জেরিকো
পাঁচ জন অর্থনীতিবিদ একত্র হলে যে কোন বিষয়ে ছয় রকমের অভিমত প্রকাশ করেন। মতের অমিল অন্য বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও হয়তো সম্যক প্রযোজ্য - কিন্তু অন্তত একটি শহরের বয়েস সম্বন্ধে গুণীজনেরা একমত। এই পৃথিবীর প্রাচীনতম শহরের নাম: হিব্রুতে ইয়ারিহো, আরবিতে আরিহা, ইংরেজিতে জেরিকো। এগারো হাজার বছর যে তার স্থাপনা হয়েছিল সকলে মানেন। ঈশ্বরের আদেশ অনুযায়ী জর্ডান নদী পেরিয়ে কানানের আদি অধিবাসীদের উৎখাত করে প্রতিশ্রুত ভূমি দখলের সদুদ্দেশ্য নিয়ে জশুয়া তাঁর অভিযান শুরু করেছিলেন- নতুন দেশে ঢুকেই প্রথম যে দেওয়াল ঘেরা শহরের মুখোমুখি হলেন তার নাম জেরিকো। সে শহরের রাজা সব দ্বার বন্ধ করে দুর্গে কুলুপ মেরে বসে রইলেন। ঈশ্বর তখন জশুয়াকে আদেশ দিলেন ছদিন ধরে তুমি এই দেয়াল প্রদক্ষিণ করবে, দিনে একবার, সপ্তম দিনে সাত বার – শেষের সে দিন সাত পুরোহিত ঐশ্বরিক চুক্তির দলিল (আর্ক অফ কভেনানট) সামনে রেখে শিঙ্গা বাজালে হুড়মুড় করে ধ্বসে পড়ে জেরিকোর শক্ত দেওয়াল। জেরিকোর মানুষ লড়াই করেছেন বলে জানা যায় না তবে হিব্রু বাইবেল বলেছে জশুয়ার বাহিনী শহরে প্রবেশ করে নারী পুরুষ নির্বিশেষে সকলকে হত্যা করে, গোরু ছাগল গাধা বাদ যায় নি। কানান অভিযানের প্রথম যুদ্ধে বিজয়ী জশুয়া জেরিকোকে শাপ দিলেন – ভবিষ্যতে কেউ যদি জেরিকোর প্রাচীরের পুনপ্রতিষ্ঠা করে তাদের প্রথম সন্তানের তৎক্ষণাৎ মৃত্যু হবে (জশুয়া ষষ্ঠ বই)। তাদের পানীয় জলের স্বাদ হবে তিক্ত।
এইখানে আমাদের গাইড, ইস্ট জেরুসালেমের সায়েদ একটু বিরতি নিলেন।
সকালে জেরুসালেম থেকে বেরিয়েছি সঙ্গে কন্যা মায়া। তার স্কুলের রিলিজিয়াস এডুকেশন পাঠে একটু সহায়তা করতে গিয়ে কথা দিই একবার আমরা জেরুসালেমে একসঙ্গে ইস্টার পরব কাটাবো, যিশুর শেষ যাত্রা পথে হাঁটবো তার আগে বাকি দেশটা একটু দেখে নেওয়া যাবে। জেরুসালেম থেকে খাড়া উত্তরের যাত্রা পথে বাঁ পাশে চলেছে জুডেয়ার পাহাড়, প্রখর রৌদ্রে তার চেহারা আরও ভয়ঙ্কর, রুক্ষ। কোথাও কোন সবুজের, প্রাণের চিহ্ন মাত্র নেই। ভেড়া গোরু চরতে দেখা যায় না প্রায়। মরুভূমির এই সফরে ক্রমশ নেমে যাচ্ছি সমুদ্রতট (সী লেভেল) থেকে নিচে আরও নিচে।
অকস্মাৎ মায়া একটি প্রশ্ন করল – আচ্ছা সায়েদ এটা হিব্রু ৫৭৭৮ সাল, তাই তো (আনো দমিনি ২০১৭ সাল সেটা)? জেরিকোর বয়েস এগারো হাজার বছর যদি হয় তাহলে আদম ইভ, হিব্রু দিন গণনা শুরুর সাড়ে পাঁচ হাজার বছর আগেই এই শহর তৈরি হয়েছে?
আমার সংসর্গের প্রভাবে সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ এবং যত্র তত্র এঁড়ে তর্ক করাটা মায়ার অভ্যেসে পরিণত হয়েছে। তবে তার যুক্তিটা কোন দিকে যাচ্ছে বুঝতে অসুবিধে হয় না। সম্মানিত ইহুদি পণ্ডিত দার্শনিক মায়মনিদেস বিস্তর গবেষণা করে বললেন বিশ্বসৃষ্টির সময়কাল হলো খ্রিস্টপূর্ব ৩৭৮১। সেই বছরে ঈশ্বর সৃষ্টি করলেন আলো, দ্বিতীয় দিনে আকাশ ইত্যাদি। সেই সব কঠিন কর্ম শেষে সপ্তম দিনে তিনি বিশ্রাম নিলেন, অর্থাৎ ৫৭৭৮ বছর আগের প্রথম শনিবার। সেটাই হিব্রু ক্যালেন্ডারের প্রথম দিন। তাহলে জেরিকোর বয়েস কেমন করে এগারো হাজার হয়?
এই বছরটা ৫৭৮৪।
প্রমাদ গুনলাম। মায়া হিব্রু পঞ্জিকার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে! এই পুণ্যভূমিতে দাঁড়িয়ে বাইবেলের গণনা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করা? সায়েদ ইহুদি নন, কিন্তু সকল আব্রাহামিক ধর্ম ছ দিনে দুনিয়া বানানোর তত্ত্বটা মেনে নেয়। ঠিক কোন বছর ঈশ্বর এ কাজ শুরু করেছিলেন তা নিয়ে কোন বিতর্ক ক্রিস্টিয়ান বাইবেল বা কোরানে সম্ভবত নেই। তবে ঈশ্বরের স্টার্ট ডেট নিয়ে তিন মত – তাই তাঁর বিশ্রামের দিন ইহুদি মতে শনিবার, ইসলামে শুক্রবার, ক্রিস্টিয়ান মতে রবিবার। জেরুসালেমের চারটে পাড়া, ক্রিস্টিয়ান ও আর্মেনিয়ান পাড়ায় রবিবার দোকান বন্ধ, ইহুদি পাড়ায় শনিবার, মুসলিম পাড়ায় শুক্রবার। সেখানে ব্যাঙ্কের কাজ যে কিভাবে চলে জানি না। তবে যেখানে আমাদের মুখ্য ব্যবসা সেই তেল আভিভে কেবল শনিবারে ছুটি।
সায়েদ গাইড, তিনি সব গল্পের খবর রাখেন, হর তালেকা চাবি রখখে হর চাবি কা তালা! দুনিয়ার সকল প্রকার চিড়িয়ার সঙ্গে পরিচিত। তিনি ম্যানেজ করলেন ভালো, একবার মায়ার হাতের আইফোনটা দেখে নিয়ে বললেন - মায়া, বাইবেলের দিন তারিখের হিসেবের সঙ্গে আমাদের হিসেব মেলে না! ওটা তোমার স্টিভ জব সাহেবের আগের ক্যালকুলেশন। এই যে আমরা বলি, আপেলের সঙ্গে আপেলের তুলনা চলে, পীচ ফলের নয়!
জেরিকোর বিশেষ উল্লেখ আছে হিব্রু এবং ক্রিস্টিয়ান বাইবেলে। সায়েদ সেগুলি দেখাতে বদ্ধ পরিকর।
জেরিকো ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে, নামে প্যালেস্টাইন অথরিটি অধীনে, প্রকৃতপক্ষে ইসরায়েল দ্বারা অধিকৃত। আমরা এসেছি ইস্ট জেরুসালেম থেকে প্যালেস্টিনিয়ান গাইড তথা ড্রাইভারের সঙ্গে (ইসরায়েলিদের এমনিতে এ অঞ্চলে প্রবেশ নিষেধ)। ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের নাম্বার প্লেট ওলা গাড়িতে। এ দেশে গাড়ির নাম্বার প্লেট দু রকমের – ইসরায়েলি গাড়িতে হলুদ পটভূমিকায় কালো নম্বরে তিন-দুই-তিন সংখ্যা, প্রথম ছটি রেজিস্ট্রেশন এবং শেষের দুটি সিরিজ চিহ্নিত করে। প্যালেস্টাইনের নাম্বার প্লেট সম্পূর্ণ আলাদা, ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে সাদার ওপরে সবুজ অথবা সাদার ওপরে কালো। আগাম চিনে নেওয়া যায় কার আনুগত্য কোন খানে।
প্রথম স্টপ একটি বটগাছ, ইংরেজিতে তার নাম সিকামুর (বাংলায় কোন নাম খুঁজে পাই নি)
যিশু নামের একজন মানুষের কথা খুব শোনা যাচ্ছে। গুজব তিনি পঙ্গুকে সচল করেন, অন্ধকে দৃষ্টিদান করেন, সাতটা রুটি আর কয়েক টুকরো মাছ দিয়ে পাঁচ হাজার মানুষকে পেট পুরে খাওয়ান। এই বার্তা রটি গেল গ্রামে শহরে, তিনি এবার জেরিকো আসবেন। জাকেউস এক ধনী ব্যক্তি, তখন জেরিকোর ট্যাক্স কালেক্টর, শহরে বাজারে তাঁকে কেউ পছন্দ করে না। এমন মানুষও কৌতূহলী হলেন- কে এই যিশু? তাঁকে কি আগে ভাগে দেখা যায়? একটা সমস্যা ছিল- জাকেউস মাথায় খাটো। যিশুর ভক্ত গোষ্ঠীর ভিড়ভাট্টার ভেতরে তিনি কি সেই যিশু নামক মানুষটির কাছাকাছি যেতে বা তাঁকে দেখতে পাবেন? জাকেউস একটা শর্ট কাট বের করলেন - শহরের ঢোকার মুখে চৌরাস্তার মোড়ে ছিল একটি সিকামুর গাছ, তিনি সেই গাছে চড়ে বসলেন। যিশু তাঁর অনুগামীদের নিয়ে জেরিকো প্রবেশ করার সময়ে তাঁকে লক্ষ করলেন, বললেন গাছ থেকে নেমে আসুন, আমার সামনে দাঁড়ান। লুকের সুসমাচার (গসপেল) অনুযায়ী যিশু জাকেউসকে বলেন, আমি কি আপনার গৃহে আজকের সান্ধ্য আহার গ্রহণ করতে পারি? শহরে জাকেউসের বিশেষ বদনাম ছিল, রোমান রাজার কর্মচারী তিনি, ট্যাক্স হিসেব করায় ধূর্ত অনেককে ঠকিয়েছেন। সমবেত জনতা এইসব বলে তাঁকে তুলোধোনা করতে শুরু করলেই জাকেউস যিশুকে বললেন, আমি কথা দিচ্ছি যার কাছ থেকে যা বেশি নিয়েছি তার চারগুণ ফেরত দেব। লুকের সুসমাচার অনুযায়ী এইভাবে জাকেউসের হৃদয় পরিবর্তন হলো, তিনি যিশুর অনুগমন করলেন।
এই গাছটি দু হাজার বছরের পুরনো একথা মনে করবার কোন সঙ্গত কারণ দেখলাম না, বরং আমাদের শিবপুর বোটানিক্যাল গার্ডেনের বটগাছটি রীতিমত অথেনটিক রকমের প্রবীণ। রাস্তার মোড়ে সেই গাছের তলায় একটি ছোটো খাটো জনতা। সায়েদ বললেন, টুরিস্টের ভিড় আমরাও থামব। যিশুর স্মৃতি বিজড়িত এই গাছটির রক্ষণাবেক্ষণের ভার বহু দিন যাবত একটি মুসলিম পরিবারের হাতে আছে, নিদেন পক্ষে অটোমান সুলতানদের আমল থেকে। তাঁদের একজন হয়তো সমাগত টুরিস্টকে গাছের পাতা বিতরণ করছেন সুভেনির স্বরূপ, খানিক দক্ষিণার বিনিময়ে। তিনি ঠিক কেন জানি না মায়াকে একটা পাগড়ি গোছের কিছু মাথায় পরিয়ে দিলেন, আরও একটু দক্ষিণা লাগলো, পবিত্র ভূমির পাগড়ি বলে কথা!
এবার এলিশার ঝর্না।
জেরিকোর জলকষ্ট সেই জশুয়ার অভিশাপ থেকে। একদিন প্রফেট এলিশা বললেন তিনি জল শুদ্ধ ও পানের উপযুক্ত করে দেবেন। তিনি চাইলেন একটা নতুন পাত্র আর একটা নুনের গোলা। সেই গোলা জলে ডোবাতেই জেরিকোর জল হলো স্নিগ্ধ পানীয়। শুষ্ক রুক্ষ জেরিকোতে প্রাণ সঞ্চার করেছে এই ঝর্নার জল। জব গম ধান এখানে গজায় না কিন্তু গোটা শহর শহরতলি ভরে আছে অজস্র পাম গাছে যার জন্য জেরিকোর আরেক নাম সিটি অফ পামস, ঝর্নার নাম স্প্রিং অফ এলিশা।
তার ঠিক পিছনেই টেল জেরিকো অথবা টেল এস সুলতান- বহু হাজার বছরের দেওয়াল, টাওয়ারের সন্ধান মিলেছে, প্রমাণিত হয়েছে জেরিকোর বয়েস! এই ভগ্নস্তূপের ওপরে দাঁড়িয়ে একটা আশ্চর্য অনুভূতি হয়েছিল – চোখ চলে যায় দিগন্তে ডেড সীর জলরেখা, জুডেয়ার উষর পাহাড় তারই মাঝে ঝর্নার জলে সিঞ্চিত পাম গাছের সারি, সবুজের ছাউনি - অনন্ত কালের মাঝে আমি একা।
আরেক দিকে ক্রিস্টিয়ান বাইবেলে বর্ণিত প্রলোভনের পর্বত (মাউনটেন অফ টেমপটেশন), মাউনট কুরুন্তুল। জন দি ব্যাপ্টিস্টের কাছে দীক্ষা লাভের পরে যিশু সেখানে চল্লিশ দিন উপবাস করে তপস্যায় রত ছিলেন – সেই সময় শয়তান এসে তাঁকে অনেক প্রলোভন দেখায়। যিশু অটল থাকেন। হতাশ হয়ে শয়তান আপন গৃহে প্রত্যাবর্তন করলে যিশু পাহাড় থেকে নেমে এসে গ্যালিলিতে তাঁর ধর্মপ্রচার কাজে ব্রতী হন।
স্থানীয় এক ধনী ব্যক্তি কেবল কার বানিয়ে দিয়েছেন, তাতে চড়ে সিধে প্রলোভনের পর্বতে উঠে জেরিকোর প্যানোরামিক ভিউ দেখা যায়। তবে সেখানে গেলে প্রলোভনগুলি পুনর্বার প্রদর্শিত হয় না, সেটা বড়ো আশ্বাসের কথা – আমার মতো দুর্বল চিত্ত মানুষ অতি সহজেই দিকভ্রান্ত হতে পারে।
স্প্রিং অফ এলিশার ওপরে জেরিকো শহরের বয়েসের সার্টিফিকেট পাথরে খোদাই করা আছে – ওলডেস্ট সিটি ইন দি ওয়ার্ল্ড! এই খ্যাতির কোন চ্যালেঞ্জার এতাবৎ দেখা দেয় নি।
পু:
জেরিকো কেবল প্রাচীনতম শহর নয়, দুনিয়ার সবচেয়ে নিচা নগরি! সমুদ্রতট রেখার পৌনে তিনশ মিটার নিচে তার অবস্থান। হল্যান্ডের স্কিফোল এয়ারপোর্টে যখন প্লেন নামে, আপনি জানেন সমুদ্রতটের বারো ফিট তলায় চলে এলেন। চারিদিকের সফেন সমুদ্র দেখলে এই তথ্য হৃৎকম্প জাগানোর পক্ষে যথেষ্ট। হল্যান্ডের স্কিফোল এয়ারপোর্ট জলপ্লাবিত হবার সম্ভাবনা দুর্বার – ডাইক বানিয়ে আর ক্যানেল খুঁড়ে ডাচরা কোনমতে ঠেকিয়ে রেখেছে।। তবে জেরিকোর পাশে যে জলরেখা আছে সেই ডেড সী আরও দুশো মিটার নিচে, কাজেই জেরিকোতে বন্যার কোন আশঙ্কা নেই।