ব্যক্তিগত জীবনে সময়ানুবর্তিতার সুনাম আমার না থাকলেও হলফ করে বলতে পারি চার দশকের কর্ম কালে কোন পূর্ব নির্ধারিত ব্যবসায়িক মিটিঙে অনুপস্থিত থাকি নি। কথা রাখার কথা ছিল আমার, রেখেছি সাধ্যমত।কখনো দেরি হয়েছে – তার জন্য দায়ী করেছি লাগোস লন্ডন বা প্যারিসের মন্থর যান যাত্রাকে। টেবিলের অপর প্রান্তে আমার হোস্ট স্মিত মুখে বলেছেন, ‘কাকে বলছেন, আমরা নিত্যদিনের ভুক্তভোগী। আসুন, কফি খান।’
ব্যত্যয় ঘটেছে মাত্র একবার। আমি কাউকে আমন্ত্রণ জানিয়েছি, তিনি এসেছেন, অপেক্ষা করে ফিরে গেছেন। দেখা করতে পারি নি। অকুস্থল হিলটন অন দি বিচ হোটেল, তেল আভিভ, ইসরায়েল।
আমাদের ফেরার দিন এসে গেল। কাজে কর্মে এত তাড়াতাড়ি সময় কেটে গেছে সবার সঙ্গে দেখা করা হয়ে ওঠেনি। একটি বিশেষ ইসরায়েলি কোম্পানির (টালি) সঙ্গে আমাদের বাণিজ্যিক সম্পর্ক বেশ কিছুদিনের। তাদের লন্ডন অফিস যার সঙ্গে দেখা করতে বলেছিল তাঁকে ফোন করে জানালাম গিয়ে দেখা করতে পারি নি তার জন্য লজ্জিত। আজ লন্ডন ফিরছি, হাতে সময় খুব কম, তবু দেখাটা হোক। তাই বিনীত অনুরোধ যদি পারেন অফিসের পরে সন্ধ্যেয় আমার হোটেলে চলে আসুন। ফ্লাইট দশটায় তবে আমাকে জানানো হয়েছে সামান সমেত চেক ইন হবে হোটেলেই। অতএব এয়ারপোর্ট পৌঁছুনোর তাড়া নেই।
আভির অফিস রামাত গান এলাকায়, আধ ঘণ্টার দূরত্ব। বললেন কাজের শেষে সাতটা নাগাদ আসবেন, অন্তত এক ঘণ্টা সময় নিয়ে। আমার চেক ইন পর্ব শুরু হবে সাড়ে ছটায়, সে আর কতক্ষণের ব্যাপার। ব্রিটিশ ট্রেড ডেলিগেশন হোটেলের কয়েকটি মিটিং রুম বুক করে রেখেছিল। রিসেপশনে বলে রাখলাম সাতটা নাগাদ এই নামের মানুষটি এলেই তাঁকে যেন পাঁচ তলার ঘরে সমাদরে বসানো হয়।
টি এস (তারা শঙ্কর) রায় নামের এক জাঁদরেল অফিসার ছিলেন স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার বম্বে অফিসে। তিনি একবার কলকাতা এসেছেন আমাদের এক নম্বর স্ট্র্যানড রোডের অফিসে। আমরা নবীন যুবক কর্মীরা তাঁর আশে পাশে ঘোরাঘুরি করি, যদি চোখে পড়তে পারি। আমার মতন তিনিও জলপাইগুড়ি ব্রাঞ্চে প্রবেশনারি অফিসার হয়ে লেজার লিখেছেন। একদিন রায় সাহেব আমাকে বললেন, ‘কাল আমার ফেরা। সিটি চেক ইন করিয়ে দেবে। আমি কখনো সেটা এয়ারপোর্টে করি না’। এমন একটা দায়িত্বপূর্ণ কাজের ভার পেয়ে আনন্দের সীমা নেই কিন্তু সিটি চেক ইন কি বস্তু কিভাবে তা করা যায় জানতে অন্যের দ্বারস্থ হতে হলো।
জানলাম কলকাতার চিত্তরঞ্জন এভেনিউতে ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্স অফিসে সেটি সম্ভব। যাত্রীর টিকেট ও মাল পত্তর নিয়ে ফ্লাইটের আগে ভাগেই কেউ গিয়ে তার সিট বুক করে বোর্ডিং কার্ড সংগ্রহ এবং বাক্স প্যাঁটরা জমা দিতে পারে। যাত্রীর সেখানে পরিচয়পত্র দূরের কথা হাজিরা দেওয়ারও কোন প্রয়োজন নেই। তিনি সম্পূর্ণ খালি হাতে অথবা আতাচি কেস নিয়ে সিধে হাওয়াই জাহাজে উঠবেন।
আমাকে যখন ডেলিগেশনের যোগাযোগ সাধনের ভারপ্রাপ্ত মহিলা জানিয়েছিলেন হিলটন হোটেলের দোতলায় আমার চেক ইন হবে, কলকাতায় চিত্তরঞ্জন এভিনিউতে ইন্ডিয়া এয়ারলাইনসের ডেস্কের ছবি মনে ভেসে উঠেছিল। ব্যবস্থা ভালোই, খালি হাতে মিনিবাসে উঠে গল্প গুজব করতে করতে বেন গুরিওন এয়ারপোর্ট পৌঁছে যাবো, অধিক রাতে সেখানে মাল টানাটানি করতে হবে না। পাঁচ মিনিটের ব্যাপার, এটা চুকে গেলে আভির সঙ্গে সাক্ষাৎ করব পাঁচ তলায়।
চেক ইন হবে দোতলায়, পাশাপাশি কয়েকটি ঘরে। ঠিক সাড়ে ছটায় আমার পাসপোর্ট, ব্রিটিশ এয়ারের টিকেট এবং সুটকেসটি নিয়ে হাজির হয়েছি। ঢুকতেই সামনে ডেস্ক, একজন বয়স্ক মানুষ বসে আছেন।তাঁর পিছনে এক তরুণী দাঁড়িয়ে। দুজনের পরনে একই স্টাইলের কালো রঙ্গের পোশাক। ইউনিফর্ম?
আসন গ্রহণ করার প্রয়োজন বোধ করি নি, কয়েক মিনিটের কাজ। আমার টিকেট ও পাসপোর্ট এগিয়ে দিলাম ডেস্কে অধিষ্ঠিত ভদ্রলোকের দিকে। তিনি বললেন, একটু বসুন। এই সুরটা চেনা মনে হল - ঠিক এইভাবেই কি হিথরোতে সেই পরীক্ষকরা বলেছিলেন আপনি একটু বসুন?
বসলাম। নিজের নাম পরিচয় দিলেন না। আমার পাসপোর্টটি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে শুরু করলেন। তখন আমার নীল রঙ্গের বেঢপ দিশি পাসপোর্ট। নরডিক বাদে ইউরোপের অন্যত্র যেতে ভিসা লাগে, ফলে সেটার পাতা রঙ্গ বেরঙের স্ট্যাম্পে ভর্তি হতে সময় লাগে নয়া । এক সময় পাতা ফুরিয়ে যায়, পাসপোর্টের আয়ু তখনো বহাল। নতুন পাসপোর্ট ইস্যু না করে ভারতীয় দূতাবাস আরও পাতা জুড়ে দেন –আমাদের পরীক্ষার সময়ে যেমন আমরা অতিরিক্ত পাতা চেয়ে লিখতাম; তারপর সেগুলি সুতো দিয়ে বেঁধে জমা দিতাম। যে যত বাড়তি পাতা নিয়েছে সে তত ভালো পরীক্ষা দিয়েছে এমন ধারনা করা হতো। আমার মোটা সোটা পাসপোর্ট হাতে নিয়ে কোন কোন ইমিগ্রেশন অফিসার বলেছেন ‘আপনি একেবারে ভু পর্যটক’ (ইউ আর এ মাচ ট্রাভেলড ম্যান)।
পরীক্ষকের মুখে কোন বাক্যি নেই, পাতা ওলটাচ্ছেন। আমি বললাম আমার ইসরায়েলি ভিসার কাগজটা ওর ভেতরেই আছে আর যদি ব্রিটিশ ভিসা খুঁজছেন আমি সেই পাতাটা খুলে দেখাতে পারি। নিরুত্তরে চোখ তুলে তাকিয়েই আবার পাসপোর্টে মনোনিবেশ করলেন। এতো মন দিয়ে আমি দস্যু মোহন বা দীপক চ্যাটারজির বিশ্বচক্র সিরিজের বই পড়ি নি। পিছনের ভদ্রমহিলাকে আমার সুটকেসটি দিয়েছিলাম আমার অনুমতির অপেক্ষা না রেখে তিনি সেটি খুলে দেখেছেন।
পাঠকের অবগতির জন্য ওই ইসরায়েলি ভিসার কাগজের ব্যাখ্যান করি। সে সময়ে সকল আরব দেশ, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া ইত্যাদি বহু দেশের সরকার তাঁদের নাগরিকদের ওপরে এক নিষেধাজ্ঞা জারী করেছিলেন –এই পাসপোর্ট নিয়ে ইসরায়েল যাওয়া যাবে না। ইসরায়েল আপনাকে আটকাবে না হয়তো কিন্তু যদি সেখানে ঢুকে পড়েন আর পাসপোর্টে ছাপ পড়ে, আমাদের গোচরে আসা মাত্র সেটি বাতিল হয়ে যাবে; আপনি রাষ্ট্রশূন্য (স্টেটলেস) এবং দিকশুন্য হয়ে পড়বেন। শুধু তাই নয়, আপনার পাসপোর্টে ইসরায়েলি ইমিগ্রেশান স্ট্যাম্প থাকলে ওই একই দেশ গুলি আপনার প্রবেশ নিষিদ্ধ করবে। ব্রিটেনের কোন বৈরিতা নেই ইসরায়েলের সঙ্গে কিন্তু আমার পাসপোর্টে ইসরায়েলি ছাপ থাকলে আমার বাহরেনে ঢোকা বারণ হবে। ইসরায়েল এ ব্যাপারে সম্যক অবহিত ছিল। তাদের দূতাবাস বলে দিতো আপনার সরকারকে জানানোর প্রয়োজন কি? পাসপোর্টে আমরা ভিসার ছাপ দেব না, ভিসাটি দেওয়া হবে এক আলাদা কাগজে, পাসপোর্টে নয়। কেউ জানবে না আপনি দিজেনগফ স্কোয়ারে মাল বেচেছেন অথবা ডেড সীতে জলের ওপরে শুয়ে খবরের কাগজ পড়েছেন। সাপ মরবে লাঠি ভাঙবে না।
আমার পরীক্ষক মাথা তুললেন, ‘আপনার ইসরায়েলি ভিসা এবং ব্রিটেনে স্থায়ী ভাবে বসবাসের অনুমতির স্ট্যাম্প দেখেছি। আপনি খুব ঘোরেন!’ এটা প্রশ্ন না মন্তব্য না বুঝেই বললাম, সবটাই সিটি ব্যাঙ্কের কাজে। ভালো করে আমার দিকে তাকালেন, কিছু বললেন না। হয়তো ভাবছেন সিটি ব্যাঙ্ক আর লোক পায় নি এই দাড়িওলা ভারতীয়কে যেখান সেখান পাঠায়।
ঘড়িতে পৌনে সাতটা। এরা কখন ছাড়বে আমাকে? আভি হয়তো এসে গেছে। বলতে পারছি না আমার মিটিং আছে। তিনি লক্ষ করলেন। বললেন আপনার ফ্লাইট রাত দশটায়, অনেক সময় আছে।
- তা জানি, তবে আমার একটা বাণিজ্যিক মিটিং আছে সাতটায় এই হোটেলে। পাঁচতলার মিটিং রুমে একজন আমার জন্য অপেক্ষা করছেন হয়তো।
- আমার কিছু প্রশ্ন আছে সেগুলোর সঠিক উত্তর পেলেই আপনি মিটিঙে যেতে পারেন।
তিনি একটা বেল টিপতে উর্দি পরা এক হোটেল কর্মী উঁকি দিলো। পরীক্ষক তাকে হিব্রুতে কিছু বললেন। আমাকে জানালেন অভ্যাগতকে বসতে বলা হচ্ছে। খানিকবাদে সে ছেলেটি ফিরে এসে আমাকে ইংরেজিতে বললে আপনার গেস্ট অপেক্ষা করতে রাজি আছেন।
এবারে সত্যিকারের পরীক্ষা শুরু হল। আমি তার আঁখো দেখা হাল লিখে আপনাদের ধৈর্যচ্যুতি করতে চাই না। সংক্ষেপে প্রশ্নমালা এই প্রকারের-
- ব্যবসার কারণে এসেছেন, কার কার সঙ্গে দেখা করলেন?
- শুধু নাম নয়, বিজনেস কার্ড দেখান, তাঁদের নাম টেলিফোন নম্বর?
- আলোচনার বিষয় বস্তু? আমি ব্যাঙ্কিং বুঝি। বিস্তৃত বলতে পারেন।
- মিটিঙের স্থান কোথায় ছিল? আপনাদের ইসরায়েলে তো কোন অফিস নেই।
- কতক্ষণ ধরে চলে এইসব মিটিং?
- ব্রিটিশ রাজদূতের সঙ্গে দেখা করার কি কারণ? আপনি তো ব্যাঙ্কার।
- অর্থ মন্ত্রনালয়ে গিয়েছিলেন দেখছি
বানিজ্য যাত্রায় সংগৃহীত বিজনেস কার্ড গুলি আমার জ্যাকেটের ভেতরের বাঁ পকেটে রাখার একটা পুরনো অভ্যেস আছে। সাধারণত প্লেনে ফেরার সময়ে সেই কার্ডগুলিকে আপন পি সিতে ট্রান্সফার করি। সেই অভ্যাসটা কাজে লেগে গেল। সাধ্যমত উত্তর দিয়েছি। কোন উত্তরে তিনি খুশি হলেন কোনটায় হলেন না বোঝা গেলো না। পোকার ফেস।
আমার সুটকেস পর্যবেক্ষণকারী মহিলা এবারে মুখ খুললেন
- এসেছেন পাঁচ দিনের জন্য। এত জামা কাপড় এনেছেন কেন?
কখন এক ঘণ্টা কেটে গেছে। কাঁহাতক এই জিজ্ঞাসাবাদের জের সামলানো যায়।
- এখানে বেজায় গরম তো তাই দিনে দুবার পোশাক বদল করার জন্য কিছু অতিরিক্ত এনেছি।
মহিলা কিছু বললেন না। পরীক্ষক পাশ ফিরে একটা ইঙ্গিত করতেই মহিলা আমার সুটকেসের সামগ্রী একত্রিত করা শুরু করলেন। এবার কি?
পরীক্ষক কোন কথা না বলে আমার দিকে চেয়ে আছেন, যাকে ইংরেজিতে বলে ফিক্সড গেজ। এবারে হাতে বোর্ডিং কার্ড, সুটকেস জমা দেওয়ার টিকিট তুলে দিলেন।
- আপনাদের এয়ারপোর্টে যাবার মিনিবাস হয়তো নিচে অপেক্ষা করছে। সহযোগিতার জন্য ধন্যবাদ। শুভ যাত্রা, শালোম
- তোদা রাবা। শালোম শালোম।
ঊর্ধ্বশ্বাসে পাঁচ তলার কনফারেন্স রুমে গিয়ে দেখি সে ঘর শূন্য। টেবিলে দুটো কফির কাপ আর একটা টুকরো কাগজ।
ইউ মাস্ট হ্যাভ বিন বিজি। দেয়ার ইজ অলওয়েজ এ নেক্সট টাইম।
অ্যাজ উই সে ইন হিব্রু, শালোম
- আভি।