ক'দিন হলো শংকর জ্যাঠা দোকানে বসে না। দোকানের টিনের ঝাঁপও আধখোলা থাকে সারাদিন। গোলেনুর দাদীর তাঁতঘর পেরিয়ে ওপাশে গেলেই কাঁচামিঠা আমের বাগান। বাগানের আমগাছগুলো ছায়ার বেষ্টনী বানিয়ে রাখে সারাদিন। সেই বেষ্টনী পেরিয়ে একফোঁটা রোদও বাগানের মাটিতে পড়ে না। শ্যাওলা ধরা সেই মাটি খুঁচিয়ে উনুন বানিয়ে আমি, শুক্লা আর সুমি সুযোগ পেলেই খেলনাবাটি খেলতে বসি। আর উনুনের মাটির হাড়ি থেকে মন উবে গেলেই দৌড় লাগাই রাস্তার ওপারে শংকর জ্যাঠার দোকানে। আধখোলা ঝাপিতে উঁকি দিয়ে বলি, বিধান দাদা জ্যাঠা কোথায়? ওই ঝাপিটা খোলোনি কেন?
বিধান দাদা উত্তর দেয় না। প্রায় ফুরিয়ে আসা ঝুরিভাজার বয়ামটা এদিকওদিক সরিয়ে বলে, বুনু তুই কিছু নিবি?
নেবো কীভাবে? বাপি আজ অফিস যাবার আগে দশ পয়সা দিতে ভুলে গেছে তো। আমি উলটো গল্প জুরি বিধান দাদার সাথে, ওই লাঠি বিস্কুটের বয়ামও তো খালি। শংকর জ্যাঠা কবে লাঠি বিস্কুট আনবে? উত্তরহীন বিধান দাদা ক'খানা ঝুরিভাজা একটা কাগজের ঠোঙায় ভরে আমার হাতে দেয়, বুনু দোকানে আর নতুন মাল উঠবে না।
ঝুরিভাজা আমার চেয়েও বেশি পছন্দ করে মনিপিসি। দু'জনে মিলে বাইরবাড়ির বেঞ্চে বসে খাবো; ভাবনাটা আসার আগেই একটা প্রশ্ন চলে আসে মনে, বিধান দাদা দশ পয়সা ছাড়া কীভাবে এই ঝুরিভাজা নেবো? দোকানের আধখান ঝাপি বন্ধ করতে করতে বিধান দাদা বলে, পরে দিয়ে যাস। আমি ঝুরিভাজার ঠোঙা নিয়ে বাড়ির দিকে ফিরি আর পেছনে শংকর জ্যাঠার দোকানের ঝাপি পড়ে যায় এই অবেলায়।
মনিপিসিকে খুঁজতে আমার বাড়ির ভেতরে যেতে হয় না। বাইরবাড়ির বারান্দায় মনিপিসি আর কোহিনূর পিসি চটের আসনে ফুল তুলছে। আমাকে দেখতে পেয়েই কোহিনূর পিসি গলা চড়ায়, মনি তোকে ঠাকুমা খুঁজছে, খুব পাড়া বেড়ানো শিখেছিস তুই। আমি ঝুরিভাজার ঠোঙাটা সেই বারান্দায় রেখেই বাড়ির ভেতরে ঢুকি, ঠাকুমা আমাকে খুঁজছিলে কেন? বাড়ির উঠোনে ক'খানা ধামায় ভরা আধা ভানা ধান। ক'দিন আগেই মাদলা গ্রাম থেকে হিজলদিঘি, কাদম্বিনী আর ঝিঙেশাইল ধান এসেছে। এক রোদ দেওয়া ধানগুলো ঠাকুমা কাল থেকেই ঢেঁকিতে ভানছে। আজ শেষবার ধান ঢেঁকির গড়ে পড়বে। চালের গায়ে লেপ্টে থাকা শেষ ধানের পরতটুকু উঠে গেলেই ধবধবে সাদা চাল ঠাকুমার মাটির ডোলে জায়গা করে নেবে। ঢেঁকিতলা পরিষ্কার করতে করতেই ঠাকুমা উত্তর দেয়, সকালের ভাত খেয়েই বেরিয়েছো দিদি; কোথায় ছিলে? আহ্লাদী আসকারার আভাস পেয়ে আমি পায়ে পায়ে ঠাকুমার কাছে যাই, ও ঠাকুমা শংকর জ্যাঠার দোকানে আর কাঠি বিস্কুট আসবে না, জানো? ঢেঁকি গড়ে আধ ভানা ধান ঢালার শব্দে আমার কথাগুলো কেমন যেন হারিয়ে যায়। কিন্তু অদ্ভুতভাবে ধামা ধরা ঠাকুমার হাতখানা অল্পসময়ের জন্য থমকে যায়।
পূর্ণিমার মা ঢেঁকিতে পার দিতেই বাড়ির নিস্তব্ধ ভাব উধাও হয়ে যায়। ঠাকুমাও চঞ্চল হয়ে ওঠে ঢেঁকির তালে তালে। মুহূর্ত মেপে মেপে ঢেঁকির গড়ে হাত দিয়ে উল্টেপাল্টে দেয় ধানগুলো।
উঠোনের ঠিক দক্ষিণ কোণ ঘেঁষে রোদ গিয়ে পড়ে বড়ঘরের লাল বারান্দায়। আর ওদিকে তাঁতঘরের সামনে থেকেই রিক্সাওয়ালার হাঁক, বাবু বাজার পাঠাইছে। ঢেঁকিতলায় চাঞ্চল্য বেড়ে যায়। উঠোনে বাজারের ব্যাগ পড়তেই ঠাকুমার তাড়া, পূর্ণির মা পা চালাও, উনুনে আঁচ পড়তে দেরি হয়ে যাবে। পূর্ণিমার মা'র পায়ের তাল বেড়ে যায়। আর ঠাকুমাও গড়ের পাশ থেকে উঠে গিয়ে কুলোয় নতুন ভানা চাল ঝাড়তে বসে। হাতের টোকায় কুলো থেকে চাল বাতাসে ভেসে কুড়া ছড়ায়। আর এরসাথে কিছু ভাঙা চালও আলাদা হয়। সাদা ধবধবে আতপ চাল কুলোর মধ্যে গড়াগড়ি খায়। ও ঠাকুমা, এই আতপ চাল তো বেশ লম্বা। কুলোর সাদা চাল মাটির ডোলায় রাখে ঠাকুমা, ঝিঙেশাইল চালের ঘ্রাণ আর স্বাদও খুব ভাল হয় দিদি। কী বুঝে জানি না, মাটির ডোলা থেকে কিছু চাল মুঠোয় পুরে আমি নাকের কাছে ধরি। ও ঠাকুমা, চালের ঘ্রাণ পূজার ঘ্রাণের মতো।
অজান্তেই মনিপিসি এসে দাঁড়িয়েছে পাশে, কী যে বলিস? পূজার আবার ঘ্রাণ কী রে? তুমি জানো না মনিপিসি, পূজার দিন সারাবাড়িতে ঠিক এরকমই একটা ঘ্রাণ হয়। আমার মাথায় একটা ছোট্ট করে টোকা দিয়ে মনিপিসি বলে, ধুর বোকা, ও তো ভোগের ঘ্রাণ। কয়েকটি ঝিঙেশাইল চাল মুখে দিতেই আবার সেই ঘ্রাণ, না মনিপিসিটা কিচ্ছু জানে না। ঝিঙেশাইল চালের ঘ্রাণ সত্যিই পূজার ঘ্রাণের মতো।
উঠোনে রাখা মাটির ডোলা প্রায় ভরে এসেছে নতুন আতপে। এখন পূর্ণিমার মা এক মনে চাল ঝাড়ছে। একটা ধামার মধ্যে জমা হচ্ছে খুদ।
মনিপিসি খুদগুলো নিয়ে ঠাকুমার কাছে গিয়ে কিছু বলে। লালবারান্দার শালকাঠের একটু বাঁকানো খাম্বায় একটা লাল ফ্রেমের লম্বা আয়না ঝুলানো। ঠাকুমা স্নান সেরে এই আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তিব্বত স্নো মেখে সিঁদুর পরে। আয়নাটার দু'দিক দ'রকম। একদিকে মুখটা গোল দেখায়, অন্যদিকে লম্বা। আর একটু নড়ালেই কেমন যেন অদ্ভুত আকৃতি হয় মুখের। রাশিয়া থেকে সাহেবকাকুর পাঠানো এই আয়নাটি তাই আমার খুব পছন্দের। সুযোগ পেলেই নিজের চেহারার নানারূপ দেখি। এজন্যই মনিপিসি আর ঠাকুমার কথোপকথনে খুব একটা আগ্রহ দেখাই না আমি।
কিন্তু মনিপিসি যখন ধামা থেকে প্রায় অর্ধেক খুদ নিয়ে বাইরবাড়ির দিকে যায়, তখন আর সংযত হতে পারি কই? মনিপিসি কতগুলো খুদ নিলে তুমি! কী করবে ওগুলো দিয়ে?
মনিপিসির পেছন পেছন বাইরবাড়িতে যেতেই কোহিনূর পিসি চটের আসন সেলাই ফেলে উঠে যায়। চটের আসনে তখন ফুল আর অর্ধেক পাখি সেলাই হয়েছে মাত্র। মানুষগুলোর গতিবিধিতে আমার আগ্রহ আরোও তীব্র হয়। তোমরা কী করবে এখন? মুখ টিপে হেসে মনিপিসি বলে দাঁড়া বলছি, তার আগে একটা কাজ কর। ঠাকুমার কাছ থেকে কয়েকটা আলু নিয়ে আয়। মনিপিসির কথাতে কিছু একটা আছে। আসন্ন আনন্দের আভাস পেয়ে আমি দৌঁড়ে ঠাকুমার কাছে যাই, ও ঠাকুমা মনিপিসিরা আলু চাইছে; ওরা কী করবে তুমি জানো? বেতের ঝুড়ি থেকে কয়েকটা নতুন সাদা আলু আমাকে দেয় ঠাকুমা, জোলাভাতি করবে। আনন্দে আমার চোখ চিকচিক করে ওঠে, সেই কবে জোলাভাতিতে আলুবেগুন দিয়ে খিচুড়ি রেঁধেছিলো মনিপিসি; তার স্বাদ মনে আসতেই বায়না ধরি আমিও থাকবো জোলাভাতিতে।
কোহিনূর পিসিদের সুপারি বাগানে জোলাভাতি হবে। ভাঙা কড়াইয়ের ভেতর বসানো আলগা একটি উনুন হাজির করে কোহিনূর পিসি। আর সাথে পোষা হাঁসের ডিম। সুপর্ণা পিসি শিশি ভরে সর্ষের তেল আর কাঁচামরিচ আনে। পেঁয়াজ আর রসুন আনতে আবার বাড়ির ভেতর যায় কোহিনূর পিসি। আলু আর ডিম সেদ্ধ করে নামিয়ে নেয় সুপর্ণা পিসি। ঝিঙেশাইল আতপের বৌখুদ মনিপিসির হাতে খুব ভাল হয়। কোহিনূর পিসি তাই রসুন-পেঁয়াজ কুচিয়ে এগিয়ে দেয়। কড়াইয়ের সর্ষের তেল থেকে ধোঁয়া ছাড়তেই কুচানো রসুন-পেঁয়াজ দিয়ে একটু নেড়ে তাতে অনেকগুলো কাঁচামরিচ দিয়ে দেয় মনিপিসি। এরপর হলুদ আর লবণ দিয়ে একটু নেড়েই আতপের খুদগুলো দিয়ে দেয়। অল্পসময় চাল ভেজেই জল ঢেলে দেয় জগ থেকে। টগবগ করে ফুটে ওঠে চালগুলো। জল খেয়ে চালগুলো ফুলে উঠতেই ঢাকনা পড়ে কড়াইয়ে। কিন্তু তার আগেই ঝিঙেশাইল চালের ঘ্রাণ বাতাসে মিশে যায়। অদ্ভুতভাবে আমি এখন ঈদের ঘ্রাণ পাই। কী জানি ঝিঙেশাইল চালের সেই পূজার ঘ্রাণ কীভাবে বদলে গেলো?
কিছু সময় পর ঢাকনা তুলে বৌখুদ আরেকটু নেড়েচেড়ে মনিপিসি নামিয়ে নেয়। এরপর সুপর্ণা পিসি হাঁসের ডিমের কষা রান্না করে। মনিপিসির তাড়া খেয়ে স্নান করে পাট করে চুল আঁচড়ে আমি আবার চলে এসেছি সুপারি বাগানে। ঠাকুমার কলার ঝোপ থেকে কোহিনূর পিসিই কলাপাতা কেটে আনে। প্রায় পড়ে যাওয়া বেলায় সুপারি বাগানের এককোণ পরিষ্কার করে সামনে কলাপাতার পাত নিয়ে সারি বেঁধে বসি সবাই। মনিপিসি সবার পাতে বৌখুদ আর কষা ডিম তুলে দিতেই গোলেনূর দাদী ছোট্ট একটা বাটি হাতে নিয়ে এসে দাঁড়ায়, বৌখুদের সাথে আলু ছানা আর কালোজিরা ভর্তা ভাল লাগে।
সবার আগে হাঁসের ডিম কষা শেষ করি। এরপর বৌখুদ তুলে মুখে দিতেই বাইরবাড়ির বারান্দায় দাদুর পাশে পাঞ্জাবি পড়া মানুষটিকে দেখতে পাই আমি। ইচ্ছে হয় জোলাভাতি ফেলে চলে যাই ওই বারান্দায়। মানুষটি এ বাড়িতে আসা মানেই রঙিন কাঠি লজেন্সে লাল হবে আমার জিহ্বা।
আমি কোনোরকমে বৌখুদ শেষ করে গোলেনূর দাদীর কুয়াতলায় চলে যাই। হাতল ছাড়া বালতি থেকে জল নিয়ে হাত ধুয়েই এক দৌঁড়ে আমাদের বারান্দায়। জামার এক কোণে হাত মুছতে মুছতে শংকর জ্যাঠার পাশে দাঁড়াই আনন্দ লুকিয়ে। হৈ চৈ করা মানুষটির চোখেমুখে এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা আজ। শুধু পাশ থেকে দাদু বারবার বলছে, এত কমদামে সব বিক্রি করে দিলি শংকর?
কী বিক্রি হয়েছে, কেন বিক্রি হয়েছে সেসবে আমার আগ্রহ নেই। শুধু কাঠি লজেন্সের কথা শংকর জ্যাঠাকে মনে করে দিতেই বলি, শংকর জ্যাঠা তোমার দোকানে সব বয়াম খালি হয়ে গেছে কেন? কাঠি লজেন্সও তো দেখলাম না আজ। না, এতে কাজ হয় না। শব্দহীন কিছু সময় মাথানিচু করে বসে থাকে শংকর জ্যাঠা, এরপর দু'হাত ভাঁজ করে বুকের কাছে নিয়ে বলে, আর কিছুর জন্য নয়, শুধু ভিটার জন্য মনের ভেতর পোড়ায়।
শংকর জ্যাঠা আমাকে নিরাশ করে দেবদারু গাছের তলা দিয়ে আমাদের তাঁতঘর পেরিয়ে চলে যায়, আর ঠিক তখনই কোনো এক তাঁতি গলা ছেড়ে গেয়ে ওঠে,
'নিরাকার ব্রহ্ম হয় সে সদাই ফেরে অচিন দেশে
দোসর তাই নাইকো পাশে
ফেরে সে একা একা।।'
গল্প আর খাবারের ছবি দুটোই ভীষণ নান্দনিক ।
রান্নার সুবাস যেন পাচ্ছি।