একদা সিটি ব্যাঙ্ক অসলোর মক্কেল অধুনা ইসরায়েল বাসিন্দা বিওরন আগের দিন সন্ধ্যে বেলার ডিনারে বলেছিল জেরুসালেম ঘুরে এসো। গাড়ি এবং ড্রাইভার পাঠাবো। দাভিদ অবশ্য কেবল ড্রাইভার নয়, ডাক পড়লে গাইডের কাজও করে তবে কেবল ওয়ান টু ওয়ান, এই যেমন কাল তোমাকে নিয়ে যাবে! ইতিহাসটা তোমার আমার চেয়ে ভালো জানে। গল্পগুজবে সময় ভালো কাটবে।
সাড়ে আটটায় হিলটন অন দি বিচ হোটেলের রিসেপশনে দাভিদ হাজির হয়েছে, সঙ্গে একটি মাঝ বয়েসি ভোলভো গাড়ি। আলটপকা মন্তব্য করার পয়লা সুযোগ - দাভিদকে বললাম আমি লন্ডনের যে ইহুদি অধ্যুষিত অঞ্চলে বাস করি সেই গোলডারস গ্রিনের আরেকটা নাম চালু আছে – ভোলভো সিটি! ঐতিহাসিক কারণে ইহুদিরা জার্মান গাড়ি কিনতে অনিচ্ছুক, আর সেই জার্মানদের সঙ্গদোষের কারণে জাপানি গাড়িও বাদ। ফলে সুইডিশ গাড়ির বোলবোলাও। দাভিদ একটু অবাক হলেন,’ আপনি ইসরায়েলে সব দেশের গাড়ি পাবেন, দামে পোষালেই হলো!, আমি ভোলভো চালাই কেন না এ গাড়ি টেকে বেশি! এই দেখুন এর বয়েস বছর বারো, ধুলো বালি সয়েও দিব্যি টিকে আছে। তবে এখানে স্নো পড়ে না।
আমাদের প্রাথমিক যাত্রা দক্ষিনে, সমুদ্রকে ডান পাশে রেখে, বিচ বরাবর, তারপরে পশ্চিম মুখে শার্প টার্ন। সে পথে পড়ল হলোন, জানতাম না সেটি একদিন আমাদের এককালের ন্যানি, সেই কিশোরী শীরার, আবাস হবে দুই দশক বাদে। তেল আভিভ থেকে জেরুসালেম মেরে কেটে সত্তর কিলো মিটার রাস্তা – জার্মান হিসেবে আধঘণ্টা। কিন্তু ইসরায়েলে দেড় ঘণ্টার বেশি লাগে। পথে অনেক গাড়ি, কিছু নিতান্ত ঝরঝরে, কিছু শৌখিন আর বাস।
- জেরুসালেম যাওয়ার রেল লাইন নেই?
- আছে।
- ট্রেন?
- কখনো সখন।
গুরুর কথা মনে পড়লো।
কাবুল যাবেন চাকরিতে যোগ দিতে, আটকে পড়েছেন পেশাওয়ারে। সেখানকার বন্ধুজন মুজতবা আলি সাহেবকে পেয়ে আড্ডা জমিয়েছিলেন, তাঁকে ছাড়তে চান না, উলটে বুঝিয়েছেন কাবুল যাওয়াটা ভয়ানক শক্ত ব্যাপার। ট্রেন নেই, ক্বচিৎ চার চাকার কোন বাহন হয়তো পথ ভুলে সেদিকে যায়। তিনি অস্থির হয়ে পালানোর পথ খুঁজছেন। একদিন বাজারের চায়ের আড্ডায় বসে আলি সাহেব দেখলেন একটা বাসে লোকজন ওঠা নামা করছে। তিনি বললেন ‘আচ্ছা এই যে বাস দেখছি…’ তাঁর মুখের কথা ছিনিয়ে নিয়ে বন্ধু বললেন, ‘ ও বাস কাবুল যায় না।
- লাইন আছে তবে নিয়মিত ট্রেন যায় না কেন?
দাভিদ এই প্রশ্নেরই যেন অপেক্ষা করছিলেন। তিনি ইংরেজি বলেন চমৎকার, গল্প বলার ভঙ্গিটি অননুকরণীয়। তবু আমার মতন করে বলি -
‘একটু মনোযোগ দিয়ে যদি ম্যাপ দেখেন, লক্ষ করবেন ভূমধ্যসাগরের এই হাইফা বন্দর থেকে সিধে একটা লাইন টানলে সেটা চলে যাবে জর্ডান পেরিয়ে বাগদাদ, বাসরা অথবা সৌদি আরবের রিয়াধ – এটাই ছিল পুরো আরব দুনিয়া এন্ট্রি পয়েন্ট।। জাহাজে চড়িয়ে হামবুর্গ থেকে মেশিন আমদানি করতে গেলে পুরো আরাবিয়ান পেনিনসুলা ঘুরে সে মাল বাসরা পৌঁছুতে সময় নেবে অনেক, খরচাও বেশি। শোয়াশো বছর আগে এই ইকনমিকস বুঝে ফেলে অনেক ইংরেজ, ফরাসি এ অঞ্চলে ট্রেন লাইন পাতার ধান্দায় ঘোরাঘুরি করতে থাকে। ইংরেজের যতোই টেকনিকাল জ্ঞান থাকুক না কেন, জমির মালিক কনস্তানতিনোপেলের অটোমান সুলতান ; তিনি খামখা কূটবুদ্ধি ইংরেজকে রেল লাইন পাতার জন্য জমি দেবেন কেন? তিনি বললেন কেটে পড়ো, দান খয়রাতি করলে রাজ্য চলে না। ততদিনে ইংরেজ সেই লাইনের মাপজোক, এমনকি কোন খানে লাইন পড়বে তার অঙ্ক অবধি কষে ফেলেছে। খরচা হয়েছে, উশুল নেই। এবার তারা নরম সুরে ধর্ম সহিষ্ণু সুলতানের কাছে ইংরেজ (এবং কিছু ফরাসি) আবেদন জানাল, জাহাঁপনা, আপনি ক্রিস্টিয়ান, ইহুদিদের ধর্মস্থলের মেরামত করে দিয়েছেন, আপনার মহিমা অপার। একবার ভেবে দেখুন যাঁদের জন্য আপনার এই অসামান্য অবদান, তাঁদের, মানে ইহুদি ক্রিস্টিয়ান তীর্থযাত্রীদের পুণ্য শহর জেরুসালেমে পৌঁছুনোর পথে অনেক ঝকমারি, জাহাজ থেকে নেমে দুর্গম গিরি পার হতে হয়। সেই সব তীর্থ যাত্রী যদি জাফা (তেল আভিভের পত্তন এই মাত্তর ১৯০৯ সালে ; জাফা অতি প্রাচীন শহর) বা হাইফাতে জাহাজ থেকে নেমে ট্রেন ধরে সিধে জেরুসালেম যেতে পারেন তাহলে যাত্রী সংখ্যা ও সুলতানের তিজউরিতে অর্থাগম বাড়ে (জিজিয়া কর অবিশ্যি ততদিনে উঠে গেছে)। এই কাহিনি শুনে সুলতানের উজির বললেন হঠাৎ ইংরেজ ফরাসি এ তল্লাটে কেন হাজির হলেন তাঁরা নিজের রাজত্ব সামলান গিয়ে। এ হলো গিয়ে ১৮৬৫ সালের কথা।’
- আপনি যে বললেন ট্রেনের লাইন আছে?
‘বাকিটা শুনুন। ইতিমধ্যে রেল লাইন পাতা নিয়ে চাপান ওতর চলছে, এমন সময় য়োসেফ নাভন নামে আমাদের এক ইহুদি ভাই কনস্তানতিনোপেলে সুলতানের দরবারে হাজির হলো। জানেন তো অটোমান সুলতানদের কাছে আমাদের একটু বাজার দর ছিল, স্প্যানিশরা মেরে তাড়ালে এঁরা আমাদের আশ্রয় দিয়েছিলেন। য়োসেফ বললে প্যালেস্টাইনে রেল চললে প্রজা ও রাজা দু পক্ষেরই লাভ। তবে শুধু জাফা-জেরুসালেম কেন প্রভু, প্যালেস্টাইন পেরিয়ে এদিকে মিশর অন্যদিকে সিরিয়া চলে যেতে পারে ট্রেন,সবটাই আপনার সলতানৎ । আরেকটা কথা, সে ট্রেন ছাড়বে কনস্তানতিনোপেল থেকে। বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না তিন বছর যাবত য়োসেফ রুটি আর বাদাম খেয়ে (আমাদের ভাষায় আদা জল) পড়ে রইল কনস্তানতিনোপেলে। নিয়মিত যায় তোপ কাপিতে, সরকারের দফতরে। ইস্তানবুল গেছেন তো, তোপ কাপি চেনেন? একদিন তার ভাগ্যের চাকা ঘুরল। সুলতান একাত্তর বছরের জন্য জাফা-জেরুসালেম ট্রেন লাইন পাতার ফরমান বা কনসেশান, জমি অনুদানের সম্মতি দিলেন সামান্য ফি'র বিনিময়ে। এবার য়োসেফ গেল সেই ইংরেজের কাছে যারা এতদিন এরই জন্যে হা পিত্যেশ করে বসে ছিল। তাঁরা ক্ষেপে গেলেন, ফরমানটা তারা নয়, পেয়েছে জেরুসালেমের এক ইহুদি! তাঁরা বললেন আমরা ওতে নেই। এবার প্যারিস! ইংরেজের সঙ্গে জুটে ফরাসি এই ট্রেন লাইনের ব্যাপারে খানিকটা জেনে ফেলেছে। প্যারিসে জুটল ইনভেসটর, লাইন তৈরি হলো,। আরও মজার কথা কি জানেন? এই রেল কোম্পানির বোর্ড মূলত ফরাসি ক্যাথলিক তার সঙ্গে বসল য়োসেফ, তার ভাইপো, একজন গ্রিক অর্থোডক্স এবং এক সুইস প্রটেস্টান্ট ব্যাংকার – চার ধম্মের মানুষের একত্রে ওঠা বসা, এই যেমন জেরুসালেম শহরে নিত্যি দিন হবার কথা। পয়লা দফায় জাফা-জেরুসালেম ট্রেন চলল, ঠিক একশ বছর আগে।
আপনারা জেরুসালেম বলেন, হিব্রুতে ইয়েরুশালায়িম, মানে শান্তির অধিকার। শান্তি বস্তুটা এ শহরের কপালে নেই, দখল নিয়ে লড়াই হয়েছে হাজার বছর। তেমনি জাফা -জেরুসালেম ট্রেন লাইনে বোমাবাজি হয়েছে বারে বারে’
- বারে বারে কেন?
- অটোমানদের হারাতে পয়লা বড়ো লড়াইয়ে (বিশ্বযুদ্ধ) ট্রেন লাইন ওড়াল ইংরেজ, তুর্কী বিদেয় হলে ইংরেজ ম্যানডেট আমলে স্বাধীনতার দাবিতে বোমা বাঁধল ইহুদি হাগানা, ইহুদিদের ইসরায়েল রাষ্ট্র বনে গেলে তাদের তাড়াতে ওড়ালো প্যালেস্টিনিয়ান লড়াকু যোদ্ধা। ট্রেন লাইন একটাই, ওড়ানোর কারণটা বদলিয়ে গেছে রাজনৈতিক অবস্থা অনুযায়ী! একবার ডাইনে তাকিয়ে দেখুন, সাতষট্টির যুদ্ধের একটা ভাঙা ট্যাঙ্ক, সেটাও ওই লাইন ওড়ানোর চেষ্টা করেছিল!’
পুঃ
রেলপথ খুব খারাপ, সারানো বা মেরামতি হয় না। সেই সময়ে, নয়ের দশকে, দিনে একটি ট্রেন কোনমতে জাফা থেকে জেরুসালেম যেতো, বিকেলে ফিরে আসতো। অনেক চিন্তা ভাবনার পরে এবং বিপুল অর্থব্যয়ে শেষ পর্যন্ত ইসরায়েলি সরকার সেই পুরনো লাইনকে স্ট্যান্ডার্ড গেজের ছাঁচে ঢেলে ট্রেন চালাচ্ছেন এই ২০১৮ সাল থেকে। খুব মডার্ন ব্যাপার স্যাপার। একদিকের ভাড়া চারশ টাকা।
পরে জার্মানিতে বন্ধু অরটউইনের বাবার কাছে বারলিন-বাগদাদ ট্রেন রুটের কাহিনি শুনেছি – প্রথম মহাযুদ্ধের সময়ে জার্মান কাইজার এই রেল রুট কায়েম করে সুয়েজ খালের ওপরে ব্রিটিশ আধিপত্যকে সম্পূর্ণ এড়িয়ে প্রাচ্যে ব্যবসা বাণিজ্য এবং সামরিক আধিপত্য বৃদ্ধির পরিকল্পনা করেন। তবে তাঁর আমলে সেটা হয়ে ওঠে নি, ১৯৪০ সাল নাগাদ, মহাযুদ্ধের ঘোর ঘনঘটার মধ্যেই কনস্তানতিনোপেল -বাগদাদ ট্রেন চালু হয়। আমরা কনস্তানতিনোপেল -প্যারিস, ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেসের কথা সবাই জানি। তরুণ তুর্কীরা ট্রেন চালিয়েছিলেন কনস্তানতিনোপেল হতে একদিকে সিরিয়া লেবানন ছাড়িয়ে বাগদাদ বাসরা, অন্যদিকে সিরিয়া হতে ডাইনে মুড়ে আরেক ট্রেন আজকের ইসরায়েলের হাইফা জাফা পেরিয়ে একেবারে কাইরো। কনস্তানতিনোপেল - কাইরো বা বাগদাদ দুটোই দিন তিনেকের পথ। ট্রেনের নাম টরাস এক্সপ্রেস।
বাইবেলে বহু উল্লিখিত গাজা ছিল ব্যস্ত সমুদ্র বন্দর। ট্রেন আসার অনেক আগেই বণিকদের উটেরা যাত্রা করেছে মিশর থেকে সিরিয়া আজকের গাজা পেরিয়ে ভূমধ্যসাগর বরাবর আফ্রিকার সঙ্গে এশিয়ার যোগাযোগ করেছে যে হাইওয়ে তার ঐতিহাসিক ল্যাটিন নাম ভিয়া মারিস বা সমুদ্র পথ অথবা বাইবেলে উল্লিখিত প্যালেস্টাইন পথ (হিব্রু বাইবেলে এর উল্লেখ আছে – ইসাইয়া নবম পরিচ্ছেদ প্রথম লাইন)।
ইসরায়েলি সরকার অবিশ্যি বলেন চিরদিন পুরো দেশটা ছিল ইসরায়েল। দু হাজার বছর আগে ইহুদি বিতাড়িত হলে পর থেকে খালি পড়েছিল, তাঁরা এসে প্রপিতামহের জমিদারির দখল নিয়েছেন। প্যালেস্টাইন নামের কোন দেশ কখনো ছিল না।
আজকে গাজা কেন, অধিকৃত প্যালেস্টাইনের কোথাও কোন ট্রেন চলে না।