ছবি - র২হ
পূর্ব ইউরোপে
বাঙ্কা ট্রানসিলভানিয়া থেকে যিনি দেখা করতে এলেন তাঁর নাম ডান (ডানিয়েল) কমেস্কু।
সে ব্যাঙ্কের সদর দফতর রোমানিয়ার পশ্চিমে, ক্লুজ নাপোকা শহরে। ইউরোপের আর কোন শহরের জোড়া নাম এভাবে একসঙ্গে উচ্চারিত হয় বলে জানা নেই। সম্রাট হাদ্রিয়ানের স্মৃতি বিজড়িত দু হাজার বছরের পুরনো এই রোমান জনপদের আদি নাম ছিল নাপোকা। তারপর দীর্ঘদিন দক্ষিণ জার্মানির স্যাক্সনরা বসবাস করেছে। অতি অল্প সংখ্যক এখনো করেন। দেশের বর্তমান প্রেসিডেন্ট জার্মান বংশোদ্ভূত - ক্লাউস ইওয়ানিস। এ শহরের জার্মান নাম ক্লাউসেনবুরগ (কোন ক্লাউসের দুর্গ)। হাঙ্গেরির অধিকারে ছিল বহু বছর। তারা একে বলে কলসভার। সেটা ওই জার্মান নামেরই অনুবাদ। হাঙ্গেরিয়ানে ভার মানে দুর্গ। রোমানিয়ান নাম ক্লুজ। অধিকন্তু ন দোষায় বিধে তার সঙ্গে রোমান নামটা জুড়ে দিয়ে আমাদের কৌতূহল ও টুরিস্টের আগ্রহ বাড়ায়।
শক হুন দল পাঠান মোগল ইংরেজ তাদের ভাষার ও শব্দের সম্ভার যোগ করেছে আমাদের সংস্কৃতিতে। বাক্যবন্ধে ইংরেজির প্রকোপ তো উঠতে বসতে। দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে এই মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হয়ে দৈনন্দিন জীবনে আপন করে নিয়েছি অজস্র শব্দ। আমরা মনে রাখি না বিমা বা চশমা ফারসি শব্দ; আদালত, হিসাব তুরকি; ইশারা, আজব আরবি; জানলা, আলমারি পর্তুগিজ; আরবির হাত ধরে এসেছে হিব্রু আব্বা, মোকাম। বাংলা মহানন্দে গুলতানি করছে, সুর বাঁধছে তাদের সকলকে নিয়ে।
আমার বউকে বলি দেশ দখল করার পরে রোমান রাজারা কেড়ে নিয়েছে তোমাদের মুখের ভাষা, দিয়েছে ভালগার ল্যাটিন! সারা পূর্ব ইউরোপে রোমানিয়ান একমাত্র ভাষা যার শেকড়টি গাঁথা আছে ল্যাটিনে (ফল স্বরূপ ইতালিয়ান ফরাসি পর্তুগিজ স্প্যানিশের সঙ্গে তারা আত্মীয়তা অনুভব করে, প্রতিবেশীদের স্লাভিক ভাষার সঙ্গে নয়। আমাদের পরিবারের লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা ইংরেজি কিন্তু আমাদের মেয়ে মায়া স্প্যানিশ শেখে অনায়াসে, রোদিকা ইংরেজির চেয়ে ফরাসিতে বেশি স্বচ্ছন্দ, আমি যেমন বাংলায়)। তোমাদের দেশের নামটা অবধি পুরনো প্রভুদের নামে- রোম থেকে রোমানিয়া! আর কোন উপনিবেশে রোমানরা এমন পোক্ত ছাপ রেখে যায় নি! আর বিগত সাতশো বছরে জার্মানরা তোমাদের দিয়ে গেছে সভ্যতা, শিল্প, স্থাপত্য। একটা আলাদা সংস্কৃতি।
ইউরোপ থেকে শুরু হয়ে যে পর্বত মালার শেষ হয় হিমালয়ে, সেই কারপেথিয়ানের কোল ঘেঁষে পুব থেকে পশ্চিমে একটি জনপদ গড়ে উঠেছে যার ল্যাটিন নাম ট্রানসিলভানিয়া। অর্থ পাহাড়ের অন্য দিকে। জার্মান নাম জিবেন বুরগেন (সাতটি দুর্গ) - আশীর্বাদের ভূমি। এখানে চলতে ফিরতে যে দেশটি দেখবেন তার ছবি মেলে জার্মানি, অস্ট্রিয়ার সঙ্গে, বাকি দেশটার সঙ্গে নয়। আজকের রোমানিয়ার একশোর বেশি শহর ও গ্রাম তাদের জার্মান নাম বাঁচিয়ে রেখেছে, যেমন ব্রাশভ। ড্রাকুলার ব্রান দুর্গ দেখতে হলে আপনি এই আদ্যোপান্ত জার্মান স্থাপত্যে মোড়া ব্রাশভ বা ক্রোনস্টাড পার হয়ে যাবেন। এখানকার প্রধান গিরজেয় রবিবারের প্রার্থনা হয় জার্মান রোমানিয়ান এবং হাঙ্গেরিয়ান ভাষায়। আজকের বারো বছরের কম বয়েসি বালক বালিকারা হোটেল ট্রানসিলভানিয়া নামের যে ডিজনি ছবিটি দেখে সেটি ব্রাশভের ওপর আধারিত।
এককালে আমেরিকা দেখেছে ওয়েস্টওয়ার্ড হো। ইউরোপ থেকে আসা মানুষ পূর্ব তটে নেমে চাষ ও বাসের জমির সন্ধানে ধাওয়া করেছে পশ্চিম পানে। অজস্র মানুষকে হত্যা ও একটি সভ্যতাকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে সেই অভিযান থেমেছিল একেবারে ক্যালিফোর্নিয়া গিয়ে। কারণ এর পরে সমুদ্র। এখন ইউরোপের হুঙ্কার হল - ইস্টওয়ার্ড হো। ভেঙ্গেছে দুয়ার, এসেছ জ্যোতির্ময়! মুনাফার হউক জয়। চলো পুব দিকে। যদিও পঞ্চাশ বছর আগে হিটলার দ্রাং নাখ ওস্টেন (পূবে এগিয়ে চলো ) আওয়াজ তুলে, চেক পোল্যান্ড দখল করে দুনিয়ার জন সমুদায়ের কাছে নিতান্ত অপ্রিয় হয়েছিলেন।এবারের অভিযানের অগ্রদূত ট্যাঙ্ক নয়, ব্যাঙ্ক।
পাঁচ বছর আগে বার্লিন দেওয়াল মিশে গেছে ধুলোয়। চেক পোল্যান্ড রাশিয়ার পরে সিটিব্যাঙ্কের শাখা খোলা হয়েছে বুখারেস্টের পিয়াতসা ভিকতোরিতে (বিজয় চত্বর )। আমাদের মতো ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্কাররা অবশ্য তার আগেই "ডলার ধার নেবে গো?” বলে সে দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দরোজায় কড়া নেড়েছি। তারপর শুরু হয় ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে বিশ্বের ব্যাঙ্কের দুয়ারে ধর্ণা। দুর্জনে নাম দিয়েছিল সুটকেস ব্যাংকার - যারা সুটকেসটি নিয়ে স্থানীয় হোটেলে ওঠে, খদ্দেরের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ পূর্বক আপন ডিল বা ডালটি সেদ্ধ করেই কেটে পড়ে। এক মাঘে শীত যায় না এ প্রবাদটি আমাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয় – আমাদের শীত বা গ্রীষ্ম ওই কয়েক সপ্তাহের মাত্র, যতদিন না ডিলটি সম্পন্ন হচ্ছে। শাখা খোলা হলে অবশ্য মুশকিল - ফি বা পারিশ্রমিক পকেটস্থ করে সিটি ব্যাঙ্ক দেশ থেকে কেটে পড়তে পারে না। তখন সেথায় নিত্য ওঠা বসা। খদ্দেরের খোঁজে জুতোর সুকতলা খোয়ানো। সেই তালিকার ওপরে থাকতো নব গঠিত বেসরকারি ব্যাঙ্ক এবং সরকারি মালিকানাধীন তেল, টেলিকম কোম্পানি।
যেমন বাঙ্কা ট্রানসিলভানিয়া।
এত বাখানিয়া বলছি কারণ আমরা তখন এই বাণিজ্য পদ্ধতি শুধু রোমানিয়া নয়, রাশিয়া থেকে পোল্যান্ড, লিথুয়ানিয়া থেকে ক্রোয়েশিয়া সর্বত্র প্রয়োগ করেছি।
ডান কমেস্কুর সঙ্গে আলাপ আলোচনার মুখ্য বিষয় ছিল বিদেশী মুদ্রা ব্যবসা এবং তাদের জন্য বিশ্বের বাজারে ঋণ সংগ্রহ করা। সে ব্যাঙ্কের ডলার অ্যাকাউনটটি সিটি ব্যাঙ্ক নিউ ইয়র্কের করতলগত করার বিপুল অভিপ্রায় তার মধ্যেই নিহিত। ডান ইংরেজি বলেন চমৎকার। আমরা রোমানিয়াতে তখন কচি এবং কাঁচা। স্থানীয় লোক জনের সঙ্গে কথা বার্তা বলে জানবার চেষ্টা করি আদতে কোথায় কি ঘটছে। সেই সব জ্ঞান যা ফাইনান্সিয়াল টাইমস বা ব্লুমবেরগে পাওয়া যায় না।
কমিউনিস্ট আমলে পূর্ব ইউরোপের সব দেশে ছিল কঠোর সরকারি মালিকানাধীন দুটি মাত্র ব্যাঙ্ক -একটি বৈদেশিক বাণিজ্যের জন্য, অন্যটি আম জনতার সুবিধার্থে আভ্যন্তরীণ ব্যাঙ্কিঙ্গের জন্য। সেখান থেকে পশ্চিমি কায়দায় ব্রাঞ্চ ব্যাঙ্কিঙ্গে উত্তরণ সহজ নয়। পশ্চিমের চোখে যেটা ডাল ভাত বা রুটি মাখনের মত জলবৎ তরলং, সেটা এইসব দেশে কোয়ান্টাম ফিজিক্সের মত কঠিন।
লন্ডনে অভ্যাগত বিদেশি ব্যাঙ্কারদের সঙ্গে আলাপন শেষ হলে একটি আপাত নিরীহ প্রশ্ন করতাম " আচ্ছা এবার কোথায় যাবেন? পরের মিটিং লন্ডনের কোন খানে?" এমন নিরিমিষ প্রশ্ন শুনলে আমাদের অতিথি ভাবতেন এইসব বিদেশি মানুষকে তাদের পরবর্তী ঠিকানায় সহি সালামত পৌঁছে দেবার দায়িত্ব নিজের ঘাড়ে তুলে নেবার জন্য আমি ভয়ানক উৎসুক। এর পিছনে নিহিত ছিল একটি একান্ত স্বার্থপর উদ্দেশ্য – জানতে চাই এবার তিনি কোন ব্যাঙ্কের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছেন। আমরা এক অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী। তাই শত্রু পক্ষকে চিনে রাখা দরকার।
ডান বললেন, "এটাই আমার শেষ মিটিং। এবার হিথরো। আজ বাড়ি যাব।। তেল আভিভ।"
জানলার বাইরে টেমস নদী, ঘোলা জলে ঢেউ। যেন কলকাতায় ষ্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার স্ট্র্যানড রোডের অফিসে ছ তলার জানলা দিয়ে গঙ্গা দেখছি। টাওয়ার অফ লন্ডনের আলো গুলো এক এক করে জ্বলে উঠছে অপর পাড়ে।
রোমানিয়ার ক্লুজ নাপোকার ব্যাঙ্কারের বাড়ি ইজরায়েলের তেল আভিভ?
ডান মৃদু হাসলেন।
" ভাবছেন বাড়ি যদি তেল আভিভে তাহলে ক্লুজ নাপোকায় কি করি? আমরা ইহুদি। বহু পুরুষে আমরা রোমানিয়ান। সেটা আমাদের দেশ। আমার বাবা কমিউনিস্ট পার্টিকে চাঁদা বা ঘুষ দিয়ে ইজরায়েলে যাবার অনুমতি আদায় করেন। সীমান্ত খুলে যাওয়ার পরে প্রথম যে দেশে ভাগ্যের অনুসন্ধান শুরু করি সেটা অবশ্যই রোমানিয়া। তেল আভিভ থেকে ক্লুজ তিন ঘণ্টার পথ। সংসার এখনো রামাত গান, তেল আভিভ। আপাতত আমি আসা যাওয়া করছি। মাসে দু বার ইজরায়েল যাই "।
আইনস্টাইন বা স্পিলবেরগের মত যে সব নামের জার্মান ভাষায় একটা অর্থ আছে সেটি নব্বুই শতাংশ ইহুদি নাম। কিন্তু এই শর্ট কাটটি রোমানিয়ায় খাটে না। মসেস্কু পেত্রেস্কু খাঁটি রোমানিয়ান পদবি। সেটি ইহুদিদেরও হতে পারে। হাঙ্গেরি ট্রানসিলভানিয়া রোমানিয়ার এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ইহুদিরা বাস করেছেন দ্বিতীয় শতাব্দী থেকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুতে জার্মানি ও রোমানিয়ার ইহুদি জনসংখ্যা প্রায় সমান।
যুদ্ধ শেষ হল ১৯৪৫ সালে। ইজরায়েলের প্রতিষ্ঠা ১৯৪৮। তার সংবিধানে দেওয়া হল দুনিয়ার সব ইহুদির ইজরায়েলে বসবাসের সমান অধিকার (হিব্রুতে আলিয়া বা ঘর ওয়াপসি)। পূর্ব ইউরোপ থেকে ইহুদিরা ইজরায়েল যেতে চাইলেন, আপন দেশে। একমাত্র পোল্যান্ড তাদের সে ইচ্ছায় কোন বাধা দেয় নি। যেতে চাইলে যান, কেবলমাত্র অস্থাবর সম্পত্তি ও পৈত্রিক প্রাণটি নিয়ে। যাবার সময়ে বাকি বিষয় টুকু মানে এই বাড়ি, গাড়ি, চাষের জমি, দোকান, কারখানা ইত্যাদি অপ্রয়োজনীয় বস্তুগুলি মহান সাম্যবাদী আন্দোলনের খাতায় দান করে যাবেন।
রাশিয়াতে তখন বাস করেন ছ লক্ষের বেশি ইহুদি। ইজরায়েল চাইল তাঁদেরও আপন দেশে ফেরাতে। সরকার জানালেন কোনো ইহুদি যদি স্বেচ্ছায় ইজরায়েলে যেতে চান, সোভিয়েত ইউনিয়ন সে আবেদন অবশ্যই সযত্নে বিবেচনা করবে। তবে তাদের ভরন পোষণ বাবদ যে ব্যয় সোভিয়েত ইউনিয়ন এযাবৎ বহন করেছে তার একটা অংশ বিদেশি মুদ্রায় দিলে এই নির্গমনের অনুমতি সহজলভ্য হতে পারে। কৃষক শ্রমিকের স্বর্গরাজ্য থেকে বিদায় নেওয়ার মাথা পিছু দক্ষিণা কি ভাবে নির্ণীত হত তা জানা শক্ত। সে তথ্য তো আর রাশিয়ার সরকারি মুখপত্র প্রাভদায় (আক্ষরিক অর্থে সত্য) ছাপা হত না। শোনা যায় গোয়েবলস রাশিয়ান খবরের কাগজের এই নাম শুনে অট্টহাস্য করেন। তিনি নিজে ফেক নিউজের কারখানা চালাতেন তবে তাকে " সত্য” বলে অভিহিত করার ধৃষ্টতা দেখান নি। তাঁর মুখপত্রের নাম ছিল জনতার পর্যবেক্ষক।
রাশিয়ার দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে পূর্ব ইউরোপের কিছু দেশ এই নতুন বিজনেস মডেলটি গ্রহণ করলেন।
ইহুদি বেচে অর্থাগম।
রাশিয়ান বিপ্লবে অনেক ইহুদি সক্রিয় অংশ নিয়েছিলেন। লেনিন নিজে ইদিশ ভাষায় বিপ্লবের বাণী ছড়িয়ে দেওয়ার আবেদন জানান। সেন্ট পিটারসবুরগের পথে হিব্রু, ইদিশে লেখা বিপ্লবী ব্যানার তুলে ইহুদিরা মিছিলে অংশ নিয়েছেন। অন্তত দু জন ইহুদি কমিসার ছিলেন- কার্ল রাদেক (সংবাদ বিভাগ) লিটিনোভ (বৈদেশিক বিভাগ)। হালে শ্রী পুটিন বলেছেন মহান রাশিয়ান বিপ্লবের পরে প্রতিষ্ঠিত নতুন সরকারের আশি শতাংশ সদস্য ছিলেন ইহুদি। যতদূর জানা যায় লেওন ট্রটস্কি সেই সরকারের একমাত্র ইহুদি সদস্য। একাই একশো না আশি?
আজকাল অবশ্য অনেক দেশেই ইতিহাসের সংশোধন করা হচ্ছে। রাশিয়া তার ব্যতিক্রম হতে যাবে কেন?
প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের অব্যবহিত আগে বা পরে ইউরোপের কিছু ইহুদি বুদ্ধিজীবী কমিউনিস্ট চিন্তাধারাকে সমর্থন জানান। বহু শতাব্দী যাবত জার্মান কাইজার, অস্ট্রিয়ান হাবসবুরগ সম্রাট এবং রাশিয়ান জারের নিরন্তর নিপীড়নের পরে ইহুদিরা হয়তো ভেবেছিলেন শ্রেণিহীন এক সমাজে তাঁদের ধর্মটা প্রাত্যহিক বিড়ম্বনার কারণ হবে না। এক সংগ্রামী নাম পোলিশ ইহুদি রোজা লুকসেমবুরগ। কার্ল লিবকনেখটের সঙ্গে জার্মানিতে যুদ্ধ বিরোধী স্পারটাকুস লিগ স্থাপনা করেন, সেটি পরবর্তী কালের জার্মান কমিউনিস্ট পার্টির পুরোধা। ক্ষমতা দখলের ব্যর্থ অভ্যুথানের পরে তাঁকে হত্যা করা হয়।
১৯২০র পরে রাস্তা ঘাটে নাৎসিদের সঙ্গে কমিউনিস্টদের মারপিট প্রতিদিনের কর্মসূচীর অন্তর্ভুক্ত হল।
সাতের দশকে ব্যারিকেড নাটকে উৎপল দত্ত জার্মানিতে দুই যুদ্ধের মধ্যবর্তী এই উত্তাল সময়টিকে বাঙময় করে তুলেছেন।রবীন্দ্র সদনের মঞ্চে এই নাটকের একটা দৃশ্য মনে আছে। সত্য বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন , " এটা কাদের পাড়া জানেন না? দেওয়ালগুলো দেখে নিন। সেখানে যদি লেখা থাকে 'জার্মানি জাগো' বা 'নিতশে আমাদের চিন্তা ধারার জনক', তাহলে বুঝবেন নাৎসি পাড়ায় আছেন। দুটো রাস্তা পার হলে দেখবেন দেওয়ালে দেওয়ালে কাস্তে হাতুড়ি আঁকা। কোনটা খুঁজছেন ?”
রবীন্দ্র সদনের বাইরের কলকাতা শহর তখন ঠিক সেই ভাবে ভাগ হয়ে গেছে। কোনো পাড়ার দেওয়ালে লেখা ‘চিনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান’ ‘বন্দুকের নলই ক্ষমতার উৎস’। অন্য পাড়ার দেওয়াল লিখনে তার প্রতিবাদী উত্তর। শহিদ বেদিতে শহর ভরে গেছে।
‘কমরেড তিমু তোমাকে ভুলছি না। ভুলব না’।
নাৎসিরা ইহুদি এবং বলশেভিজম বা কমিউনিজমকে সমার্থক ঘোষণা করেন। দুটোই শত্রু। গ্যাস চেম্বার উদ্বোধনের আগেই রাজনৈতিক কারণে পালান হাজার তিনেক ইহুদি কমিউনিস্ট -অনেকেই যান মেকসিকো। যুদ্ধের শেষে অন্তত দু হাজার ফেরেন পূর্ব জার্মানিতে, যেমন আলেকসানডার আবুশ (পূর্ব জার্মানির সাংস্কৃতিক বিভাগীয় মন্ত্রী)। রেখা রোটশিল্ড বলেছিলেন, "নতুন, এক সভ্য জার্মানির প্রতিষ্ঠার অপেক্ষা করছি অধীর আগ্রহে"। কমিউনিস্ট গণতান্ত্রিক জার্মান প্রজাতন্ত্র তাদের সে বাসনা পূরণ করেছিল কিনা জানা শক্ত।
নাৎসি যুগের কঠোর অ্যান্টি সেমিটিজমের সঙ্গে সুপরিচিত যে সব ইহুদি যুদ্ধোত্তর পূর্ব ইউরোপে প্রাণ এবং ভগ্ন কুটির নিয়ে বেঁচে রইলেন তাঁদের অনেকেই কমিউনিস্ট সরকারের সমর্থন করেছেন,কেউ কেউ নেতৃত্ব দিয়েছেন। নতুন দিন, উজ্জ্বল দিনের আশায় - লিবারতে এগালিতে ফ্রাতারনিতে। স্বাধীনতা সমতা ভ্রাতৃত্ব। ১৯৪৮ সালে চেকোস্লোভাকিয়াতে ভোটের মাধ্যমে যে কমিউনিস্ট সরকার নির্বাচিত হল তাতে ইহুদি নেতা রুডলফ স্লান্সকির বিশাল অবদান ছিল। পার্টিতে তাঁর শক্তি বৃদ্ধি দেখে কমরেড স্টালিন পছন্দ করেন নি অতএব ১৯৫২ সালে স্লান্সকি নিধন সম্পন্ন হল। অত্যন্ত দরিদ্র ইহুদি পরিবারের মেয়ে আনা পাউকার আজীবন রোমানিয়ান কমিউনিস্ট পার্টির জন্য কাজ করেছেন। যুদ্ধের পরে নব গঠিত প্রশাসনে অনেক উঁচুতে উঠেছেন। রোমানিয়ান কমিউনিস্ট পার্টির শীর্ষ পদ, পার্টি সেক্রেটারির জন্য মনোনীত হন - মেয়ে বলে সেটি নিজেই প্রত্যাখ্যান করেন। ১৯৫০ সালে আনা পাউকার পৃথিবীর প্রথম মহিলা বিদেশ মন্ত্রী হলেন। স্টালিনের রোষানলে পড়লেন। বলির হাড়ি কাঠে প্রায় চাপানো হয়েছিল। প্রাণে বাঁচলেন এই মাত্র। হাঙ্গেরিতে সরকারি ভাবে ইহুদি বিদ্বেষ বে আইনি। কিন্তু তাঁদের ইজরায়েল যাবার বাসনাকে বিচ্ছিন্নতাবাদী জাতীয়তা বিরোধী মনোভাব বলে নিন্দা করা হল। পূর্ব ইউরোপের অন্যান্য দেশে এর পুনরাবৃত্তি ঘটেছে।
তবে কি ইজরায়েলের জন্মের সঙ্গে কমিউনিস্ট ইউরোপে ইহুদি বিদ্বেষের কোন পরস্পর বিরোধী সম্পর্ক আছে? ইজরায়েল সৃষ্টি হল বলেই কি সেটি বর্ধিত হল? তোমরা নিজের দেশে চলে যাও?
অথবা সাম্যবাদের ভবিতে কিয়তকাল ভোলার পরে ইহুদি জানলেন হাজার বছরের বিদ্বেষ মারক্সিয় তত্ত্বের পুণ্য স্রোতে ধুয়ে মুছে গেলো না, যাবার নয়?
কে মনে রাখে ইহুদিরা সে সব দেশে কয়েকশ বছর বাস করেছেন! অন্য পাঁচজনের পাশাপাশি, বাণিজ্যের সঙ্গে সঙ্গে সংস্কৃতির জগতে ছাপ রেখেছেন।
ইহুদিরা পুনরায় প্রবঞ্চিত হলেন।
ডান একটা চমৎকার মন্তব্য করেছিলেন। তিনি হেসে বলেন "আপনি ডাভিড বেন গুরিওনের নাম জানেন তো? পোলিশ ইহুদি, তাঁর জার্মান পদবি গ্রুনকে গুরিওন বানালেন?"
এখানে একটা শ্লেষ আছে। ইজরায়েলে এসেই আশকেনাজি বা জার্মান নামধারি ইহুদিরা তাঁদের পদবিকে সযত্নে পরিবর্তন করেছেন। চেক, হাঙ্গেরিয়ান, রাশিয়ান বা রোমানিয়ানরা সেটি সচরাচর করেন না।
"জানি, তিনি ইজরায়েলের প্রতিষ্ঠাতা, রাষ্ট্রপিতা। আপনাদের প্রথম প্রধান মন্ত্রী।"
"ইজরায়েলে তাঁর সম্বন্ধে একটা বক্রোক্তি প্রচলিত আছে! যে দেশটার পিতা বলে আপনি তাঁর সম্মান দিলেন, তিনি সেটাকে নিয়ে দুবার ব্যবসা করেছেন। আমেরিকাকে দেশটা বেচে পেলেন টাকা। তারপরে রাশিয়া ও পূর্ব ইউরোপ থেকে কিনলেন মানুষ। ইহুদি বাণিজ্য বুদ্ধি ও চালাকির শ্রেষ্ঠ নমুনা!"
**********
মস্কো
রাত আড়াইটে বাজে। ময়শে গোল্ডওয়াইনের দরজায় ঘন ঘন কড়া নাড়ছে কেউ।
ময়শে (ভেতর থেকে) : কে দরজায়?
উত্তর : পোস্ট ম্যান। চিঠি আছে।
দরজা খুলতেই দুজন কে জি বি এজেন্ট তাকে ঠেলে নিয়ে গেছে বসার ঘরে। বউ ছেলে মেয়ে ভয়ে ভয়ে উঁকি দিচ্ছে পরদার পিছন থেকে।
কে জি বি এজেন্ট : আপনার নাম?
ময়শে : ময়শে গোল্ডওয়াইন
কে জি বি এজেন্ট : আপনি সপরিবারে ইজরায়েলে চলে যাবার আবেদন জানিয়েছিলেন?
ময়শে : হ্যাঁ।
কে জি বি এজেন্ট : আমরা আপনার ফাইল তন্ন তন্ন করে পড়ে দেখলাম। আপনি ভালো সরকারি কাজ করেন। আপনার ছেলে মেয়েরা উপযুক্ত স্কুলে যাচ্ছে। শিগগির বিশ্ব বিদ্যালয়ে যাবে। আপনি রাশিয়া ছেড়ে যেতে চান কেন?
ময়শে : আমি এমন দেশে থাকতে চাই না যেখানে রাত আড়াইটের সময় পোস্টম্যান চিঠি দিতে আসে।
**********
ভ্লাদিভস্তক
গ্রুনবেরগ ফোন করছে ফিঙ্কেলস্টাইনকে
গ্রুনবেরগ : কেমন আছো? খবর পাই না কেন?
ফিঙ্কেলস্টাইন : ভীষণ ভালো আছি।
গ্রুনবেরগ : এই বাজারে কি করে ভালো আছো?
ফিঙ্কেলস্টাইন : জানো, আমাদের সমবায়ের দোকানে এখন আলু আর রুটি শুধু নয়, কমলালেবু, বেদানাএসেছে। কাল সকাল থেকে মুরগি পাওয়া যাবে। পরের শনিবার থেকে সসেজ আসবে অঢেল।
গ্রুনবেরগ : কে জি বির লোকেরা তোমার ফ্ল্যাট থেকে চলে গেলে আমাকে একবার ফোন কোরো।
**********
জানুয়ারী ১৯২৪
বরফে ঢাকা রেড স্কোয়ার। হাজার হাজার মানুষের বিশাল সমাবেশ। কমরেড লেনিনের অনন্ত শয়নের আয়োজন চলছে। ক্রেমলিনের দেয়ালে গাঁথা মসোলিয়াম সেখানে একটি কাঁচের শবাধারে তিনি থাকবেন শায়িত। যেন গভীর নিদ্রায় রত ।
দুবস্কি কোহেনকে বললে "দেখেছিস কত খরচা করছে এক মৃত মানুষকে গোর দিতে?"
কোহেন দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বললে, " অপচয়। এই খরচায় গোটা পার্টিকে গোর দেয়া যেতো। "
**********
মস্কো
নাথান গেছে মাংসের দোকানে। মুরগি ভেড়া সসেজ কিছু নেই। তার পরে আরেকটা দোকানে। সেখানেও ভাঁড়ার শূন্য। উত্তেজিত হয়ে চেঁচামেচি করেছে সে। তৎক্ষণাৎ কে জি বির লোক হাজির- তাকে বেঁধে নিয়ে গেছে আপন দফতরে।
গ্রোনেনকো : কমরেড নাথান অলেগোভিচ,, কমরেড স্টালিনের সময়ে আপনি এই ধরনের মন্তব্য করলে গুলি খেতেন। আমরা অত নিষ্ঠুর নই। তবে সাবধান করি - আপনার মনের কথা মনেই রাখুন। সেটা চিৎকার করে বলে বেড়াবেন না। বাড়ি যান। নাথানের ধরা পড়ার খবর শুনে উদ্বিগ্ন নাফতালি তার বাড়িতে খবর নিতে এসেছে।
নাথান : নাফতালি, চিন্তার কারণ নেই। দোকানে মাংস নেই কিন্তু কে জি বির বন্দুকের গুলিও শেষ!
**********
কিয়েভ
বিপ্লবের তাত্বিক ভিত্তি নিয়ে পার্টির মহান নেতারা অনেক বিচার বিমর্শ করলেন। এবার সার্বিক উন্নয়নের ছবি স্পষ্ট হবে।
ইয়াঙ্কেল তার রাবির কাছে গেছে।
ইয়াঙ্কেল : রাবি, আপনি আমাকে একটা জিনিস বোঝাবেন? দান্দ্বিক বস্তুবাদ আর ঐতিহাসিক বস্তুবাদের পার্থক্য কি?
রাবি : কোন পার্থক্য নেই। এ দেশ থেকে কেটে পড়ো।
**********
আব্রাহামোভিচের বাড়িতে পার্টির দুই স্থানীয় নেতা এসে হাজির। তাঁরা সোভিয়েত রাষ্ট্রের কাঠামোগত উন্নয়নের খরচা তুলতে জনগণকে বন্ড বিক্রি করছেন। সকল নাগরিকের উচিত তাদের সাধ্যমত টাকা সেই সব প্রকল্পে নিবেশ করা। আব্রাহামোভিচ শুনেই উচ্ছ্বসিত।
আব্রাহামোভিচ : অবশ্য! দেশের কল্যাণ বলে কথা। আমি বিশ হাজার রুবেল দেব।
প্রথম কমরেড : বাজে কথা বোলো না। সারা বছরে বিশ হাজার রুবেল রোজগার করার ক্ষমতা নেই তোমার।
আব্রাহামোভিচ : তাহলে অন্তত অর্ধেক দেব। এই মনে করুন ন হাজার রুবেল?
দ্বিতীয় কমরেড : এত টাকা তোমার আছে নাকি? বিশ্বাস হয় না।
আব্রাহামোভিচ : তাহলে দশ রুবেল দেব। দোহাই আপনারা এর চেয়ে কম দিতে বলবেন না।
**********
কমিউনিস্ট রাশিয়া থেকে যে কোন নাগরিকের বিদেশ যাওয়া শক্ত ব্যাপার। প্রভূত অর্থ না দিলে ইহুদিদের পক্ষে ইজরায়েল যাওয়া তো একেবারেই অসম্ভব।
ক্রেমলিনের পাশে জরাদিয়ে পার্কের বেঞ্চে বসে কোহেন খুব মন দিয়ে হিব্রু শেখার বই পড়ছে। রাশিয়ান পুলিশ টহল দিয়ে যায়। একবার যায় দু বার যায়। কোহেন মাথা তোলে না। তৃতীয় বারে পুলিশ ঠিক সামনে এসে দাঁড়াল।
পুলিশ : এতো মন দিয়ে কি পড়ছিস? বোমা বানানোর কলা কৌশল?
কোহেন : না। হিব্রু! এই হিব্রু শিখছি।
পুলিশ : হিব্রু শিখে কি হবে? তোদের ইজরায়েল যাবার রাস্তা আমরা বন্ধ করে দিয়েছি।
কোহেন : তা জানি। যদি স্বর্গে যাই, কাজে লাগবে।
পুলিশ : আর যদি নরকে যাস?
কোহেন : অসুবিধে হবে না। রাশিয়ান জানি।
**********
প্রাগ। প্রতিবাদী বসন্ত। ১৯৬৮
রাশিয়ান সৈন্য টহল দিচ্ছে প্রাগে।
সিলবারস্টাইন দৌড়ে এসেছে ওয়েনসেসলাস স্কোয়ারের পুলিস দফতরে।
সিলবারস্টাইন : আমার সর্বনাশ হয়েছে। একজন সুইস সৈন্য আমার রাশিয়ান ঘড়ি চুরি করেছে!
পুলিশ : আপনি বলতে চাইছেন একজন রাশিয়ান সৈন্য আপনার সুইস ঘড়ি চুরি করেছে?
সিলবারস্টাইন : ছোট মুখে বড় কথা হয়ে যাবে! সেটা তো আপনি বললেন, সার।
**********
ডাভিড ব্রণস্টাইন শুনেছেন তাঁর ছেলে লাইব এখন মস্কোর ক্রেমলিনের সর্বেসর্বা । ছেলে তাঁকে চারিদিক ঘুরিয়ে দেখায়।
ডাভিড : লাইব, আমি শুনেছি তুমি এখানকার বস। অথচ সব জায়গায় ভ্লাদিমির উলিয়ানভ নামের একজন দাড়িওলা অর্থোডক্স ক্রিশ্চিয়ানের ছবি টাঙ্গানো আছে দেখছি। তাহলে তুমি কি করো?
লাইব : কি করা যায় বলো বাবা ? ব্যবসা আমি চালাই। কিন্তু লাইসেন্সটা যে ওদের হাতে।
লেভ (লাইব) ডাভিডোভিচ ব্রণস্টাইনকে আমরা অন্য নামে চিনি।
লেওন ট্রটস্কি
**********
ট্রানসিলভানিয়া, রোমানিয়া
শীত আসন্ন। বয়স্ক লাইবোভিতসের খামারে কাঠ আছে কিন্তু সেগুলো কাটবার ক্ষমতা তার নেই। ঘর গরম করার জন্য কাঠ লাগে। তার সমস্যার কথা শ্মিলোভিতসকে জানালে সে বললে কোন চিন্তা নেই।
শ্মিলোভিতস (ফোনে) : সিকুরিতাতে (রোমানিয়ান গোয়েন্দা বিভাগ)? খবর পেয়েছি কুটনো গ্রামের লাইবোভিতস তার খামারে কাঠের গাদাতে সোনা লুকিয়ে রেখেছে।
তৎক্ষণাৎ ব্রাশভ থেকে দু লরি পুলিশ কুটনোয় হাজির। লাইবোভিতস যত বলে তার কাছে সোনা নেই পুলিস তত উৎসাহের সঙ্গে তার খামারের কাঠ ছোট ছোট করে কেটে ছিন্ন ভিন্ন করে সোনা খোঁজে। হতাশ হয়ে তারা ফিরে গেলে লাইবোভিতস ফোন করছে।
লাইবোভিতস : শ্মিলোভিতস, তোমার কি দারুণ পরিষ্কার মাথা! আগামী শীতের জন্য চুল্লী জ্বালানোর কাঠ কেটে কুটে দিয়ে গেল সিকিউরিতাতে। তোমার কি উপকার করতে পারি বলো?
শ্মিলোভিতস : আমার প্রতিবেশী পপেস্কু তার বাড়ি তৈরির কাজ শেষে রাজ্যের ইট পাটকেল জমা করে রেখেছে আমার বাড়ির সামনে। অনেক বার বলেছি সরাতে। বুড়ো ইহুদির কথা কে আর শোনে।
লাইবোভিতস (ফোনে) : সিকিউরিতাতে, আমার কাছে খবর আছে সিনকা গ্রামের শ্মিলোভিতস তার বাড়ির সামনে ইটের গাদায় বন্দুক লুকিয়ে রেখেছে।
**********
মস্কো
পাড়ার কমিউনিস্ট পার্টি অফিসে ডাক পড়েছে ইয়াকুবোভিচের।
আনানিয়েনকো : কমরেড ইয়াকুবোভিচ, আপনি আমাদের সর্ব শেষ দল বৈঠকে আসেন নি কেন?
ইয়াকুবোভিচ : কমরেড আনানিয়েনকো, বিশ্বাস করুন, যদি জানতাম সেটাই দলের শেষ বৈঠক ছিল, আমি নিশ্চয় আসতাম। এমনকি সপরিবারে হাজিরা দিতাম।
**********
ইরকুটসক, রাশিয়া
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর।
ইহুদি শিক্ষক রূপকথার গল্প পড়ে শোনাচ্ছেন শিশুদের।
স্লিমোভিচ : তারপরে ঈশ্বর এক টুকরো চিজ দিলেন খরগোশকে।
ইভান (বাধা দিয়ে) : সার, কমরেড স্টালিন বলেছেন, ঈশ্বর বলে কেউ নেই।
স্লিমোভিচ : আর চিজ? চিজ বলে কিছু আছে কি? সেটা শেষ কবে চোখে দেখেছো?
**********
মস্কো
কমিসার ইভান এবং লিভোভিতসের বাক্যালাপ
ইভান : কমরেড লিভোভিতস, পার্টি যদি আপনার শেষ রুবেলটি চাঁদা হিসেবে দাবি করে, আপনি কি করবেন?
লিভোভিতস : কমরেড ইভান, এটা আবার কি প্রশ্ন করলেন? আমি তৎক্ষণাৎ দিয়ে দেব।
ইভান : পার্টি যদি আপনার শেষ শার্টটা দান করতে বলে, আপনি কি করবেন?
লিভোভিতস : আমি কান্নাকাটি করব। কখনোই দেব না।
ইভান : যুক্তিটা বুঝলাম না। আপনার শেষ রুবেল দেবেন কিন্তু জামাটা দেবেন না?
লিভোভিতস : যুক্তি খুব সহজ, কমরেড ইভান। রুবেল আমার কাছে একটাও নেই কিন্তু এটাই যে আমার একমাত্র জামা।
**********
বুদাপেস্ট ১৯৫৬
পার্টি সেমিনার শেষে প্রশ্নোত্তরের পর্ব । কেউ মুখ খোলে না। সেক্রেটারি একটু তাড়া দিলেন। অবশেষে শাপিরো উঠে দাঁড়ালো।
শাপিরো : আমার দুটো প্রশ্ন আছে, কমরেড । আমাদের শস্য সামগ্রী কোথায় যাচ্ছে? আমাদের মাছ মাংস কোথায় যাচ্ছে? দোকানে মেলে না কেন?
সেক্রেটারি : নোট করে নিলাম। পরবর্তী সেমিনারে এর উত্তর দেওয়া হবে। এক মাস বাদে।
সেমিনারের শেষে প্রশ্নোত্তরের পর্ব। সেক্রেটারি তাড়া দেবার আগেই ইহুদি ইয়েসলোভিতস উঠে দাঁড়াল।
ইয়েসলোভিতস : কমরেড আমার একটাই প্রশ্ন আছে। কমরেড শাপিরো কোথায়?
অনলাইন কিনতে এখানে ক্লিক করুন
**********
ক্রাকাউ থেকে ওয়ারশর ট্রেন। কামরায় একজন পোলিশ অফিসার আর কাফতান পরা ইহুদি সুখ দুঃখের গল্প করছেন। একটি ছোট গ্রাম আসছে দেখে ইহুদি ফিঙ্কেলস্টাইন উঠে দাঁড়াল।
ফিঙ্কেলস্টাইন : অফিসার এই যে গ্রাম দেখছেন, এখানেই আমার বাবা -ঈশ্বর তাঁর আত্মাকে শান্তি দিন- সর্বস্ব খুইয়েছিলেন।
পোলিশ অফিসারও তৎক্ষণাৎ উঠে সেই আত্মার প্রতি স্যালুট জানালেন।
পাঁচ মিনিট বাদে।
ফিঙ্কেলস্টাইন : :আর অফিসার, এই দেখুন এই যে গ্রামটা আসছে, এখানেই আমার বাবা- ঈশ্বর তাঁর আত্মাকে শান্তি দিন – আবার নতুন করে ব্যবসা শুরু করে অনেক অর্থ আয় করেন।
**********
পোল্যান্ডের ইহুদি বিদ্বেষ অত্যন্ত প্রকট। কর্ম ও বন্ধুত্ব সূত্রে কিছু মানুষের কাছে তার পরিচয় পেয়েছি! নাৎসি আমলে পোলিশদের সক্রিয় সহযোগিতার কথা উল্লেখ করা দেশদ্রোহিতা! সেই মর্মে আইন পাস হয়েছে।
ওয়ারশ, পোল্যান্ড ১৯৭০
সমস্ত ইহুদিকে কাজ থেকে বরখাস্ত করা হচ্ছে। না পোষালে ইজরায়েল চলে যাও!
আবেনডশাইনের সঙ্গে ইলানের রাস্তায় দেখা।
আবেনডশাইন : কেমন আছো?
ইলান : ভালোই আছি।
আবেনডশাইন: চাকরি বেঁচে গেছে নাকি?
ইলান : না, চাকরি নেই।
আবেনডশাইন: তো চলে কিসে?
ইলান : ব্ল্যাকমেল করে।
আবেনডশাইন: কাকে ব্ল্যাকমেল করো?
ইলান : সেই যে একজন পোলিশ আমাকে নাৎসিদের আমলে সেলারে লুকিয়ে রেখেছিল! তাকে।
**********
পোল্যান্ড ১৯৬৭
ছোট দেশ ইজরায়েল লড়াই করছে প্রকাণ্ড আরব বাহিনীর বিরুদ্ধে এবং জিতছে। পোল্যান্ডে মহা উল্লাস। কারণ সোভিয়েত ইউনিয়ন আরবদের পক্ষে- আরব পরাজয় মানে রাশিয়ার নাক কাটা যাওয়া।
গ্রুন সকাল বেলা তার ফ্ল্যাট বাড়ি থেকে বেরুচ্ছে। দরোজার পাহারায় থাকে মারেক।
মারেক (উৎসাহিত) : শুনেছেন? আরব সৈন্য বেজায় মার খাচ্ছে সিনাই এর যুদ্ধে!
পরের দিন
মারেক : খবর রাখেন? আরবদের পুরো সিনাই থেকে খেদিয়ে দিয়েছে ইজরায়েল!
পরের দিন
গ্রুন বেরুচ্ছে। সামনে মারেক। বিষণ্ণ চেহারা।
গ্রুন : কি ব্যাপার মারেক? কে জিতল যুদ্ধে?
মারেক : আরবরা হেরেছে। কিন্তু এইমাত্র জানতে পারলাম ইজরায়েলিরা আসলে ইহুদি।
**********
মস্কোতে ভাষা শিক্ষার ভবিষ্যৎ নিয়ে কিছু তথ্য সংগ্রহ করা হল। রাশিয়ান ছাড়া ছাত্র ছাত্রীরা কে কোন ভাষা শিখতে চায়।
উত্তর : যারা দেশে থাকতে চায়, তাদের পছন্দ চিনা ভাষা। যারা বিদেশে যেতে চায়, তাদের পছন্দ হিব্রু।
**********
সোভিয়েত ইউনিয়নে র্যাশন ব্যবস্থা নির্ধারণের দায়িত্ব ছিল মস্কোর কেন্দ্রীয় সরকারের। তবে কোন কোন বস্তু বিতরণে স্থানীয় পার্টি নেতারা সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন। দুষ্টু লোকেরা বলত সেটা ঐ নিজের কোলে ঝোল টানার সুযোগ!
দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পরে রুটি বাঁধাকপি আলু আর ভদকা ছাড়া আর সব প্রায় অমিল। এমন সময় কাজান শহরে রব উঠল সমবায়িকার দোকানে মাংস পাওয়া যাবে। ভোলগার পাড়ে সে দোকান। জানুয়ারি মাস। একে বরফে চতুর্দিক জমে আছে তায় নদী থেকে ছুটে আসে ঠাণ্ডা হাওয়া। জনতা লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ভোর ছটা থেকে। পুলিশ সে লাইন সামলাচ্ছে।
আটটা নাগাদ পুলিশ এসে বার্তা দিয়ে গেলো: মাংস খুব কম এসেছে। সেটা শুধু রাশিয়ানদের জন্য বন্টিত হবে। ইহুদিরা যেন স্থান পরিত্যাগ করে। পরিচয় লুকোনোর চেষ্টা করে লাভ নেই। ফিদেলবাউম বা লেভি লেখা আছে সনাক্ত করণ পত্রে। ইহুদিরা বাড়ি ফিরে গেল।
বাকিরা হিম শীতে দাঁতে দাঁত দিয়ে দাঁড়িয়ে।
এগারোটা নাগাদ ঘোড়ায় চড়া পুলিশ এসে জানালো: মাংসের পরিমাণ কম বলে শুধু মাত্র কমিউনিসট পার্টি সদস্যদের দেয়া হবে। পার্টি মেম্বার যারা নন তাঁরা ফিরে যান। ধাপ্পা দেয়ার চেষ্টা বাতুলতা মাত্র। পার্টি কার্ড দেখাতে হবে! অনেকে প্রস্থান করলেন।
বেলা দুটোয় আবার ঘোড় সওয়ার পুলিশের আবির্ভাব। এবার নতুন নির্দেশঃ আপনাদের মধ্যে যারা জার্মানদের বিরুদ্ধে গৌরবময় জনযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন কেবল তাঁরা থাকুন। বাকিরা ফিরে যাবেন।
এটিও মোক্ষম বাছাই ব্যবস্থা। পরিচয় পত্রে প্রমাণ থাকে।
লাইনে মানুষের সংখ্যা কমে এসেছে।
রাত্তির আটটা বাজে তখনো কিছু লোক দাঁড়িয়ে -তারা ইহুদি নয়, কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য, জার্মানদের বিরুদ্ধে লড়েছে। এবার পুলিশ এসে জানাল -আজ মাংস এসে পৌঁছয় নি। আপনারা সবাই বাড়ি যেতে পারেন।
এক রাশিয়ান আরেক রাশিয়ানকে বলল "দেখেছিস, ইহুদিদের বরাতটা কেমন ভাল? এই ঠাণ্ডায় সারাটা দিন হা পিত্যেশ করে বসে রইতে হল না!"
**********
কাগানোভিচ কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেবে। স্থানীয় পার্টি সেক্রেটারির সঙ্গে তার ইন্টারভিউ।
সেক্রেটারি : কমরেড কাগানোভিচ, কার্ল মার্ক্স কে?
কাগানোভিচ: জানি না।
সেক্রেটারি : লেনিন?
কাগানোভিচ: নাম শুনি নি।
সেক্রেটারি : ব্রেঝনেভ?
কাগানোভিচ: রাস্তায় পোষ্টারে ছবি দেখেছি।
সেক্রেটারি : ইয়ার্কি হচ্ছে?
কাগানোভিচ: মোটেই না। আপনি খাইম ডাভিডোভিচকে চেনেন?
সেক্রেটারি : না।
কাগানোভিচ: ইতঝিক গোল্ডস্টাইন?
সেক্রেটারি : তিনি কে?
কাগানোভিচ: এই দেখলেন তো? আপনি আমার বন্ধুদের চেনেন না। আমিও আপনার গুষ্ঠির লোককে চিনি না।
**********
কুরস্ক
সারা আব্রামোভনা কোন মতে আমেরিকা পৌঁছেছে কিন্তু আব্রাহাম আটকে আছে মস্কোতে। তাদের সব চিঠি পত্র রাশিয়ান পুলিস খুলে পড়বে সেটা দু জনেই জানে। তাই নিজেদের মধ্যে তারা স্থির করে নিয়েছে যা কিছু মিথ্যে সেটা নীল কালিতে লিখবে আর যেটা সত্যি সেটা লাল কালিতে। নীল কালিতে লেখা আব্রাহামের প্রথম চিঠি:
সারা
দারুণ ভালো আছি। দিন দিন অবস্থার উন্নতি হচ্ছে। দোকানে প্রচুর জিনিস পত্তর, কোনটা ছেড়ে কোনটা কিনব ভেবে হিমসিম খেতে হয়। কেবল একটাই সমস্যা – লাল কালি পাওয়া যাচ্ছে না।
পুঃ বার্লিন দেওয়ালের পতনের এবং চাউচেস্কুর মৃত্যুর পাঁচ বছর পরেও আমার লেখা চিঠি বুখারেস্টে রোদিকার কাছে পৌঁছত খোলা অবস্থায়। কোন জিনিস পাঠালে তো কথাই নেই। তার এত্তেলা পড়তো পুলিশের অফিসে।
**********
ওয়াশিংটন। নিকসন ব্রেঝনেভ মিটিং।
ব্রেঝনেভ : প্রেসিডেন্ট, আপনার দেশে প্রকট বর্ণ বৈষম্য আছে। কালো মানুষের অধিকার ছিনিয়ে নিয়েছেন আপনারা।
নিকসন : সেক্রেটারি ব্রেঝনেভ, আপনাদের দেশেও সেই একই সমস্যা। ইহুদিদের প্রতি আপনারা দুর্ব্যবহার করেন। আমি শুনেছি কিয়েভ শহরের রাবির পদটি পাঁচ বছর খালি পড়ে আছে। কেন?
ব্রেঝনেভ : আমি এখুনি খোঁজ নিয়ে জানাচ্ছি। পাঁচ মিনিট।
ব্রেঝনেভ ফোন করলেন মস্কোতে। পার্টির দু নম্বর ব্যক্তিকে।
ব্রেঝনেভ : ওলেগ সেরগেভিচ, প্রেসিডেন্ট নিকসন বলছেন পাঁচ বছর কিয়েভের রাবির পদ খালি আছে। সেটা কি সত্যি?
ওলেগ : হ্যাঁ কমরেড সেক্রেটারি।
ব্রেঝনেভ : কেন?
ওলেগ: কমরেড সেক্রেটারি ব্রেঝনেভ, আগের রাবি মারা যাবার সঙ্গে সঙ্গে আমরা নতুন রাবির সন্ধান করেছি। একজনকে পাওয়া গেলো। সে ইহুদি বাইবেল তালমুদ জানে কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য নয়। আরেকজনকে পাওয়া গেলো সে পার্টির সদস্য কিন্তু তালমুদ জানে না। আমরা হাল ছাড়ি নি। আরেকজনকে খুঁজে বের করলাম যে পার্টির সদস্য এবং রাবির কাজকর্ম জানে।
ব্রেঝনেভ (অধৈর্য) : তা তাকে রাবির কাজে রাখা হল না কেন?
ওলেগ : কমরেড সেক্রেটারি, সে লোকটা যে ইহুদি।
পুঃ রাশিয়ানদের অভ্যাস হল কথায় কথায় বাপকে টেনে আনা! ব্রেঝনেভ ওলেগকে আদরের সঙ্গে সেরগেভিচ বললেন , সেরগেইএর ছেলে। শুধু বাবার নামে ডাকা যায়। আমাদের গ্রামে যেমন বন্ধু অজিতকে ‘ও পটলের ছেলে’ বলে সম্বোধিত হতে দেখেছি!
**********
বেআইনি ভাবে রাশিয়ান বর্ডার টপকে পালাতে গিয়ে ধরা পড়েছে রাপাপোর্ট। কে জি বির অফিসার ইভান ইন্টারভিউ নিচ্ছে।
ইভান : কমরেড রাপাপোর্ট, আপনি এই শ্রমিক কৃষকের স্বর্গরাজ্য থেকে পালানোর চেষ্টা করছিলেন কেন?
রাপাপোর্ট : তার দুটো কারণ, কমরেড ইভান ভিক্টরোভিচ। শ্রমিক কৃষকের এই স্বর্গরাজ্য যদি ভেঙ্গে চুরে যায় তার সব দোষ পড়বে এই আমাদের, ইহুদিদের ওপরে। সে শাস্তি আমি চাই না।
ইভান : আপনি কি ভেবেছেন? আমাদের এই সোভিয়েত ইউনিয়ন দিনে দিনে শক্তিশালী হয়ে উঠছে। আমরা এখন সুপার পাওয়ার হতেচলেছি। এ দেশের ভাঙচূর হবার কোন সম্ভাবনা নেই।
রাপাপোর্ট : কমরেড ইভান ভিক্টরোভিচ, সেটাই আমার পলায়ন প্রয়াসের দ্বিতীয় কারণ।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।