কাটলো ফাঁড়া
২১.০১.২০ - সকাল সাড়ে নটা। পান্না বাস টার্মিনাসে দাঁড়িয়ে আছি। যাবো সালেহা। বাসটা আস্তে আস্তে ব্যাক করে ঢুকছে স্লটে। কন্ডাক্টর বাসের মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে “চলো চলো” বলে ড্রাইভারকে গাইড করছে। পিঠের বারো কেজি দুম্বো স্যাকটা বেঞ্চিতে রেখেছি। বুকে চার কিলোর ন্যাপস্যাক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ একটা রিফ্লেক্সে দু হাত তুলে চেঁচিয়ে উঠি - “রোকো”! ড্রাইভার হয়তো রিয়ার ভিউ মিররে দেখছিল। ঘচাং করে ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে যায়। কন্ডাক্টর ছুটে আসে। বাসের পিছনে মাঝামাঝি জায়গায় একটি বয়স্ক লোকের ফুট দুয়েক দুরে বাসটা দাঁড়িয়ে গেছে। ড্রাইভার ওকে দেখতেই পায়নি। কন্ডাক্টর পিছনে থাকলে ওকে দেখতে পেতো।
বাসটা যখন ঢুকছিল স্লটে তখনই মনে হয়েছিল লোকটি ওখানে কেন দাঁড়িয়ে? ভেবেছিলাম সময়ে সরে যাবে। বাসের পিছনটা যখন ওর থেকে ফুট চারেক দুরে - লোকটি এদিকে মুখ ফেরালো - দুটো চোখই অন্ধ! তাই বেচারা দেখতেই পায়নি বাসটা ওর দিকেই আসছে। তাই নির্বিকার দাঁড়িয়েছিল। সঙ্গে কেউ নেইও যে ওকে গাইড করবে। বাসটা আস্তে আস্তে ব্যাক করছিল বলে বড়সড় দুর্ঘটনা হয়তো হতো না তবে বয়স্ক মানুষ, ধাক্কা খেয়ে বেকায়দায় পড়ে বেশ চোট পেতো। কন্ডাক্টর নিজের ভুল বুঝতে পেরে লোকটির ঝোলাটা তুলে, ওর হাত ধরে বাসে বসিয়ে দেয়। দৃশ্যটা দেখে অজ্ঞেয় ঈশ্বরকে কৃতজ্ঞতা জানাই - দৃষ্টিহীনতা আমার কাছে চরম অভিশাপস্বরূপ।
চললুম শ্রেয়াংসগিরি
পান্না থেকে সালেহা ৫০কিমি। লোকাল বাসে ভাড়া ৬০ টাকা। মাঝে দেবেন্দ্রনগর স্ট্যান্ডে মিনিট দশেক দাঁড়িয়েছিল। মধ্যপ্রদেশের প্রাইভেট লোকাল বাসের সার্ভিস বেশ ভালো। ম্যাপে যা মনে হয়েছিল তার থেকে সালেহা ভালোই জমজমাট। বাসস্ট্যান্ড থেকে গুনৌর, সাতনার রেগুলার সার্ভিস রয়েছে। ৩০ কিমি দুরে নাগোদের পথে সালেহা থেকে এক কিমি দুরে গঞ্জ তিরাহা (তেমাথা)। ওখান থেকে ডানদিকে ছোট রাস্তায় চার কিমি দুরে জৈনতীর্থ শ্রেয়াংসগিরি ও হিন্দুতীর্থ চৌমুখনাথ। জায়গাটির স্থানীয় নাম নাচনা, কেউ বলে নাচনে। আমার গন্তব্য সেখানেই।
শেয়ার অটোয় চললুম। দূরত্ব ছয় কিমি। ভাড়া দশ টাকা। অটোওয়ালা জয়রাম সাহুর সাথে আলাপ করে মোবাইল নম্বর নিয়েছিলাম। পরে কাজে এসেছিল। নাচনা ছোট্ট জায়গা। উত্তর দক্ষিণে বিস্তৃত একটি বড় জলাশয়ের পাশে একটি প্রাচীন বটবৃক্ষের তলায় অটোস্ট্যান্ড। স্ট্যান্ডের কাছেই উত্তরে প্রাচীন চৌমুখনাথ মন্দির। জলাশয়ের দক্ষিণ পূর্ব কোনে প্রায় এক কিমি দূরে জৈন ধর্মে একাদশ তীর্থঙ্কর শ্রী শ্রেয়াংসনাথস্বামীর স্মৃতিধন্য জৈনতীর্থ শ্রেয়াংসগিরি।
জৈনতীর্থ শ্রেয়াংসগিরি
জলাশয়ের উত্তর ও পশ্চিম পাড়ে স্নানের বাঁধানো ঘাট। জলাশয়ে একটু আধটু শালুক ফুটে আছে। একটি লোক পুঁচকে ডিঙি নিয়ে জালে মাছ ধরছে। ভারি স্নিগ্ধ দৃশ্য। অটোস্ট্যান্ডের আশপাশে কয়েকটি মোটে দোকান। সেদিন সন্ধ্যায় এসে দেখেছিলাম তাদের কয়েকটি দোকানে মোমবাতি জ্বলছে। কথা বলে জানলাম, কোথাও তার ছিঁড়ে বিজলি চলে গেছে। অনেকেই হুকিং করে বিদ্যুৎ নিয়েছে। বিল দেয়না। তাই পর্ষদও মাস দেড়েক হয়ে গেছে সারায় নি। ওদের অভিযোগ করার রাস্তা নেই। চলছে কোনো মতে। এই সব দেখলে মনে হয় মানুষ কত অল্পে চালিয়ে নিতে পারে।
সরোবরের পশ্চিম পাড়ে বিদ্যালয়। ছেলেমেয়েরা উঠোনে মোটা শতরঞ্জি পেতে শীতের মিঠে রোদে বসে পড়ছে। মধ্য ত্রিশের শিক্ষিকা চেয়ারে বসে পড়াচ্ছেন। কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে দেখি। মন হামা দেয় শৈশবে গ্ৰামের স্কুলের স্মৃতিতে। অচেনা মানুষ দেখে কয়েকজন পড়ুয়া ঘাড় ঘুরিয়ে আমায় দেখে। মনযোগ বিঘ্নিত হচ্ছে দেখে আমি এগিয়ে যাই। ওরা পড়তে থাকে।
অনতিদূরে একটি বাড়িতে হয়তো কিছু মেরামতির কাজ হচ্ছে। সামনে বালি পড়ে আছে। বালি দেখলে ঘাঁটতে ইচ্ছা করে না এমন ক্ষুদে খুব কমই হয়। তাই তিনটি তিন সাইজের ক্ষুদে তাতে খেলা করছে। দুটি ছেলে জ্যাকেট চাপিয়ে আছে। পুঁচকে মিষ্টি হিরোইনের হয়তো শীতবোধ কম। তিনি হাতকাটা কালো ফ্রক পরে চুটকি বেণী দুলিয়ে ওদের সাথে খেলছেন। তিনজনেরই নগ্নপদ। কোদালের হাতল প্রায় তেনার সমান লম্বা তবু ওটি নিয়েই মাঝের ক্ষুদে মহারাজ গামলায় বালি ভরার কথা ভাবছে। এমন সব মজারু দৃশ্য দেখতে দেখতে বুকে পিঠে দুটো স্যাক নিয়ে টুকটুক করে এগোই।
স্কুলের একটু পরে উজ্জ্বল গোলাপি রঙের পঞ্চায়েত ভবন। বাইরে কজন রোদে বসে গজালি করছেন। আমায় পরদেশী বুঝে ডাকেন। আমার তাড়া নেই। চেয়ারে বসে ওনাদের সাথে খানিক গল্পগাছা হয়। তারপর এগোই জৈনতীর্থর দিকে।
1. বাহুবলী মন্দির 2. পুরোনো ধর্মশালা 3. রায়পুরওয়ালে নতুন ধর্মশালা 4. নির্মিয়মান মন্দির 5. সন্তনিবাস 6. চৌবিশি মন্দির 7. আদিনাথ মন্দির. দক্ষিণে পাহাড়ে আছে কয়েকটি সাধনগুফা
তীর্থের বিরাট পরিসর। তিনদিকে অনেক ঘর। দক্ষিণে প্রথম তীর্থঙ্কর ঋষভনাথ বা আদিনাথজীর পুত্র বাহুবলী বা গোমতেশ্বরের মন্দির (1)। এই সিদ্ধক্ষেত্রটি চতুর্থ শতাব্দীর। ১৯৯১ থেকে গণাচার্য বিরাগসাগর মহারাজের উদ্যোগে তীর্থক্ষেত্রের বিকাশ শুরু হয়েছে। উনি এখানেই পাহাড়ের ওপরে গুহায় দীর্ঘদিন তপস্যা করেছিলেন। আমি যখন গেছি, পরিসর জনহীন। জায়গাটা একান্তে। জৈন উৎসবের সময় ভক্তসমাগম হয়, নয়তো সারাবছর জনবিরলই থাকে।
ঠিক দুপুর বেলা - ভূতে মারে ঢেলা
বাড়ি থেকে বেরোনোর মাসখানেক আগে ফোনে এই ক্ষেত্রের কোষাধ্যক্ষ নবীন জৈনের সাথে কথা হয়েছিল। তিনি থাকেন ৩০কিমি দূরে দেবেন্দ্রনগরে। আমি জৈন সম্প্রদায়ের নই, কলকাতার মাছখেকো বঙ ব্রাহ্মণ। তবু এতোদূরে এক অপ্রচলিত জৈনতীর্থ দর্শন করতে যেতে চাই শুনে ঘর পাওয়ার আশ্বাস দিয়েছিলেন। আজ পান্না থেকে রওনা হওয়ার আগে ফোন করেছিলাম। কলকাতা থেকে আসছি বলতেই চিনতে পারেন। বলেন, ওখানে ম্যানেজার শৈলেশ জৈনকে আপনার কথা বলে দিচ্ছি। গিয়ে ওর সাথে যোগাযোগ করবেন। এখন ফাঁকাই আছে।
কিন্তু এখানে এসে কাউকে কোথাও দেখছি না। সার সার ঘর তালা বন্ধ। একটি ঘরের দরজায় পর্দা রয়েছে। হয়তো ওখানে কেউ হবে ভেবে দরজায় কড়া নাড়ি। মধ্য চল্লিশের এক মহিলা দরজা খুলে রুক্ষভঙ্গিতে বলেন, কী চাই? বলি, শৈলেশ জৈন আছেন? নেহি, বাহার গিয়া - দড়াম করে মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দেন। হতভম্ব হয়ে যাই।
তখন দেখি দুর থেকে একটি লোক এদিকে আসছে। এতক্ষণ দেখতে পাইনি তাকে। কাছে এসে বলে, ওর নাম সুরেশ, এখানকার চৌকিদার। আমি এখানে বেড়াতে এসেছি, নবীন জৈনের সাথে কথা হয়েছে ঘর পাওয়ার - এসব জানিয়ে বলি - উনি অমন ওভাবে মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিলেন কেন?
সুরেশ হাত জোর করে বলে, বাবুজী, উনি শৈলেশজীর পত্নী। ওনার মাথার গণ্ডগোল আছে। মেহেরবানী করে ওনার ব্যবহারে কিছু মনে করবেন না। কার্যকারণ জেনে ক্ষণপূর্বের বিষ্ময়সূচক মৃদু খারাপ লাগার অনুভূতি সহানুভূতিতে বদলে যায়। সুরেশ বলে, শৈলেশজী সালেহা গেছেন। আসতে দেরী হবে। আপনি নবীনজীকে ফোন লাগান। স্পীকারফোন অন করে কথা বলাই সুরেশের সাথে। নবীনজী অতি সজ্জন। শৈলেশ বাইরে গেছে শুনে সুরেশকে বলেন, মুখার্জীসাবকো রায়পুরওয়ালে কামরা দে দো। ধন্যবাদ জানিয়ে ফোন রাখি।
এবার সুরেশ গিয়ে নক করে দরজায়। মহিলাটি বেরিয়ে খরখরে চোখে দেখেন আমায়। এখন তো জানি উনি মানসিকভাবে অসুস্থ। তাই ভাবলেশহীন মুখে গোবেচারার মতো দাঁড়িয়ে থাকি। সুরেশ বলে, নবীনজী সে বাত হুয়া, রায়পুরওয়ালে মকান কা চাবি দিজিয়ে। মহিলাটি ঢুকে যান ঘরে। একটু পরে, ঠিক দুপুর বেলা, ভূতে মারে ঢেলার মতো - ঝরাং করে খোলা দরজা দিয়ে একটা চাবির গোছা এসে পড়ে উঠোনে। আমি একটু চমকে গেলেও সুরেশ নির্বিকার। চাবি কুড়িয়ে বলে, চলিয়ে বাবুজী।
ভবঘুরের কপালে জোটে গুরুকৃপা
উত্তর আর পশ্চিম দিকের সাদামাটা ধর্মশালার ঘরগুলোর তুলনায় একটা নতুন বাড়ির সামনে আসে সুরেশ। প্রায় ৭৫x৫০ ফুট আয়তাকার একতলা বাড়ির সামনে ফলকে লেখা - গুরুকৃপা পরিবার - রায়পুর (সবুজ তীর)। সুরেশ জানায় রায়পুরের এক জৈন পরিবার যাত্রীসেবার নিমিত্তে এটা বানিয়ে দিয়েছেন। ভাবি - জয় গুরু - এমন সদ্ভাবনায় ধন্য হয় আমার মতো ভবঘুরে। তার পাশেও তৈরী হচ্ছে আর একটি ধর্মশালা (লাল তীর)। তার মানে তখন জনহীন হলেও কোনো জৈন উৎসবের সময় যথেষ্ট ভক্তসমাগম হয় এখানে। এমন ব্যাপার ২০১৯এ দেবগড় জৈনতীর্থে গিয়েও দেখেছি। ধর্মশালায় অনেক ঘর কিন্তু তখন কেউ নেই। লোহার গেটের তালা খুলে ঢোকে সুরেশ। টাইল বসানো কোর্টইয়ার্ড। বড় দলে এলে চেয়ার পেতে জমিয়ে আড্ডা দেওয়ার জন্য ওটা অনবদ্য। কোর্টইয়ার্ডের উত্তরে গেট। বাকি তিনদিকে দশটি একতলা ঘর। দক্ষিণে ছাদে যাওয়ার সিঁড়ি। সব ঘর খালি। তার একটার তালা খোলে সুরেশ। ভিট্রিফায়েড টাইলের মেঝে। দেওয়ালে ডিসটেম্পার। ম্যাট্রেস পাতা দুটো সিঙ্গল খাট। দেওয়ালে ক্লথ হ্যাঙার, তাক। আয়না, আলো, প্লাগ পয়েন্ট, পাখা। সব একটি। সংলগ্ন বাথরুম। ওয়াশ বেসিন। গীজার নেই। ছোট্ট একটা কিচেন প্ল্যাটফর্মও আছে। তীর্থযাত্রীদের জন্য বাহুল্যবর্জিত ঘর - যেটুকু না হলে নয় - সেটুকুই আছে।
তখন প্রায় একটা বাজে। সুরেশ বলে, এখানে খাবার দাবার কিছু পাবেন না, আশপাশে হোটেলও নেই। দুপুরে কী খাবেন? বলি, আমার কাছে কিছু খাবার আছে, চালিয়ে নেবো। ও বলে, তাহলে আপনি বিশ্রাম করুন। ম্যানেজার সাহেব এলে খবর দেবো ওনাকে। কিছু বখশিশ দিই ওকে। নমস্কার করে চলে যায় সুরেশ।
সকালে চান করে বেরিয়েছি। বেড়াতে গিয়ে শীতকালে রোজ চান করা আমার কাছে জরুরী নয়। জায়গাটা ফাঁকা। খুব নির্জন। দক্ষিণ দিকে পূর্ব পশ্চিমে ছড়ানো পাহাড়। ভালোই ঠাণ্ডা। তাই আর চানের হ্যাপায় না গিয়ে সারভাইভ্যাল কিট খুলি। মুড়ি, ছোলা/বাদাম ভাজা, বিস্কুট, ম্যাগী, চা, চিনি, গুঁড়ো দুধ, কাজু, কিসমিস, খেজুর, মটরশুঁটি, গাজর, চিকি - যা আছে কাল ডিনার অবধি চলে যাবে।
অনেকের কাছে সুস্বাদু ভোজনও ভ্রমণের একটা মুখ্য অনুষঙ্গ। ভ্রমণকালে লোকাল কুইজিন এক্সপ্লোর করা গুরুত্ব পায়। হেরিটেজ ট্যূরিজমের মতো ফুড ট্যূরিজম নামক ব্যাপারও শোনা যায়। তবে কমখরচে একাকী ভ্রমণে আমার কাছে ভোজন মূলতঃ ক্ষুধানিবৃত্তির প্রয়োজনে - রসনাতৃপ্তির বাসনা তখন গৌণ। সেসব হয় বাড়িতে থাকলে। আমার কাছে ম্যাগী এবং চা করার জন্য মেসটিন থাকে। কিচেন প্ল্যাটফর্মে দুটো ইঁট পেতে, খবরের কাগজ, কাঠকুটো দিয়ে আগুনের জোগাড় করতে হবে। আশির দশকে পুরুলিয়ার জঙ্গল পাহাড়ে রক ক্লাইম্বিং ক্যাম্পের দিনগুলোর স্মৃতি অমলিন। বয়স হলে শরীর মন একটু আরাম চায়। তবু একাকী ভ্রমণে মন্ত্রশক্তির ঈশ্বর পাটনীর মতো সাময়িকভাবে ফিরে যাই ঘাসমূলে।
দূর্ভাগ্যতাড়িত সহৃদয় ম্যানেজার
হালকা লাঞ্চ করে একটু বিশ্রাম নিচ্ছিলাম। তিনটে নাগাদ আসে শৈলেশজী। বছর বাহান্ন বয়স হবে। রোগা, হাসিখুশী মানুষ। প্রথমেই হাতজোড় করে ক্ষমা চায়। সুরেশ বলেছে তাকে কী হয়েছে। বলি, ঠিক আছে, আমি কিছু মনে করিনি। বাস্তবিকই অন্তর থেকে বলেছি। এযাবৎ কতো সুস্থ মানুষের অসুস্থ আচরণ দেখেছি। উনি তো মানসিক ভারসাম্যহীন। তাই ওনার আচরণে মনে করার কিছু নেই।
শৈলেশ ওর কথা বলে। বেশি পড়াশোনা করেনি। ঘরে মন টেকেনি বলে বছর সতেরো বয়সে জৈন সাধুদের সাথে পদযাত্রায় বেরিয়ে পড়ে। এভাবে কাটে বছর পনেরো। ও নিরুদ্দেশ হয়নি, বাড়ির সাথে যোগাযোগ ছিল। ওর সুন্দর স্বভাব, সততা, সেবার মনোবৃত্তির জন্য অনেকের প্রিয় ছিল। বয়স তিরিশ হয়ে গেলে বাড়ির, সমাজের লোকজন বলে বিয়ে থা করে সংসার করতে। কিন্তু মন্দিরে পুজো আচ্চা, তীর্থক্ষেত্রের টুকটাক কাজ ছাড়া আর তো কোনো যোগ্যতা নেই। বিয়ে করে চলবে কীভাবে? তখন জৈন সমাজ ওকে এই ক্ষেত্রের পূজারী কাম ম্যানেজার নিযুক্ত করে। বিশ্বস্ত বলে নির্মাণ কাজে খরচের হিসেবও রাখে। হাজার পনেরো মাইনে পায়। বাথরুম সহ একটা ঘর ও কিছু আসবাব পেয়েছে। জল, বিদ্যুৎ নিঃশুল্ক। উৎসবের সময় যাত্রীদের থেকে ভালো বখশিশ পায়। এতেই চলে যায়। ওখানে খরচও কম।
বছর বত্রিশে বিয়ে হয় শৈলেশের। পাত্রীর যে মাথায় গণ্ডগোল আছে সেটা চেপে যায় বাড়ির লোক। এমনিতে দেখে বোঝাও যায় না। মাঝে মাঝে খর চোখে তাকায়, গুম হয়ে থাকে, নয়তো আপন মনে অস্পষ্ট বিড়বিড় করে। তখন অনেকে শলা দেয় ছেলেপুলে হলে ঠিক হয়ে যাবে। বিয়ের বছর দুয়েক বাদে একটি মেয়ে হয়। দু বছরের শিশুকে ছিটগ্ৰস্ত মা একদিন হঠাৎ মাটিতে আছড়ে ফেলতে যায়। ভাগ্যিস শৈলেশ কাছেই ছিল। চকিতে গিয়ে ধরে ফেলে। সে যাত্রা মেয়েটি বেঁচে যায়। শিশুটি মরে গেলে মাকেও হাজতে যেতে হোতো। নয়তো পাগলাগারদে। সেই থেকে শৈলেশ আগলে রাখে মেয়েকে। মাঝেও আরো কয়েকবার অমন হতে যাচ্ছিল। বছর চারেকের মাথায় মেয়েকে কাটনীতে মায়ের কাছে পাঠিয়ে দেয় শৈলেশ। ওখানে মা, অবিবাহিত দাদা, ছোট ভাই ও তার বৌ, সবাই একসাথে থাকে। ওদের কাছেই মেয়ে বড় হতে থাকে।
শৈলেশ আর সন্তান চায়নি। কিন্তু অনেকে শলা দেয় হয়তো কন্যাশিশু বলে কোনো কারণে ছিটগ্ৰস্ত মা ওকে মেরে ফেলতে যাচ্ছিল। হয়তো তার মনে পুত্রসন্তানের আকাঙ্খা ছিল। ছেলে হলে হয়তো ঠিক হয়ে যেতে পারে। কিন্তু দ্বিতীয় সন্তান যে ছেলেই হবে তার তো কোনো নিশ্চয়তা নেই। তবু সবার শলা শুনে দিশেহারা শৈলেশ অসীম দ্বিধান্বিত হয়ে পুনরায় পুত্রার্থে মিলিত হয় স্ত্রীর সাথে। আশ্চর্য আপতনে এবার পুত্রই হয়। যত্ন আত্তি, স্তন্যদান - মানে মায়ের যা যা করা উচিত, সবই করে তার ছিটগ্ৰস্ত বৌ। তবু বছর তিনেকের মাথায় তাকেও একদিন মাটিতে আছড়ে ফেলতে যায়। সেবারও শৈলেশ ঠিক সময়ে বাধা দিয়ে ধরে ফেলে।
আমি নীরবে ওর কথা শুনছিলাম। কেনই বা শৈলেশ এক অচেনা পরদেশী যাত্রীকে তার জীবনের একান্ত ব্যক্তিগত কথা বলে যাচ্ছিল কে জানে। হয়তো ওর বৌ আমার সাথে দূর্ব্যবহার করা সত্ত্বেও আমি ওর সাথে সহানুভূতির সাথে কথা বলেছি - সেটা একটা কারণ হতে পারে। তাছাড়া আমি বয়স্ক মানুষ। তাই হয়তো বৌয়ের আচরণের জন্য মার্জনা চাইতে গিয়ে তার প্রেক্ষাপট ব্যাখ্যা করতে ঐ সব বলছিল। বলে, বাবুজী সেই সাত আট বছর আমার যে কীভাবে কেটেছে কী বলবো। পৃথিবীতে সন্তানের সব থেকে কাছের মানুষ মা। সেই মায়ের কাছ থেকে যদি সন্তানকে বাঁচিয়ে রাখতে বাবাকে সর্বক্ষণ পাহারা দিতে হয়, আপনিই বলুন, কেমন লাগে? আমি ওদের রেখে কোথাও যেতে পারতাম না। সেই ক’বছর আমার মা এসে ছিলেন আমাদের কাছে।
বলি, ডাক্তার দেখান নি? ও বলে, দেখিয়েছিলাম কিন্তু ডাক্তার কিছু ধরতেই পারলো না। বললাম না, এমনিতে দেখে, কথাবার্তা বলে কিছু বোঝা যায় না। কিন্তু যে মা নিজের সন্তানকে আছড়ে ফেলতে চায় সে পাগল নয়তো কী? বলি, আপনার কখনো ওনার সাথে থাকতে ভয় করে নি? শৈলেশ বলে, সত্যি বলতে কী, প্রথম ঐ ঘটনার পর রাতে ওর পাশে শুতে একটু অস্বস্তি হোতো। ভাবতাম কোনো অপদেবতা ভর করেনি তো? কিন্তু এযাবৎ আমার সাথে কোনো হরকৎ করেনি। পাগলেও নিজের ভালো বোঝে। হয়তো জানে আমিই ওর একমাত্র আশ্রয়।
শৈলেশের ব্যাখ্যা আমায় ভাবায়। মানবমনের কতটুকুই বা জানি। বলি, আচ্ছা আপনি তো বিয়ে করতেই চাননি। তবু যারা আপনাকে বিয়ে করতে জোর করেছিল, তাদের ওপর বা ধরুন মেয়ের মাথার দোষের কথা লুকিয়ে বিয়ে দেওয়ার জন্য শশুরালের লোকজনদের ওপর বা বৌয়ের ওপর কখনো রাগ, আক্ষেপ হয়েছে? কথা হচ্ছিল ছাদে বসে। শীতার্ত মেঘলা বিকেল। দুরে পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে আত্মমগ্ন হয়ে শৈলেশ বলে - না, বাবুজী। বৌয়ের ওপর রাগ করার তো প্রশ্নই আসে না, ও তো বিমার। যা করেছে, জেনেবুঝে তো করেনি। যারা আমায় বিয়ে করে সংসারী হতে বলেছিল, তারাও তো আমার ভালোই চেয়েছিল। ওর বাড়িতে ভেবেছিল বিয়ে হলে হয়তো ঠিক হয়ে যাবে। সেটা হয়নি। আমাদের দূর্ভাগ্য। অনেকে বলেছিল, বৌকে ডিভোর্স করতে। মন মানেনি। অসহায় একটি মহিলা, কোথায় যাবে? তাই এভাবেই কেটে গেল বিশ বছর। একটা কথা বুঝেছি বাবুজী, নসীবের লিখন কে খন্ডাবে, আপনিই বলুন।
শৈলেশের জবাব নাড়া দেয়। নিয়তিবাদীদের এই এক সুবিধা - কপালের লিখন, পূর্বজন্মের কর্মফল - এই সব বিশ্বাসে ভর করে দুঃখময় জীবনে আক্ষেপ থাকলেও অস্থিরতা, অক্ষম ক্রোধ গ্ৰাস করে না। তাই ও শান্ত ভাবে মেনে নিয়েছে ওর ভাগ্যবিপর্যয়। ওর বৌও তো কম দূর্ভাগ্যবতী নয়। মা হয়েও সন্তানদের ভালোবাসা পেলো না। তখন মেয়ের বয়স আঠারো, ছেলের বারো। চার ও তিন বছর বয়স থেকে মাকে ছেড়ে ঠাকুমা, কাকিমা, কাকু, জেঠুর কাছে বড় হয়ে বাবার পরে ওরাই ওদের নিকটজন। ওদের মায়ের প্রতি কোনো টান নেই, বিতৃষ্ণাও নেই। দু একবার বৌকে নিয়ে গেছিল কাটনী। ছেলে, মেয়ে মায়ের কাছে ঘেঁষতে চায়নি। সেই থেকে মাঝেমধ্যে শৈলেশ একাই যায় কাটনী। সবার সাথে দেখা করে আসে। সেই কদিন ওর বৌ এখানে একাই থাকে।
শৈলেশ বলেছিল, মুখার্জীসাব, আপনি তো কাটনী যাবেন, ওখানেও জৈন ধরমশালাতেই উঠবেন। পাশেই একটা বাড়িতে ওরা সবাই থাকে। সময় পেলে গিয়ে দেখবেন, মায়ের মাথার গণ্ডগোল হলেও ওরা কিন্তু স্বাভাবিক। ওখানে ধরমশালার ম্যানেজার খুব ভালো। আমার বড়দা ওখানে কাজ করে। আপনি একা মানুষ, আমি বলে দেবো, ঘরের যা ভাড়া তার থেকে কমই নেবে। এখানেও এ ঘরের ভাড়া তিনশো। ফাঁকাই পড়ে আছে। আপনি দেড়শোই দেবেন।
শৈলেশের আন্তরিকতা ছুঁয়ে যায়। নির্জন তীর্থক্ষেত্রে দুর্ভাগ্যতাড়িত পরিবারটির জন্য খারাপ লাগে। বলি, কাটনীতে গেলে অবশ্যই দেখা করবো ওদের সাথে। আমি কথা রেখেছিলাম। নিম্নবিত্ত পরিবার। আড়াই খানা ঘরে সবাই কোনোমতে থাকে। আমি যেতে শৈলেশের বাহাত্তর বছরের মা মেঝেতে আসন পেতে, পাশে বসে গল্প করতে করতে খুব যত্ন করে খাওয়ালেন। ভাই, ভায়ের বৌ আন্তরিকভাবে গল্প করলো। শৈলেশের মেয়ে ঋতু এগারো ক্লাসে পড়ছে। সপ্রতিভ, স্বাভাবিক। ছেলেটি শান্ত। নাম জিতু। সিক্সে পড়ে। ঋতু এই বয়সেই ভালো রান্না শিখে গেছে। বললো, সেদিনের দুটি পদ ও রেঁধেছে। স্কুল, পড়াশোনা সামলে কাকীমাকে বাড়ির কাজে সাহায্য করে। আসলে মা, বাবা ছেড়ে দুরে অন্যের আশ্রয়ে যারা বড় হয় তারা হয়তো নিজেও বোঝে, আত্মীয়তা সত্ত্বেও ওরা দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক। তাই সাধ্যমতো প্রতিদান দিতে চেষ্টা করে।
শৈলেশ বললেন, এখানে তো কিছু পাওয়া যায় না, রাতে আমাদের সাথে খাবেন। তবে আমরা তো সূর্যাস্তের পরই সাড়ে ছটার মধ্যে খেয়ে নি। আপনাদের অতো তাড়াতাড়ি ডিনারের অভ্যাস নেই। আপনি আটটা নাগাদ আসবেন। খাবার করা থাকবে, কেবল গরম করে দেবো। বলি, তার কোনো দরকার হবে না, আমার কাছে যা শুকনো খাবার আছে, তাতেই হয়ে যাবে। তবে আমার কাছে বর্তন আছে। যদি ঐ কিচেন প্ল্যাটফর্মে ইঁট পেতে একটু আগুন জ্বালি, চা, ম্যাগী করার জন্য, অসুবিধা নেই তো? যাওয়ার আগে সব পরিস্কার করে দিয়ে যাবো।
শৈলেশ বলে, তার কোনো দরকার নেই। ছোট গ্যাস স্টোভ আছে। দিয়ে যাচ্ছি। ইচ্ছে মতো চা, ম্যাগী বানান তবে ডিম সেদ্ধ করবেন না, এটা জৈন সিদ্ধক্ষেত্র, বুঝতেই পারছেন। বলি, তাহলে তো খুব ভালো হয়। বাঙ্গালীরা আমিষ খায় বলে কিছু জৈনতীর্থে ঘর দিতে চায় নি। বুঝিয়ে বলাতে এযাবৎ অনেক জৈন তীর্থে থেকেছি। কোথাও ফিরিয়ে দেয় নি। মাস দুয়েকের জন্য যখন একা বেরোই, মাছ মাংস খাই না। রাস্তায় কখনো ডিমসেদ্ধ খাই বটে তবে এসব জায়গায় থাকলে কখনোই নয়। ভরসা করতে পারেন।
শৈলেশ বলেন, আমি জানি বাঙালীরা আমিষভোজী। স্বামী বিবেকানন্দও মাছ, মাংস খেতেন। তাতে আমার কিছু এসে যায় না। যাদের যেমন আচার। আপনি এই বয়সে এতোদিন ধরে একা ঘুরছেন। এমন বিরান জায়গায় তিনদিন থাকবেন বলছেন। তার মানে আপনি একটু অন্য ধরনের মানুষ। আমি অন্ততঃ এমন কাউকে দেখিনি। বললেন যখন, অবশ্যই আপনি অন্যের আস্থার মর্যাদা রাখবেন। আমি সুরেশকে বলছি, ওর বাড়িতে মোষ আছে, দুধ দিয়ে যাবে।
(চলবে)
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।