

আজকাল একটি শব্দবন্ধ শোনা যায় - দি এলিফ্যানট ইন দি রুম। অর্থাৎ আমরা একত্র বসে নানান বিষয়ে আলোচনা করছি একটা জরুরি ব্যাপারকে এড়িয়ে। জানি সেটা অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ, আমরা সবাই তার সম্বন্ধে অবগত আছি কিন্তু সে বিষয়টি মুখে আনছি না। জেনেশুনে উপেক্ষা করি, নয় ভান করি। ও কিছুই নয় আল ইজ ওয়েল।
ইসরায়েলে বাণিজ্যিক মিটিঙে কথাটা বার বার মনে হয়েছে। এই যে আমরা ব্যবসা বাণিজ্যের চর্চা করছি সেখানে ইসরায়েল মানে সাদা,ইহুদি ইসরায়েল। যেমন আমেরিকা এবং পশ্চিম ইউরোপের রুলিং গোষ্ঠী পরিচিত ওয়াসপ (White Anglo Saxon Protestant) নামে। এমন নয় যে এখানে ইহুদি মুসলিম ক্যাথলিক বা অর্থোডক্স ক্রিস্টিয়ানদের কোন ভূমিকা নেই কিন্তু ওয়াসপ নামটা টিকে গেছে। ইসরায়েলে আমাদের যাবতীয় আলোচনা কাকে নিয়ে? ইসরায়েল ইলেকট্রিক, টালি, নানান ব্যাঙ্ক যেমন ব্যাঙ্ক হাপোয়ালিম, মিজরাহি ইত্যাদি। এরেতস ইসরায়েলে (দেশ ইসরায়েল) বিশ লক্ষ আরবের বাস- মোট জনসংখ্যার পাঁচ ভাগের একভাগ (ভারতীয় নাগরিকদের মধ্যে ১৪% মুসলিম ধর্মাবলম্বী)। তাঁরা পূর্ণ নাগরিক, পাসপোর্ট ইসরায়েলি, ভোট দেওয়ার অধিকার আছে, দশ জন নির্বাচিত আরব প্রতিনিধি বসেন বর্তমান Knesset এ। ভ্রমণে, কাজে কর্মে কোন বাধা নেই, সরকারি ভাবে। যে সময়ে ইসরায়েলকে বাণিজ্যিক দিক দিয়ে জানতাম, আরব ইসরায়েলিদের বিষয়ে কোন আলোচনা শুনি নি। আপনি যে দেশে আছেন তার একটি মাত্র অংশের সঙ্গেই সব কাজকর্ম? বাকি বিশ শতাংশ মানুষের সঙ্গে কোন কাজ কারবার নেই? বিভাজন না হয় ধর্মের, জমির মালিকানার কিন্তু রোটি কাপড়া মকান? হাইফা, আকোর বাজারের মুদি? তারা কি শুধু আরবদের মশলাপাতি বেচে? এমন তো নয়!
প্রসঙ্গত আমেরিকান সংবিধান স্বাক্ষরের পুরো একশ বছর এবং রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধের পরে কালো মানুষদের নির্বাচনে দাঁড়ানো এবং ভোট দেওয়ার অধিকার মেলে। গেটিসবারগে প্রদত্ত আব্রাহাম লিঙ্কনের যে বক্তৃতার অংশ বিশেষ (গভর্নমেন্ট অফ দি পিপল, বাই দি পিপল, ফর দি পিপল) সকল গণতান্ত্রিক মঞ্চে সসম্মানে গুঞ্জরিত হয় সেই গভর্নমেন্ট ছিল কেবলমাত্র সাদা মানুষের।
দেশের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করলে তৎক্ষণাৎ ইসরায়েল আরবকে পূর্ণ নাগরিক অধিকার দিয়েছে এটা অবশ্যই মনে রাখা দরকার।
১৯৮৫ সালে সিটি ব্যাঙ্কের ট্রেনিঙে আমস্টারডাম গেছি। আপারথাইড তখন একেবারে তুঙ্গে, লন্ডনে প্রায় প্রতি শনিবার জুলুস বেরোয় – ফ্রি ম্যানডেলা! মিসেস থ্যাচার বলে চলেছেন স্যাঙ্কশান বা দক্ষিণ আফ্রিকাকে বয়কট করাটা কোন সুবুদ্ধির লক্ষণ নয়। আমাদের বসতে হবে তাদের সঙ্গে, আফ্রিকানার নেতৃত্বের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করতে হবে, হমে সোচনা হ্যায়।
আমস্টারডামে প্রথম একজন আফ্রিকানারের সঙ্গে পরিচয়, জোহানেসবুরগ ব্রাঞ্চের ফ্রঁসোয়া ওয়েনজেল। চমৎকার খোলামেলা ছেলে, পরিষ্কার কথা বলে, কথায় কথায় হাসে। সরাসরি আপারথাইডের প্রসঙ্গ তোলা যায় না, তবু জিজ্ঞেস করেছিলাম তোমার শহরে একই বাসে সাদা কালো মানুষ চড়ে না কেন? ফ্রঁসোয়া বললে কালোরা থাকে শহরের একদিকে যেমন আলেক্সান্দ্রিয়া, অন্যেরা থাকে ধরো ক্লিফটন বা সাক্সনওল্ড। দুটো সম্পূর্ণ বিপরীত দিকে। তাহলে সেন্ট্রাল বিজনেস ডিসট্রিক্ট স্যানডটন থেকে যারা বাড়ি ফিরবে তারা সেই বাস ধরবে যেটা তার পাড়ার দিকে যায়!
যুক্তি অচ্ছেদ্য। কিন্তু সাদা আর কালোরা পাশাপাশি বাস করে না কেন তার উত্তর নেই। কালোদের ভোটের অধিকার মিলেছে ১৯৯৪ সালে।
আপারথাইড রেজিম চাক্ষুষ করি নি, প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ শুনছি। আমাকে এমনিতেই ঢুকতে দিতো না! দক্ষিণ আফ্রিকা গিয়েছি ভারত বনাম দক্ষিণ আফ্রিকা ক্রিকেট ম্যাচের শুরু* অথবা আপারথাইড অবসানের পরে! কালো মানুষদের সামাজিক অগ্রগতি (ব্ল্যাক এমপাওয়ারমেনট) কথাটা মুখে মুখে ফেরে। ১৯৯৫ সালে জোহানেসবুরগে আবার ব্রাঞ্চ খোলার পরে রীতিমত তাদের ফাইনাসিঙ্গের কাজে লেগে পড়েছি। কিন্তু অনুমান করতে অসুবিধে নেই আমাদের পুরনো অফিস, ১৯৮০ সালের সিটি ব্যাঙ্ক ব্যবসা করেছে কেবল সাদা দক্ষিণ আফ্রিকানদের সঙ্গে। আপারথাইডের প্রতিবাদে সে ব্রাঞ্চ বন্ধ হয়ে গেলে ধার দেনার কাগজপত্র সিটি ব্যাঙ্ক স্ট্র্যানডের দোতলায় স্থানান্তরিত হয়, স্টেফানুস ভেনটার নামের একজন আফ্রিকানার সেটি দেখেন। আমার দীর্ঘদিনের বন্ধু অ্যানডি গার্ডেন তার সহকারী। তখন জেনেছি কি শুভ্র সফেদ ছিল আমাদের ব্যবসার চেহারা।
ইসরায়েলে তাই দেখলাম। হয়তো প্রত্যহের ওঠাবসা নেই কিন্তু আরেক বর্ণের মানুষ তো আছেন আপনার চারপাশে? অফিসে টাইপ করেন, ছোট খাটো ব্যবসা করেন, হয়তো আপনার গাড়িও চালান।**
ইসরায়েল সৃষ্টির ষাট বছর বাদেও গড়ে ওঠে নি ইসরায়েলি আরব ব্যাঙ্ক। তাঁদের স্থান পেতে দেখি নি ব্যবসায়িক আলোচনায়, ডিনার টেবিলে। অস্বীকার, অবহেলা? ওটা বিবেচ্য বিষয় নয়। আগে কহ আর!
আমরা কি দেখতে পাচ্ছি না?
ঘরের মধ্যে হাতি!
গাজা দেখি নি। দেখেছি অধিকৃত প্যালেস্টাইন। প্যালেস্টাইন অথরিটির অধীনে ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক। দুই দশকের মধ্যে দেখলাম বার্লিন ওয়ালকে হার মানানো ইসরায়েলি দেওয়াল, এ প্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে। মনে হলো এই দুই দশকের মধ্যে কি পিছিয়ে গেলাম পঞ্চাশ বছর?এককালে লোকাল বাসে যাওয়া যেতো এখন জেরুসালেম থেকে বেথলেহেম যেতে হয় এমনি দুর্ভেদ্য দেওয়ালে ঘেরা সরু সুড়ঙ্গের ভেতর দিয়ে, দু বার পাসপোর্ট দেখাতে হয়। পুরনো বার্লিনের ছবি! ১৯৭৯ সালে প্রথম দেখা - পূর্ব বার্লিন আর পশ্চিম বার্লিন- দিন রাতের তফাত। পশ্চিমে জ্বলে নিওন বাতি, পূবে টিম টিম করে আলো, অর্ধেক রাস্তা অন্ধকার। জেরুসালেম থেকে একটা দেওয়াল পেরুলেই পিছনে ফেলে আসি আলো। ঈশ্বরের সন্তান যেখানে জন্ম নিয়েছিলেন সেখানে আজ ভীষণ অন্ধকার। ঘর বাড়ি রাস্তা ঘাটের চেহারা, গাড়ির মডেল বদলে যায়। দারিদ্র্য দৃশ্যমান। সেখানকার ক্রিস্টিয়ান মানুষের আজ অধিকার নেই জেরুসালেমে প্রভুর সমাধিতে বন্দনা করার।
কতটা বিভক্ত এই দেশ? তেল আভিভ হতে ডেড সী যাবার মোটরওয়েতে বারবার চোখে পড়বে বড়ো অক্ষরে লেখা A B C : এটি কোন বর্ণ পরিচয়ের পাঠশালা নয়। এই অক্ষর মালা নির্দেশ করে কোন অঞ্চল কার তাঁবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার বহু বছর পরেও ব্রিটিশ ফরাসি আমেরিকা এই তিন মিত্র শক্তি শাসন করেছে পশ্চিম বার্লিন। আপনি হাঁটছেন, হঠাৎ দেখলেন একটা মানুষের সাইজে সাইনবোর্ড – তাতে লেখা ‘আপনি ফরাসি সেক্টর পরিত্যাগ করিলেন’। এবার আপনাকে আরেকটি সাইনবোর্ড আমেরিকান সেক্টরে আপনাকে স্বাগত জানায়। মিত্র শক্তির এই দফায় দফায় দেওয়া নোটিসে আপনার চলা ফেরার কোন অসুবিধে হতো না কারণ কেউ আপনার পাসপোর্ট ভিসা পরীক্ষা করতে চায় নি ( যদিও সে ক্ষমতা তাদের ছিল। এক সেক্টর ছেড়ে অন্য সেক্টরে প্রবেশ করলে কোন পরিবর্তন চোখে পড়ে না, কেবল পুলিশের, সৈন্যের পোশাকটা বদলে যায়। মুশকিল ছিল সোভিয়েত সেক্টর নিয়ে, সেখানে উঁচু দেওয়াল।
বিভাজিত বার্লিন দেখেছি তাই হয়তো বার বার সে কথা মনে পড়েছে। কিন্তু তুলনাটা বেশিদূর খাটে না। ইসরায়েল ও প্যালেস্টিনিয়ান অথরিটির মাঝে সরাসরি টানা সীমানা নেই। ইসরায়েল প্রায় খুবলে খাবলে নিয়েছে ইচ্ছে মতন।এডমিনিস্ট্রেশন তিন ভাগে। তার মানে এই নয় যে তিনটে সম্পূর্ণ আলাদা এলাকা, একটা সীমান্ত পেরিয়ে আরেক দেশে যাবেন (খানিকটা বসনিয়ার মতো, সার্ব, ক্রোয়াট,বসনিয়াক, সেটারও তিন ভাগ কিন্তু সীমানা চিহ্নিত নয়)। ইসরায়েলে ভাগাভাগির ব্যাপারটা মানুষের গতি বিধিকে অসম্ভব জটিল করে তুলেছে। আপনি কোথা থেকে কোথায় যাবেন, যেতে পারেন কিনা তার পুলিশি পাহারা চলছে সর্বক্ষণ। কাজ কর্ম সেরে আমি হেবরনে বা রামাল্লায় (স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাঙ্কের ব্রাঞ্চ ছিল) জেরুসালেম গামী বাসে ওঠার আগে আমার ব্রিটিশ পাসপোর্ট দেখাতে হবে। কিন্তু আমার প্যালেস্টিনিয়ান সহকর্মীকে সান্ধ্য ডিনারের জন্য সঙ্গে নিয়ে যাওয়া অত্যন্ত কঠিন।
এক দশক আগে জেরুসালেম ওল্ড সিটিতে ম্যাকডোনালডে ঢুকতেই মনে হল সকলে চুপ করে আমাকে লক্ষ করছেন, একটা সন্দিগ্ধ দৃষ্টি আমার প্রতি : এমন চেহারা, এ কে? সুবিধের মনে হচ্ছে না, পকেটে ছুরি পিস্তল নেই তো? এখানে ঢুকলো কি করে? কাউনটারে এক শীতল অভ্যর্থনা। আমার শেকেল এঁরা নেবেন, হামবুরগার দেবেন কিন্তু আমি স্থানত্যাগ করলে এঁরা বেশি খুশি হবেন। আমি লেজিটিমেট কিনা সে প্রশ্ন আমাকে করতে পারছেন না, কারণ সেটা পরীক্ষা করার কাজ ইসরায়েলি নিরাপত্তা সংস্থার। তবে সে জাল কেটে কেউ কেউ তো বেরিয়ে পড়তে পারে! ব্রিটিশ পাসপোর্টটা দেখিয়ে জেরুসালেম তথা ইসরায়েলে আমার আইন সম্মত অবস্থিতি প্রমাণ করে খাবার অর্ডার দেওয়ার একটা দুর্বার বাসনা মনে জেগেছিল সেদিন।
আমেরিকার দক্ষিণে কৃষ্ণ বর্ণ মানুষের অধিকার এককালে অত্যন্ত সীমিত ছিল। আজ গল্প মনে হবে - প্রয়াত অধ্যাপক সুব্রত ঘটকের কাছে শুনেছিলাম এক নামকরা ভারতীয় অর্থনীতিবিদ অ্যাটলানটা শহরের রেস্তোরাঁতে অনেকক্ষণ বসেছিলেন, কেউ তাঁর টেবিলে এসে জানতে চায় নি কোন অভিপ্রায়ে তিনি এখানে আস্তানা গেড়েছেন। শেষ অবধি চামচ দিয়ে কাঁচের গ্লাসে শব্দ করে ওয়েটারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন।
পুরো ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের সীমান্ত এক লাইনে নয়। কোন অঞ্চলে ঢোকা বা বেরুনোর অধিকার আছে কিনা তার পরীক্ষা করবে যুগপৎ ইসরায়েলি ও প্যালেস্টাইন প্রহরী, কোনোটা কেবলমাত্র প্যালেস্টাইন বাকিটা একেবারে ইসরায়েলি অধিকারে। মোদ্দা কথা প্যালেস্টাইনে কে ঢুকবে বেরুবে সেটি ইসরায়েলি কন্ট্রোলে। এতই প্যাঁচালো এই বিভাজন যে লিখে বোঝানো শক্ত তাই একটু গুগল ম্যাপের সাহারা নিতে হচ্ছে।

পু:* দক্ষিণ আফ্রিকার স্পোর্টিং আপারথাইডের অবসানের কাহিনীর সঙ্গে চিরদিন জড়িয়ে থাকবে আমার শহর কলকাতার নাম। ১৯৬৯ সাল থেকে খেলার মাঠে তারা ছিল ব্রাত্য। এমনকি ইংল্যান্ড অস্ট্রেলিয়া নিউ জিলানডের মতন সাদা দেশগুলি দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে খেলতে অস্বীকার করে বা জনমতের ঠেলায় করতে বাধ্য হয়। নেলসন ম্যানডেলার মুক্তির ঠিক উনিশ মাস বাদে ১০ই নভেম্বর ১৯৯১ দক্ষিণ আফ্রিকা তার ইতিহাসে প্রথম অশ্বেতকায় যে দেশের সঙ্গে একদিনের ক্রিকেট ম্যাচে খেলার মাঠে নামে সে দেশ ভারত। ইডেন উদ্যানে ভেঙ্গে পড়ে আপারথাইডের দুর্গ। লন্ডনে কর্মরত সিটি ব্যাঙ্কের এক দক্ষিণ আফ্রিকান সহকর্মী রে ফরসাইথ কটন সেন্টারে অফিসের বাইরে টেমসের রেলিং ধরে বিয়ারের গ্লাস হাতে আমাকে বলেছিল ‘ হোয়াট এ ডে! ইয়োর কান্ট্রি প্লেয়িং মাইন! ওয়াজ আনথিঙ্কেবল টু ইয়ারস এগো!’
** কিছু আলোকরেখা চোখে পড়ছে। অন্তত হাজার দশেক ইসরায়েলি আরব এখন আই টি সেক্টরে কর্মরত, ইউ এ ই এবং সৌদি আরবের সঙ্গে সমঝোতা হলে তাঁদের কাজের সুযোগ বাড়বে এমন আশা করা যায়।
syandi | 45.25.***.*** | ৩০ অক্টোবর ২০২৩ ০১:৩৭525325
হীরেন সিংহরায় | 2a00:23c7:672e:2001:3006:3aa:9d88:***:*** | ৩০ অক্টোবর ২০২৩ ১৩:৪৮525337
হীরেন সিংহরায় | 2a00:23c7:672e:2001:c9ba:5003:8b47:***:*** | ৩০ অক্টোবর ২০২৩ ২২:৩৫525358