রঘুনাথ চক্রবর্তী বললেন, "টিবি বড় খারাপ অসুখ রে বাচি। কাগজে দেখেছি বটে, ওষুধ বেরিয়েছে, স্ট্রেপ্টোমাইসিন। কিন্তু সে এখানে কোথায় পাবি?"
রোগা, কালো কলেজে-পড়া ছেলেটার মুখ শুকিয়ে গেছে। তার প্রাণের বন্ধু সুকান্ত যাদবপুরের টিবি হাসপাতালে ভর্তি।
"স্ট্রেপ্টোমাইসিন কেন পাব না আমরা? রঘুদা?" বাচি অস্থির।
"গরীব দেশ আমাদের, তার ওপর পরাধীন। কোথায় পাব বল? পোড়া দেশে এ সব ওষুধ কী করে মিলবে?"
"তা বলে ছেলেটা এমন চোখের সামনে চলে যাবে?" বাচি কিছুতেই মেনে নিতে পারে না।
রঘুনাথ চক্রবর্তী বয়েসে কিছুটা বড়। তাকে, তার পরিবারকে দাদার মত আগলে রাখেন। আদর্শ দিয়ে, স্নেহ আর মমতা দিয়ে। সান্ত্বনা দেন, বোঝাতে চেষ্টা করেন বাচিকে। যার পোশাকি ভালো নাম সলিল, সলিল চৌধুরী।
সলিলের হাত মুঠো হয়ে যায়। রাগে, অসহায়তায়। মামারবাড়ি কোদালিয়া গ্রাম থেকেই সে স্কুলে পড়াশোনা করেছে। বাবা ডাক্তার, আসামের চা বাগানে ডাক্তারি করেন, থাকেন মা আর অন্য ভাইবোনদের নিয়ে। সে কলকাতার কলেজে যাতায়াত করে মামারবাড়ি থেকেই। রাজপুর, সোনারপুর, কোদালিয়া, হরিনাভি সহ আশপাশের পাঁচটা গ্রাম তাকে চেনে বাচি নামে। বয়েসে ছোট ছেলেদের কাছে সে বাচিদা। উনিশশো তেতাল্লিশের দুর্ভিক্ষ দেখেছে সে। দেখেছে দরজায় দরজায় ভাতের একটু ফ্যান ভিক্ষা-করা নিরন্ন মানুষের ভিড়, পোকামাকড়ের মত মৃত্যু। অন্য দিকে ক্ষমতাবানের দম্ভ, ফেলে ছড়িয়ে খাবার নষ্ট করে ধনীর উৎসব। দুনিয়ায় এত অসাম্য কেন? তার দিশাহারা লাগে।
পাশের গ্রাম রাজপুরে থাকেন শিবডাক্তার। ইংরেজদের রাজত্ব তখন প্রায় শেষের দিকে। দেশভাগের খসড়া চলছে। সাম্প্রদায়িক মারামারি, হানাহানি উঁকি মারছে যেখানে সেখানে। মনুষ্যত্ব, সহমর্মিতা মিলিয়ে যাচ্ছে সুদূরে। বড় অস্থির সে সময়।
এই অবিশ্বাসী সময়েও রাজপুরের শিবডাক্তার এক উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। গরীবদুঃখী মানুষের অবারিত দ্বার তাঁর কাছে । সুদূর দক্ষিণবাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে রুগি আসে। ডাক্তারবাবুকে দেখিয়ে সে রাতটা তাঁর বৈঠকখানাতেই থেকে যায়। পেটভরা ডালভাত পায়। বৈঠকখানাতে তাই সারাক্ষণই মানুষের ভিড়।
তাদের মধ্যেই মিশে থাকে আশপাশের পাড়ার কিছু ছেলে। বাচি এদেরই একজন। রঘুদাও এই দলেরই ছেলে। শিবডাক্তার এদের প্রশ্রয় দেন। খাওয়াদাওয়া, রাতে থাকার জায়গা জুটে যায়। রোগা, কালো, সাধারণ চেহারার বাচি বাঁশিতে সুর তোলে। বাঁশিটি তার নিত্যসঙ্গী। একটা সিঙ্গল রিডের হার্মোনিয়াম নিয়ে কসরত করে।, গানে সুর বসায়, নতুন গান বাঁধে। গানই তার প্রতিবাদের ভাষা, গানের মধ্যে দিয়েই সে বলে অত্যাচারিত, ক্ষুধার্ত মানুষের কথা। রঘুদা আর বাকিরা সবাই শোনে।
'ঢেউ উঠছে, কারা টুটছে...'
'হেই সামালো ধান হো, কাস্তেটা দাও শান হো...'
খেটে খাওয়া মানুষের গান, দিনবদলের গান। কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য সে। আই পি টি এ-র (Indian Peoples’ Theatre Association) দলের সঙ্গে যুক্ত। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করে অন্যদের সঙ্গে। রঘুদার সঙ্গে এখানেই আলাপ। পার্টির বহুদিনের সদস্য রঘুদা দাদার মত দুহাতে কাছে টেনে নিয়েছেন সলিলকে, ছায়া দিয়েছেন, সুখেদুঃখে পাশে থেকেছেন। পরবর্তীকালে সলিলের ছোটবোনের সঙ্গে ঘর বাঁধবেন তিনি। তবে সে আরো অনেক বছর পরের কথা।
কাকদ্বীপ থেকে কীর্ণাহার পর্যন্ত দেশের প্রতিটি প্রান্তে ঘুরে ঘুরে গান গেয়েই সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে যায় তারা। গলায় ঝোলে একটা সিঙ্গল রিডের হারমোনিয়াম। সলিলের বাবা কিনে দিয়েছিলেন তার ছোটবোনকে। সেই হারমোনিয়াম বাজিয়েই সুর করা, গানবাজনা।
দিনকয়েক হল সলিল আর তার বন্ধুদের খুব মন খারাপ। ওদেরই আরেক বন্ধু সুকান্ত ভট্টাচার্য, টিবি হয়েছে তার। যাদবপুরের টিবি হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছে। সুকান্ত কবি। এই বয়েসেই তার কবিতা তুমুল জনপ্রিয়। ফুল, চাঁদ আর প্রেমের ভাববিলাসিতা নয়, তার কবিতায় পূর্ণিমার চাঁদকে দেখায় যেন ঝলসানো রুটি। এ যে সাধারণ মানুষেরই মনের কথা! বেঁচে থাকাটাই যাদের কাছে লড়াই, সেই শোষিত, বঞ্চিত মানুষের কবিতা সুকান্তের কলম ছাড়া কেই বা লিখবে!
সেই সুকান্তকে ধরেছে কালরোগে। চোখ ফেটে জল আসে। কিছুদিন ধরেই মাথায় ঘুরছে কাব্যগীতি। মনে মনে ঠিক করে, সুকান্তর কবিতায় সুর দেবে।
সুকান্তর রানার কবিতাটি পড়ে সে চমকে উঠেছিল। কোনোদিন তো ভাবেনি, পিঠে চিঠির পাহাড় আর টাকার বোঝা নিয়ে ছুটে চলা ডাকহরকরার কথা? পিঠে বোঝা নিয়ে সারা রাত দৌড়ে যায় সে, মানুষের চিঠি, টাকা গ্রাম থেকে গ্রামে পৌঁছে দেয় সূর্য ওঠার আগেই। তাকে কি কেউ চিঠি লেখে? যৎসামান্য অর্থে দিন-গুজরান, অভাব যার নিত্যসঙ্গী, সেই রানার নিজেও কি কোনোদিন ভেবে দেখেছে তার দুঃখের কথা? না কি তার সব বোধ, অনুভূতি গেছে অসাড় হয়ে? এ কবিতা পড়ে সলিলের চোখ খুলে গিয়েছিল। তখন থেকেই গান বাঁধার ইচ্ছে, রানারের ছুটে চলার গান।
কেমন হবে সে গান? ভেবে দেখে সলিল, সাধারণ অস্থায়ী, অন্তরা, সঞ্চারীর বাঁধনে রানারকে বাঁধা যাবে না। রানারের গতি ধরতে হবে সুর আর লয়, অর্থাৎ রিদম দিয়ে। বড় শক্ত কাজ। সিঙ্গল রিড হারমোনিয়ামটি নিয়ে আঙুল চালায় আর ভেবে যায় সে। শিবডাক্তারের বৈঠকখানায়, আরো কত মানুষের ভিড়ের মাঝখানে বসে ভেবেই চলে আর ভেবেই চলে। কী যেন ধরা দিয়েও দিচ্ছে না।
রানার যখন পিঠে বোঝা নিয়ে চলা শুরু করল, তার গতি তখন স্বচ্ছন্দ, ক্লান্তিহীন। শুদ্ধ সুরের আবহে, দ্রুতলয়ে শুরু হোক গান। 'দিগন্ত থেকে দিগন্তে ছোট রানার, রানার কাজ নিয়েছে সে নতুন খবর আনার' - জানা-অজানা সংবাদ পৌঁছে দিচ্ছে ডাকহরকরা, নতুন রকমের কয়েকটি স্বরের জাল বুনে বুঝিয়ে দিলে কেমন হয়? প্রচলিত কর্ড ভেঙে বেরিয়ে আসুক সুর।
রাতের অন্ধকারে লন্ঠন হাতে ছুটে চলা। পেরিয়ে যাচ্ছে লোকালয়, পিছনে ফেলে আসছে অরণ্য। পৃথিবী ঘুমিয়ে আছে, রানারের সঙ্গে জাগছে আকাশের তারা। ক্লান্তি এসে ঘিরে ধরে। গতি কমে যায় অজান্তেই।
মুখ তুলে রানার আকাশের দিকে তাকায়। মনে পড়ে ফেলে আসা ছোট্ট ঘরটিতে প্রিয়ার মুখ। সেও তো বিনিদ্র, তারও চোখে ঘুম নেই! গানের লয় কমে আসে, কোমল স্বর ব্যবহার করে হতাশা মেশা ক্লান্তির ছবিটি আঁকা হয়।
‘এমনি করেই জীবনের বহু বছরকে পিছু ফেলে
পৃথিবীর বোঝা ক্ষুধিত রানার পৌঁছে দিয়েছে মেলে
ক্লান্তশ্বাস ছুঁয়েছে আকাশ, মাটি ভিজে গেছে ঘামে
জীবনের সব রাত্রিকে ওরা কিনেছে অল্প দামে
অনেক দুঃখে বোধ বেদনায় অভিমানে, অনুরাগে,
ঘরে তার প্রিয়া একা শয্যায় বিনিদ্র রাত জাগে...'
কবিতার প্রতিটি ছত্রের সঙ্গে সঙ্গে স্বর এক এক পর্দা ওঠে। শ্রান্তি, অবসাদ, বিক্ষোভ যেন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। শেষ ছত্রে প্রিয়ার দীর্ঘনিঃশ্বাস হাহাকার হয়ে ছড়িয়ে যায় তারসপ্তকে, কোমল ঋষভের দুঃখে বিনিদ্র রাত চোখের জল ফেলে।
আকাশে আলো ফুটছে কি? ভাববিলাসের সময় কোথায়? রাত থাকতেই তো ডাক পৌঁছে দিতে হবে। ক্লান্ত রানার নিজের পা দুটোকে আরো জোরে চালায়। গানও গতি পায় -
‘রাত নির্জন, পথে কত ভয় তবুও রানার ছোটে,
দস্যুর ভয়, তারও চেয়ে ভয়, কখন সূর্য ওঠে!’
নাই বা দেখল মানুষ, রানারের সংগ্রামের সাক্ষী থাকে জ্বলতে-নিবতে-থাকা তারা। সহানুভূতির চিঠি পাঠায় ভোরের আকাশ। রানারের গতানুগতিক দিনযাপনে লাগে এক অন্য আলোর ছোঁয়া।
'রানার রানার ভোর তো হয়েছে, আকাশ হয়েছে লাল,
আলোর স্পর্শে কেটে যাবে কোন এই দুঃখের কাল...'
কবিতা এখানে চেনা পৃথিবী ছাড়িয়ে ঢুকে পড়ছে সে কোন অজানা জগতে। নিয়ে আসছে সম্পূর্ণ নতুন এক আশার খবর। ম্যাজিক রিয়ালিজম বদলে দিচ্ছে দুনিয়া, স্বপ্ন আঁকছে চোখে! এমন কথায় সুর বসাতে গেলে প্রথাগত স্বরবিন্যাস কাজ করে না। কোন এক অদেখা চিত্রকরের তুলির লম্বা লম্বা টানে যেন আঁকা হয় গানের ছবি। তিন চার ধাপ লাফিয়ে চলে সুর। তারসপ্তকে স্বপ্নের মায়াকাজল বুলিয়ে দিয়ে নেমে আসে মুদারার স্নিগ্ধতায় -
'রানার, গ্রামের রানার,
সময় হয়েছে নতুন খবর আনার
রানার, রানার, রানার...'
শুদ্ধ মধ্যম ফেড আউট করে ভাসিয়ে দিল নতুনের আহ্বান, অবসাদকে জয় করল জীবনের শক্তি।
সলিল চমকে জেগে ওঠে। রাতের অন্ধকার ফিকে হয়ে আসছে। এতক্ষণ একটা ঘোরের মধ্যে ছিল সে। চেতনা আছে কি নেই! রানার গানের সুর দেওয়া শেষ। তড়িঘড়ি উঠে বসে। তখন ভোর চারটে। রঘুদা জেগে বসে আছে আর শুনছে হারমোনিয়ামের সুর। দেখছে সাদা-কালো রিডের ওপর সলিলের আঙুলের ম্যাজিক।
পেয়েছে, সে পেয়েছে! কাঙ্খিত সুর ধরা দিয়েছে। এক্ষুনি, এক্ষুনি শোনাতে হবে রঘুদাকে।
সেই ভোরেই গান গাওয়া হল। রানার শুনে রঘুদা মন্ত্রমুগ্ধ। চোখে জল। পরে তাঁর পরিচিত বৃত্তে বহুবার বলেছেন, "সেই আধো অন্ধকার ভোরে রানার গান সলিলের গলায় শোনা এক অনন্য অভিজ্ঞতা। তার সঙ্গে আর কিছুরই তুলনা চলে না।"
এবার যেতে হবে হাসপাতালে। সুকান্তকে না শোনালে যে শান্তি নেই!
উঠে বেরোবার জন্যে তৈরী হচ্ছে, খবরের কাগজ এসে গেল। সেদিন মে মাসের তেরো তারিখ, উনিশশো সাতচল্লিশ সাল। কাগজের পাতায় বড় করে খবর, কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য আর নেই।
সলিল আস্তে আস্তে বসে পড়ে। তার বুকের পাঁজর যেন খসে যাচ্ছে। বোধশক্তি আচ্ছন্ন করে ফুটে উঠছে রানার গানের শেষ কয়েকটি কথা -
'সময় হয়েছে নতুন খবর আনার...'
সত্যিই তাহলে সময় হল আজ? সুকান্ত? তুই কি নতুন ভোরের খবর জেনে যেতে পারলি?
এর কিছুদিন পরই দেশ ভেঙে দু’টুকরো হয়ে স্বাধীন হল। কলেজে-পড়া ছেলেটার মন আচ্ছন্ন করে থাকে বন্ধু সুকান্ত। যে বন্ধুটি এমন আকালের দিনেও স্বপ্ন দেখত,
'চলে যাব - তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ।
প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।'
দেশ স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু খেটে খাওয়া মানুষের দুঃখ ঘোচে না। মানুষে মানুষে প্রবল বৈষম্য, অবিশ্বাসের আগুন। এ কেমন স্বাধীনতা? লড়াই থামে না, 'প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল' - বন্ধুর অঙ্গীকার কানে বাজে!
কমিউনিস্ট পার্টি ততদিনে নিষিদ্ধ। স্বাধীন ভারতের পুলিশ সলিলকে খুঁজে বেড়ায়। গ্রেপ্তারি পরোয়ানা আছে। বেশ কয়েকবার ধরা পড়তে পড়তেও বেঁচে গেছে সে। কখনো মেডিক্যাল কলেজের ছাত্ররা তাকে হোস্টেলে লুকিয়ে রেখেছে, কখনো বা পার্টির কমরেডের বাবা-মা পরিচয় দিয়েছেন নিজের ছেলে বলে। এভাবে তো বেশিদিন চলে না! তাই অজ্ঞাতবাসে লুকিয়ে পড়তে হল। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় সুখ্যাত সংগীতশিল্পী, আইপিটিএর সঙ্গে যুক্ত। তাঁর হাতে সলিল দিয়ে গিয়েছিল নিজের লেখা কাহিনি-সংগীত - 'গাঁয়ের বধূ'। একদম অন্যরকমের গান। কথায় আর সুরে গল্প শোনায়, বলে যন্ত্রণার কথা, স্বপ্নভঙ্গের কথা। হেমন্তের মনে ধরল গানটি। নিজেই অর্কেস্ট্রেশন করে রেকর্ড করলেন। সে গান মানুষের হৃদয় জিতে নিল। সলিল অবাক হয়ে দেখল, রেকর্ডে বাজছে, লক্ষ মানুষ শুনছে 'কোনো এক গাঁয়ের বধূর কথা'। টার্নটেবলে 78 আরপিএম গতিতে ঘুরে চলা কালো চাকতির কল্যাণে 'গাঁয়ের বধূ' ঢুকে পড়ল বাঙালির ঘরে ঘরে। এমনটি আগে শোনেনি কেউ। সেটা উনিশশো উনপঞ্চাশ সাল। সলিল তখন লুকিয়ে আছে আন্ডারগ্রাউন্ডে।
উনিশশো পঞ্চাশ সাল নাগাদ সলিল মেতে উঠল বন্ধু সুকান্তর আরেকটি কবিতা নিয়ে। গণনাট্য সংঘের আসরে গাইবার জন্যে নিত্য নতুন গান দরকার। সুকান্তের 'অনুভব' কবিতাটি আবৃত্তি করেই চলে সে, অসংখ্যবার আবৃত্তি করে করে যেন কবিতার গভীরে ঢুকে যেতে চায়, তার মূল সুরটিকে মিলিয়ে দিতে চায় গানের সুরের সঙ্গে, যাতে এতটুকুও অসামঞ্জস্য না থাকে । তৈরি হল গান - 'অবাক পৃথিবী'। গণসংগীতের যুগে সেও এক মাইলস্টোন। কবিতার সুর যেন বিনা আয়াসে এসে মিশে গেল গানে, সার্থক হয়ে ফুটে উঠল তার অভিব্যক্তি। এখানেও মেজর আর মাইনর কর্ড অবলীলায় মিশে যাচ্ছে, লয়ের তফাতে স্পষ্ট হয়ে উঠছে গানের বিভিন্ন অংশ। এক অংশ যদি গীতিকবিতার সুরে মায়া ছড়ায় তো অন্য অংশে আসে যূথবদ্ধ পা ফেলা - মার্চিং সং।
অবাক পৃথিবী তো গান নয়, যেন বিরাট এক ক্যানভাসে আঁকা ছবি, বিশালত্বের ব্যাকড্রপে তৈরী করা এক অসামান্য নাটক। এমন নাটকের অভিনয়ের কুশীলব ছিলেন দুজন - প্রীতি সরকার ও দেবব্রত বিশ্বাস। প্রীতি সরকার গাইতেন গানের প্রথমাংশ। 'রক্ত খরচ' করে মিলল শুধুই 'পদাঘাতের' যন্ত্রণা, পরম মমতায় ফুটিয়ে তুলতেন তার অনুভূতি।
এর পরপরই মানুষ ফেটে পড়ে বিদ্রোহে। দেবব্রত বিশ্বাসের বলিষ্ঠ গলা এবার কর্তৃত্বের রাশ হাতে নেয় -
'বিদ্রোহ আজ! বিপ্লব চারিদিকে।
বিদ্রোহ আজ! বিপ্লব চারিদিকে।
বিদ্রোহ আজ!
আমি যাই তারি দিন-পঞ্জিকা লিখে
বিদ্রোহ চারিদিকে, বিদ্রোহ আজ...'
গণনাট্য সংঘের আসরে প্রীতি সরকার-দেবব্রত বিশ্বাসের যুগলবন্দিতে প্রাণ পেত সুকান্তের 'অনুভব', সলিলের 'অবাক পৃথিবী'।
দেবব্রত বিশ্বাসের উৎসাহে সেই গান উনিশশো পঞ্চাশ সালে পুজোয় রেকর্ড করলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। আবার শ্রোতারা উদ্বেল। গাঁয়ের বধূর পর আরো একটি মাইলফলক। সলিল-হেমন্ত জুটি বাংলা গানকে নতুন নতুন চূড়ায় পৌঁছে দিচ্ছে।
সলিলেরই সুর করা 'রানার' কিন্তু তখনো শ্রোতার কাছে অচেনা। কোন ডাকহরকরা ছুটে চলে বুকের মধ্যে, অবিশ্রান্ত রক্তক্ষরণ হয়, সে সন্ধান কেউই জানে না।
হেমন্তের কাছেই সলিল একদিন হাজির হল 'রানার'কে নিয়ে। অসামান্য এই গানটিতে শুদ্ধ ও কোমল স্বর মিলিয়ে বারোটি স্বরই লাগে। হারমোনিয়ামে বাজাতে গেলে সাদা ও কালো সবগুলি রিডেই আঙুল ছোঁয়াতে হয়। এমন গানে কণ্ঠে ধারণ করতে কি যে সে কেউ পারবেন? পরের বছরেই, উনিশশো একান্ন সালের পুজোয় হেমন্ত রেকর্ড করলেন 'রানার', খবরের বোঝা নিয়ে ছুটে চলা এক ডাকহরকরার গান। ইতিহাস গড়ে দিল সে রেকর্ড। সুকান্ত-সলিল-হেমন্ত বৃত্ত পূর্ণতা পেল।
রানার গানটি শুনলে আজও মনে ভেসে ওঠে শিবডাক্তারের বৈঠকখানায় উনিশশো সাতচল্লিশ সালের মে মাসের সেই ভোরের কথা। পরবর্তীকালে প্রবাদ হয়ে যাওয়া কম্পোজার সলিল চৌধুরী রাত জেগে সুর করা শেষ করলেন। পাশে বসে রঘুনাথ চক্রবর্তী মুগ্ধ হয়ে শুনছেন। শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ গানের সুরসৃষ্টি হল তাঁর চোখের সামনে, একটা সিঙ্গল রিডের হারমোনিয়াম বাজিয়ে। ভাগ্যিস সেদিন মোবাইল ফোন ছিল না! সুকান্তর মৃত্যুসংবাদ এসে পৌঁছনোর আগেই সলিল চৌধুরীর সুর পূর্ণতা পেয়েছিল! তাই তো আমরা 'রানার'কে পেলাম। রাতের অন্ধকারে বেজে চলা ‘ঝুম ঝুম ঘণ্টা’র আওয়াজ অক্ষয় হয়ে রইল আমাদের কানে। ধন্য হল বাংলার সংগীত, বাঙালির গর্ব।