ডেস্কের সামনে দাঁড়ানো মেয়েটা কী যেন বলছে, তবে রিয়া-র সেটা কানে যাচ্ছে বলে মনে হয় না। হাতে ধরা মোবাইল ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে আছে সে এক মনে, আর সমানে পা নাড়াচ্ছে। জামিল এখনও ফোন করেনি, অথচ দুপুর পার হয়ে গেছে! আজ একটা ভেন্যু দেখতে যাওয়ার কথা দুজনের এক সাথে। ওদের বিয়ের রিসেপশান যেখানে হবে, সেই ভেন্যু।
‘চল, চল,’ সামনে থেকে আরেকবার তাড়া দিলো অ্যাঞ্জি। প্রায় প্রতিদিন ওরা এক সাথে লাঞ্চ খেতে যায়, অনেক দিনের অভ্যাস।
রিয়া মুখ তুলে তাকাল এবার। না, এবারও শোনেনি অ্যাঞ্জি কী বলেছে। তবে বুঝে গেছে, লাঞ্চের কথাই বলছে নিশ্চয়ই।
‘আজ মনে হয় যাওয়া হবে না, অ্যাঞ্জি।’
‘কেন? কী হল?’
‘জামিলের কল করার কথা এতক্ষণে,’ রিয়া বললো, ‘আজ আমাকে আগে আগে বের হতে হবে হয়ত। মানে, ও যদি আসে আর কী।’
‘যাচ্ছ কোথাও তোমরা?’ অ্যাঞ্জি উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করে।
রিয়া কাঁধ ঝাঁকায় একটু, ‘দেখা যাক’।
অ্যাঞ্জি চলে যায় একাই। রিয়া লম্বা শ্বাস নেয় দু’বার, হাতের ফোনটা মুঠোর ভেতর শক্ত করে চেপে ধরে । উল্টে নিয়ে ফোনটাকেই এবার দেখে সে। খুব সুন্দর একটা নোকিয়া সেট। ৬৬২০। একেবারেই নতুন মডেল, রঙিন স্ক্রিনের। জামিলেরই দেয়া গিফট এটা, রিয়া কিছুতেই নিতে চায়নি।
জামিল এখনও পিএইচডি করছে, সেই টাকাতেই চলে সে। সাথে অবশ্য কয়েকটা টিউটোরিয়াল ক্লাস নেয়, সেখান থেকেও কিছু খরচ উঠে আসে। কিন্তু সব মিলিয়ে খুব বেশি কিছু না। দু’জনের মধ্যে রিয়া-ই যাকে বলে ‘প্রপার জব’ করছে। আর দু’জনেই ওরা বিয়ের খরচ সামলাতে টাকা জমাচ্ছে এর মধ্যেই। রিয়ার বাবা-মা যদিও মেলবোর্নেই থাকেন, কিন্তু জামিলের বাবা-মা থাকেন ঢাকায়। বিয়ের সময় ওদেরকে নিয়ে আসতে হবে এখানে। ভিসা খরচ লাগবে, প্লেনের টিকেট, মেডিকেল ইনস্যুরেন্স। এখানকার ভেন্যু আর অনুষ্ঠানের খরচও রয়েছে। এ সবের মধ্যে এই নতুন ফোন রিয়া চায়নি। ওর বেশ অপরাধ বোধও হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, ওর জন্মদিনটা কেন যে রিসেপশানের আগে আগে পড়ল! বছরের শেষে হলে জামিলকে এখন এই খরচটা করতে হত না।
পনের তলা দালানের ভেতরে দুপুরের ব্যস্ত অফিসে বসে রিয়ার হঠাৎ করে জামিলের জন্যে অদ্ভুত মায়া হলো। জানালার পাশেই ওর বসার ডেস্ক। ছোট্ট একটা রোদের টুকরো এসে ডেস্কের উপরে রাখা কী-বোর্ডের উপরে পড়েছে। একটা আঙুল সেখানে বসিয়ে খানিকটা উষ্ণতা নিলো সে। অনামিকায় পরা ছোট্ট স্বর্ণের আঙটিটা রোদের আলোয় মিশে যেতে চাইল যেন। আরেকবার ডায়াল করে ফোন কানের কাছে তুলে নিয়ে বিড়বিড় করল রিয়া, ‘পিক আপ, জামিল। ফোনটা ধরো। প্লিজ, পিক আপ।’