয়ে কবার পাখা নেড়ে দিনের মধ্যে কতবার প্রার্থনা করবে তাই নিয়ে লড়াই চলে ; দেবস্থানের ঠিক কোন কোণায় কে দাঁড়াবে তার মীমাংসা হয় নি, এই নিয়ে মারামারি হয়েছে প্রভুর ক্রুশের সামনে। ধর্মের এই কুরুক্ষেত্রের লিগে ছজন প্লেয়ার, ছয় পুরুত, পূজারী পক্ষ – গ্রিক অর্থোডক্স (তাদের গলা সর্বদা উঁচুতে, আমাদের ভাষায় বাইবেল লেখা হয়েছে, বাবা, নইলে কি কেউ জানতে প্রভু এয়েছেন?), আর্মেনিয়ান চার্চ (দুনিয়ার পয়লা ক্রিস্টিয়ান দেশ, যখন বাকিরা পুতুল পুজোয় ব্যস্ত), মিশরের কপটিক (প্রভুর বাল্যকাল কেটেছে আমাদের দেশে), ক্যাথলিক (রোমের সে মহান গিরজে কে বানালো শুনি?), ইথিওপিয়ান চার্চ (সলোমনের বউ আমাগো দ্যাশের মাইয়া), সিরিয়ান চার্চ (ক্রিস্টিয়ানের পয়লা দীক্ষা, দামাস্কাসের পথে?)। প্রত্যেকে চান তাঁদের আপন নিয়ম মাফিক এই গিরজের পরিচালনার ভার এবং চাবি। এই নিত্যি দিনের ঝগড়াঝাঁটিতে তিতিবিরক্ত হয়ে সম্ভবত (যতদূর জানা যায়) সালাদিন বললেন ‘তোমাদের কাউকেই দেবো না। এক দলকে দিলে আর পাঁচ পক্ষ খেউর শুরু করবে, সে ঝঞ্ঝাট আমার পোষাবে না, আমার রাজকর্ম আছে। আমি চাবি দিচ্ছি সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ সম্মানিত মুসলিম পরিবারবর্গের হাতে, তাঁরা বংশ পরম্পরায় এই গিরজের তত্ত্বাবধান করবেন’।
ধর্মের নামে উন্মত্ত এই পৃথিবীতে আজ সাতশ বছর ধরে তাই চলে আসছে – খ্রিস্ট ধর্মের সবচেয়ে পূজনীয় গিরজের রক্ষণাবেক্ষণের ভার দুই মুসলিম পরিবারের ওপরে সমর্পিত। আরবরা কবে চলে গেছেন, পাঁচশ বছরের তুর্কি রাজত্বের শেষ হয়েছে এক শতাব্দী আগে। তার পরে জেরুসালেম শাসন করেছে ব্রিটিশ, জর্ডান, ইসরায়েল কিন্তু গিরজের চাবি রয়ে গেছে ইউদে ও নাসবিয়া পরিবারের হাতে।
চাবির ভার পেলেন না কোন পক্ষ। কয়েকশ বছর কোন মতে কাটলে আবার সেই আচরণ বিধির বখেড়া মাথা চাড়া দিলো। পুজো আচ্চার রীতি রেওয়াজের ঝগড়া। গ্রিকরা বললে আমরা এখানে দাঁড়িয়ে প্রভুর অর্চনা করবো, ক্যাথলিকরা বলে মোটেও নয় ওটা আমাদের আমাদের জায়গা, আর্মেনিয়ান পুরুত মারধোর করে হটিয়ে দিলো কপটিক পূজারীকে। এবারে অটোমান সুলতান মধ্যস্ততার চেষ্টা করলেন – আহা তোমরা না হয় পালা করে সমাধির সামনে দাঁড়াবে, প্রার্থনা করবে। একদিন গ্রিক একদিন সিরিয়ান, ছদিন ছয় পক্ষ ; আবার সেই গ্রিক থেকে শুরু – এই রুটিন চলুক। সেটি বেজায় অসফল প্রমাণিত হলো : গ্রিক পুরোহিত চেয়ার নিয়ে বসে পড়েছেন তাঁর নির্দিষ্ট জায়গায় কিন্তু আর ওঠেন না, সারা রাত্তির সেখানেই অনশন করে বসে রইলেন। সকাল বেলা সিরিয়ান পূজারী এসে দেখেন তার জায়গা বেদখল। সে গেলো সুলতানের দরবারে নালিশ করতে। দিনের পর দিন একই নাটিকার অভিনয় হতে থাকে। প্রভুর সমাধির সামনে সকল পক্ষের এই মারমূর্তি, লড়কে লেঙ্গে অপনি জগহ স্লোগান শুনে শুনে অটোমান সরকার ক্ষিপ্ত হয়ে এক ফরমান জারি করলেন ১৭৫৭ সালের ইস্টার পরবের দিন – তোমরা ছ পক্ষ ঠিক যে ভাবে যেখানে বসে আজকের পুজো করছ সেটাই জারি রইবে তার কোন ব্যত্যয় হবে না। এই হল স্ট্যাটাস কো (তুর্কিতে স্টাতুসকো) বাংলায় স্থিতাবস্থা। সেদিন কোন এক সন্ন্যাসী গিরজের দেওয়ালে একটা মই লাগিয়েছিল- সে ঝাঁপিয়ে পড়ার উদ্যোগ বা হাওয়া খেতে বসার ব্যবস্থা করছিল কিনা অথবা চুনকামের মিস্ত্রি তার মই লাগিয়েছিল কিনা সে বিষয়ে বিতর্ক আছে। কিন্তু সেইদিনে সুলতানের ফরমান জারি হয়েছে – এই গিরজের রীতি রেওয়াজ আচার আচরনে কোন পরিবর্তন চলবে না – ছোটবেলায় অনেকে যেমন খেলেছেন ‘স্ট্যাচু’ বা ‘ফ্রিজ’, তেমনি। যে যেখানে দাঁড়িয়ে, সে সেখানেই থাকবে যে ধুনুচি যেখানে রাখা আছে সেখান থেকে নড়ানো যাবে না।
কেউ বলেছিলেন ‘আচ্ছা ওই যে একটা মই বেখাপ্পা ভাবে জানলার গায়ে লাগানো আছে, ওটার কি হবে?’
ততক্ষণে ফরমান পাঠ সম্পূর্ণ। প্রশ্ন শুনে সুলতানের প্রতিনিধি তাঁর হাতে রোল করা কাগজটা গুটিয়ে নিয়ে নাকি বলেছিলেন, ‘ওটাও সরানো যাবে না। আমার এই পাঠের সঙ্গে সঙ্গে স্ট্যাটাস কো বলবত হয়ে গেছে’।
সেই মই আজও সেখানে লাগানো – সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে।