সম্ভবত মনোজ বসু বলেছিলেন ছোট গল্প ছোট হবে, গল্পও হবে।
ফ্রয়েড এবং ওঁরি বেরগসঁ একমত যে ইহুদি কৌতুকের বৈশিষ্ট্য তার শব্দ ব্যবহারের সংযমে।শেক্সপীয়ার বলেছেন রসিকতার শিকড় নিহিত তার সংক্ষিপ্ততায় ( সিনস ব্রেভিটি ইজ দি সোল অফ দি উইট ...আই উইল বি ব্রিফ..:ইয়োর নোবল সন ইজ ম্যাড- পোলোনিয়াস: হ্যামলেট - দ্বিতীয় অংক, দ্বিতীয় দৃশ্য) ।
ইহুদি কৌতুকের চারিত্রিক লক্ষণ বিদ্রূপ, ব্যঙ্গ এবং শব্দের খেলা। বিদ্রূপের মূল লক্ষ সরকারি সেরেস্তা থেকে রাস্তার পুলিস, পাড়ার জমিদার, স্থানীয় রাজা, ধনী ব্যক্তি, আদালতের উকিল – যে কোন ক্ষমতার অধিকারী! ধর্মের প্রভাব, প্রকোপ অথবা অভাব দুটোই ব্যঙ্গের পাত্র। মূলত জার্মান, কিছু হিব্রু ও স্লাভিক ভাষার সমন্বয়ে গড়ে ওঠা ইদিশের শব্দ সংখ্যা কম কিন্তু তার ব্যবহার চতুর। সে ভাষার প্রথম ব্যাকরণ বই ছাপা হয় মাত্র ১৯০৭ সালে। তার অনেক আগেই তাকে কলা দেখিয়ে ইদিশ কখনো বিশেষ্য, বিশেষণ বা ক্রিয়া পদ কর্তা কর্ম করনকে এখানে ওখানে সেখানে লাগিয়ে দিয়ে আখের রসের মতন মজাটা নিংড়ে বের করে নিয়েছে। একই শব্দের একাধিক অর্থ নিয়ে খেলেছে। লক্ষণীয় এই যে ভাঁড়ামোর ভিকটিম কখনো ইহুদি নিজে, কখনো নিজেরই আত্মীয় স্বজন, পাড়া পড়শি, গোয়, রাব্বি, মোজেস, দশ আদেশ, ইজরায়েল, তাদের নিজেদের নির্বুদ্ধিতা, অতি চালাকি, অর্থ লোভ! এর একমাত্র তুলনা আমাদের লুধিয়ানা বা জলন্ধরের জোক ফ্যাক্টরি! সেখানে সরদার যে মজে কি কাহানি ছাড়ে, সেই ব্যঙ্গের পাত্র সরদার এবং তার গুষ্ঠি! হরিয়ানার হিসারের জাঠ সে গল্পে কদাচ আসে।
তবে ইহুদি রসিকতার কোনটা নিছক ভাঁড়ামো, কোনটা কৌতুক আর কিসের ভেতরে লুকিয়ে আছে গভীর আত্ম নিগ্রহ সেটা বুঝতে হয়! ফ্রয়েড বলেন ইহুদি রসিকতা একটা কঠোর দুঃখকে অনায়াসে লুকিয়ে রাখে মস্করার মোড়কে।
ইজরায়েলি টেলিভিশানে ইহুদিরা আসছে ( দি জুস আর কামিং) নামক একটি সিরিয়ালে মোজেস এবং ধর্মকে নিয়ে বেয়াড়া রসিকতা পাবেন। কিন্তু সেটা একেবারে হলিউডি চিত্রনাট্য যেমন টেন কমান্ডমেনটস ছবিতে নেফারতেরি বেশিনি অ্যান ব্যাকসটার যে সব অলঙ্কারে সজ্জিত হয়ে ঘুরে বেড়ান তার জহুরি জন্মাতে হাজার খানেক বছর দেরী আছে। এঁর সঙ্গে মোজেসের প্রেম দূরে থাক, কোনদিন সাক্ষাৎ হয়েছে এ কথা বাইবেলে নেই। তিন ঘণ্টা উনচল্লিশ মিনিটের ছবিতে প্রয়োজক পরিচালক সিসিল ডি মিলের কাছে মনোরঞ্জন প্রয়াসটা ছিল প্রধান, ইতিহাস সেখানে বিড়ম্বনা মাত্র।
কিছু মনীষী হিব্রু বাইবেলে কৌতুক বা রসিকতা খোঁজার চেষ্টা করেছেন। সেখানে পাওয়া যায় মজার মজার মন্তব্য যেমন “ তিন দিনের বেশি বাড়িতে অভ্যাগত অতিথি বাস করলে বা বৃষ্টি চললে গেরস্থ ক্লান্ত হয়ে পড়ে (স্যামুয়েল)“। নেই দ্বিপাক্ষিক সংলাপ, তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গ।
ইজরায়েল থেকে নির্বাসিত হবার পরের দেড় হাজার বছরকে কৌতুকশূন্য যুগ (ভিতসলোসে পেরিওডে) বলে চিহ্নিত করা হয়। আমরা আজ যে ইহুদি রসিকতার সম্ভারকে চিনি সেটি দুর্বলের অস্ত্র - তার বয়েস খুব বেশি হলে দুশো বছর। এই সব কৌতুকময় পথ নাটিকা অনুষ্ঠিত হয়েছে মধ্য এবং পূর্ব ইউরোপের গ্রাম শহর ষ্টেটেলে, হাটে মাঠে, দোকানে বাজারে, আদালতে। হাজির জবাব মানুষের চোখা সংলাপে।
উনবিংশ শতাব্দীতে যখন ইহুদি সমাজ জীবন নানান শেকলে বাঁধা, কোন কাজ করা যাবে না তার তালিকা দীর্ঘ, মাঝে মধ্যেই ইহুদি নিধন নিপীড়নের চ্যাম্পিয়নশিপ লিগের খেলা চলে এমন কালে জন্ম নিয়েছিল এই সব রসিকতা। ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়েছে তার কলেবর, লুধিয়ানার সরদারের স্টাইলে একজন আরেকজনকে বলেছেন, ওটা আমি জানি। অব এ ভি সুন লো ইয়ার। মনে রাখা প্রয়োজন ইহুদি কোন জাতি নয়, একটি জনতা। সব ইহুদির রং ধলা নয়, কালো বা হলদে হতে পারে। একটি জনতা, যার কোন দেশ নেই, রাজা নেই, কেন্দ্রীয় ধর্মগুরু নেই। কে যে কোন দেশে থাকে জানা নেই। প্রবাসী সম্মিলন বা নন রেসিডেনট ইজরায়েলি ( এন আর আই) নামক সংস্থান গড়ে ওঠে নি। ভাষাটাও ভুলে যাবার যোগাড়। এক অপরিচিত জগতে বিদ্বেষী মানুষের সমাজে নানান অত্যাচার অবহেলার মাঝে যে যেখানে থাকে সেখানেই ইহুদি ধরে রাখে তার ধর্মকে - তোরা, দশ আদেশ, বাইবেলে নির্দেশিত ও রাব্বি দ্বারা ব্যাখ্যা করা জীবন যাপনের নিয়মাবলী। মিশর থেকে নিষ্ক্রমণের সন্ধ্যার স্মরণে পাস ওভারের টেবিলে একে অপরকে বলে, তারা এসেছিল মারতে, বেঁচে গেছি। এখন খেতে বোসো।
পরের বছরে জেরুসালেমে হবে (নেক্সট ইয়ার ইন জেরুসালেম) । সেই আশায় বেঁচে থাকা, ইহুদিদের বাঁচিয়ে রাখা।
সেই দুর্বল ইহুদিকে ঈশ্বর প্রদত্ত বাসভূমিতে ফেরানোর আন্দোলনের নাম জায়নিজম আর তার নেতৃত্ব দিলেন অস্ট্রিয়ান ইহুদি থিওডোর হ্যারতসল। রনাঙ্গনে পর্বে আমরা তাঁর সঙ্গে পরিচিত হয়েছি।
তুরস্কের অটোমানরা (আসলে কথাটা ওসমানলি) তখন প্যালেস্টাইনের প্রভু। খাজনা নিয়মিত পেলেই খুশি। ধর্ম নিয়ে তাঁদের মাথা ব্যথা কম।
জেরুসালেমে যিশুর সমাধি স্থলের ওপরে নির্মিত চার্চ অফ দি হোলি সেপালকার খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের কাছে সবচেয়ে পবিত্র ভজনালয়। সেটির পরিচালনা নিয়ে আর্মেনিয়ান গ্রিক প্রটেস্টাণ্ট ক্যাথলিক পুরোহিতরা সব সময়ে বিতণ্ডায় ব্যস্ত থাকতেন। তাদের পারস্পরিক ঝগড়া ঝাঁটি থামাতে অটোমান সুলতান সে গিরজের সংরক্ষণ ও দেখভালের ভার দিলেন একটি মুসলিম পরিবারের হাতে। চারশো বছর বাদে আজও সেই মুসলিম পরিবার খ্রিস্ট ধর্মের পবিত্রতম ধর্মস্থলের দায়িত্বপূর্ণ রক্ষক।
এই ঘটনার কোন ভারতীয় তুলনা খুঁজতে যাওয়া বাতুলতা।
বিগত শতাব্দীর শুরুতে যখন ইউরোপ থেকে কিছু ইহুদি ভিসা ছাড়াই জাফা বা হাইফায় নৌকো থেকে নামলেন, অটোমান সরকার তাতে খুব একটা ভ্রুক্ষেপ করেন নি। তিন আব্রাহামপন্থী ধর্মের চমৎকার সহাবস্থান বলে মেনে নিয়েছিলেন জেরুসালেমে ইহুদি মুসলিম খ্রিস্টান ও আর্মেনিয়ান পাড়ায় যে যার নিজের মতন থাকে, বাজার বন্ধ রাখে কেউ শুক্রবার কেউ শনিবার কেউ রবিবার।
বসন্তের টিলা নামের একটি শহরের গোড়া পত্তন হল যাকে, আমরা তেল আভিভ নামে চিনি। বিংশ শতাব্দীর শুরু।
জেরুসালেম শহরকে ঘিরে আছে ছোট খাট মাপের পাহাড়। কোথাও বা পাথরের স্তূপ যেমন মাউনট অফ অলিভ। সেখানে যিশু ও তাঁর সঙ্গীদের গ্রেফতার করে রোমান সৈনিকরা। আজকের হেব্রন শহরের অদূরবর্তী কিরিওট শহরের মানুষ য়ুডাস তাঁর গালে চুমু খেয়ে যিশুর পরিচয় জানিয়ে দেন। আরেকটির নাম জায়ন পাহাড় ( মাউনট জায়ন – দেখে একটি ছোট টিলা বলে মনে হয়েছিল, মাউনট একটা অত্যুক্তি) । খ্রিস্ট জন্মের ছ শো বছর আগে হিব্রু বাইবেলে জায়ন শব্দটি প্রথম পাওয়া যায়। মাউনট জাওনের নিচের অংশে রাজা ডেভিডের সমাধি এবং ওপর তলার হল ঘরে যিশু শেষ বারের মত তাঁর শিষ্যদের সঙ্গে একত্র আহার করেন ( দি লাস্ট সাপার) । ব্যাপক অর্থে জায়ন জেরুসালেম এবং ইজরায়েলকে বোঝায় (এরেতস ইসরায়েল)।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত তুরস্ক শক্তি বিদায় নিলে লিগ অফ নেশন্স ব্রিটিশ সরকারকে ম্যানডেট দিলেন এ জমিদারি দেখাশোনার। পরের চার দশক ঘটনা বহুল। ইউরোপে মহা গনসংহার চলল দুর্নিবার। প্রাণ বাঁচিয়ে আরও অনেক ইহুদি এলেন প্যালেস্টাইনে।
পনটিউস পাইলেটের দু হাজার বছর বাদে তাঁরই সুরে ইংরেজ বলল, প্যালেস্টাইন নামক দেশটির বিষয়ে আমরা হাত ধুয়ে ফেললাম। আয়ারল্যান্ড আর ভারতবর্ষের মতো কোন অধিকৃত দেশ ছাড়ার আগে তাকে ভাগ করার চিরাচরিত অভ্যাস অনুযায়ী ইংরেজ প্যালেস্টাইনকে তিন টুকরো করে স্বস্থানে প্রস্থান করল। এক অংশ পেলো জর্ডান, এক অংশ মিশর আর বাকিটা হল ইজরায়েল। দু হাজার বছর বাদে আপন দেশ পেলেন ইহুদি আর বিগত হাজার বছর যারা এ ভূমিতে বাস করতেন তাঁরা ঘর ছাড়া হলেন।
প্রসঙ্গত, আমাদের যুবা বয়েসে শোনা রিভারস অফ বাবিলন গানটি কারো কারো মনে থাকতে পারে, যার প্রথম স্তবক -
বাই দি রিভার্স অফ বাবিলন দেয়ার উই স্যাট ডাঊন
ইয়া, উই ওয়েপট, হোয়েন উই রিমেমবারড জায়ন।
বাবিলনে নির্বাসনের মধ্যে ইহুদি স্মরণ করেন সেই জায়ন পাহাড়কে। বোনি এম নামক জামাইকান গ্রুপের এই গানের নিহিত দুঃখটি অবশ্য দাসত্বের, সর্বত্র।
ষাট লক্ষ ইহুদি নিধনের পরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে বিধ্বস্ত ইউরোপে একটা সামগ্রিক অপরাধ বোধ মাথা চাড়া দিলো। মনে যাই থাক না কেন, প্রকাশ্যে ইহুদিকে দু ঘা দেওয়া দূরের কথা, কোন অসেমিতিক মন্তব্য অবধি করা যাবে না। আমেরিকা তার দ্বার খুলে দিয়েছে। পূর্ব ইউরোপ ধরেছে ইহুদি বেচার বিজনেস।
ভীত সন্ত্রস্ত যে জনসমষ্টি ইউরোপের এক দেশ থেকে অন্য দেশে ফুটবলের মত নিক্ষিপ্ত নির্যাতিত নিহত হয়েছে তারা খুঁজে পেল কেবল আপন বাসভূমি নয়, পেলো একটি কণ্ঠ, আত্ম চেতনা, আত্ম গৌরব, আত্ম বিশ্বাস।
এবং আপন কৌতুক !
ইহুদি রসিকতার রঙ বদলের দিন শুরু।
সিটি ব্যাঙ্ক লন্ডনে আমার এক ইহুদি কর্তা ছিলেন। তিনি বোস্টন শহরের মানুষ। বেনের ( বেঞ্জামিন) ব্যবহার, আচার, আচরন, ভাষা সবই ছিল অসম্ভব উঁচু মাপের। তাঁর মত পরিশীলিত ভদ্র মানুষ জীবনে কম দেখেছি। মনে প্রাণে নিউ ইয়রকারদের অপছন্দ করতেন। বেন বলতেন নিউ ইয়র্কের মানুষ অসভ্য, তাদের উচ্চারণ বর্বর সুলভ। এরা সকালবেলা তোমাকে শুধু ‘হেলো ‘ বলেই তোমার সারা দিনটা খারাপ করে দিতে পারে ! মানুষ সেখানে টাকার পেছনে ছুটছে জানি, কিন্তু সেটা কোন সঙ্গত অজুহাত নয়। ভদ্রতার প্রকাশের জন্য সময় লাগে না, লাগে মন। নিউ ইয়রকারদের রুঢ় আচরণের যে সম্যক পরিচিতি আছে সেই তালিকায় সমদোষী সাব্যস্ত করতেন সেখানকার বিশাল ইহুদি জন সমাবেশকে (আজকের তেল আভিভের সঙ্গে জেরুসালেমের জনসংখ্যা যোগ করলে যা হয় তার চেয়ে বেশি ইহুদি মানুষের বাস নিউ ইয়র্কে- বারো লক্ষ) !
‘ইহুদি রসিকতার চর্চা আমেরিকায় আছে, কিন্তু সেটা পুরনো দিনের গাল গল্প (ওল্ড পিপলস টেলস) মাত্র। দুর্বলের কাছে রসিকতার একদিন যে মূল্য ছিল সেটা এদের বোঝাবে কে? এদের কৌতুকের চেহারা আজ বদলেছে বটে তবে তার ধার হয়তো কমে নি! ‘
বাঁকুড়া, বরিশাল হোক আর বার্লিন কি বের্ণ হোক, ভাষা বা শব্দ ব্যবহারের পবিত্রতা রক্ষার দায়িত্ব সেই জনগণের ওপরে বর্তায় না। অস্ট্রিয়ান পাবকে বলে বাইসল। জার্মান তাকে চেনে সম্পূর্ণ অন্য নামে ( Kneipe) । আজকের ফরাসি ভাষায় উইক এন্ড বা বিজনেস অনায়াসে ঢুকে পড়েছে (বিশ বছর আগে একজন ফরাসি সি ই ও তাঁর বক্তৃতায় বিজনেস শব্দ ব্যবহার করায় ক্রুদ্ধ রাষ্ট্রপতি শাক শিরাক দ্রুতবেগে সে সভাস্থল পরিত্যাগ করেন)।
জর্জ বারনারড শ বলেছিলেন ব্রিটেন এবং আমেরিকা এই দুটি দেশ একই ভাষার দ্বারা বিভক্ত (টু কান্ট্রিস ডিভাইডেড বাই এ কমন ল্যাঙ্গুয়েজ) । এই বিভাজনের ব্যাখ্যা আমেরিকার অভিবাসনের ইতিহাসে নিহিত। ১৫২০ সালে মে ফ্লাওয়ার জাহাজ যাদের নিয়ে আমেরিকার পূর্ব তটে পৌঁছুল, তাঁরা সবাই ইটন বিদ্যালয়ে পড়াশোনা না করে থাকলেও মোটামুটি ইংরেজি বলতেন। পরের কয়েকশ বছর ইউরোপ থেকে যারা এলেন তাঁদের মধ্যে কেবল আইরিশদের মাতৃভাষা ছিল ইংরেজি (কেন যে আমেরিকার কথিত ইংরেজি আইরিশ উচ্চারণের উপর আধারিত হল জানি না। এঁদের বৃহত্তর দলটি আসতে শুরু করেন দেরীতে, আলু দুর্ভিক্ষের পরে, উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি)।
ইতালিয়ান, ডাচ বা পোলিশ আমেরিকার পথে ঘাটে যে ভাষায় কথা বললেন সেটা তাঁরা ইউরোপ থেকে শিখে আসেন নি। প্রাশিয়ান রাজাদের ঠেলায় নিজের দেশ হারিয়ে উনবিংশ শতকে যে বিশাল পোলিশ জনতা আমেরিকায় আসেন তাঁরা মধ্য পশ্চিম ( মিড ওয়েস্ট) অঞ্চলে কষাই খানা, খনি ও গৃহ নির্মাণ ব্যবসায় জীবিকার সন্ধান করেছেন – সেখানে সহকর্মীর সঙ্গে বাক্যালাপের প্রয়োজন সামান্য। কোন মিটিং বা কনফারেন্সে আপন ডিল উপস্থাপিত করতে হয় না। ইলিনয় ( শিকাগো), উইসকনসিনে পোলিশ বংশোদ্ভূত আমেরিকানের সংখ্যা আজ তাই সবচেয়ে বেশি। সেই একই কারণে মধ্য পশ্চিম অঞ্চলে এসেছেন অজস্র জার্মান অভিবাসী।
আমাদের অল্প বয়েসে দেখা প্রিন্স অ্যান্ড দি শোগার্ল ছবিতে একজনকে জার্মান ভাষায় ফোনে চক্রান্তের কথা বলতে শুনে মেরিলিন মনরো সেটা ধরে ফেলেন। তাঁকে বলেন, ‘জার্মান জানি। আমি মিলওয়কির মেয়ে ‘। আজকের বৃহত্তর মিলওয়কি শহরের ৭০% মানুষ জার্মান বংশোদ্ভূত।
কলকাতার বাঙালি দোকানদার যখন চিৎপুরের ফুটপাথে দাঁড়িয়ে বিলিতি খদ্দের ধরার আগ্রহে বলেছেন ‘সায়েব, টেক টেক, নো টেক নো টেক, একবার তো সি’, ঠিক সেই সময় আমেরিকার পথে ঘাটে একই প্রকারের বার্তা বিনিময় হয়েছে মেঠো ইংরেজিতে। সুযোগ বুঝে বিভিন্ন ইউরোপীয় তাঁদের আপন ভাষার শব্দও কানে শোনা ইংরেজিতে গুঁজে দিয়েছেন। উদাহরণ অজস্র। নিউ আমস্টারডাম (আজকের নিউ ইয়র্ক) শহরের বাসিন্দা ডাচ দিয়েছে ক্যান্ডি, কুকি, ক্রেন এমনকি বস (বাস থেকে)। আমেরিকান অভিব্যক্তি হাও কাম এসেছে ডাচ হো কম থেকে। রেপ্লিকা, গ্রাফিতি ইতালিয়ান শব্দ। মাচো, ল্যাসো, টরনাডো, ক্যানিয়ন স্প্যানিশ শব্দ।
উনবিংশ শতাব্দীর শেষ দশকে ইহুদিরা আসতে শুরু করলেন, মূলত মধ্য ও পূর্ব ইউরোপ থেকে। ডাচ বা ইতালিয়ানের মতো তাঁরাও আনলেন অপরিচিত শব্দের সম্ভার পরিচিত জনতার সরণিতে। সেটি হিব্রু নয়।
তাঁরা আমেরিকাকে দিলেন ইদিশ!
জন সংখ্যার অনুপাতে আমেরিকান ফিল্ম, টেলিভিশন, সঙ্গীত জগতে ইহুদিদের ভূমিকা খুবই বড়ো। প্যারামাউনট স্টুডিওর প্রতিষ্ঠাতা হাঙ্গেরিয়ান ইহুদি অ্যাডলফ যুকর, জার্মান ইহুদি কার্ল লেমেলে বানান ইউনিভারসাল। পোলিশ ইহুদি শ্মুএল গেলবফিশ ( নাম বদলে স্যামুএল গোল্ডউইন), রাশিয়ান ইহুদি লুইস মায়ার এবং মারকাস লো একত্র হলেন একটি পতাকার তলায়। সেখানে একটি সিংহ ঘাড় ঘুরিয়ে গর্জন করে –মেট্রো গোল্ডউইন মায়ার বা এম জি এম ! এঁরা সকলেই বাড়িতে ইদিশ বলেছেন। যেমন বলেছেন অভিনেতা জগতের কিংবদন্তী স্বরূপ ডগলাস ফেয়ারব্যাঙ্কস, মে ওয়েস্ট, গ্রাউচো চিকো হারপো মার্কস থেকে কার্ক ডগলাস ( ইয়েসুর ড্যানিয়েলোভিতস) , ড্যানি কে (ড্যানিয়েল কামিন্সকি) , হেডি ল্যামার (হেডউইগ কিসলের) এবং আরও অনেকে।
আলাবামার তুলো বিক্রেতা দুই ভাই ইমানুয়েল এবং মায়ার লেমান ( পরে লেমান ব্রাদারস), নিউ ইয়র্কের ব্যবসায়ী মারকুস গোল্ডমান ও জামাতা সামুয়েল জাকস ( পরে গোল্ডমান জাকস) জার্মান ইহুদি। পোলিশ ইহুদি খাইম সলোমনের বংশধর স্থাপনা করলেন সলোমন ব্রাদারস। জন পিয়েরপনট মরগানের মত কয়েকজন বাদে নিউ ইয়র্কের ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্কিঙ্গের প্রতিষ্ঠাতারা প্রায় সকলে বাড়িতে ইদিশ বলেছেন।
যে আমেরিকান ইংরেজিকে জর্জ বারনারড শ বিদ্রূপ করেছেন সেটি গড়ে ওঠে এক বৃহৎ মেলটিং পটের ভেতরে, আপন প্রয়োজনে। অক্সফোরড সংক্ষিপ্ত অভিধান বা কেম্ব্রিজের আওতার বাইরে।
নিউ ইয়র্ক বা হলিউডের ছবিতে যে ইংরেজির সঙ্গে আমরা পরিচিত সেখানে পাই এমন অজস্র শব্দ যার শেকড়টি ইদিশে সেঁধিয়ে আছে। আমেরিকান ইংরেজিকে ইদিশ শুধু সমার্থক শব্দ বা প্রতিশব্দ দেয় নি। একই শব্দের বিভিন্ন অর্থের প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেছে। আরও মজার কথা এই যে ইতিমধ্যে আমেরিকায় আগত এবং স্থিত জার্মানরা অবাক বিস্ময়ে তাঁদের চেনা শব্দের অন্য অর্থ খুঁজে পেলেন ইদিশের মাধ্যমে!
তেরশোর বেশি এমন শব্দ সেখানে ব্যবহৃত হয় যার সূত্র ইদিশ। এই স্বল্প পরিসরে বাগাড়ম্বর না করে সুযোগ পেলে স্বতন্ত্র ভাবে এ নিয়ে কোথাও লেখার বাসনা আছে।
আপনারা সবাই চেনেন এমন সামান্য কয়েকটি আমেরিকান ইদিশ/ ইংরেজি শব্দের নমুনা দিই।
কোশার ( হিব্রু –আক্ষরিক অর্থে খাবার উপযুক্ত, ধার্মিক আইনসম্মত) – এ শব্দটির আমেরিকান প্রয়োগ বহুবিধ।
শুধু নিউ ইয়র্ক নয়, লন্ডনের বাজারেও ব্যাঙ্কের কর্তা জিজ্ঞেস করছেন - ইজ দিস ডিল কোশার? এখানে সব ঠিক আইন কানুন মানা হয়েছে তো?
খদ্দেরটি কেমন? ইজ হি কোশার – ইনি কি বিশ্বাসযোগ্য?
বড়ো সায়েব এ ডিলে রাজি আছেন। তিনি বলেছেন ইট লুকস কোশার টু মি।
~~~
শ্লেপ –( মূল জার্মান - শ্লেপেন : টানা, বওয়া) ।
ডোন্ট শ্লেপ। লেট দি শপ সেন্ড দি প্যাকেজ টু ইউ – তুমি বইবে কেন দোকানদার পাঠাক।
হি শ্লেপড মি টু সি হিজ হাউস - তার বাড়ি দেখাতে টেনে নিয়ে গেল।
ইফ ইউ শ্লেপ লাইক দিস, ডিল উইল নেভার গেট ডান-
এমন দোনামনা করলে ডিলটা আর হবে না।
~~~
ককামামি ( উৎস অজ্ঞাত – অবিশ্বাস্য, আজগুবি)
নেভার হার্ড সাচ এ ককামামি স্টোরি -এমন আজগুবি গল্প কখনো শুনিনি।
এ রিয়াল ককামামি এক্সকিউজ – আষাঢ়ে অজুহাত।
~~~
স্টিক ( জার্মান স্টুক – পিস, টুকরো, অংশ)
গিভ হিম এ স্টিক কেক – ওকে এক টুকরো কেক দাও ( কখনো ‘ স্টিক অফ কেক’ নয়। ঠিক যেমন জার্মানে আইন স্টুক কুখেন, আইন স্টুক ফন কুখেন নয়)
ইউ ফেল ফর দ্যাট স্টিক- তার চাতুরীতে ভুলে গেলে?
হি মেড আস লাফ উইথ হিস স্টিক- তাঁর মজায় আমাদের হাসালেন (অভিনয় অর্থে)
~~~
গ্লিচ ( জার্মান – গ্লিচেন, পিছলে যাওয়া। ইদিশে ব্যাপক অর্থে সমস্যা, গণ্ডগোল)
বি কেয়ারফুল, দেয়ার মে বি এ গ্লিচ ইন দিস মডেল। সাবধান, এই মডেলে কিছু গোলমাল থাকতে পারে।
দি সিস্টেম হ্যাজ এ গ্লিচ – কোনকিছু কাজ না করলেই কম্পিউটার মেরামতির মিস্ত্রির কাছে এটি শুনতে আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি।
~~~
ডেলি : জার্মান ডেলিকাট( উপাদেয়) + এসেন ( খাবার) । এসেন ক্লীব লিঙ্গ অতএব সমাসবদ্ধ হয়ে ডেলিকাটেসএসেন। জার্মান তার সংক্ষিপ্ত রূপ দিয়েছিল ডেলিকাটেসেন। সেটিকে ছেঁটে ইদিশ বানাল ‘ডেলি’- নিউ ইয়র্কের পথে ঘাটে পাবেন।
~~~
দ্রেক ( জার্মান দ্রেক -রাবিশ, ধুলো, তলানি। ইদিশ বাজে, অপদার্থ)
ইউ সোলড মি এ দ্রেক ! একটা বাজে মাল আমাকে বেচেছো !
~~~
শ্মুজ ( জার্মান শ্মুজেন, আদর। ইদিশ ভাব ভালবাসা, মিষ্টি কথা)
দে হ্যাড এ স্মুজ অ্যান্ড সেটলড এভরিথিং -তারা মিষ্টি কথা বার্তায় ব্যাপারটা মিটিয়ে নিয়েছে।
ডোন্ট শ্মুজ মি। হোয়াট ডু ইউ রিয়ালি ওয়ানট – তেল দিও না কি চাও বলো?
~~~
শ্মাক ( জার্মান শ্মুক – গয়না, জহরত। ইদিশে চার অক্ষরের অশ্রাব্য শব্দ নেই। কোন অজ্ঞাত কারণে তারা জার্মান জহরতের যা অর্থ করেছে সেটি অত্যন্ত আপত্তিকর অশ্লীল শব্দ) হি ইজ এ শ্মাক। এর অনুবাদ অবাঞ্ছনীয়।
~~~
হু হা (সূত্র অজ্ঞাত) অভিব্যক্তি ভেদে অর্থ বদলে যায় –
হোয়াটস দিস হু হা ফর? কি ঘটনা কি রটনা?
~~~
মেনশ ( জার্মান মেনশ :মানুষ। ইদিশে সত্যিকারের, খাঁটি মানুষ) – মা ছেলেকে বলেন, বি এ মেনশ – ঠিক মানুষ হও!
ইহুদি বেয়াই আমাকে বলেছিলেন, আপনার ছেলে ইন্দ্রনীল ইজ এ মেনশ !
~~~
খুতসপা ( হিব্রু/ আরামাইক - ঔদ্ধত্ব, আস্পর্ধা) । উদাহরণ
রেস্তোরাঁয় গ্রুন। পাশ দিয়ে ওয়েটার হেঁট যাচ্ছে।
গ্রুন : কটা বাজে?
ওয়েটার : আপনি আমার টেবিলে বসেন নি।
অথবা
রেস্তরাঁয় রেচেল।
রেচেল আপনাদের রান্না কিছু আহা মরি নয়। আমি এর চেয়ে ভালো মাছের রান্না খেয়েছি।
ওয়েটার আমাদের রেস্তরাঁয় নয়।
কখন, কোন পরিস্থিতিতে কেউ ‘অয়’ বা ‘অয় ভে’ বলেন তার ফিরিস্তি দীর্ঘ। আপনার পরিচিত যে কোন ইহুদিকে জিজ্ঞেস করে দেখুন।
লন্ডনের বেকার স্ট্রিটে রুবেন্স রেস্তোরাঁ নামের একটা কোশার ভোজনালয় আছে। আমার ইহুদি আইনজীবী বন্ধু জেফ্রি (আমার সঙ্কলনে তার অবদান বিশাল) সেখানে তার স্ত্রী ইভেলিনকে নিয়ে ডিনারে গেছে। ইভেলিনকে চিনি অনেক দিন। দারুণ ছবি তোলে। তার মেয়ে মেলিসার লোকাল গার্জিয়ান ছিলাম কিছুকাল। মেলিসার বয়েস তখন পঁচিশ ! ইভেলিনকে ঠাট্টা করে বলি তুমি টিপিকাল ইহুদি মাতা !
খাওয়ার পরে ইভেলিন অর্ডার করেছে মিল ফ্লয়ে ( হাজার ফুল) । সেটা দুধ ময়দা দিয়ে নানান স্তরে সাজানো মিষ্টি একটা পেসট্রি তার মধ্যে ভানিলা দেওয়া থাকে। পেসট্রি অনেকগুলি স্তরে বন্টিত হয় বলে গৌরবার্থে এর নাম হাজার ফুল। ওয়েটার যা নিয়ে এসেছে সেটি দেখে ইভেলিন ভয়ানক খাপ্পা – একটা প্লেটে একটা পাতলা পেসট্রি, তার ওপরে কিছুটা ভানিলা ছড়ানো। ইভেলিন বললে তুমি মিল ফ্লুয়ে মানে বোঝো? হাজার ফুল ! হাজার কখনো দেওয়া হয় না জানি, কিন্তু একাধিক স্তরে এটা তৈরি হয়! যাও গিয়ে শেফের কাছ থেকে জেনে এসো।
খানিক বাদে ওয়েটার ফিরে এসেছে। প্লেটে ময়দার পেসট্রি – দুটো অতি ক্ষীণ স্তর, তার ওপরে ভানিলা। ওয়েটার বললে ‘ শেফ বললেন আপনার কথা ঠিক মাদাম। মিল ফ্লয়ে মানে হাজার ফুল কিন্তু সেটা তো দেওয়া সম্ভব নয়। দেখুন ওই একই পেসট্রি কেটে দুটো স্তরে সাজিয়ে এনেছি, মানে একের বেশি’।
খুতসপা আর কাকে বলে !
জেফ্রি বললে এই অবস্থায় বাক্যব্যয় নিরর্থক। তবে ফেরার পথে ক্রুদ্ধ ইভেলিন বলেছে জেফ্রি যেন তাকে আর কখনো কোশার রেস্তোরাঁয় নিয়ে যাবার নির্বুদ্ধিতা না করে।
যে কৌতুক একদিন ইউরোপীয় সমাজের নিচের তলার অধিবাসী দুর্বল ইহুদিকে দিয়েছিল ভাগ্যকে পরিহাসের অস্ত্র, তার চেহারা আজ বদলেছে ! সমানে সমানে! শঠে শাঠং !