মেসোপটেমিয়াতে আব্রাহাম ব্যবসা করে দিন গুজরান করছিলেন। ঈশ্বর তাঁকে বললেন হেথা নয়, তোমাদের জন্যে আমি একটা বাসস্থান স্থির করে রেখেছি। যাও সেথা। অতএব ভেড়া গোরু ঠেঙ্গিয়ে গুষ্টি শুদ্ধু আব্রাহাম এলেন জুদিয়া। সেখান থেকে একদিন পরিযায়ী শ্রমিক হয়ে ইহুদিরা মিশর গেলেন। মোজেস তাদের ফেরালেন আপন দেশে। কিন্তু সঙ্কট পিছু ছাড়ে না। প্রথমে অ্যাসিরিয়ানরা পরে ব্যাবিলনের রাজা তাদের খেদালেন। ফিরে যদিও এলেন কয়েকশ বছরের ভেতরে রোমান রাজা এসে তাদের মন্দির ধ্বংস করলেন, জেরুসালেম পোড়ালেন।
ইহুদি ঘর ছাড়া হল।
ইউরোপে তারা দেখা দিল এক যাযাবর জনতা রূপে। সব দেশে তারা বিদেশি । ১৩শ শতাব্দীতে পোল্যান্ডের রাজা বোলেস্লাভ পূর্ণ নাগরিকতা না দিলেও খানিকটা স্বীকৃতি দিলেন। বাকি ইউরোপ তাদের দূর ছাই করছে। আইন করে ১২৯০ সালে ইংল্যান্ড, ১৪৯২ সালে স্পেন তাদের বহিষ্কার করল। নরওয়ে সুইডেন ডেনমার্ক প্রবেশ নিষেধ বোর্ড টাঙ্গিয়ে দিলো।
রনাঙ্গনে ইহুদিদের নামার কোন প্রশ্ন ওঠে না তখন।
ফরাসি বিপ্লবের কারণ ও তাহার ফলাফল সম্বন্ধে যাহা জান তাহা লিখ। এই ধরনের প্রশ্ন আসতো বরানগরে স্কুলের ইতিহাস পরীক্ষায়।
ইউরোপের ইতিহাসে ফরাসি বিপ্লবের পরে লিখিত সংবিধানটিও বিপ্লবী! প্রথমত এটি সম্পূর্ণ ভাবে ঈশ্বর বর্জিত – ইউরোপের প্রথম সেকুলার সংবিধান। ইউরোপীয় ইতিহাসে ইহুদিরা প্রথম পেলেন নাগরিক অধিকার। ১৭৯১।
বাস্তিল পতনের তিন বছরের মধ্যে আনসেলম নরদাঁ হলেন প্রথম ইহুদি সামরিক অফিসার। ইহুদি সৈনিক লড়েছেন নাপোলেওঁর বাহিনীতে।
তার একশো বছর বাদে, ১৮৯৪ সালে, ফরাসি সৈন্য বাহিনীর এক ইহুদি ক্যাপ্টেন আলফ্রেড দ্রাইফুসকে (আক্ষরিক অর্থে তিনটে পা) জার্মান সরকারের কাছে গোপন রাষ্ট্রীয় তথ্য সরবরাহ করার সাজানো অভিযোগে ক্যারিবিয়ানের কুখ্যাত ডেভিলস আইল্যান্ডে যাবজ্জীবন নির্বাসন দেওয়া হয়। আসল আসামি এস্টারহাজিকে নামমাত্র বিচারের প্রহসন করে মুক্তি দেওয়া হল। দ্রাইফুসের পুনর্বিচারের জন্য ফ্রান্সে যে গুঞ্জন ওঠে তাতে গোটা দেশ হল দুই ভাগে বিভক্ত।
একদিকে ন্যায় বিচারের দাবিতে সোচ্চার হলেন সারা বারনহারড, আনাতোল ফ্রাঁস, জর্জ ক্লেমানশ সহ অনেক বরেণ্য ফরাসি লেখক ও গুণী ব্যক্তি। এমিল জোলা একটি খোলা চিঠি লিখলেন ফরাসি রাষ্ট্রপতিকে : , জাকুস (আমি অভিযোগ করছি) । লরোরে কাগজের প্রথম পাতায় এটি ছাপা হল ১৮৯৮ সালে ১৩ই জানুয়ারি। এই চিঠি লেখার কারণে এমিল জোলার বিরুদ্ধে মামলা করল ফরাসি সামরিক কর্তৃপক্ষ। এক বছরের কারাবাস এবং সে আমলের সর্বাধিক অর্থদণ্ড ৩০০০ ফ্রা নির্ধারিত হল। এ ধরনের ঘটনা আর কোন দেশে ঘটেছে বলে আমার জানা নেই। ১৯০২ সালে জোলার অন্ত্যেষ্টি যাত্রার সঙ্গী, আনাতোল ফ্রাঁস বললেন-
এবার আমি বলি
ঈর্ষা করো তাঁকে : তিনি তাঁর দেশ ও দুনিয়াকে সম্মানিত করেছেন তাঁর প্রতিবাদে
ঈর্ষা করো তাঁকে : তাঁর হৃদয় আমাদের করেছে সমৃদ্ধ
তিনি ছিলেন মানুষের বিবেকের একটি মুহূর্ত।
অন্যদিকে ফ্রান্সের পুরনো ইহুদি বিদ্বেষ তার কণ্ঠ খুঁজে পেলো। কট্টর জাতীয়তাবাদী ফরাসিরা জেগে উঠলেন - ইহুদিদের জন্য ফ্রান্সের প্রতিরক্ষা, ফরাসি সভ্যতা বিপন্ন। সে ক্রোধ এমনি রুদ্র রূপ নিয়েছিল যে এমিল জোলা আনাতোল ফ্রাঁসের মত মানুষের প্রাণ নিয়ে টানাটানি। একশোর বেশি জেলায় ইহুদিদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ, তাদের সম্পত্তির বিনাশ চলল -পুলিস নির্বাক দর্শক মাত্র (হিটলারের বয়েস তখন ন বছর, গোয়েরিঙের ছয় : আইখমানের জন্মাতে আট বছর দেরি আছে) । কোন প্রমাণ ছাড়াই পুনর্বিচারে দ্রাইফুসের সাজা আরও দশ বছর বাড়ানো হল। তাঁকে জানানো হল তিনি মুক্তি পাবেন যদি অপরাধ স্বীকার করেন। পাঁচ বছর ডেভিলস আইল্যান্ডের কঠোর জীবনে ক্লান্ত দ্রাইফুস তাতেই সই করে মুক্ত হলেন (ডাসটিন হফমান অভিনীত পাপিলন ছবিতে ডেভিলস আইল্যান্ড চিত্রায়িত হয়েছে)। সামরিক বাহিনীতে পুনর্বাসন হল দ্রাইফুসের। তিনি জার্মানির বিরুদ্ধে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন।।
দ্রাইফুসের বিচারের পরিহাস ও প্রকট ইহুদি বিদ্বেষের এই কাহিনি ইউরোপে সাড়া জাগায়। চল্লিশ বছর বয়সী এক অস্ট্রিয়ান ইহুদি সাংবাদিক দ্রাইফুসের মামলার বিবরণ পাঠাচ্ছিলেন ভিয়েনার নয়ে প্রেসে পত্রিকার জন্য। আপন দেশে ইহুদি বিদ্বেষের সঙ্গে সম্পূর্ণ পরিচিত তিনি। কিন্তু ভাবেননি ফ্রান্সে তার পুনরাবৃত্তি দেখবেন। এই সেই দেশ যেখানে ইউরোপের ইতিহাসে ইহুদিরা প্রথম পূর্ণ নাগরিকের সম্মান পেয়েছিলেন একশ বছর আগে।। দ্রাইফুস ঘটনার পরে তিনি লিখলেন, “ফ্রান্সের মতন সভ্য দেশে যদি এই বর্বরতা চলে, ইউরোপে আমাদের কোন ভবিষ্যৎ নেই। আমাদের চাই আপন দেশ “।
তাঁর নাম থিওডোর হ্যরতসল। জাইওনিসট আন্দোলনের, ইহুদিদের আপন বাসভূমি স্থাপনার পুরোধা। ইজরায়েল প্রতিষ্ঠার অনেক আগেই অবশ্য তিনি মারা যান। তাঁর সম্মানে তেল আভিভের একটি শহরতলির নাম হ্যরতসলিয়া।
দ্রাইফুস ঘটনার (লোকমুখে এর নাম হয়ে যায় শুধুমাত্র " ঘটনা” বা লা ফের) - দেড় দশক বাদে প্রথম বিশ্ব যুদ্ধ শুরু হয়। অস্ট্রো হাঙ্গেরিয়ান রাজত্বে তখন প্রায় ২৫ লক্ষ ইহুদি নাগরিক বাস করেন। অন্য অস্ট্রিয়ানদের পাশে দাঁড়িয়ে তিন লক্ষ ইহুদি সৈন্য এই যুদ্ধে সম্রাটের পক্ষে লড়াই করেছেন। অস্ট্রো হাঙ্গেরিয়ান সরকার ইহুদি সৈন্যদের জন্য আলাদা হেঁসেলের ব্যবস্থা অবধি করেন। যুদ্ধক্ষেত্রে ক্রিস্টিয়ান সৈন্যদের সঙ্গে যেমন আপন ধর্মযাজক (চ্যাপলেন) চলেন, ক্যাপ্টেনের সামরিক মর্যাদা সহকারে রাবিদের নিযুক্ত করা হয় ইহুদি সৈন্যদের পাশে থাকার জন্য (ফেলডরাবিনার) । এডুয়ার্ড রিটার ফন শোয়াইতসার এবং আডলফ করনহাবার অস্ট্রো হাঙ্গেরিয়ান বাহিনিতে ফিল্ড মার্শাল পদে উন্নীত হন।
প্রসঙ্গত, আজকের ইজরায়েল বাদ দিলে বিগত একশ বছরে এক মাত্র ইহুদি যিনি কোন সেনা বাহিনীর লেফটেনানট জেনারেল পদে উন্নীত হয়েছেন তিনি আমাদের ভারতের জ্যাক ফারজ রাফায়েল জেকব। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তাঁর নাম স্বর্ণাক্ষরে লিখিত আছে। এমনকি আমেরিকান সৈন্য বাহিনীতেও কোন ইহুদি পূর্ণ জেনারাল দেখা যায় না।
রাশিয়ান সাম্রাজ্যে কোন ইহুদির বসবাস ছিল না। কিন্তু উনবিংশ শতাব্দীতে জারেরা যখন পোল্যান্ড, ইউক্রেন এবং বালটিক দেশগুলি দখল করেন, রাজত্বের সঙ্গে ফাউ হিসেবে পেলেন পঞ্চাশ লক্ষের বেশি ইহুদি (পেল অফ সেটলমেনট – ইহুদি রসিকতা ষষ্ঠ পর্ব দ্রষ্টব্য) । ইজরায়েল সৃষ্টি হবার আগে অবধি ইতিহাসে এটি বৃহত্তম ইহুদি জনপদ। রাশিয়ান জার ইহুদিদের সামাজিক স্বীকৃতি কখনোই দেন নি কিন্তু আঠারো থেকে পঁচিশ বছরের ইহুদিদের মিলিটারি সার্ভিস বাধ্যতা মূলক করা হল। ছ'লক্ষ ইহুদি নাগরিকের অধিকার না পেলেও লড়াই করলেন জার্মানদের বিরুদ্ধে। অন্তত এক লক্ষ জারের জন্য প্রাণ দিলেন।
ভারসাই চুক্তিতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দায় জার্মানির ওপর চাপানো হয়। হিটলার সারা জীবন এর তীব্র বিরোধিতা করেছেন যদিও এ যুদ্ধে জার্মানির ভূমিকা আকস্মিক বা অনিচ্ছুক অংশীদারের নয়। কয়েকটি উদ্ধৃতি দেওয়া যেতে পারে -
জার্মানির লক্ষ্য হল পুবের পানে ধাবিত হওয়া। আমাদের এই দীর্ঘ দিনের অস্ত্র সঞ্চয় কেবলমাত্র পূর্বের স্লাভিক দেশগুলি অধিকারের জন্য (প্রাশিয়ান জেনারাল বারনহারদি, ১৯১২) – এক দশক বাদে হিটলার জার্মান জাতিকে উদ্বুদ্ধ করবেন " যাও পূবে” ( দ্রাং নাখ অস্টেন) ।
জার্মানির উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন সাম্রাজ্য বিস্তার। মানুষের সভ্যতার শ্রেষ্ঠ শিক্ষা হল যুদ্ধ (অধ্যাপক ওবারহোফেন, ১৯১৩)
কাইজারের পঁচিশ বছরের শান্তিপূর্ণ শাসন একটি বিশাল যুদ্ধের প্রস্তুতি মাত্র (বারলিনার জাইতুং, ১৯১৩)।
আমরা কি চাই? আমরা চাই একটি ভয়ঙ্কর আগ্রাসী যুদ্ধ (কার্ল পিটারস, আগস্ট ১৯১৩ : গোয়েটিংগেন ও বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস এবং দর্শনের ছাত্র। শোপেনহাউয়ারের ওপর এসে লিখে স্বর্ণ পদক প্রাপ্ত)
সারায়েভোতে ল্যাটিন ব্রিজের সামনে গাভ্রিলো প্রিন্সিপ অস্ট্রিয়ার ভাবি রাজা ও রানির ওপর গুলি চালাবেন এক বছর বাদে, ২৮শে জুন, ১৯১৪। শুরু হবে এক মহারন। কিন্তু সেই যুদ্ধের জার্মান মহড়া শুরু হয়েছে অনেক আগে। জার্মানিতে তখন পাঁচ লক্ষ ইহুদি পূর্ণ নাগরিকের মর্যাদায় বাস করেন। এই বিশাল যুদ্ধের উন্মাদনায় অংশ নিলেন এক লক্ষের বেশি ইহুদি। পূর্বে রাশিয়ান ফ্রন্ট থেকে পশ্চিমে বেলজিয়াম ফ্রান্স অবধি বিস্তৃত রণক্ষেত্রে বারো হাজার প্রাণ দিলেন কাইজারের নামে।
তাঁদের মধ্যে কয়েকজনের কথা মনে করি।
অটো ফ্রাঙ্ক : হাইডেলবেরগে অর্থনীতি পড়েন। কিছুদিন নিউ ইয়র্কে কাজ করেছেন। তারপর বাবার ব্যাঙ্কিং ব্যবসায়ে যোগ দেন ফ্রাঙ্কফুর্টে। পশ্চিম রনাঙ্গনে অসম্ভব বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করে ১৯১৭ সালে লেফটেন্যান্ট পদে উন্নীত হন। দুই ভ্রাতুষ্পুত্র যুদ্ধে মারা যান। অটো ফ্রাংকের দুটি মেয়ে – মারগট ও আনেলিস। হিটলারের অভ্যুদয়ের পরে হল্যান্ডে পালালেন। আমস্টারডামের এক চোর কুঠুরিতে বসে আনেলিস যে দিনলিপি লিখেছিলেন সেটি পরে অ্যান ফ্রাংকের ডায়ারি নামে বিশ্ববিখ্যাত হয়। স্ত্রী এডিথ ও দুই কন্যা কনসেনট্রেশান ক্যাম্পে মারা যান। অটো প্রাণে বেঁচে ফিরে আসেন।
কুরট লানডাউয়ার : আজকের সুবিখ্যাত বায়ার্ন মিউনিক ফুটবল ক্লাবের একেবারে প্রথম যুগের সবচেয়ে সফল খেলোয়াড়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে লড়াই করেছেন পুরো চার বছর। বায়ার্ন যখন প্রথম ফুটবল লিগ জেতে (১৯৩২) লানডাউয়ার তখন ক্লাব প্রেসিডেন্ট। নাৎসিরা এসেই তাঁকে দাখাউ কনসেনট্রেশান ক্যাম্পে পাঠায় কিন্তু তাঁর অসামান্য সামরিক রেকর্ডের জন্য একমাস বাদে ছাড়া পান। বন্ধুজনের সহায়তায় সুইজারল্যান্ড পালালেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে পশ্চিম জার্মানি তাঁকে সসম্মানে ফিরিয়ে আনে। আবার বায়ার্ন প্রেসিডেন্ট হলেন লানডাউয়ার।
হুগো গুটমান : যুদ্ধ শুরু হতেই নুরেমবেরগের হুগো গুটমান ব্যাভেরিয়ান কামান বাহিনীতে যোগ দিয়ে লেফটেনানট হলেন ১৯১৫ সালে। পশ্চিম ফ্রান্সের বিভিন্ন রণক্ষেত্রে বীরত্ব প্রদর্শনের কারণে প্রথম শ্রেণির আয়রন ক্রস অর্জন করেন। ১৯১৮ সালে তিনি হলেন ক্যাম্প কমানডানট । এই সময়ে তাঁর চোখ পড়ে বছর তিরিশেকের এক সাহসী সৈন্যের ওপরে। উপরওয়ালাদের কাছে হুগো সুপারিশ করলেন সেই সৈন্যকে প্রথম শ্রেণির আয়রন ক্রস দেওয়া হোক। আগস্ট মাসের চার তারিখে পশ্চিম ফ্রান্সের সোয়াসাঁ শহরে এক অনুষ্ঠানে হুগো গুটমান তাঁকে আয়রন ক্রস পরিয়ে সম্মানিত করলেন। এই সৈনিক তাঁর জীবনের শেষদিন অবধি সেই ক্রস সর্বদা গর্বের সঙ্গে পরিধান করতেন।
এই বীর সৈনিকের নাম আডলফ হিটলার!
ভাগ্যের বিদ্রূপ! এক ইহুদির হাত থেকে হিটলার পেলেন তাঁর সামরিক জীবনের শ্রেষ্ঠ পদক!
এই সোয়াসাঁ থেকে ৪০ কিলো মিটার পশ্চিমে গেলেই কম্পিয়েন শহর। তিন মাস বাদে, ১১ নভেম্বর ১৯১৮ সালে, একটি রেলের বগিতে বসে পরাজিত জার্মানি সেখানে ফ্রান্সের সঙ্গে সন্ধিচুক্তি স্বাক্ষর করতে বাধ্য হয়। হিটলার তার শোধ নিলেন বাইশ বছর বাদে। পরাজিত ফ্রান্স জার্মানির পদপ্রান্তে বসে যুদ্ধ বিরতি ভিক্ষা করলো ২২শে জুন ১৯৪০। হিটলারের আদেশে পুরনো রেলের বগিটিকে টেনে আনা হলো ঠিক একই জায়গায়। সেখানে বসে ফ্রান্স সই করলো সেই চুক্তিতে।
ইতিহাসে এমন প্রতিশোধের দৃষ্টান্ত বিরল।
১৯৩৫ সালে ইহুদি হুগো গুটমান হারাবেন তাঁর জার্মান নাগরিকত্ব, গ্রেফতার হবেন গেস্টাপোর হাতে। গ্যাস চেম্বারে প্রেরিত হবার আগে নিতান্ত ঘটনাচক্রে একজন এস এস অফিসার তাঁর পুরনো কমানডারকে চিনতে পেরে তাঁকে বেলজিয়ামে পালিয়ে যাবার সুযোগ করে দেন।
প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের পরে স্বাক্ষরিত ভাইমার সংবিধান সকল নাগরিককে দিয়েছে সমান মর্যাদা, মানুষের মনের ভেতরে যাই থাক না কেন। নাৎসিরা যখন ক্ষমতায় এলো, জার্মানিতে ইহুদিদের অনেক অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত। কেবল ব্যবসা বাণিজ্যে নয়, শিল্পে বিজ্ঞানে সাহিত্যে সঙ্গীতে ইহুদিরা সমাজের বিভিন্ন স্তরে আসন করে নিয়েছেন। জনসংখ্যার এক শতাংশ ইহুদি জার্মানিকে এনে দিয়েছেন এগারোটি নোবেল প্রাইজ। মুখর না হলেও চাপা ইহুদি বিদ্বেষ জার্মানি এবং ইউরোপের সুপ্রাচীন ব্যাধি । নাৎসিরা সেই বিদ্বেষকে ভালো মতন লালন পালন করে তাকে দিল এক সশব্দ উপস্থিতি – ইহুদিদের জন্য আমাদের সমাজ, ধর্ম, জীবন, বিপন্ন। পাঁচ লক্ষ ইহুদীর জন্য ছ কোটি জার্মান তাদের সভ্যতা নিয়ে শঙ্কিত।
দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের ডঙ্কা যখন বাজল, ততদিনে জার্মানিতে ইহুদি সম্প্রদায়ের নাগরিকত্ব ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। তাঁদের কপালে জুটেছে হয় নির্বাসন অথবা স্থান হয়েছে ঘেটোতে বা কনসেনট্রেশান ক্যাম্পে। নাৎসিরা তাদের হাতে বন্দুক তুলে দিয়ে দেশ রক্ষা করার কথা বাতুলতা বিবেচনা করে।
নুরেমবেরগের জাতি আইনে (১৯৩৫) নির্ধারিত হয়েছিল কে জার্মান বা আর্য আর কে অনার্য। বিগত চার পুরুষের মধ্যে তিনজন ইহুদি থাকলে তিনি ইহুদি। জার্মান নাগরিকত্ব বাতিল। তিনি একান্ত অবাঞ্ছিত। নাগরিকত্ব কেন, সাধারণ সামাজিক অধিকার তাদের মিলবে না। বিগত আট পুরুষের ভেতরে যদি একজন বা দুজন ইহুদি হয়ে থাকেন তাঁকে মিশ্রিত জাতির মানুষ (মিশলিং) বলে চিহ্নিত করা হবে। তাঁকে আংশিক ভাবে জার্মান বলা যাবে, নাগরিকত্ব বহাল থাকবে। তবে কাজে কর্মে অনেক বাধা। মনে রাখা দরকার এঁরা ধর্মান্তরিত ইহুদি, ক্রিস্টিয়ান। কিন্তু খানিকটা ইহুদি রক্ত থেকে গেছে।
সাত আটশ বছর বসবাসের পরে রক্তের ভিত্তিতে ইহুদিদের জার্মান নাগরিকত্বের প্রমাণ চাওয়া হল।
তবু অন্তত ৭৭ জন অর্ধ বা পৌনে ইহুদি ( যাদের চার পুরুষে এমনকি তিনের অধিক ইহুদি ছিলেন এবং যারা নুরেমবেরগের জাতি আইন অনুযায়ী জার্মান নন) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মান সৈন্য বাহিনীতে উচ্চ পদ অধিকার করেন - যেমন ফিল্ড মার্শাল এরহারড মিলশ, জেনারাল হেলমুট উইলবেরগ। হিটলার এবং গোয়েরিং স্বহস্তে স্বাক্ষর করে তাঁদের নির্বাচনে সম্মতি দেন।
গোয়েরিঙ বলেছিলেন, কে ইহুদি কে নয় সেটা আমি ঠিক করি! প্রয়োজন বুঝে।
প্রতিপক্ষে, মিত্র বাহিনীতে প্রায় পনেরো লক্ষ ইহুদি যোগ দেন। অনেক বাদ বিতণ্ডার পরে আমাদের দেশের গোর্খা রেজিমেন্ট বা আসাম রাইফেলস এর ধাঁচে ১৯৪৪ সাল নাগাদ ব্রিটিশ বাহিনীতে একটি ইহুদি ব্রিগেডের গঠন অনুমোদিত হয়।
দু হাজার বছর পরে ইহুদি এই প্রথম যুদ্ধক্ষেত্রে নামল তার আপন পরিচয় সামনে রেখে – ইউনিফরমে লাগানো ছিল মাগেন দাভিদ (ছ কোনা তারা- স্টার অফ ডেভিড) । এঁরা লড়াই করেন ইউরোপের দক্ষিণে, ইতালিতে। পরবর্তী কালে ইজরায়েল পত্তনে এই ইহুদি ব্রিগেডের বিশাল অবদান আছে। এক হিসেবে আজকের ইজরায়েলি সৈন্য বাহিনীর পিতামহ এই ব্রিটিশ ইহুদি ব্রিগেড।
নরমানডির বিশাল প্রান্তরে আমেরিকান ইউরোপীয় অস্ট্রেলিয় কানাডিয়ান সৈন্যের পাশে দেখেছি অজস্র ইহুদি সমাধি। মিত্র পক্ষের পক্ষে লড়ে প্রাণ দিয়েছেন।। তার এক কিলোমিটার ব্যবধানে আছে জার্মান সামরিক সমাধি ক্ষেত্র। পাথরে যাদের নাম লেখা আছে তাদের অনেকের বয়েস কুড়ি পেরোয় নি।
৬ই জুন ১৯৪৪ সালে জার্মান অধিকৃত ইউরোপের মূল ভূখণ্ডে মিত্র শক্তি প্রথম আঘাত হানে নরমানডিতে। তাদের শৌর্য গাথা, বীরত্বের কাহিনি আপনাদের জানা। ডি ডে ছবিটি অনেকেই দেখেছেন। যদি পারেন একবার নরমানডি তটে আসুন- আরোমানশ, কোলভিল যে কোন বিচে। এ এক তীর্থযাত্রা।
বন্দুকের, কামানের আওয়াজ থেমে গেছে কবে। নরমানডিতে আদিগন্ত বিস্তৃত মৃত সৈনিকের সারি সারি শ্বেত সমাধি প্রস্তর দেখে মাথা নিচু করে অজস্র ভ্রমণকারীকে নিশ্চুপ হয়ে যেতে দেখেছি। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ শেষ। শৌর্য বীর্যের কথা আজ অবান্তর।
কেন এই মহারণ? জীবনের অর্থহীন অপচয়?
দূরে আটলান্টিক। নীল সমুদ্র। সামনে চির নিদ্রায় শায়িত হাজার হাজার সৈন্য : শত্রু, মিত্র। সকলেই ঈশ্বরের সন্তান। মানুষ।