শ্নরার বা উপযাচককে নিয়ে
ছয়ের দশক। কলেজের প্রথম বছর। একটা গান পুজো প্যান্ডেলের লাউড স্পিকারে খুব শোনা যেতো (ছবির নাম দস লাখ) -
গরিবোঁ কি সুনো, ওহ তুমহারি সুনেগা
তুম এক পয়সা দোগে, ওহ দস লাখ দেগা
এ কথা গুলোর সার মর্ম খুঁজতে গিয়ে মনে হয়েছে এ তরিকাটি তো মন্দ নয়। আমি এক জনকে এক পয়সা দিলে ঈশ্বর দশ লাখ দেবেন আমাকে। অল্প কমিশনে ডিরেক্ট মানি ট্রান্সফার। লাভ শুভ, শুভ লাভ। ওপরঅলার কাছে সরাসরি দশ লাখ চাইলে হয়তো খরচা বেশি পড়তো।
সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষের সাহায্যার্থে অর্থবানের টাকার থলির বাঁধন আলগা করার আইনি নির্দেশ সব আব্রাহাম পন্থী ধর্মের অন্তর্ভুক্ত। ইহুদি ধর্মে প্রথমে ফসলের, পরে আয়ের কিছু শতাংশ (দশ অবধি) অভাবী মানুষের সেবায় উৎসর্গ করার আদেশ পাওয়া যায় – এর নাম জেদেকাহ (আক্ষরিক অর্থে ন্যায়)। সবাই সমান উপার্জনে সক্ষম নন বলে অর্জিত ধন ভাগ করে নেওয়াটা ন্যায় বলে বিবেচিত হয়। প্রাচীন সমাজে আপামর জনসাধারণের জন্য সরকারি দাতব্য চিকিৎসা ব্যবস্থা ছিল না -রাজা রাজড়ারা কর আদায় করে যুদ্ধু বাধাতেন। জনসেবায় কুয়ো খোঁড়া বা রাস্তা বানানোর কাহিনি ইতিহাসে পাওয়া যায় বটে তবে সেটি সবসময় প্রয়োজন অনুযায়ী সাধিত হত কিনা তা বিতর্কের বিষয়। অতএব দরিদ্র জনগণের ভরসা স্বচ্ছল জনগণ। এই দানের সদিচ্ছা স্বচ্ছল জনগণের ওপরে ছেড়ে না দিয়ে একটা ধর্মীয় আদেশ সেই দান ব্যবস্থাটিকে কায়েম করে।
আজকের মতন বেসরকারি সাহায্য উদ্যোগ অথবা এন জি ও গড়ে উঠতে বহু বছর লেগে গেছে। জেরুসালেমে মন্দির ধ্বংস হবার পরে ইহুদি ধর্মে ভ্যাটিকান সুলভ কোন কেন্দ্রীয় কর্তৃত্ব কোন দিন ছিল না। তাই শনিবারে সিনাগগে দান আদায়ের কৌটোতে (তার নাম পুষকে) সংগৃহীত দানের যথার্থ বণ্টন দায়িত্ব বর্তায় স্থানীয় ইহুদি সমাজের ওপরে। গ্রামে গঞ্জে পর্বে আমরা দেখেছি ষ্টেটেলের মানুষ গ্রামের দরিদ্র মেয়েদের বিয়ের যৌতুকের টাকা অবধি সংগ্রহ করতেন সেই বাকসোয়।
খ্রিস্ট ধর্মে আয়ের দশ শতাংশ দানের নির্দেশ আছে যাকে বলা হয় টাইথ। সেটি গিরজেয় জমা করতে হতো। কি ভাবে তা ব্যয় করা হবে স্থির করতেন ধর্ম পিতাগণ। ইসলামে আছে জাকাত। সকল ধর্মনিষ্ঠ মুসলিমের কর্তব্য আয়ের অন্তত আড়াই শতাংশ সৎ কাজে ব্যয় করা।
আমরা দান করি স্বেচ্ছায়। কর দিই অনিচ্ছায়।
করের টাকা সরকার ঠিক কোনখানে ব্যয় করেন আর মাছ কখন জল খায় সেটা জানা একই রকম দুরূহ কাজ। দানের টাকাটা কোথায় বা কাকে দেব সেটা আমি নিজে স্থির করতে পারি। আজকাল অকসফ্যাম ইউনিসেফ ইত্যাদি অজস্র সংস্থা আমাদের এই শুভকর্ম সাধনে সহায়তা করার জন্য হাত বাড়িয়ে আছেন। তবে তাঁরাও যে যথাযথ ব্যয় করছেন এমন ভাববার কোন সঙ্গত কারণ নেই। সেটা আরেকটা বিষয়।
ইহুদি তালমুদে দান করার আদেশ তো দেওয়া হল। সেটি করা ঈশ্বর সেবার সমতুল্য সেটাও বোঝা গেল। কিন্তু সে দানের বারিধারা কার ওপরে বর্ষিত হবে তার হদিশ দেওয়া নেই। সিনাগগের ভাঁড়ে টাকা জমা দিলেই কি কাজ ফুরলো? এ টাকার স্রোতের গতি কোন মুখে যাবে?
ধনী থেকে দরিদ্রে ক্যাশ পৌঁছে দেবার এইন কঠিন কাজটি করার জন্য ইহুদি সমাজে যে বরেণ্য মনুষ্য কুল আবির্ভূত হলেন তাঁদের আমরা জেনেছি শ্নরার বা উপযাচক নামে।
শ্নরেন একটি পুরনো জার্মান ক্রিয়াপদ যার সামগ্রিক অর্থ আপনার হৃদয়ে যুগপৎ দয়া, করুণা, দুঃখ উৎপাদন করে আপনার কাছ থেকে কিছু অর্থ তৈল তণ্ডুল লবণ সংগ্রহ করা।
শ্নরেন থেকে এসেছে ইদিশ শব্দ শ্নরার। তদ্ভব!
শ্নরারকে আপনি ভিখিরি বলে খামখা বেইজ্জতি করতে পারেন না। শ্নরার রাস্তার ভিখিরি নন । তাঁর কোন বৃত্তি আছে,। হয় ছোট খাটো দোকান চালান নয় পরের বাড়িতে মজুর খাটেন। সব সময় অর্থের টানাটানিতে ভোগেন। অনেকগুলো ছেলে মেয়ে নিয়ে সংসার কাটে কষ্টে সৃষ্টে। অশিক্ষিত নন, কিঞ্চিৎ লেখাপড়া জানা আছে। ইদিশ তাঁর ভাষা। হিব্রুতে দু চারটে বাক্যি বলে চাষা ভুষোর সম্ভ্রম কুড়োন। বাইবেলের প্রথম পাঁচটি বই বা তোরা এবং তালমুদ সম্বন্ধে তিনি কানে শুনে ওয়াকিবহাল। জুতসই জায়গায় জেনেসিস, একসোডাস বা দশ আদেশ থেকে দু লাইন ছাড়তে পারেন। হিব্রু বাইবেলের গল্পকে আজকের সমাজের পরিপ্রেক্ষিতে পেশ করতেও সক্ষম তিনি।
শ্নরার খুব ভালো মতন জানেন জেদেকাহ বা দান করে পুণ্য অর্জন করাটা ধনীর অভীষ্ট। তিনি পথে নামেন সেই অমৃত সুলভ দানের বারিধারার সন্ধানে। সেটা তাঁর বিজনেস মডেল।
শ্নরার নিয়মিত সিনাগগে হাজিরা দিয়ে উপস্থিত জনতাকে খুঁটিয়ে দেখেন - কোন মানুষের কাছে কি পাওয়ার সম্ভাবনা থাকতে পারে সেটি অনুধাবন করে তৈরি হয় তাঁর নিজস্ব টার্গেট মার্কেট। রাবির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে পাঁচটা পরামর্শ পান। ইহুদি সমাজে রাবি কেন্দ্রীয় দস্তাবেজ দফতর বা মহাফেজখানা। যে কোন বিষয়ে মতামত, কারো চরিত্রের সার্টিফিকেট তাঁর কাছে প্রাপ্তব্য। রাবিকে শ্নরার সরবরাহ করেন বাজারি গুজব (যাকে আমরা আমাদের ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্কিং ব্যবসায় মার্কেট ফিডব্যাক বলি)। রাবি সামাজিক বিবেকের দর্পণ। তাই রাবির নেক নজরে থাকা এবং তাঁর সার্টিফিকেট পাওয়াটা শ্নরারের কর্তব্য।
শ্নরার হাজির জবাব। তার ব্যঙ্গ, কৌতুক এবং রসবোধ উচ্চ মার্গের। ব্যারন রোটশিল্ড বা ব্যাঙ্কার ফুরসটেনবেরগের উলটো দিকে চেয়ার টেনে বসে শ্নরার বাজারের হাল হকিকত, পাড়ার কেচ্ছা বা ধার্মিক তত্ত্বের ওপরে দুটো মন্তব্য হাওয়ায় ভাসিয়ে দেবার দক্ষতা রাখেন। পোশাক আষাক সস্তার কিন্তু পরিষ্কার। আচরণ ও শব্দ চয়ন ভব্য। ধনীর দুয়োরে দুয়োরে ঘুরে সমবেদনা এবং তার সঙ্গে লবণ ও অর্থ সংগ্রহ করেন। সেটির পরিমাণ সঙ্গত বা মনোমত না হলে ধনীকে আবার বাক্যবাণে বিদ্ধ করতে ছাড়েন না।
আয়ের এক দশমাংশ সমাজের অভাবি মানুষকে দান করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বাইবেলে- নির্দ্বিধায় সে কথা তিনি ধনী ইহুদিকে মনে করিয়ে দেন।
দরিদ্র জন সাধারণকে সাহায্য করে ঈশ্বরের আজ্ঞা পালন করা সেই ধনবানের কর্তব্য। শ্নরার নিমিত্ত মাত্র – তিনি ধনী ব্যক্তিকে তাঁর ঐশ্বর্যের সম্ভার বণ্টনের সুযোগ করে দিয়ে কৃতার্থ করছেন। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তাঁকে বুঝিয়ে দেন যে প্রভূত অর্থ সঞ্চয় করার পরে তার যথা যোগ্য অংশ শ্নরারের হাতে তুলে দিলে তবেই সেই ধনবান প্রভুর অপার করুণা অর্জন করতে সক্ষম হবেন।
দরিদ্রের প্রয়োজন অর্থের, ধনীর প্রয়োজন জুতসই দানের। সেই সেতু বন্ধনের পবিত্র দায়িত্ব যার হাতে তিনিই শ্নরার যাকে আমরা উপযাচক বলতে পারি।
ধনী ও দরিদ্র এই দুজনকে যে দুজনের দরকার তার একটা চমৎকার ছবি পাই ইদিশ ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক শলেম আলাইখেমের (আসল নাম সলোমন রাবিনোভিতস) বর্ণনায়। কাসরিলেভকা নামক একটি পোলিশ গ্রামকে তিনি অমর করে গেছেন। এই নামে কোন গ্রাম সত্যি ছিল কিনা জানা যায় না। তবে এটি সেই সময়ের ষ্টেটেলের ইহুদি জীবনের কঠোর দারিদ্র্য আর সংগ্রামের প্রতীক।
লেমবেরগের (ইউক্রেন) ইহুদি সম্প্রদায় রীতিমত স্বচ্ছল হয়ে উঠেছে। সবারই কাজ কর্ম, ব্যবসার অবস্থা বেশ ভালো - জারের পুলিশ উৎপাত করে না অবধি। কারো কোন অভাব নেই।
একদিন শনিবারের সমাবেশে রাবি জানালেন সিনাগগের তহবিলে টাকা জমা পড়ছে ভালো রকম। এই উদারতার জন্য সমবেত মানুষদের ধন্যবাদ দিলেন। কিন্তু জেদেকাহ বা ন্যায় পালনের ক্ষেত্রে একটি সমস্যা দেখা দিয়েছে। দান আসছে বর্ষার ধারা মতো কিন্তু সেটি দেওয়া হবে কাকে। গ্রহীতা নেই। সবাই সুখে স্বছন্দে আছে। গরিব মানুষ খুঁজতে যে বেরুতে হয় লন্ঠন হাতে! প্রভুর ইচ্ছা কি ভাবে পূরণ হবে?
এক গুণী বললেন তিনি শুনেছেন শখানেক মাইল দূরে কাসরিলেভকা নামের একটি গ্রামে কেবল হাড় হাভাতে দরিদ্র ইহুদির বাস। আমরা কি তাদের সাহায্য পাঠাতে পারি? রাবি বললেন তারচেয়ে ভালো হয় যদি আমরা লোক পাঠিয়ে সেখান থেকে বরং কাউকে লেমবেরগে নিয়ে আসি। সে আমাদের মধ্যে বাস করে, নিয়মিত দান গ্রহণ করে আমাদের পুণ্য অর্জনের সুযোগ দিক। সিনাগগের বাকসোয় যে দান জমা পড়বে সবটাই তার প্রাপ্য হবে।
পাঁচটি ছেলে মেয়ে বউ নিয়ে সপরিবারে ব্লুম এসে বাসা বাঁধল লেমবেরগ শহরে ইহুদি সমাজের একমাত্র দান গ্রহীতা রূপে।
সে দিব্যি থাকে, খায় দায়। ছেলে মেয়েরা মিদ্রাশে পড়া শোনা করে, হিব্রু শেখে। ব্লুমের বউকে প্রায়ই কেনা কাটা করতে দেখা যায় লেমবেরগের বাজারে দোকানে। ব্লুম তাস খেলে দিনে দুপুরে। কুটোটি কাটে না। অথচ ব্লুমের দাবি দাওয়া ক্রমশ বাড়তে থাকে। একদিন সে জানালে সিনাগগের সাপ্তাহিক দানে তার পোষাচ্ছে না। ব্লুম তার মার্কেট ভ্যালু বুঝে গেছে। সে জানে লেমবেরগের গোটা ইহুদি সমাজের পুণ্য অর্জনের চাবি তার হাতে।
রাবি পড়লেন সমস্যায়। ব্লুমের দাবি চক্র বৃদ্ধি হারে বাড়তে থাকলে সিনাগগের সাপ্তাহিক চাঁদাতে কুলোবে না। অনেক চিন্তা ভাবনা করে একদিন রাবি এক সমাবেশ ডাকলেন (হিব্রুতে মিনিয়ান – অন্তত দশ জন হাজির হলে তবেই মিটিং শুরু করা যায়)। সেখানে ব্লুমকে তার দাবি গুলো কমাবার অনুরোধ জানানো হল। মিনিয়ানের বক্তব্য শুনে ব্লুম যে উত্তর দিলো সেটি এই রকম:
শেষ গল্পটা মারাত্মক।
শ্রী ব
ঠিক তাই। বাহিরে যার হাসির ছটা ভিতরে তার চোখের জল ।
প্রতিটা পর্বে ই নতুন নতুন বিষয় জানা যাচ্ছে। সঙ্গে মজাদার রসিকতা। এবারে ও তার ব্যতিক্রম নেই। রুবিনের বাজনা ,বা , গেলেস ও ডাক্তারের গল্পোটি বেশ সরস, হাস্যরসাত্মক। ময়শের কথা সার্কাসের ক্লাউন, রাজাদের বিদুষক বা ভাঁড়েদের কথা মনে করিয়ে দেয়।
দারুণ লাগলো
দুর্দান্ত সিরিজ হচ্ছে এটা।
এi সিরিজের লেখাগুলি পড়ার জন্য অপেক্ষায় থাকি।
খুব ভালো লেগেছে . ইহুদি সমাজ সম্পর্কে অনেক জানা হলো .