সময়ের হাত ধরে ভাদুড়ি বাড়ির বাগানে জমা হতে শুধু করেছে রাতের কুয়াশা। সে বাড়ির আঙিনায় অযত্নে বেড়ে ওঠা ঢোল কলমির বুকে জড়ো হতে শুধু করেছে রোদহারা বিকেলের শীনশীনে বাতাস। সে বাতাসের আলগোছে ছোঁয়ায় বাতাবিলেবুর পাতায় জমছে সোনারঙ। আর ডালিমের কোয়া ভরে উঠছে টসটসে রসে।
মাঠের মসজিদ থেকে ভেসে আসা ফজরের আজানে ভোরের ঘুম যতটুকু আলগা হয়, ঠিক ততটুকুই গেড়ে বসে অগ্রহায়ণের নরম বাতাসে। সেই ঘুম যতটা না দু-চোখে, তার চেয়েও বেশি শরীরের আলসেমিতে গেড়ে বসে। আমি কাঁথাটা টেনেটুনে মুখ ঢেকে নেই। ঘরের খিড়কি খুলে গেছে এর মধ্যেই। বাড়ি থেকে বয়ে আনা গোবরজলের ছরার কৃষ্টি শহরের এসে শুধু জলের ছরায় এসে দাঁড়িয়েছে। তবে বাসি উঠোনে ঝাড়ু পড়ে নিয়ম মেনেই—মুসার মায়ের হাতে দিন শুরু হবার আগেই। এরপরেই টান পড়ে আমার আদুরে ঘুমের আলিস্যিতে,
মনি ওঠো, রেওয়াজে বসতে হবে….
কেরোসিনের স্টোভ থেকে নামল উষ্ণ জল। স্টিলের গ্লাসে এক চিমটি লবণে মিশল উষ্ণ সে জল। বাসি হাতমুখে রাতভর চৌবাচ্চায় জমে থাকা পাথর-ঠান্ডা জল পড়তেই অগ্রহায়ণের হালকা শীত আরেকটু টোকা দেয় আমার শরীরে। এসব সময়ে আমার ঠাকুমার সেই নস্যিরঙের চাদরের কথা মনে পড়ে খুব।
জামজামরুলের পাতার ফাঁকে লালচে মেঘের ভোরের আকাশ ভাসতে শুরু করেছে, আকাশের এই রঙ আমার খুব পরিচিত। এমন আকাশ মাথার উপরে রেখেই যে আমি আর ঠাকুমা বের হতাম নিত্যপূজার ফুল আনতে। আচ্ছা কী করছে ঠাকুমা এখন? ফুলের সাজি নিয়ে বের হল কি?
আর নিশি নাই ওঠ রে কানাই,
গোঠে যেতে হবে–দ্বারে দাঁড়ায়ে বলাই…
কালীবাড়ির নাট মন্দির থেকে বের হয়েছে নগরকীর্তন। গয়লার মাঠ ছাড়িয়ে কীর্তনের দল এগিয়ে আসছে আমলাপাড়ার দিকে। আমার ছুটে বেরিয়ে যেতে ইচ্ছা করে প্রতিদিন এই সময়। মনে হয় নগরকীর্তনের দলের সাথে এ-পাড়া ও-পাড়া ঘুরে গিয়ে দাঁড়াই কাঁসার থালের মতো নদীর বুকে ভেসে থাকা সূর্যের সামনে। কুড়িয়ে মুঠো-ভরা বাতাসা আর খাগড়াই নদীর জলে ভাসিয়ে স্রোতের কোলে ওদের লুকিয়ে পড়তে দেখি একমনে।
কিন্তু এমন কিছু হবার সুযোগ নেই মোটেও। সামনে আমার বার্ষিক পরীক্ষা। তাই রেওয়াজ সেরে পড়তে বসতে হবে। মা বলে, বড় হলে এসব করার অনেক সুযোগ নাকি পাবো আমি। এখন মন দিয়ে পড়া আর গান করাই আমার কাজ। তাই ফটকের সামনের রাস্তায় নগরকীর্তন ফেলে আমাকে গার্গল করতে হয়, এরপর যষ্ঠিমধু খেয়ে হারমোনিয়াম নিয়ে বসতে হবে।
আকাশের লালচে রঙ সাদাটে হবার আগেই আমি হারমোনিয়াম নিয়ে বসি। সাদাকালো রিডে সুর তুলি,
পিয়া কি নজরিয়া
যাদু ভরি…
আমার সুযোগ না হলেও ভোরের বাতাস গায়ে মাখতে বাবা বের হয়ে গেছে এরই মধ্যে। সাথে রহিম চাচা। যমুনার ধার ঘেঁষে হাঁটতে হাঁটতে বাবা চলে যায় বটতলার শ্মশান ঘাটের দিকে। ওই ঘাট পার হলেই জেলখানার ঘাট। সেখানে সারারাত জাল ডুবিয়ে বসে থাকা জেলেদের জালে এসময় মাছের বাড়বাড়ন্ত। বেলা উঠলেই ঘাটের পাড়ে শুরু হয় সদ্য নদী থেকে তোলা মাছের বিকিকিনি। সেখানে খালুই ভরা—কখনো আইড়-ভেউশ, কখনো রূপালী পাবদা। সেসব খালুই থেকে বেছে বেছে সেরা মাছ বাবার জন্য তুলে নেয় রহিম চাচা।
নগর কীর্তনের দল আমলাপাড়া পেরিয়ে চক্ষু হাসপাতালের দিকে চলে গেল।
লাল কাপড়ে হারমোনিয়াম ঢেকে রাখতেই চামচ ভরে তুলসীপাতার রস আর মধু এগিয়ে দিল মা। বাসার উঠোনের এককোনায় বড়দাদীর লাগানো রাম তুলসীর গাছগুলো এখন ঝাড়ের মতো হয়ে আছে। মা প্রতিদিন সন্ধ্যায় সেই ঝাড়ে প্রদীপ দেয়। আর বড় দাদী ঠান্ডা-কাশিতে মুঠোভরে নিয়ে যায় সেই ঝাড়ের পাতা।
বারান্দায় কেরোসিনের স্টোভে বসেছে চা। বাবা সকালের হাঁটা শেষ করে এসে কলঘরে ঢুকেছে। টাইমকলে জল এসেছে। উঠোনে পড়েছে নদীর তাজা মাছের ব্যাগ। আজ রহিম চাচা বেছে বেছে তেলভরা চকচকে পাবদা দিয়ে ভরেছে সেই ব্যাগ। তবে মুসার মা এখনো বড়দাদীর বাড়ি থেকে সকালের কাজ শেষ করে আসতে পারেনি। তাই মাকেই এখন বসতে হবে মাছগুলো কেটেবেছে নিতে। স্টোভ থেকে চা নামতেই সেখানে ভাতের হাঁড়ি বসিয়ে মা উঠোনে নেমে গেলো মাছ কাটতে। সেখান থেকেই খানিক সময় পরপর মা হাঁক ছাড়ছে,
রচনাটা মুখস্ত করো মনি। আটের ঘরের নামতা লিখতে ভুলো না কিন্তু….
বার্ষিক পরীক্ষা নিয়ে আমার যতটুকু না ভাবনা, তারচেয়ে অনেক বেশি দুঃশ্চিন্তা মায়ের। আমার বইগুলোর সঙ্গে, সত্যি বলতে, আমার চেয়ে মায়ের সখ্যতা বেশি। পড়াশুনো নিয়ে মা-র ওই একই কথা,
ঠিকমতো পড়াশুনো করতে হবে বলেই বাবা আমাদের শহরে নিয়ে এসেছে।
আচ্ছা, কবে শেষ হবে আমার পড়াশুনা? কবে পড়া শেষ করে ফিরে যাব বাড়ি? কবে ফিরে যাব ঠাকুমার কাছে?
আমার প্রশ্নগুলো কেন যেন উত্তরহীন হয়ে বারবার বাতাসে হোঁচট খায়। আমি আবার জোর করে মন বসাই নামতার খাতায়।
আজ সকালের পাতে পড়বে গরম ভাত, আলু সেদ্ধ, পটল ভাজা আর তেল পাবদা।
মুসার মা চলে এসেছে বেশ কিছুক্ষণ। চা মুড়ি খেয়ে তরকারি কাটতে বসে গেছে। পকেট ভরা মার্বেল নিয়ে মুসাও চলে এসেছে অনেকসময়। আমাকে পড়তে দেখে মুসাকেও বসতে হয়েছে স্লেট আর চক নিয়ে। তাতে যতটুকু অ, আ লিখছে, তার চেয়ে বেশি আঁকিবুকি করছে। আর খানিক পরপর বায়না ধরছে,
এ্যা মা আজ আমাক নই কিইন্যা দিবি কিন্তুক…
মুসা জানে, এ বাসার কেউ না কেউ ওর বায়না শুনে ক-টা খুচরো পয়সা ওকে দেবে। আর তা না হলে, বাটি ভরে কদমা, বাতাসা ওর সামনে ধরবে। তবে আজ দু-টো বেলা বিস্কুট পড়ল মুসার বাটিতে। আর সাথে পড়ল একটা গ্লাসে খানিক চা।
সেই চায়ে ডুবিয়ে মুসা বেলা বিস্কুটের সাথে আগবেলার তেজহীন রোদের আয়েশ নেয় আর আমাকে সেসব পাশ কাটিয়ে মুখস্ত করতে হয় বিজ্ঞান বইয়ের পরিবেশ কাকে বলে!
কেরোসিনের স্টোভ থেকে ভাতের হাঁড়ি নামলেই তাতে বসলো ভাজাভুজির কড়াই। কড়াইয়ের তেলে লাল করে ভাজার জন্য যতবার সবজি পড়ে ঠিক ততবারই মা গলা ছাড়ে,
এরপর ইংরেজি খাতা নিয়ে বসো মনি…
ভাদুড়ি বাড়ির বাগানে একটা কুটুম পাখি ডেকে উঠলো। ব্যস্, ইংরেজি খাতা উল্টে এবার আমি পাখি আঁকতে বসে যাই। আর মনে ভেতর অজস্র প্রশ্ন,
কুটুম পাখি কেন ডাকছে?
কার বাড়িতে কুটুম আসবে?
বাসায় কেউ কি আসবে বাড়ি থেকে?
কে আসবে? কখন আসবে?
মনের প্রশ্নগুলো পাখির ডানা আঁকতে আঁকতে কখন যে মুখে চলে এসেছে খেয়ালই করিনি,
মনি, পড়ার সময় এত প্রশ্ন কেন? কে আসবে এই অদিনে?
হ্যাঁ তাই তো ক’দিন আগেই বাড়ি থেকে চিঠি এসেছে সবাই ভালো আছে জানিয়ে। সেখানে কেউ লেখেনি কারো আসার কথা।
আমি সব প্রশ্ন হাওয়াই ভাসিয়ে আবার লেখার খাতায় মন দিই।
স্টোভে এবার উঠলো মাছের কড়াই। তাতে পড়লো সর্ষের তেল। ফোড়নে কালোজিরা আর কাঁচামরিচ। ফোড়ন বাস ছাড়লেই তাতে কুচিয়ে রাখা বেগুন আর পটল ছেড়ে দিলো মা। অল্প নেড়ে লবণ আর হলুদ মিশিয়ে ঢেকে দিলো কড়াই।
এদিকে রূপালী পাবদা মাছের গায়েও হলুদ পড়েছে। সাথে লবণও।
বাবা অফিসের জন্য তৈরী হয়ে গেছে এরইমধ্যে। বারান্দায় আসন পড়েছে আমার আর বাবার।
কড়াইয়ের ঢাকনা উঠলো এবার। তেলে মজে আসা সবজিগুলো মা এবার খানিকটা কাঁচামরিচ বাটা দিয়ে দিল। অল্প গরম জলে কষাতে শুরু করল মশলা আর সবজি।
ফটক ঠেলে রহিম চাচা ঢুকলো হন্তদন্ত হয়ে। বাবাকে ডাকলো গলা চড়িয়ে।
এই সময় রহিম চাচা আসা মানেই এক বাটি মুড়ি আর চায়ের বরাদ্দ হয়ে যায় ওনার জন্য। কিন্তু আজ তা হল না। বাবাকে কিছু একটা বলেই বেরিয়ে গেলো রহিম চাচা।
কড়াইয়ের তেল ছেড়ে আসা কষানো সবজিতে এবার পড়লো ঝোলের জন্য উষ্ণ জল। সেই জল ফুটে উঠতেই হলুদে ছোঁয়া পাবদা মাছগুলো গিয়ে তেলভাসা ঝোলে। অল্প সময় জোর আঁচে তেল পাবদা ফুটিয়ে মা স্টোভের নব ঘুরিয়ে আঁচ কমিয়ে দিল।
সকালের পাতে ভাত পড়লো আমাদের। সাথে উঠোনে পাত পড়লো মুসারও।
ভাদুড়ি বাড়ির বাগানে আবার ডেকে উঠলো কুটুম পাখি। এবার শুধু আমি না মাও বেশ কৌতূহলী হয়ে উঠলো,
পাড়ার কার বাড়িতে আজ কুটম আসবে মুসার মা?
উত্তরহীন মুসার মায়ের মুখে হাসি। যা থেকে পড়ে নিতে হয়,
পাখি ডাকলেই কুটুম আসে নাকি?
আমার পাতে পড়লো তেল পাবদা। নরম মাছের গা থেকে ভেসে আসা ধোয়ায় মিশে আছে কাঁচামরিচের রুচি ফেরানো ঘ্রাণ। আমি ভাত ফেলে খসে আসা নরম এক টুকরো মাছ তুলে নেই।
উঠোনের চিলতে রোদের জায়গাটুকু আস্তে আস্তে দখল করে নিচ্ছে জাম-জামরুলের ছায়া। বড়দাদীর ছাদের কার্ণিশে পোষা পায়রাগুলো উড়ে এসে বসল। কলঘরের সামনে ছায়ার তলায় দুলছে সাবান সোডায় ধোয়া নিত্যদিনের কাপড়। সেই ছায়াহীন দুলুনিতে আমি আনমনে আঁকতে থাকি একটা পাখি, দুইটা পাখি, তিনটা পাখি…
মসজিদের মাঠের সামনে এসে থামলো রহিম চাচার রিকশা। কবিতা আর শিল্পী আপা এবার অনেকদিন পর এল সামাদ দাদুর বাড়ি।