ইতিহাসে এই প্রথম দৃষ্টান্ত যেখানে কোন দখলকারী শক্তি বার বার নিজেকেই আহত, ক্ষতিগ্রস্ত ঘোষণা করেছে। ইসরায়েল সীমান্তের আধঘণ্টা মাত্র দূরে কি ঘটছে ইসরায়েলিরা হয় জানেন না, জানবার চেষ্টা করেন না বা তাতে ভ্রুক্ষেপ করেন না।
-গিদিওন লেভি
ইসরায়েলি সাংবাদিক, হায়ারেতস পত্রিকার নিয়মিত লেখক
১০ এপ্রিল ২০১৫
হেবরন নামটি এসেছে হিব্রু কাভার বা বন্ধু থেকে, আরবিতে আল খালিল, বন্ধু। এই বন্ধু জুডাইজম, ক্রিস্টিয়ানিটি এবং ইসলামে ধর্মের কুলপিতা আব্রাহাম / ইব্রাহিম।
বাগদাদ থেকে সন্ধ্যে সাড়ে ছটায় ছশ কিলোমিটার দক্ষিণে বাসরা অভিমুখে যে এক্সপ্রেস ট্রেনটি ছাড়ে, মধ্যরাত্রি নাগাদ সেটি অতিক্রম করে উর (তাল আল মুকাইয়্যা)। সুজলা সুফলা ইউফ্রেতিস নদীর পাশের এই সমৃদ্ধ শহরে বাস করতেন আব্রাম এবং সেরাই। পিতার ব্যবসা বাণিজ্য ছিল। আব্রাম নিজেও পশুপালন করতেন। একদিন ঈশ্বর তাঁর সম্মুখে প্রকট হলেন অথবা স্বপ্নে দেখা দিলেন- বললেন আমিই একমাত্র ঈশ্বর, আমাকে মানো। তোমার এই দেশ পিছনে ফেলে লোটা কম্বল নিয়ে চলো কানান অভিমুখে। সেখানে বাস করবে তুমি।
কাল ১৯০০ খ্রিস্টপূর্ব
ট্রেন বাস ছিল না, মারাকাটোরের ম্যাপ তখনও টানা হয় নি, গুগল অনেক দূর - ঈশ্বরের আদেশে তিনি দলবল নিয়ে চললেন প্রথমে উত্তর দিকে, ব্যাবিলন, দামাস্কাস ছাড়িয়ে গেলেন হারান (আজকের তুরস্কে)। এবার আদেশ এলো, ‘চলো কানান পানে” বাঁয়ে মুড়ে খাড়া দক্ষিণে। পরের বিরতি শেখেম (এখন নাবলুস), ঈশ্বরের নামে প্রথম বেদি বানালেন। সেখান থেকে গেলেন মামরে, তাঁবু গাড়লেন। সেখানে ঈশ্বরের সঙ্গে চুক্তি হলো:
- আজ তুমি কানানে এক অতিথি মাত্র, চারপাশে চেয়ে দেখো, একদিন তোমার বংশধর জয় করবে এই দেশ, তুমি হবে বহু দেশের, মানুষের পিতা।
- তোমার নাম হবে আব্রাম নয়, আব্রাহাম।
- আমিই তোমাদের ঈশ্বর, বংশানুক্রমে আমাকে মানবে।
- সুন্নত প্রথা শুরু করো, সেটাও এই চুক্তির অঙ্গ
(জেনেসিস ১৫:১-৬)
ঈশ্বর এক্সেল ফাইল খুলে জায়গা জমির চৌহদ্দি আব্রাহামকে দেখিয়ে দিলেন। সেখানে অন্য মানুষজন বাস করছে দীর্ঘদিন- এখন মা কা বা ঈশ্বরের আশীর্বাদ নিয়ে আব্রাহাম এই বাসিন্দাদের উচ্ছেদ করতে পারেন না। তাঁর লোকবল নেই। ত্রিকালজ্ঞ মুনির মতন ঈশ্বর জানালেন এসব জমি এমনি এমনি পাওয়া যাবে না, লড়কে লেনা হ্যায়। এখন সরজমিন তদন্ত করে যাও, তবে আমি লিখে রেখেছি এ তোমাদের হবে একদিন। তোমার বংশধর লড়াই হত্যা ধ্বংস করে এই কানান দখল করবে, সেটা তোমার একার কাজ নয়।
দুশো বছর বাদে সিনাই পাহাড়ের নিচে ঈশ্বর একটা সেলেটে দশটা আদেশ লিখে দেবেন তার মধ্যে থাকবে:
- প্রানহত্যা করিও না
- অপরের সম্পত্তির লোভ করিও না
দিন সব সময়ে ভালো যায় না, এই প্রতিশ্রুত দুধ ও মধুর দেশে দেখা দিলো দুর্ভিক্ষ। খাদ্যের সন্ধানে আব্রাহাম গেলেন মিশরে, দুর্ভিক্ষ কাটলে ফিরলেন প্রথমে বীরশীবা পরে হেবরন (মামরে), কিরিয়াথ আরবা গ্রামে। সেখানে স্ত্রী সারার জীবনাবসান হল। স্থানীয় জমিদার এফ্রন কবর ভূমি দান করতে চাইলে আব্রাহাম মানলেন না। চারশো শেকেল দাম দিয়ে কিনলেন, বললেন পাহাড়ের এই গুহায় হবে আমাদের পারিবারিক গোরস্থান। তার নাম মাখপেলা। সেখানে কালে কালে সমাহিত হলেন সারা, আব্রাহাম, পুত্র আইজাক, জেকব, তাঁদের পত্নীরা রেবেকা, লিয়া। তার নাম হবে কেভ অফ দি পেত্রিয়ারকস - পিতৃপুরুষের গুহা।
তিন আব্রাহামিক ধর্মের কাছে এই গুহা তীর্থস্থান – ইহুদিদের কাছে সলোমনের দেয়ালের পরেই দ্বিতীয় পুজ্যস্থল, কাবা ও জেরুসালেমের আল আকসার পরেই ইসলামে এর স্থান, ক্রিস্টিয়ানদের কাছে তো বটেই।
ঈশ্বরের কথা ফলতে দুই শতাব্দী লাগে। ঠিক যেমনটি বলেছিলেন, আব্রাহামের বংশধর তির তরবারি নিয়ে কানানে আবির্ভূত হলেন। বহু রক্তপাতে সেই জমি দখলের কাজ শুরু হয়েছিল জেরিকো থেকে। অতঃপর হেবরন। সেখানে অভিযানে জয়যুক্ত জশুয়া বিশ্বস্ত সাথী কালেবকে হেবরন দান করলেন, হেবরনের অন্য নাম হলো আশ্রিতের শহর। ঈশ্বরের আশীর্বাদে এই হেবরনে জুডেয়ার রাজপদে একদিন অভিষিক্ত হলেন ডেভিড।
রাজা হেরোড একদিন বানিয়ে দিলেন গুহার প্রাকার।
প্যালেস্টাইনে অনেক রাজা বদলালো এডোমাইট, গ্রিক, রোমান, আরব, ক্রুসেডার, অটোমান।
অটোমান শক্তি বিদায় হলে রাজদণ্ড হাতে দেখা দিলো ইংরেজ – জানালে এ জমি ভাগ হবে।
র্যাডক্লিফের ছুরির ঘা ঠিক কোন খানে পড়বে এ নিয়ে অনেক কানাকানি হতো। মেসোমশায়ের কাছে শুনেছি মুর্শিদাবাদ পাকিস্তানে যাবে রাজশাহী ভারতে এ নাকি পাকা কথা বলে জানা গেছিল ১৪ই আগস্ট ১৯৪৭ অবধি!
সেদিনের প্যালেস্টাইনে গুজবের অন্ত নেই। এমনি একদিন – ২৪শে আগস্ট ১৯২৯ - রটে গেলো জেরুসালেমের আল আকসা মসজিদ সহ পুরো টেম্পল মাউনট নাকি ভাবি ইহুদি রাষ্ট্র কব্জা করেছে। হেবরনে আক্রান্ত হলেন ইহুদিরা, সিনাগগ ভাঙা পড়লো, অন্তত সত্তর জন ইহুদি প্রাণ হারালেন। জনশ্রুতি অনুযায়ী অনেক আরব পরিবার অন্তত চারশো ইহুদিকে লুকিয়ে রেখে তাঁদের প্রাণ বাঁচান। কিন্তু সেই দিন থেকে ইহুদিরা হেবরন ছেড়ে যেতে শুরু করলেন।
ইংরেজের পরবর্তী প্যাঁচ কি হবে কে জানে। হাজার বছর যারা পাশাপাশি থেকেছেন তাঁরা কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারেন না। ইংরেজের হিসেবে হেবরন পড়লো জর্ডানের ভাগে -তাঁরা সত্বর ইহুদি বিতাড়ন চালু করেন। তারপর ১৯৬৭ সালের ছ দিনের যুদ্ধে ইসরায়েল দখল করলো প্যালেস্টাইন।
মোসেসের বাণী পুনরায় সত্য প্রমাণিত হলো। এবার জশুয়া নয় ইসরায়েল ডিফেন্স ফোরসের কানান বা প্যালেস্টাইন বিজয় পুনরায় সম্পূর্ণ হলো সাড়ে তিন হাজার বছর বাদে। রাষ্ট্র সঙ্ঘের সিদ্ধান্ত, মানবিক অধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ এসব তুচ্ছ। যেমন ইহুদি বাইবেলে লেখা আছে তেমনটাই হবে।
টেন কমান্ডমেনট ছবির শেষ লাইন– সো ইট ওয়াজ রিটন, সো ইট উইল বি ডান।
বড়ো ঐতিহ্য মণ্ডিত ধার্মিক স্থান, হেবরন যার প্রতিটি পাথরে গাঁথা আছে ইহুদি ইতিহাস – আব্রাহামের তাঁবু, ঈশ্বরের সঙ্গে চুক্তির অঙ্গন, ডেভিডের সিংহাসন, এবং পিতৃ পুরুষের সমাধির গুহা যদিও সেটি ভাগ করে নিতে হয় মুসলিম ধর্ম পিপাসুদের সঙ্গে।
১৯৯৩ সালে পি এল ও চিফ ইয়াসির আরাফত ও ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী ইতঝাক রাবিন ইসরায়েল প্যালেস্টাইন বিবাদের এক শান্তিপূর্ণ সমাধানের খোঁজে বসলেন অসলোতে, ঠিক যেমন তিন বছর আগে আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের নেলসন ম্যানডেলা ও দক্ষিণ আফ্রিকান প্রেসিডেন্ট ডে ক্লেরক বসেছিলেন কেপ টাউনের একটি গোপন আস্তানায়।
টু স্টেট সলিউশন - স্বতন্ত্র ইসরায়েলের পাশাপাশি স্বাধীন প্যালেস্টাইন।
সে আলোচনা চলে ধীর গতিতে।
অসলো চুক্তি স্বাক্ষরিত। এই আনন্দে নোবেল শান্তি পুরস্কার বিতরিত হলো; কোন নোবেল পুরস্কার তিনজন অবধি একত্র পেতে পারেন, তাই হয়তো আরাফত ও রাবিনের সঙ্গে ইসরায়েলি রাষ্ট্রপতি শিমন পেরেসও জুটে গেলেন। অন্য চারটি নোবেল পুরস্কার দেন সুইডিশ কমিটি, শান্তি পুরস্কার প্রস্তাবনা ও বণ্টন করেন নরওয়েজিয়ান নোবেল পুরস্কার কমিটি। ১৯৯৪ সালে সেই কমিটির সুপারিশের কয়েকটা লাইন উল্লেখনীয় –
“কেউ কেউ মন্তব্য করেছেন নোবেল কমিটির আরও একটু অপেক্ষা করা উচিত ছিল। আমরা মনে করি তাতে অসলো চুক্তির ফল খাটো করে দেখা হতো। ইমানুয়েল কান্টের কল্পিত ‘চিরন্তন শান্তি’ পর্যায়ে পৌঁছুতে আমাদের আরও আরও অনেক দিন লাগতো।
দুই পক্ষকে মনে রাখতে হবে দেওয়া এবং নেওয়ার মাঝে সাম্য থাকা চাই। এবারের এই তিনজন নোবেল বিজেতাকে আমরা ধন্যবাদ জানাই যে তাঁরা এই সমতা এনেছেন। এক পক্ষ যতটুকু রেয়াত দেবেন অপর পক্ষকে সমতুল ছাড় দিতে হবে, নইলে শান্তি আলোচনা থেমে যাবে। এ যাবত দু পক্ষ প্রভূত প্রয়াস করেছেন। আমরা আশা করি এই প্রচেষ্টা চলতেই থাকবে, কেউ এই খেলার আইন ভাঙ্গবেন না (break these rules of the game)”।
তারপরে তো তিরিশ বছর কেটে গেলো।
দুই স্বাধীন রাষ্ট্র? টু স্টেট?
স্বপ্ন ছিল। তেল আভিভে মাকাবি দলের মাঠ ব্লুমফিল্ড স্টেডিয়ামে এশিয়ান কোয়ালিফাইং গ্রুপ ম্যাচ ইসরায়েল বনাম প্যালেস্টাইন- প্যালেস্টাইন গোল দিলে সমবেত কলরব সীমানা পেরিয়ে চলে যায় নাজারেথ। যেমন আজ লিলের মাঠে ফ্রান্স বেলজিয়াম ম্যাচে বেলজিয়াম গোল দিলে তুরনাই করটরাইকের গেরস্থ উচ্চরব শুনতে পান, ঘুমন্ত শিশু জেগে ওঠে।
কে জানে সে কবে হবে
হে রাজেন্দ্র, তব হাতে অন্তহীন কাল।
আব্রাহামের আমলে প্রতিষ্ঠিত পিতৃপুরুষের সমাধি গুহাতে (ইসলামে ইব্রাহিমি মসজিদে) তিন ধর্মের মানুষের প্রবেশের ও পূজা পাঠের সমান অধিকার কারণ তাঁরা সকলে এই পিতৃ পুরুষের সন্তান। সে সম্মান সর্বদা রক্ষিত হয় নি। রাজা হেরোড দেওয়াল বানিয়ে কেবল ইহুদিদের জন্য বলে ঘোষণা করেন, বাইজানটাইন আমলে অর্থোডক্স পুরুতরা ইহুদি প্রবেশ নিষিদ্ধ করলেন। মুসলিম রাজারা ইহুদি ক্রিস্টিয়ান দোনোকো বাহর কা রাস্তা দেখালেন। এই চক্র থামল ইসরায়েলি অধিকারের পরে –দু পক্ষেরই প্রবেশ অধিকার, এমনকি একত্রে একই সময়ে।
২৫শে ফেব্রুয়ারি ১৯৯৪
সেদিন ইহুদি পালন করেছেন তাঁদের পরব পুরিম আর মুসলিমরা রমজানের নমাজ পড়ছেন একই দিনে। এমন সময়ে ব্রুকলিনে জন্ম, ইসরায়েলি ডিফেন্স ফোরসের এক ডাক্তার, বারুখ গোল্ডস্টাইন অটোমেটিক রাইফেল দিয়ে নতজানু নামাজিদের পিঠে গুলি চালান, ২৬ জন তৎক্ষণাৎ মারা যান, ১২৫ জন আহত। ইসরায়েলি পুলিস তাঁকে থামানোর চেষ্টা করে নি – ধর্মস্থলে গুলি চালানোয় মানা।
হেবরন ১৯৯৭
সাতষট্টি সালের যুদ্ধে প্যালেস্টাইন দখলের পরের তিরিশ বছর ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী পবিত্র নগরী হেবরন শাসন করেছে। অসলো চুক্তি অনুযায়ী গঠিত প্যালেস্টাইন অথরিটির (যার একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র হবার কথা, টু স্টেট সলিউশন) সঙ্গে ইসরায়েলি সরকার এক সমঝোতা করলেন- হেবরন শহর দ্বিখণ্ডিত হোক। ইসরায়েলের কন্ট্রোলে থাকবে ওল্ড সিটি, যেখানে কয়েক হাজার বছর আগে আব্রাহাম তাঁর আস্তানা পাতেন, সেই কিরিয়াথ আরবা এবং ইহুদির পুণ্যস্থান পিতৃ পুরুষের সমাধি গুহা (এইচ টু) প্যালেস্টাইন অথরিটির প্রশাসন চলবে বাকি, বৃহত্তর হেবরনে (এইচ ওয়ান)।
এইচ টুতে যে ৩৫ হাজার প্যালেস্টিনিয়ান বাস করেন, তাঁদের কি হবে? জবাব সহজ ও সংক্ষিপ্ত। দুই সেক্টরের মধ্যে আনাগোনা কঠোর ভাবে নিয়ন্ত্রিত হবে। এইচ ওয়ানের অধিবাসী কোন প্যালেস্টিনিয়ান এইচ টুতে যেতে পারবেন না কারো সঙ্কটে, আত্মীয়ের শোকে। তাঁরা এধারেই থাকুন। এইচ টু ইসরায়েলি সেক্টরে বসবাসকারী প্যালেস্টিনিয়ান এইচ ওয়ানে যেতে আসতে পারবেন তবে ইসরায়েলি চেক পয়েন্ট পেরিয়ে। এই সদ্ভাবনায় বানানো হল তিরিশটির বেশি বেড়া। আরও একটি তথ্য অবজ্ঞাত করানো হলো- এইচ টু সেক্টরের প্যালেস্টিনিয়ানরা বাস করবেন ইসরায়েলি সামরিক প্রশাসনের অধীনে, তাঁদের কোন আপিল আদালত নেই, সৈন্যের কথাই শেষ কথা। আব্রাহামের স্মৃতিতে প্রতিষ্ঠিত কিরিয়াথ আরবায় যে ইসরায়েলি সেটলমেনট তাঁদের তাঁদের ওপরে প্রযোজ্য হবে ইসরায়েলি গণতান্ত্রিক আইন বিধি। তাঁরা বাস করছেন অধিকৃত প্যালেস্টাইনে, কিন্তু ভোট এবং ট্যাক্স দেন ইসরায়েলে - পূর্ণ নাগরিক।
আমরা বার্লিন ওয়াল দেখেছি, পূব পশ্চিমে শহরটা বিভক্ত ছিল। পূর্ব বার্লিনের নাগরিকের পক্ষে পশ্চিমে প্রবেশ প্রায় অসম্ভব, অন্তত ৬৫ বছরের বেশি বয়েস না হলে (ততদিনে তাঁর ইউসফুল লাইফ শেষ), পশ্চিম বার্লিনের জার্মান নাগরিকদের পূবে যাওয়ার ভিসা মিলত অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে, কেন কি জন্যে ইত্যাদি হাজার প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর মেলার পরে, পারিবারিক কারণ তার অন্যতম। বিদেশিদের জন্য পূর্ব বার্লিনে যাওয়া কঠিন ছিল না মোটেই তবে সেটা মূলত এক দিনের ভিসা। লম্বা ভিসার জন্য কারণ প্রদর্শন প্রয়োজনীয় ছিল।
হেবরনের সঙ্গে তুলনা করলে - আপনি যদি পশ্চিম বার্লিনের বাসিন্দা এবং জার্মান নাগরিক হন, আপনি কোন মতেই পূর্বে প্রবেশ করতে পারবেন না।
কলকাতার কথা ভাবা যাক। পূবে সার্কুলার রোড পশ্চিমে চিত্তরঞ্জন এভিনিউ উত্তরে গ্রে স্ট্রিট দক্ষিণে বিবেকানন্দ রোড এই চৌহদ্দির ভেতরে দু ধরনের নাগরিক বাস করেন তাঁদের পাসপোর্ট বা পরিচয় পত্র স্বতন্ত্র। বেশির ভাগ, ৩৫ হাজার মানুষ দৈনন্দিন কাজে কর্মে ধরুন শ্যামবাজার বা কলেজ স্ট্রিটে যাবেন, প্রতিবার পরিচয় পত্র দেখাতে হবে। সেটা পাসপোর্ট নয়, পারিবারিক কুলুজী, কি করেন, কেন করেন, বাপ ঠাকুরদা কি করতেন, কোন পুলিসি রিপোর্ট আছে কিনা এ সবের তালাশ আছে সেখানে। শুধু তাই নয় এই ধরুন সকাল বেলায় ক্লাস করতে যাবেন কলেজ স্ট্রিটে বা বলরামের গেঞ্জি কিনতে শ্যামবাজার যাবেন, ফেরার সময়ে আবার সেই সব কাগজ দেখিয়ে ফিরতে হবে। যতবার আসা যাওয়া করবেন ততবার। একই রক্ষী আপনাকে কয়েক ঘণ্টা আগে দেখেছে, সে আবার আপনাকে একই প্রশ্ন করবে আপনাকে ঢুকতে বা বেরুতে না দেওয়ার ইচ্ছা তার, এখানে কোন আপিল নেই, গুলির সম্ভাবনা বেশি।
যদিও আইনত সব চেক পয়েন্ট সব সময় খোলা থাকার কথা কিন্তু ইসরায়েল সরকার মাথার দিব্যি দিয়ে রাখেন নি যে আপনি রাত বিরেতে ফিরলে আপনার জন্য সব চেক পয়েন্ট খোলা রাখতে হবে। আপনি কলেজ স্ট্রিট থেকে ফিরছেন, দেখলেন বিবেকানন্দ রোডের চেক পয়েন্ট বন্ধ ঘুরে ফিরে খুঁজুন কোনটা খোলা আছে। অ্যাম্বুলেন্সের প্রয়োজন হলে কঠিন সঙ্কট – ইসরায়েলি অ্যাম্বুলেন্স চেক পয়েন্ট অবধি নিয়ে যাবে তারপর অপেক্ষা, কখন হেবরন বা এইচ ওয়ানের অ্যাম্বুলেন্স আসে।
আমার বরানগরের বাল্যবন্ধু, আলিপুরের দাদা কেউ আমার বাড়ি আসতে পারেন না। আমার পঞ্চত্ব প্রাপ্তি সংবাদেও নয়। ওরা থাকেন ওধারে।
এবার সেই চৌহদ্দিটা আবার দেখা যাক - ধরুন বিবেকানন্দ রোড একদিকের সীমানা সেখানে আপনার বাস। বাইরে রাস্তার দিকের জানলা বন্ধ রাখতে হবে, পেরেক দিয়ে বন্ধ পাকাপাকি ভাবে, গজাল মেরে। সেই পথ বরাবর কোন দোকান কোন ব্যবসা থাকবে না। রাস্তা হবে জনশূন্য। আপনার বেরুনোর পথ পেছনের দুয়োর দিয়ে। এইচ টুর সীমানা অঞ্চল হলো স্টেরাইল, যেখানে প্রাণের জীবনের কোন সাড়া থাকবে না।
আল শুহাদা স্ট্রিট ছিল হেবরনের কেনাকাটার বড়ো বাজার, সেটি আজ জনশূন্য। এমনি অনেক পুরনো প্রাণবন্ত পথঘাট এখন সম্পূর্ণ মৃত। সেখানে দেখবেন কৌতূহলী বিদেশি ও ইসরায়েলি। প্রতিপদে বন্দুকধারী প্রহরী, আপনার ফোন ক্যামেরায় কি ছবি তুললেন সেটি তিনি খুলে দেখতে এবং পছন্দ না হলে ফোনটা ফেরত নাও দিতে পারেন।
আমরা সি সি টি ভি সম্পর্কে সকলেই অবহিত আছি। হেবরন চেক পয়েন্টের ক্যামেরা অন্য লেভেলের এগুলি শুধু আপনার শ্রীমুখের ছবি তোলে না, একেবারে খুঁটিয়ে দেখে বুঝে নেয় আপনি কি চিন্তা করছেন, আপনি চেক পয়েন্ট পৌঁছানোর আগেই!
আরেকটু খুঁটিয়ে দেখা যাক – কতজন সেটলার এই পবিত্র কিরিয়াথ আরবায় বাস করেন? ছশোর কম। তাঁদের সুরক্ষার জন্য মোতায়েন আছে আই ডি এফের দু হাজার সেনা। চেক পয়েন্ট গুলির দায়িত্ব আই ডি এফ এবং প্রাইভেট সিকিরিটি সংস্থার ওপরে : কোন আচরণ বা কাজের জন্য তাঁরা ইসরায়েলি আদালতের সামনে কোন জবাবদিহি করতে বাধ্য নন। তাঁদের বিচারের একমাত্র অধিকারী ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী।
এইচ টুর ভেতরে প্যালেস্টিনিয়ানদের গতিবিধি সর্বদা নিয়ন্ত্রিত যে কোন সময়ে সেই দু হাজার প্রহরীর কেউ জানতে চাইতে পারে আপনি কি অভিলাষে বের হয়েছেন।
বিদেশিদের প্রবেশে কোন বাধা নেই। পাসপোর্ট দেখানোর পরেই জিজ্ঞাসা
“আপনি কি মুসলমান?”
বৃহত্তর হেবরন বা এইচ ওয়ানে বাস করেন প্রায় দু লক্ষ মানুষ,এইচ টুর বিশাল পারিবারিক সমাধি ক্ষেত্রে আসবার কোন অধিকার তাঁদের নেই।
আব্রাহাম যে মুসলিমদেরও প্রনম্য তাহলে এই যে এতো বছর ইব্রাহিমি মসজিদের এদিকে ইহুদি অন্যদিকে মুসলিমরা তাঁদের পিতৃ পুরুষের অর্চনা করছিলেন তার কি হবে?
মন্দির কাহাঁ বনেগা?
ইসরায়েল সরকার বললেন, চিন্তা নেই, মন্দির ওহি রহেগা। তবে যখন খুশি সেখানে গিয়ে হত্যে দেওয়া যাবে না। মন্দিরের দুটো ভাগ হলো- মুসলিমদের দিকটায় রেবেকা আইসাকের সমাধি স্মারক, ইহুদিদের দিকটায় আব্রাহাম, জেকব। সকলকে ঢুকতে হয় ইসরায়েলি সামরিক চৌকি পেরিয়ে।