
-চাড্ডি উতারো…
লোকটা কুতকুতে চোখে আমনদীপের দিকে তাকায়। আঙুল তোলে ওর কোমরের দিকে। ছেলেটা তবু ইতস্তত করছে দেখে দাঁত পেষে,
- শালে, সুনা হ্যায় কি নেই?
ওই বাজখাঁই গলা না শুনে পারা যায়! কিন্তু বাল্যাবস্থা পেরোবার পর এই উনিশ বছর বয়স অবধি কারও সামনে পুরো নাঙ্গা হয়নি আমন। গ্রামে সমবয়সিদের সঙ্গে নদীতে সাঁতার কাটার সময়ও তার পরনে জাঙ্গিয়া আর মাথার ওপর চূড়ো করা কেশ কাপড়ে ঢাকা থাকত।
তীব্র অস্বস্তিতে সে কয়েক পা পিছিয়ে যায়! আরও জঘন্য খিস্তিখাস্তা বুলেটের মতো তার দিকে ধেয়ে আসে।
আমনদীপ জানে, এখানকার সমস্ত গ্রামগুলোতে যারা উচ্চশিক্ষার বিপুল খরচ যোগাতে পারে না, খেতিবাড়ির কাজ শেখার সঙ্গে সঙ্গে তাদের কাছে আর তিনটে পথ খোলা থাকে–
বড় হলে আর্মিতে জয়েন করা, ড্রাইভারি, নয়ত টাকা কামাবার জন্য বিদেশ যাওয়া।
তা শেষেরটা তো এখন প্রায় বন্ধ। এজেন্টকে প্রচুর টাকা দিয়ে যারা ভিনদেশি সীমান্ত পেরিয়েছিল, তাদের হাতে পায়ে শেকল পরিয়ে প্লেনে তোলার দৃশ্য গায়ের রক্ত ঠান্ডা করে দিয়েছে।
ড্রাইভারির কথা সে আর কী বলবে! যত লোক ড্রাইভিং জানে, তত গাড়ি আছে নাকি এই জেলায়! নেই। তাহলে পড়ে রইল শুধু দেশের জন্য জান কবুল করা।
কিন্তু এখন বাপ দাদার আমল পালটে গেছে। পুরোদস্তুর সোলজার নয়, লোকে এখন অগ্নিবীর বনতে পারে। চারা সালা দা সিপাহি, চার বছরের সেপাই। পাঁচ বছরে পা দিয়ে ঘরে ফিরে বসে গেলে দেশ কেন, নিজের বৌ-ও দেখবে কিনা সন্দেহ। তবু আর উপায় না দেখে আমনদীপ ঠিক করল সে অগ্নিবীরই হবে। যাই হোক না কেন বীর শব্দটা তো আছে পেছনে। ওটার আকর্ষণ তার বয়সী শিখ সর্দারের কাছে অমোঘ। আর হাত একেবারে খালি থাকার চাইতে, কিছু তো থাকা ভালো।
ফলে ফিটনেস এবং মেডিক্যাল, দুই পরীক্ষার জন্যই পাগড়ি বেঁধে আমনদীপ ভাতিন্ডায় হাজির হল। ঝাঁপাঝাপি, দড়ি বাওয়া, ওপর থেকে লাফ দেওয়া, গর্ত পেরনো, ইত্যাদি শেষ হলে তাদের বলা হল, আজ খুব রোদ। এই গরমে দৌড়ে গতবার এক ক্যান্ডিডেটের মৃত্যু হওয়ায় সারা দেশে সাংঘাতিক তোলপাড় হয়েছিল। তাই বেলা একটু পড়লে, সূর্য আর শতলুজের ঢেউয়ের মধ্যেকার ফারাক কমে এলে, তবে পাঁচ মিনিটে দু কিলোমিটার এক নাগাড়ে দৌড় করানো হবে ভবিষ্যতের অগ্নিবীরদের। তার আগে বরং মেডিকাল চেক আপটা হয়ে যাক। কোনও অসুবিধে নেই তাতে। এই পশ্চিমের ভূখণ্ডে সূর্য ঠিকমতো অস্ত যেতে যেতে সন্ধে সাতটা।
এইবার তাকে যে পুরো নাঙ্গা হতে হবে আমন জানত। গ্রামেই শুনেছিল। কিন্তু জানা আর জানার প্রত্যক্ষতা, দুটো কি এক জিনিস! লোকটা তার অন্ডকোষ জোরে চেপে ধরে তাকে কাশতে বলল, মলদ্বার টিপে টুপে আঙুল দিয়ে ছড়িয়ে ভেতরে দেখল কোনও ঘা, ফিশ্চুলা, অর্শ আছে কিনা। লিঙ্গের মুখে কোনও পুঁজরক্ত জমে আছে কিনা গ্লাভস পরা হাতে তুলে দেখল। তারপর তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে কাঁধে ঠেলা মেরে হাঁকল, নেক্সট।
আমন দাঁত চেপে সব সহ্য করল। সে কাঁপছিল, সিঁটিয়ে যাচ্ছিল, লোকটার গালিগালাজের ঠেলায় আবার শরীরটাকে আলগা করে দিচ্ছিল। তার গোপনতম জায়গায় বিষাক্ত বিছে হাঁটছে মনে হলেই, গুরু নানকজিকে প্রাণপণে ডাকছিল সে। বিড় বিড় করে উচ্চারণ করছিল গুরবাণী। পরীক্ষানিরীক্ষা শেষ হলে প্যান্ট পরবার সময় আমন কিছুটা টলছিল, মনে হচ্ছিল, তার ওপর কেউ জবরদস্তি করেছে। কিন্তু চার বছর আর্মিতে থেকে সে কিছু টাকা জমিয়ে নিজের গাঁও-এ আটাচাক্কি খুলতে চায়। এই তার অনেকদিনের আশা। এখন তো এ দুনিয়ায় তাকে সাহায্য করবার মতো কেউই নেই। এ যাবৎ ছিল একজনই, কিন্তু গত পরশু তার হঠাৎ মৃত্যু হয়েছে।
সে তার মেসো, অমরজিৎ সিং।
অমরজিতের কাছেই মানুষ হয়েছে বাপ মা মরা আমনদীপ। এই বিশাল দুনিয়ায় তারা দুজনেই ছিল একা। দুজনেই ছিল বদনসিব! আমনের বাপ মা-কে বাজপাখির মতো ছোঁ মেরে তুলে নিয়েছিল মৃত্যু, তরুণ বাপ বিনা নোটিশে হঠাৎ হার্টফেল করতেই, দুঘন্টা বাদে শোকসিন্ধুতে ভেসে মা-ও চলে গেল। সতীসাধ্বী নাম ছড়িয়ে পড়তে, শোনা যায়, স্থানীয় গুরুদ্বারের শ্রদ্ধেয় গ্রন্থিসাহেব স্বয়ং মায়ের মৃতদেহের গলায় মালা দিয়ে গিয়েছিলেন! এই গাঁওয়ে এমন সম্মানের অধিকারী জেনানা খুব কমই আছে। একই চিতায় সৎকার হয়েছিল, শতলুজের ঢেউয়ে একই সঙ্গে ভেসে গিয়েছিল আমনের বাপমায়ের অস্থি।
মাসির কোলে-চড়া শিশু আমন নাকি বার বার হাত বাড়িয়ে মায়ের চৌপায়ার দিকে ঝুঁকে পড়ছিল আর কাঁদছিল। তখন তাকে স্ত্রীর কাছ থেকে নিজের কোলে নেয় অমরজিৎ, আর বাচ্চাটা সঙ্গে সঙ্গে চুপ! হয়ত মৃত বাপের হাতের পেশির ঘামেভেজা স্পর্শ বাচ্চাটার মনে পড়ে গিয়েছিল। হয়ত অমরজিতের শক্তপোক্ত আলিঙ্গনে সে কিছু ভরসা পেয়ে থাকবে।
কিন্তু বেশিদিন টেকেনি তা। দুমাস বাদে মাসিকে ঠিক একই ভাবে খাটিয়ায় চোখ বুজে শুয়ে থাকতে দেখেছিল অবোধ আমনদীপ। কী হয়েছিল, এমনকি ডাক্তাররাও বোঝেনি।
তারপর থেকে অমরজিৎ আর আমনদীপ, মৌসা ভাতিজার সংসার। প্রথমজন দ্বিতীয়জনকে শিখিয়েছে খেতিবাড়ির সব কাজকর্ম, প্রকৃতির কত না-জানা রহস্য, মাটি আর জলতল ছেনে তুলে আনা অদ্ভুত সব ঘটনার বিবরণ! আমন এখন জানে বৈশাখী হল গেঁহু কাটার উৎসব, পূবের হাওয়া সনসন আওয়াজে না ছুটলে সেই গেঁহুর দানার বুকের ভেতর জমে থাকা সাদা দুধ না শুকিয়ে চিটচিটে হতে থাকে। অখাদ্য হয়ে যায়। অথচ মানুষ তো বেঁচে থাকে দুবেলা দুটো রুটিতে পুষ্ট হবে বলেই!
ওইরকম এক উথাল-পাথাল হাওয়ার দিনে ক্ষেতের ধারে দাঁড়িয়ে অমরজিৎ তার পুত্রবৎ-কে বলেছিল,
-শুন বেটা, এ পৃথিবী থেকে একটা জিনিস উধাও হয়ে গেছে। সেটা হল সন্নাটা। নির্জনতা। শুধু এইরকম বাতাসিয়া দিনে সূর্যের আলো পাগড়িতে মেখে গেহুঁ খেতের মাঝখানে এসে দাঁড়াবি, নয়ত শতলুজের ঢেউয়ের তলায় দম না ফাটা অবধি ডুবসাঁতার লাগাবি, দেখবি হারিয়ে যাওয়া পালতু পশুর মতো সন্নাটা ফিরে এসেছে!
সত্যি আমন যখন শতলুজের জলে ডুবসাঁতার কাটে, তখন তীরের বালিতোলা ট্রাকের ঘড়ঘড়, পাখির ডাকাডাকি, সঙ্গীদের চিৎকার, সব মুছে গিয়ে সে ডুবে যায় এক অচেনা নির্জন স্বচ্ছতায়। সেখানে শুধু সে আর বোবা মাছেদের ঝাঁক। আর আছে হরেক জলজ উদ্ভিদ, যারা ঢেউয়ের ঝোঁকে সমস্ত শরীর এমন ভাবে কিলবিলোয়, যেন শেকড়ের টান কাটাতে পারলে সবাই মিলে আমনের সঙ্গে সাঁতারে পাল্লা দিত!
বৈশাখির আগে টিয়া-ওড়া বিকেল নাগাদ গমের সুপুষ্ট দানার খরখরে ভাব ছুঁয়ে আমন বোঝার চেষ্টা করত ফসল কাটার সময় হয়েছে কিনা, হঠাৎ তার চারপাশ অবলুপ্ত হয়ে যেত, নিজেকে মনে হত পৃথিবীর সমস্ত শস্যভান্ডারের সম্রাট! সূর্যের আলো, মাটির নিচেকার জল আর পূবকোণ থেকে বহে আসা হাওয়ার ঝোঁকা নিজেদের মধ্যে কানাকানি করে অনবরত মেতে রয়েছে সৃষ্টির যে আনন্দে, সেই রহস্যের সবটুকু যেন ছেলেটার করায়ত্ত! নিজেকে মনে হত অকাল-পুরুষ, যিনি সৎ অর্থাৎ ধ্রুব, শ্রী অর্থাৎ সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ! চির আনন্দিত এক নিহাল!
হঠাৎ সামনের গুরুদ্বার থেকে ভেসে আসত সঙ্গতের সুর, লজ্জায় জিভ কাটত আমন, এত তার স্পর্ধা, নিজেকে সে কী ভাবে! অস্তমিত সূর্যের বিরাট বুকের ওপর দিয়ে ভেসে চলা পাখির ঝাঁকের দিকে তাকিয়ে সে সভয়ে বিড়বিড় করত, সৎ শ্রী অকাল / যো বোলে সো নিহাল! ওয়াহে গুরু! ওয়াহে গুরু!
অমরজিতের কাছে এই সমস্ত কিছুর জন্য আমনের কৃতজ্ঞতা! তার বিশ্বাস টিব্বা সাহিব গুরুদ্বারের সেবাদার কৃষক অমরজিৎ সিং একজন পুণ্যাত্মা! ভাগ্য করে এমন আত্মীয় পেয়েছে সে, যে তার মনের মধ্যে এইসব বিচিত্র ভাব পুরে দিয়েছে, তাকে শিখিয়েছে সেই মন্ত্র, যার বলে তার মন থেকে থেকেই পূর্ণ হয়ে উপচে ওঠে শুদ্ধতায়!
খেতিবাড়ির শ্রমসাধ্য কাজ শেষ করে আবার গুরুদ্বারে সেবা দিতে যাবার তোড়জোড় করছে দেখে, মেসোকে শুধিয়েছিল আমন, তকলিফ হয় না? দাড়ির ভেতর থেকে হাসি ফোটে, যেন মেঘের আড়াল থেকে রোদ, অমরজিৎ বলে, সবসে বড়া তকলিফ, হাথ মে কাম না হোনা!ত ভেবে দ্যাখ বেটা, দুটো শক্তপোক্ত হাত আছে, অথচ সে হাত দিয়ে করার মতো কাজ নেই দুনিয়ায়, এটা কি সবচেয়ে ভয়ানক না-থাকা নয়? করার যোগ্য কাজ চাই। প্রত্যেকের। নইলে সে বেতাজ বেলড় জীবন দিয়ে মানুষ করবেটা কি?
কিন্তু হঠাতই একদিন গুরুদ্বারের সামনে পুণ্যার্থীদের জুতো সাফ করতে করতে অমরজিতের ধুম জ্বর এল। প্রায় বেহোঁশ অবস্থায় সে আমনের হাত ধরে বলতে লাগল,
-আমন, আমাকে সাদা পোশাক পরিয়ে দে। সফেদ চাদরে শুইয়ে দে বাপ।কেন যেন মনে হচ্ছে আমার আয়ু আজকের রাতটাই। দেখতে পাচ্ছি যেন, আমার জন্য ফুল দিয়ে গাড়ি সাজান হচ্ছে।
আমন ঠাট্টা করে পরিবেশ হালকা করতে চায়। মেসোর কপালে হাত রেখে বলে,
-গাড়িতে যাবে? কী রঙের গাড়ি? ওহো, সাদা গাড়ি? বেশ, বেশ। তা বসে যাবে না দাঁড়িয়ে?
-বসে যাব, অমরজিৎ গুঙিয়ে ওঠে, খাঁটি শিখ সর্দার কারও সামনে শির ঝোঁকায় না, যুদ্ধক্ষেত্র ছাড়া চিত হয়ে শোয় নানা !
রাত তখন কটা কে জানে, আমনের চোখ জ্বালা করতে শুরু করে। সে মেসোর পাশেই খাটিয়ায় একটু কাত হয়েছে সবে, হঠাৎ কার ধাক্কায় যেন ধড়মড়িয়ে উঠে বসে, দেখে অমরজিত সোজা হয়ে বিছানায় বসে আছে তার চোখ গুরুজির ছবির ফ্রেমে সাঁটা। তাকে পেছন থেকে ধরে শুইয়ে দেবার চেষ্টা করতেই অত লম্বা চওড়া দেহখানা কেমন ধপ করে পড়ে গেল। চোখের কোণ দিয়ে গড়িয়ে পড়ল একফোঁটা অশ্রু।
সেটি ছোঁয়াচে ছিল কিনা আমন জানে না, কিন্তু তারও চোখভাঙা বন্যা থামছিল না, তেমনি থামছিল না বাইরের বৃষ্টি। শিশম গাছের মাথায় মাথায় হঠাৎ এমন শব্দ উঠতে লাগল, এমন প্রবল বাতাসের প্রবল ঢেউ, যেন মুলুকের পাঁচ পাঁচটা নদী থেকে প্রলয় ছুটে আসছে। ভয় করছিল আমনের, যেন এই ঝড়বৃষ্টির শেষ নেই, যেন ভোরবেলায় টিয়ার ঝাঁক ডেকে উঠবে না আর কোনওদিন। দরজা খুলে বাইরে উঠোনে এসে আকাশের নিচে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল আমন, তার পাগড়ি বেয়ে অবিরল জল গড়িয়ে এল সুগঠিত ঊর্ধাঙ্গ বেয়ে, ট্র্যাক্টর চালানো কড়া পায়ের গোছ বেয়ে নেমে আবার মাটিতেই মিশে গেল।
সকাল হতে না হতেই গোটা গ্রাম ভেঙে পড়ল উঠোনে, সাদা ফুলে সাজানো ট্রাক্টরে ছাউনি দিয়ে মরদেহ নিয়ে যাওয়া হোল গুরুদ্বারে, তখনও বৃষ্টি পড়েই যাচ্ছিল। ওপরে উঠে যাওয়া সিঁড়িগুলোর ধাপের একেবারে সামনে দাঁড়াল ট্র্যাক্টর, এইখানে বসে সকলের জুতো পরিষ্কার করত সেবাদার অমরজিৎ সিংহ। এখন তার মরদেহ ঘিরে নাঙ্গা পায়ের গ্রামবাসীর দল বলাবলি করছিল, আহা মানুষটি বড় ভাল ছিল গো।
এই আহাজারিকে আরও জোরদার করতে রাতের মতোই আবার ঝেঁপে এল বৃষ্টি। ছাউনি ভেদ করে জল পড়ছিল মেসোর মুখের ওপর দেখে নিজের হাত দিয়ে সে জল কাচিয়ে দিচ্ছিল আমন। তখনই আর কিছু না পেয়ে গুরু গ্রন্থসাহিবের মাথার ওপর লাগানো খোদ দরবারি ছাতা নিয়ে নেমে এলেন গ্রন্থিসাহেব, সেখানিকে মৃতের মুখের ওপর তুলে ধরে জল আটকালেন!
সবাই ধন্য ধন্য করতে লাগল, কেউ দেখল না একেবারে নিঃস্ব হয়ে যাওয়া এক সদ্য যুবকের চোখের জল শেষ প্রিয়জনের মুখের ওপর পড়াও আটকে দিল সেই পবিত্র ছাতা।
চোখের জল মুছতে মুছতেই পরদিন ঘরে তালা দিয়ে ব্যাগে ইন্টারভ্যু লেটার পুরে ভাতিন্ডা চলে গেল আমনদীপ।
সভিলোগ পংক্তিমে খাড়ি হো জায়ে!
বাঁজখাই গলার একটা চিৎকারে ভাবনার সুতো ছিঁড়ে ধড়মড় করে উঠে দাঁড়াল আমনদীপ সিং, ক্যান্ডিডেট নম্বর দোশো চৌদা। তাকে নাঙ্গা করে চেক করা লোকটা এবার মুখে একটা হুইসল পুরে জোরে জোরে ফুঁ দিচ্ছে। আর গর্ত থেকে বেরনো সাপের বাচ্চার মতো গোটা ভারতবর্ষের জওয়ানি ছুটে যাচ্ছে তার দিকে। কেউ এতক্ষণ বসেছিল গাছের তলায়, কেউ শেডের নিচে। আমনদীপের মতো যাদের আর কোথাও জায়গা হয়নি তারা রোদের মধ্যেই দাঁড়িয়ে দেখছিল অন্য অগ্নিবীর ক্যান্ডিডেটদের দৌড়। এত ছেলে এসেছে বঙ্গাল বিহার, হরিয়ানা, হিমাচল থেকে, এক একটা দলে ভাগ করে তাদের এই শেষ পরীক্ষা নিচ্ছে আর্মির লোকেরা।
শেষ পরীক্ষাই বটে। পাগড়ির নিচে রোদে তেতে ওঠা মাথা নিয়ে আমন দেখে লাইনে দাঁড়িয়ে পড়ছে আধা ল্যাংটা ছেলের দল। নিজেদের ভাষায় কত কথা বলছে তারা, কেউ ঈশ্বরকে ডাকছে কেউ বা সরকারকে গালি পারছে, এত কান্ড যদি, তবে তা মাত্র চার বৎসরের জন্য কেন ! ঝুঁকি তো একই। যুদ্ধে মৌত তো আর দেখতে আসবে না কে রেগুলার সোলজার, কে অগ্নিবীর! পেনসন নেই, অন্য সুবিধে নেই। শুধু চারটে বছরের রেশন আর মাইনে। তবুও কেউ শক্ত মুঠোয় কপালে ছোঁয়াচ্ছে গলায় ঝোলা তাবিজ কবচ, বিড়বিড় করে ইষ্টনাম জপ করছে। সকলের বুক পিঠ দিয়ে দরদরিয়ে ঘাম নামছে, যেন গতকাল মেসোর মুখের ওপর পড়তে থাকা তার চোখের জল। কালকের কথা মনে পড়তেই অমরজিতের গলা শোনে সে, দুটো সক্ষম হাতে যদি করার মতো কাজই না থাকে, তাহলে তার থেকে বেশি দুঃখের আর কী! এই যে দেশের কোনা কোনা থেকে এসেছে সব উঠতি যুবকেরা, এদের হাতে কোনও কাজ নেই বলেই না এরা দাঁড়িয়ে এই চড়া রোদে। ক্লান্ত আমন দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। পারবে কি সে এই পাঁচ মিনিটে দু কিলোমিটার দৌড়ে যেতে ? সে তো স্প্রিন্টার নয়, গ্রামের মাঠে দৌড়ঝাঁপ করা সাধারণ ছেলে! নিজের চোখেই তো সে দেখল, দৌড়াতে গিয়ে কেউ পড়ে গেলে তাকে পায়ে দলে এগিয়ে যাচ্ছে নওজোয়ান দৌড়বিদের দল। মায়া-মমতাহীন এই তীব্রতার মধ্যে আমন কি পারবে তার লক্ষ্যবিন্দুতে পৌঁছাতে?
ঠিক তখনই নোংরা গালাগাল দিয়ে সেই অপদার্থ লোকটা তাকে লাইনে দাঁড়াতে বলে। এত অন্যমনস্ক ভাবুক সর্দারজি সে জন্মে দ্যাখেনি। প্যান্ট খোলার সময় কেমন দুহাতে নিজের পুরুষাঙ্গটি ঢাকছিল বার বার। যেন সে ওর ইজ্জত লুটে নেবে এখুনি। হাসতে হাসতেই জঘন্য খিস্তিখাস্তা করে সে, তারপর ঘাড়ে ধাক্কা দিয়ে আমনকে লাইনে ঢুকিয়ে দেয়।
ডান পা সামনে অল্প ভাঁজ করা, পেছনে টান টান বাঁ পা, ছেলেগুলো দু হাত শক্ত করে ছোটার জন্য তৈরি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বাঁশিতে ফুঁ পড়ার সঙ্গে সঙ্গে যেন তাদের পিঠের পেছনে ডানা গজাবে আর তারা উড়ে পার হয়ে যাবে এই দূরত্ব। লোকটি বদমায়েসি করে ঝুঁকে ফুঁ দেবার ভঙ্গি করতেই কয়েকজন লাইন ভেঙে এগিয়ে যায়, পর মুহূর্তে সবার হাসির শব্দে লজ্জা পেয়ে পিছিয়ে আসে।
তারপর একসময় সত্যিই বাঁশিতে ফুঁ পড়ে, অন্য সবার সঙ্গে আমনদীপ সিংহের পিঠেও ডানা গজায়, সে দৌড়তে থাকে শতলুজের তীর ধরে, গেঁহুক্ষেতের পাশ দিয়ে। গুরুদ্বারের কীর্তন, বাতাসের শব্দ, গন্নার রসের গন্ধ, পপলারের মাথা দোলানো, সব ছাড়িয়ে আমন ছুটে চলে আগামী চারটে বছরের দিকে। একটা না হওয়া আটা চাক্কির ঘরঘর কানে আসে তার। সেখান থেকে কাজে ব্যস্ত যে আমন বেরিয়ে আসে তার চোখের পাতা অব্দি সাদা হয়ে গেছে আটার কণায়, চাক্কির মুখোমুখি গ্রামের সরু পথ দিয়ে ছুটে আসছে এক শিশু, তার দুহাত দুদিকে ছড়ানো, যেন এক অরণ্য থেকে উড়ে আসা পাখি। ওর মুখটা আমনের খুব চেনা। আহা, বাপ মা মরা অবোধ শিশু, দুনিয়ায় বড় একা ! আটা চাক্কি থেকে বার হয়ে এসে শিশুটির দিকে ছুটে যায় আমন, যেন কাঁধে তুলে নেবে নিজের অতীতকে, তারপর ছোটা শুরু ভবিষ্যতের দিকে। মাথার ওপর আগুন, বুকের ভেতর আগুন, সব মিলে তার হৃদপিন্ড পুড়তে থাকে ফটফট। খাবি খেতে খেতে দৌড়ে চলে আমনদীপ।
অনেক দূরে ঝাপসা দেখা যায় আর্মিওয়ালাদের ছোপ ছোপ উর্দি। সে কি ওখানে কখনও পৌঁছতে পারবে! তার পাশ দিয়ে তীরের মতো ছুটে বেরিয়ে যায় বাংলা, বিহার, হিমাচল! পাথরের মতো ভারী বুক নিয়ে ছুটতে ছুটতেই আমন বিড়বিড় করে, ওয়াহে গুরু! ওয়াহে গুরুজি কা কিরপা!
মহুয়া | 2405:201:8016:d80a:513b:8fd7:85c6:***:*** | ২০ এপ্রিল ২০২৫ ১৭:১১542470
রেজানুল করিম | 2409:40e1:10bd:8065:9c25:7e72:1d03:***:*** | ২০ এপ্রিল ২০২৫ ২০:১১542474
শিবানী ভট্টাচার্য দে | 2409:40e0:1058:5612:8000::***:*** | ২০ এপ্রিল ২০২৫ ২০:৩৫542478
মহুয়া মীল | 2401:4900:7078:f1c0:68a5:1fda:d2bd:***:*** | ২০ এপ্রিল ২০২৫ ২০:৪২542479
Lopamudra | 223.223.***.*** | ২০ এপ্রিল ২০২৫ ২৩:০২542482
অর্ঘ্য দত্ত | 2402:3a80:4165:8621:0:f:85fc:***:*** | ২১ এপ্রিল ২০২৫ ০১:০২542485
% | 51.158.***.*** | ২১ এপ্রিল ২০২৫ ০১:০৯542486
প্রতিভা | 2401:4900:1c65:4660:6dc0:61d6:e666:***:*** | ২১ এপ্রিল ২০২৫ ০৮:১৫542490
Sunrita | 2402:3a80:1cd0:7a65:178:5634:1232:***:*** | ২১ এপ্রিল ২০২৫ ০৯:১৯542491
% | 51.158.***.*** | ২১ এপ্রিল ২০২৫ ০৯:২৮542492
প্রতিভা | 2401:4900:1c65:4660:6dc0:61d6:e666:***:*** | ২১ এপ্রিল ২০২৫ ০৯:৪৩542493
% | 51.158.***.*** | ২১ এপ্রিল ২০২৫ ০৯:৫৯542494
প্রতিভা | 2401:4900:1c65:4660:6dc0:61d6:e666:***:*** | ২১ এপ্রিল ২০২৫ ১০:২৫542498
প্রতিভা | 2401:4900:1c65:4660:6dc0:61d6:e666:***:*** | ২১ এপ্রিল ২০২৫ ১০:২৭542499
অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী | 103.75.***.*** | ২১ এপ্রিল ২০২৫ ১৪:০১542504
প্রতিভা | 2401:4900:1c65:4660:6dc0:61d6:e666:***:*** | ২১ এপ্রিল ২০২৫ ১৪:৪৭542505
Guruchandali | ২২ এপ্রিল ২০২৫ ০১:৩৯542528
Sonali Chanda | 202.142.***.*** | ২৩ এপ্রিল ২০২৫ ১৩:৪০542597
সুমনা ভট্টাচার্য | 2405:201:800c:5a26:587f:e3d3:5852:***:*** | ২৩ এপ্রিল ২০২৫ ১৮:০৯542607
| 2406:7400:63:d58c:d849:aeba:14e7:***:*** | ২৪ এপ্রিল ২০২৫ ২২:২৯542629
| 2406:7400:63:d58c:d849:aeba:14e7:***:*** | ২৪ এপ্রিল ২০২৫ ২২:৩০542630
রঞ্জন ভট্টাচার্য | 202.142.***.*** | ২৮ এপ্রিল ২০২৫ ০৭:২১542707