পাইক পাড়ার বাড়িতে কারো বিশেষ অসুস্থতার হবার খবর দেওয়া হলে রানি ফরমাশি থেকে ডাক্তার রমেশ বাবু টানা রিকশ চড়ে আমাদের বাড়ি এসেছেন। তিনি পুরনো আমলের এলো এম এফ পাশ ( লাইসেনসিয়েট অফ মেডিকাল ফ্যাকালটি ) যাকে আজকের হিসেবে ডাক্তার বলেই মান্য করা হয় না। তিনি ছিলেন আমাদের গৃহ চিকিৎসক, বদ্যি, ধন্বন্তরি। দু রকমের ওষুধ দিতেন – দুটি মিক্সচার । সর্দি কাশিতে লাল রঙ্গের , পেটের অসুখে সবুজ রঙ্গের। কম্পাউন্ডার বিমলদা সেই মিক্সচারের শিশির গায়ে ছোট ছোট চৌকোনা লেবেল এঁটে বলে দিতেন - দিনে তিন বার!
তারপরে এলাম জার্মানি। সেখানে বাড়িতে ডাক্তার আসেন না। হালত যাই হোক না কেন, রোগীকে ট্রামে বাসে ট্যাক্সিতে গাড়িতে চড়ে ডাক্তার খানায় গিয়ে প্রতীক্ষালয়ে বসতে হয়। শনি রবিবারে ডাক্তার অমিল। তাঁর দপ্তরের ঝাঁপ বন্ধ।অগতির গতি নিকটবর্তী হাসপাতাল। খাতায় নাম লিখিয়ে অপেক্ষা। অবস্থা সঙ্গিন হলে অবশ্য লাল আলো এবং ভেঁপু বাজিয়ে অ্যাম্বুলেন্স আসে বাড়িতে। সরকারের খরচায়।
আটের দশকে জার্মানি থেকে ইংল্যান্ডে এসে আশ্বস্ত হলাম- রুগী দেখতে বাড়িতে ডাক্তার আসেন। মনে হল যেন পাইক পাড়ায় ফিরে গেছি। তবে এই সর্দি কাশি, গাটা কেমন যেন ম্যাজ ম্যাজ করছে অথবা গলা খুস খুস করছে এ সংবাদে নয় । ফোনে অবস্থা জেনে, ব্যাপারটার গুরুত্ব বিবেচনা করে তবেই ডাক্তার আসেন। গল্প গুজব করেন– বেড সাইড ম্যানার প্রতিপন্ন করেন! প্রেসক্রিপশন লেখেন। মহারানির সরকার সেটির খরচ খরচা দেন, আমারই করের পয়সায়।
এদেশের সকল নাগরিক জাতীয় স্বাস্থ্য সেবা ( ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস ) প্রকল্প দ্বারা সুরক্ষিত। চিকিৎসা খাতে নাগরিকের ব্যয় নেই। ওষুধ এককালে সবার জন্য ফিরিতে পাওয়া যেতো এখন একটা বয়েসের পরে। এদেশে এলেই স্থানীয় ডাক্তারখানায় নাম পাতা লেখাতে হয়। পাঁচ জন ডাক্তার মিলে যেখানে বসেন তার চলতি নাম প্র্যাকটিস। যখনই সেখানে নাম লেখাবেন, সেই জনা পাঁচেকের একজন আপনাকে দেখবার দায়িত্ব নেবেন। তিনি আপনার জি পি- জেনারাল প্রাকটিশনার। কেউ ছুটিতে গেলে সাময়িক ভাবে অন্য কেউ তার কাজ করেন। তাঁকে বলে লোকুম। কেন যে বলে জানি না। আমাদের জি পি মাইকেল হ্যারিস, লিথুয়ানিয়ার ইহুদি। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের আগে তাঁরা ইংল্যান্ডে এসেছেন। আমি এই লেখার চতুর্থ পর্বে ( নামাবলি) ইহুদি নাম করনের যে থিওরিটি ছেড়েছি , সেটি ইংল্যান্ডে তেমন প্রযোজ্য নয়। এ দেশের ইহুদিরা ফিঙ্কেলস্টাইন বা হালবগেওয়াকস নামে পরিচিত হতে চাননি। তাঁরা স্মিথ হ্যারিস বা রিচারডস পদবি নিয়েছেন। যেমন আমাদের মাইকেল হ্যারিস। ইন্দ্রনীলের স্কুলের বন্ধুর বাবা ডক্টর স্মিথ।
সাদা সাপটা মুখে হাসির গল্প করার একটা অনবদ্য ক্ষমতা ছিল ডাক্তার হ্যারিসের। যাকে ইংরেজিতে বলে উইথ এ স্ট্রেট ফেস। নিজে না হেসে আপনাকে লুটোপুটি খাইয়ে দিতে পারতেন। আমাদের জার্মান ওয়াইনের গুণগ্রাহী ছিলেন। অবশ্য প্রত্যেকবার বলেছেন আঃ, ওটার কোন প্রয়োজন ছিল না।
হাতে পায়ে গায়ে যে কোন ব্যথার জন্য ভল তারোল এবং অন্য যন্ত্রণার জন্য প্যারাসিটামল বরাদ্দ ছিল- সেই রমেশ বাবুর লাল সবুজ মিক্সচারের মত। একই গতে বাঁধা।
চাকরির দায়ে আমি সে সময়ে বিভিন্ন দেশের বায়ু কলুষিত করে নিত্য হাওয়াই জাহাজ চড়ি। সেটি তিনি নিতান্ত অপছন্দ করতেন। স্বাস্থ্যের পক্ষে নাকি হানি কারক। একদিন বুঝিয়ে বললেন: প্লেনের ভেতরে একটা বদ্ধ হাওয়া কেবল ঘুরপাক খায়। তার পরিমাণ একই থেকে যায়। তাজা হাওয়া যোগ হয় না। ফলে লন্ডন থেকে সিঙ্গাপুরের এগারো ঘণ্টার ফ্লাইটে আমি নিশ্বাস নিচ্ছি যে হাওয়াতে সেটি বারে বারে ঘুরে ফিরে আসছে। তাতে যারা প্রশ্বাস ছাড়ছেন তাঁদের কার যে কি রোগ আছে আমার জানার কথা নয় কিন্তু নাকের ভেতর দিয়ে সেটি মরমে পশিয়ে যায়! সংক্রমণের আড়ত।
আমার দুনিয়া ঘোরা পেশার খাতিরে।সেটিকে মুলতুবি রাখা যায় না। তবে ডাক্তার হ্যারিসের সতর্কবাণী মনে রেখেছি। আর মনে রেখেছি কিছু গল্প গাছা !