
ইজরায়েলে প্রথমবার ইজরায়েল যাই ১৯৯১ সালে, ব্রিটিশ সরকারের একটি বাণিজ্যিক ডেলিগেশানে সিটি ব্যাংকের প্রতিনিধি রূপে। আমাদের নেতৃত্ব দেন তৎকালীন ট্রেড সেক্রেটারি টিম সেইনসবেরি। সঙ্গে ছিলেন আমাদের পাড়ার এম পি জন মার্শাল।
যদিও সিটি একটি আমেরিকান ব্যাঙ্ক, লন্ডন শহরে বসে ব্যবসা বাণিজ্য করার সুবাদে মহারানির সরকার মাঝে সাঝে আমাদের ব্রিটিশ বলে বিবেচনা করতেন। তাই কোটের লেপেলে ইউনিয়ন জ্যাকের তকমা লাগিয়ে সে দেশের প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ হয়েছে !
সিটি ব্যাঙ্ক প্রায় বিশ্বময় ছড়িয়ে গেছে ততদিনে কিন্তু ইজরায়েলে কোন শাখা তখনো খোলা হয় নি। আমাদের কাজকর্ম শুধু ইজরায়েলি ব্যাংকের সঙ্গে। সরাসরি কর্পোরেট ব্যবসায় আমরা হাত দিই না। সেটি করলে স্থানীয় ব্যাঙ্কের পকেটে টান পড়বে। মিজরাহি, ইজরায়েল ডিসকাউনট, ব্যাংক মেলি এবং ব্যাংক লেউমি এই চারটে আমাদের প্রধান খদ্দের। এদের প্রত্যেকের লন্ডন শাখা ছিল। সেই সূত্রে এমন অনেককে চিনতাম যারা স্বল্প সময়ের জন্যে অনেকে লন্ডন এসেছেন তারপর ফিরে গেছেন ইজরায়েলে। তেল আভিভ আসছি জেনে কেউ কেউ আপ্যায়নের জন্য উদগ্রীব হলেন।
আজকের পয়লা গল্পটি শুনি ব্যাঙ্ক লেউমির ইলান শফিরের কাছে।
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতাকা ততদিনে নিম্নগামী। কিঞ্চিত রজত মুদ্রা প্রদানে পূর্ব ইউরোপের ইহুদিদের ইজরায়েল আসার অনুমতি মেলে।। অনেকেই আসছেন। ইহুদি রাষ্ট্র ইজরায়েল তার সংবিধান অনুযায়ী দীন দুনিয়ার সমস্ত ইহুদিকে তাদের প্রতিশ্রুত দেশে রোটি কাপড়া মকান এবং ইজরায়েলি নাগরিকত্ব দিতে বাধ্য ( ইহুদিয়ানা প্রমাণ হয় মায়ের পরিচয়ে)। ছোট দেশ। বাস স্থান অপ্রতুল। কিন্তু সেটি জোগাড় করে দেওয়া সরকারের জিম্মেদারি।
কাজান থেকে সদ্য আগত একটি রাশিয়ান পরিবারকে তুলে দেয়া হয়েছে তেল আভিভের উত্তরে হারজলিয়া (ইজরায়েলের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা থিওডোর হারজলের নামাঙ্কিত) শহরের মেয়রের হাতে। তিনি সেই পরিবারকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছেন সম্ভাব্য বাসস্থান দেখাতে। নবাগত মানুষদের বেছে নিতে হবে কোনটা তাদের পছন্দ। বাকি কাজটা মেয়র মশায় করে দেবেন। মেয়র তাঁদের একটা ফ্ল্যাট দেখান, দুটো দেখান কিন্তু সে রাশিয়ান মানুষটি হ্যাঁ না কিছুই বলেন না। মেয়র ভাবলেন এরা হয়তো হিব্রু ভালো বোঝে না। তাই অসুবিধে হচ্ছে জবাব দিতে। অফিসে ফোন করে রাশিয়ান জানে এমন একজনকে আনালেন। সে নবাগত ইহুদিকে সেই একই প্রশ্ন করলঃ কোন ফ্ল্যাট তোমার পছন্দ? সেটা মেয়রকে বলো।
এবার রাশিয়ান ভদ্রলোক মুখ খুললেন। চলনসই হিব্রুতে বললেন, আপনারা আমাদের বলে দিন কোন ফ্ল্যাটটা আমাদের জন্য নির্দিষ্ট, কোনটা আমাদের দেবেন। আমাকে পছন্দ করতে বলবেন না। রাশিয়াতে আমাদের কেউ কখনও জিজ্ঞেস করে নি আমরা কি বা কোনটা চাই।
গল্প শেষ করে ইলান বললেন আপনি আমি অর্থনীতির বইতে থিওরি অফ চয়েস পড়েছি কিন্তু কমিউনিজমের এই দিকটার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা আমার এই প্রথম। ।
গত তিন দশকে একাধিকবার ইজরায়েলে গিয়েছি, বেশির ভাগ কাজে। ব্রাঞ্চ খোলা হয় দু হাজার সালে। প্রথম ব্রাঞ্চ ম্যানেজার ভারতীয়, নন্দন মার (ইহুদি নন) । ব্যবসায়িক ভ্রমনের দিন ফুরিয়েছে এখন। সম্প্রতি মায়াকে জেরুসালেমে নিয়ে যাই ইস্টার এবং পাস ওভার পরব দেখাতে। দুনিয়ার লোক জড়ো হয় যিশুর শেষ যাত্রা পথে।
অনেক কিছু বদলে যেতে দেখলাম। নয়ের দশকে জেরুসালেম থেকে বেথলেহেম বা বেথানি (শেষ বারের মত জেরুসালেম আসার আগের রাতটি সেখানে কাটান যিশু) অথবা তেল আভিভ থেকে হাইফা, সেখান থেকে বাস বদলে নাজারেথ যাওয়া যেতো সহজেই। কখনো কোথাও পাসপোর্ট দেখাতে হতো না। প্যালেস্টাইন আর ইজরায়েল যে দুটো আলাদা দেশ তা সব সময় বোঝা যেত না। ইহুদি ধর্মের পবিত্রতম স্থান সলোমনের ভগ্ন মন্দিরের প্রাচীরের (ওয়েলিং ওয়াল) পাশ দিয়ে ভারা বাঁধার মত সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেছি টেম্পল মাউন্টে, স্বর্ণ মণ্ডিত ডোম অফ দি রক চত্বরে। সেটি ইসলামের দ্বিতীয় পবিত্রতম ভূমি। তারপর মুসলিম মহল্লা দিয়ে চলে গেছি গলগথা- যেখানে যিশুকে ক্রুশ বিদ্ধ করা হয়। ফিরে এসে লোককে বলেছি একবার জেরুসালেমে যাও – দুই কিলো মিটারের মধ্যে তিনটি মহান ধর্মের ছায়া মিলে মিশে একাকার হয়ে আছে।
এখন সেটি সম্পূর্ণ অসম্ভব।
এবার মায়াকে নিয়ে বেথলেহেম যেতে পার হতে হয়েছে কাঁটা তারের বেড়া, সুড়ঙ্গের মতো সীমান্ত। বারে বারে প্রমাণ করতে হয়েছে আমাদের পরিচিতি। ডোম অফ দি রকে যাওয়া অসম্ভব – অনেক জায়গা থেকে অনুমতি নিতে হয়। পদে পদে প্রহরী।
গত বছরে ইন্দ্রনীল কিছুদিনের জন্য ইংরেজি পড়িয়েছে হেব্রনে – সেটি প্যালেস্টাইনে। ব্রিটিশ পাসপোর্টের কল্যাণে তার আপন গতিবিধি ছিল অবাধ। সে বাসে চড়ে অনায়াসে জেরুসালেম যেতে পারে কিন্তু তার ছাত্র ছাত্রীরা পারে না। তার গায়ের রং দেখে যেখানে সেখানে ইজরায়েলি রক্ষীরা জানতে চেয়েছে পরিচয়। কোন গাড়ি কোন পথে যেতে পারে, কোন এলাকায় যেতে পারে তার হাজার কড়া কড়ি। খোলা আকাশের নিচে এক বিশাল বন্দিশালা।
বিভিন্ন সময়ে আমরা তিনজনেই ফিরে এসেছি এক বিভাজিত অধিকৃত দেশের বেদনাময় স্মৃতি নিয়ে।
তথ্যের খাতিরে মনে রাখা প্রয়োজন পৃথিবীতে ইহুদির সংখ্যা দেড় কোটি। তাঁদের অর্ধেকের বেশি থাকেন আমেরিকায়। তিরিশ শতাংশের বাস ইজরায়েলে। ইজরায়েল এবং ইহুদি সমার্থক নয়।
তবে ইজরায়েলে জুতো আজ অন্য পায়ে। এককালের ইউরোপের সর্বত্র নিপীড়িত নির্যাতিত অনেক ইহুদি পেয়েছে আজ আপন দেশ আর আপন দেশে পরবাসী হয়েছে প্যালেস্টাইনের সকল আরব।
দেখেছি যা হল, যা হয়েছে। জানি না কোন পথে আলো জ্বেলে পৃথিবীর ক্রম মুক্তি হবে। সে নিশ্চয় অনেক শতাব্দীর, অনেক মনিষীর কাজ।
তবুও তো প্যাঁচা জাগে !
আজকের ইজরায়েলি জীবনে সেই প্রতিকূল পরিবেশ নেই। রসিকতার রূপ বদলেছে। হারায়নি সূক্ষ্ম তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গ কৌতুক।
guru | 103.2.***.*** | ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২১ ২০:১৯498337
:|: | 174.255.***.*** | ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২১ ০৫:০২498353
হীরেন সিংহরায় | ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২১ ১২:০৫498368
হীরেন সিংহরায় | ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২১ ১২:০৯498369
রমিত | 202.8.***.*** | ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২১ ২২:০৫498411