ভাষা পরিচয়
প্রায় এক দশকের জার্মান প্রবাস কালে ইহুদি রঙ্গ রসিকতার সঙ্গে আমার পরিচিতি ছিল ক্ষীণ। সেটা ওই দক্ষিণের ব্যাভেরিয়া বা উত্তরের ফ্রিসল্যান্ডের অধিবাসীদের নিয়ে চালু রসিকতার চেয়ে অন্য রকম কিছু ছিল না। কিছু মজার গল্প, স্থানীয় রঙ মেশানো। কিছুটা ভাঁড়ামো। আকাশে বিদ্যুৎ চমকালে ফ্রিসল্যান্ডের মানুষ হাসে কেন? তারা মনে করে তাদের ছবি তোলা হচ্ছে। ব্যাভেরিয়ানদের আলাদা জাতি বলে মনে করে বাকি দেশটা। ব্যাভেরিয়ানরা সেই বাকি দেশকে প্রাশিয়া বলে অভিহিত করে নানান ভাষায় গালমন্দ করে। মিউনিকের আলিয়ান্তস ষ্টেডিয়ামে বায়ার্ন –মিউনিক বনাম হামবুর্গের খেলা দেখার সৌভাগ্য হয়েছে এককালে। ব্যাভেরিয়া বনাম প্রাশিয়া। দু পক্ষের শব্দ চয়ন ও তার বিন্যাস স্মরণীয় হয়ে আছে ।
আমার জার্মানির দিনগুলিতে ইহুদি রসিকতা শুনেছি। তার সবটাই জার্মান ভাষায়। ইদিশ নামক একটা ভাষা আছে বলে শুনেছিলাম। তার সঙ্গে জার্মান ভাষার নিকটতম আত্মীয়তা যে স্থাপিত হয়েছে এক হাজার বছর আগে, সে তথ্য আমার সম্পূর্ণ অজানা ছিল। লন্ডনের ইহুদি পাড়ায় বাসা বাঁধার পরেও নয়।
১৯৮৫ সালে আমি লন্ডনে এসেছি। সিটি ব্যাঙ্কে কাজ করি। একদিন পূর্ব লন্ডনে গেছি খদ্দেরের খোঁজে। হাতে অনেকটা সময়। ট্যাক্সি নয় টিউব ধরে স্ত্রান্দে আমাদের অফিসে ফিরব। হোয়াইট চ্যাপেলে কমার্শিয়াল রোড ধরে হাঁটছি, পুরনো লন্ডন ডকের কাছাকাছি । দেড়শ দুশ বছর আগে এই জলপথে মানুষ লন্ডন আসতেন। হিথরো তখন অনেক দূরের কল্পনায়। রাইট ভ্রাতৃদ্বয় সবে হাওয়ায় প্লেনের মডেল ওড়াচ্ছেন।
ডক এলাকায় অভ্যাগত বিদেশির প্রথম পদার্পণ। অল্প পয়সায় ছোট ঘরে মাথা গোঁজা, নতুন জীবন যাত্রার চেষ্টা শুরু। এখান থেকেই অভিবাসনকারীরা ক্রমশ ছড়িয়ে পড়েছেন সারা দেশে। নিউ ইয়র্কের এলিস আইল্যান্ড এর সমতুল্য। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে লন্ডন ব্লিতসের (১৯৪০) সময়ে ডকল্যান্ড সম্যক বিধ্বস্ত হয়। তার মেরামতি বা পুনর্নির্মাণ হয়েছে মাত্র বছর চল্লিশেক আগে, সেটি জলের সীমানা ঘেঁষে। আশেপাশের পথে কিছু লাল ইটের বাড়ি বেঁচে গেছে, সংখ্যায় খুবই কম।সেগুলোকে হয়ত কালজয়ী আখ্যা দেওয়া যায় ।
অজস্র দোকান। বেশির ভাগ জামা কাপড়, সংসারের প্রয়োজনের জিনিসের। গত কয়েক দশকে অনেক মানুষ এসেছেন বাংলাদেশ থেকে, পূর্ব লন্ডন তাঁদের প্রথম ঠিকানা - যেমন ছিল এককালে ইহুদিদের। নানান সাইনবোর্ডে বাংলায় দোকানের নাম লেখা। একটা উঁচু লাল ইটের বাড়ি বাঁ দিকে চোখ পড়ল। তার মাথাটা ত্রিকোণাকৃতি, যাকে গেবল বলে। যুদ্ধে বিজিত হয়নি। তবে বহু বছরের অবহেলায় অযত্নে বিবর্ণ! তার দেওয়ালে, উঁচুর দিকে যেন ইটে কালো রঙে লেখা আছে জুইশ থিয়েটার। সে নাট্যশালা হয়ত বহুদিন যাবৎ বন্ধ । রাস্তার লেভেলে তিনটে আর্চ – এককালে হয়ত টিকিট ঘর ছিল। এখন সেগুলোকে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে যাতে ভারসাম্য হারিয়ে বাড়িটি ভেঙে না পড়ে। এই সব রাস্তায় বাড়ি জমির দাম কম। এখনো কোন ডেভেলপারের আগ্রহ সঞ্চার করেনি বলে একশ বছরের স্মৃতি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কারো অপেক্ষায় ।
হাতে সময় আর মনের ভেতরে অপ্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করার দুর্মদ অভিলাষ। আরেকটু কাছে গেলাম। মাঝের আর্চটির দু পাশে কিছু লেখা আছে। ডান দিকে সম্ভবত হিব্রু (কেন না সেটি দুর্বোধ্য!) বাঁ দিকে রোমান অক্ষরে কয়েকটা শব্দ। সেটা ইংরেজি নয়, মনে হল জার্মান। পড়বার চেষ্টা করলাম। কথাগুলো পড়তে পারি। চেনা মনে হয় কিন্তু অর্থ উদ্ধার করা গেল না। কৌতূহল বাড়ল। কিছুটা বুঝি পুরোটা নয়। এ কোন ভাষা? সে আমলে ফোন ক্যামেরা ছিল না যে ছবি তুলে রাখব। পথ চলতি জনতাকে জিগ্যেস করার কোন মানে হয় না। অলডগেট স্টেশন এসে টিউব পাওয়া গেল। সদ্য আহরিত শব্দ গুলো আমার ব্যাংকের নোটবইতে যতটুকু মনে পড়ল লিখে রাখলাম।
জার্মানি ছেড়ে ইস্তক মনে হত ভাষার সঙ্গে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হচ্ছে। সে আমলে লন্ডনের স্যাটেলাইটে জার্মান টেলিভিশন পাওয়া যেত না। অফিস থেকে জার্মান সরকারের লাইব্রেরীতে গেছি, কেনসিংটনে। সেখানে পত্র পত্রিকা মেলে, বসে পড়ার জন্য। তারপর একদিন আবিষ্কার করলাম আমাদের গোলডারস গ্রিনের বাড়ির কাছেই বারনেট কাউন্সিলের লাইব্রেরি, সেখানে জার্মান বই রাখে। এখানেই আমি মূল ভাষায় হেসে, কাফকা ইত্যাদি পড়েছি।
একজন বয়স্ক অধ্যক্ষ ছিলেন। আমার নির্বাচিত বইগুলি কাউন্টারে রেখে যখন ছাপ মারছেন কোনও কর্মী, তিনি পাশ থেকে আমার নানান বিচিত্র বিষয়ে বই নেওয়ার ব্যাপারটা সকৌতুকে লক্ষ্য করতেন। একদিন একসঙ্গে ছটি বই নিচ্ছি দেখে বললেন আপনি কি কাজ থেকে অবসর নিয়েছেন?(তখন আমার বয়েস ৩৬) । এত বই পড়বার সময় কোথা থেকে পান?
ব্যস্ত নেই দেখে তাঁকে একদিন ধরলাম।
“একটা কথা জিগ্যেস করতে পারি? আপনি কি এই ভাষাটা চেনেন?” এই বলে আমার হাতের প্রায় অপাঠ্য হরফে লেখা একটি কাগজ তাঁর দিকে বাড়িয়ে দিলাম। সেখানে লেখা আছে “গুট টাক ইম বেটাগে”।
চশমার ফাঁক দিয়ে চোখ তুলে আমার দিকে হাসিমুখে তাকালেন ।
“কোথায় পেলেন”
ঘটনাটা বললাম।
“ওটা এককালে ইহুদি থিয়েটার ছিল। সে তো পঞ্চাশ বছর আগে বন্ধ হয়ে গেছে।”
“সেটা অনুমান করতে পারি! তবে কী, এই শব্দগুলো একটু চেনা মনে হচ্ছে, কিন্তু মাথায় ঠিক ঢুকছে না। তাই আপনাকে জিগ্যেস করছি।”
“কোন ভাষার সঙ্গে মিল খুঁজে পাচ্ছেন? জার্মান?” আমি নিয়মিত জার্মান বই নিতাম । কাজেই তিনি সে সম্পর্কে অবহিত ছিলেন।
“আজ্ঞে হ্যাঁ। ডাচ সুইডিশ ডেনিশ নরওয়েজিয়ানের সঙ্গে জার্মান মেলে। কিন্তু এই শব্দগুলো তাদের সঙ্গেও ঠিক মিলছে না।খটকায় পড়ে গেলাম”।
লাইব্রেরিয়ান পাশের আর একজনকে ডাকলেন কাউন্টার সামলানোর জন্য।
“আসুন আমার সঙ্গে”।
নিয়ে গেলেন একটি অফিস ঘরে। চারিদিকে স্তূপাকৃতি বই। নাম নম্বর দিয়ে ক্যাটালগে গ্রন্থিত হবার অপেক্ষায় আছে। একটা মাত্র জানলা। তার পাশে একটা ছোট্ট টেবিল আর দুটো চেয়ার। বাইরে একটা ম্যাগনোলিয়া গাছ। ফুলে ভরে আছে। বসন্ত জাগ্রত গোলডারস গ্রিনে।
১৮ শতকের শেষ পর্বে নাপলেওঁ মিশর অভিযানে আসেন শুধু সেনাবাহিনী নিয়ে নয় । সঙ্গে আনেন ১৬৭ জন বৈজ্ঞানিক ভাষাবিদ গণিতজ্ঞ । ইংরেজ হাওয়ারড কারটার মহা নিদ্রায় নিদ্রিত ফারাওদের সমাধি লুণ্ঠন করেছিলেন। নাপলেওঁ দু বছরের ভেতরে সে সময়কার মিশরের সঙ্গে বাকি পৃথিবীর পরিচয় করান। কিন্তু মুশকিল হল ভাষাটা নিয়ে । হায়ারোগ্লিফিক কোন পরিচিত ভাষার সঙ্গে মেলে না। ওই আঁকি বুকি কাটা অক্ষর কি অচেনা থেকে যাবে মানুষের কাছে? যেমন থেকেছে মোহানজোদরো?
১৭৯৯ সালের ১৯ জুলাই মিশরের রাশিদ গ্রামে পিয়ের বুশা নামক এক ফরাসি মাটিতে পোঁতা একটি শিলালিপি উদ্ধার করেন। এমনধারা পাথরের ছড়াছড়ি মিশরে। কিন্তু পিয়ের লক্ষ করলেন এখানে পাশা পাশি তিন স্তরে কোন ভাষ্য লিখিত হয়েছে। হয়ত তিনটে আলাদা ভাষায়। তার একটি গ্রিক। হঠাৎ আলোর ঝলকানি। তবু সময় লাগে। দুই দশক বাদে জন ফ্রানসোয়া শামপিলিওঁ হায়ারোগ্লিফিকে লুকনো মিশর রহস্যের সমাধান করলেন। ১৮২১। নাপলেওঁ তখন সেন্ট হেলেনায় বন্দি। তিনি কি সে খবর পেয়েছিলেন?
প্রায় তিরিশ বছর আগে গোলডারস গ্রিন লাইব্রেরিতে রবিবার সকালে এক সহৃদয় ইহুদি লাইব্রেরিয়ান আমার কাছে মিশরের সেই রোসেটা শিলালিপির মত আরেকটা ভাষার জানলা খুলে দিলেন। পরিচয় করিয়ে দিলেন যার সঙ্গে তার নাম ইদিশ। জার্মানের নিকটতম আত্মীয়। শুধু একটাই অসুবিধে। এটি লেখা হয় হিব্রু লিপিতে, ডান দিক থেকে বাঁ দিকে। তবে তিনি (আজ আর নাম মনে নেই বলে দুঃখিত) বললেন “যে লেখাটা আপনি দেখেছেন তার অর্থ ‘দিন হোক মঙ্গলময়’। এটি একটি বাক্যের অংশ। পুরো কথাটা হল যিনি এই প্রার্থনার বইটি সিনাগগে নিয়ে আসবেন তাঁর দিনটি হোক মঙ্গলময়। ১৩ শতকের একটি হিব্রু প্রার্থনা বইতে প্রথম পাওয়া যায়। আপনি এখানে চিনেছেন প্রথম দুটো শব্দ গুট টাক। আপনার মনে হয়েছে চেনা শব্দ, এটা জার্মান। গুট টাক পড়ে ভেবেছেন হওয়া উচিত ছিল গুটেন টাগ!”
আমি বললাম “তাহলে ওই থিয়েটারের ডান দিকের আর্চে হিব্রু হরফে একই কথা লেখা ছিল?”
লাইব্রেরিয়ান বললেন, “ঠিক তাই। এক পাশে হিব্রুতে, অন্য দিকে রোমান অক্ষরে। ভাষাটা ইদিশ।” হতাশ হয়ে বললাম “এ বয়সে আমার আর হিব্রু অক্ষর পরিচয় করা হয়ে উঠবে না! সেখানেই আটকে যাব!”
“ইদিশ হিব্রু হরফে লেখা হয়। সেটা আপনার পক্ষে বিষম বাধা। তবে আপনি রোমান হরফেও অনেক কিছু পড়ার বস্তু পাবেন। জার্মান যখন জানেন, মাঝে সাঝে আটকালেও পার পেয়ে যাবেন। আর একটা কথা । আমাদের এই লাইব্রেরিতে ইদিশ শেখার ক্যাসেট আছে। সেটা কানে শোনার ব্যাপার। নিয়ে যান। চোখ বন্ধ করে শুনুন! ইদিশে গল্প গুজব! সেখানে আপনি হিব্রু হরফের ধন্দে পড়বেন না। সত্তর শতাংশ শব্দ আপনার যে চেনা! তবে আপনার মনে হবে নিতান্ত অশিক্ষিত লোকের মুখে জার্মান শুনছেন”।
অনেক ধন্যবাদ দিয়ে বিদায় নেবার জন্য যখন উঠে দাঁড়ালাম, আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “ইদিশ ভাষাভাষীর সংখ্যা পৃথিবীতে কম। এই গোলডারস গ্রিনের পথে ঘাটে কিছু বয়স্কদের মুখে শুনবেন, কান খাড়া করে রাখলে। সবচেয়ে বেশি ইদিশ শোনা যায় ইসরায়েলে নয়, নিউ ইয়র্কের ব্রুকলিনে। পরিচয় যখন হল আশা করি ইদিশ ভাষাটার চর্চা করবেন! আমি নিজে ইহুদি বলে বলছি না। মন দেবেন ইহুদি রসিকতাতে। প্রায় সমস্ত ইদিশ রসিকতা জার্মানে পড়তে পারবেন। ইংরেজিতেও। তবে জার্মানে সেটা বেশি খোলে, এ দুটো ভাষার গভীর আত্মীয়তার কারণে।গভীর সমুদ্রে নিমজ্জিত হবেন। এর থেকে মুক্তি নেই !”
খুব ভালো লাগলো I
সমৃদ্ধ হলাম l জানতে পারলাম যুগে ভাষার বিবর্তন কি ভাবে ঘটে চলেছে l
অসাধারণ। তথ্য পরিপূর্ণ লেখা; গল্পের ছলে পরিবেশনার গুণে এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলা যায়।সমৃদ্ধ হলাম তো বটেই, সাহিত্য পাঠের নির্ভেজাল আনন্দও পেলাম।
অসাধারণ। তথ্য পরিপূর্ণ লেখা; গল্পের ছলে পরিবেশনার গুণে এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলা যায়।সমৃদ্ধ হলাম তো বটেই, সাহিত্য পাঠের নির্ভেজাল আনন্দও পেলাম।