চন্দননগরের লোকেদের একটা সমস্যা হলো সব কিছুতেই জগদ্ধাত্রী পুজোর উদাহরণ চলে আসে। সেই চতুর্থী বা তৃতীয়ার দিন থেকে দিবারাত্র ২৪ ঘন্টা ধরে একাদশীর ভোর রাত পর্যন্ত হই হুল্লোড় আনন্দ উৎসব (থাক উৎসব শব্দটাকে বাদ রাখলাম) মোচ্ছব চালানোর পর ক্লান্ত হয়ে সবাই ধুঁকতে থাকে। ঠাকুরটা কে বিসর্জন দেওয়ার ইচ্ছে শক্তি আর কারোর অবশিষ্ট থাকে না। এই দিচ্ছি, এই দেবো, একে ডাক, ওকে বল, কোথায় গেলি রে .....এমনি চলতে থাকে। আরো মজা হলো বিসর্জনের পর এই অবস্থাটা হবে জেনে পুরোহিত দশমীর দিনই পাওনা গণ্ডা বুঝে নিয়ে বাড়ি রওনা দেয়। বিসর্জনের পর শান্তির জল ছেঁটাবে কে? হঠাৎ মনে পড়ে পাড়ার বেচারাম মুখার্জির কথা। ডাকা হল বেচাদাকে। জীবনে ঠাকুর দেবতা মন্তর তন্তর করেনি যে, তাকে বলা হলো শান্তির জল ছেঁটাতে। তাতে তিনি মন্ত্র আওড়ালেন, "আমি কিছু জানি না, এরা সব জানে, সর্বনেশে ব্যাটারা সব, আমায় ধরে টানে। তোরা সর্বস্বান্ত হ' তোরা সর্বস্বান্ত হ''।
বিকেল তিনটে, মিছিল করে সিজিও কমপ্লেক্স যাওয়া হবে। অবস্থান প্রত্যাহার করা হবে, এটা তো তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নয়। অতএব ডেকরেটার্স কে সব নিশ্চয়ই ঠিকঠাক বলাই ছিল। তাই সকাল থেকেই ডেকরেটার্স সব খুলতে থাকল। তা নিয়েও দেখলাম অভিযোগের নাটক তৈরি হলো। সরকার পুলিশ নাকি চাপ সৃষ্টি করেছে ডেকরেটার্সের উপর। আর সবশেষে তিলোত্তমা হত্যার চতুর্থ দিন থেকে যে তদন্ত রইল সিবিআই এর ঘরে, নানা দিক থেকে সমালোচনা এলো, লালবাজার কেন? কেন সিজিও নয়? তাই শেষমেষ চাঁদ সওদাগরের বাঁ হাতের ফুল অথবা বেচারামদার শান্তির জল, একবার সিজিও কমপ্লেক্স অভিযান। ব্যাস সব সাঙ্গ। না পুরো সাঙ্গ হল না, আপাতত সাঙ্গ। এরপর দেখতে হবে নিরাপত্তার বন্দোবস্তগুলো ঠিকঠাক হলো কিনা। থ্রেট কালচার, ভয় দেখানো, হুমকি দেওয়া, সেটা বন্ধ হল কিনা দেখতে হবে। কারণ এখনো জুনিয়র ডাক্তাররা হাসপাতালে ফিরে যেতে ভয় পাচ্ছে। জয় করে তবু ভয় কেন তোর যায় না।
এই ভয়টা অহেতুক না, এর যৌক্তিকতা আছে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেল, বৌবাজার উদয়ন হোস্টেল, এন আর এস এর হোস্টেল, এতো আলাদা কিছু নয়। কমবেশি একই। এইতো মাস দু আড়াই আগে, বৌবাজার উদয়ন ছাত্রাবাসে মোবাইল চোর সন্দেহের বশে ইরশাদ (৪৭) কে গণপিটুনি দিয়ে মারা হলো। আর এনআরএস এর হোস্টেলে কুরপান শাহকে এই দেবশিশু সম বাচ্চা বাচ্চা ডাক্তাররাই তো মোবাইল চোর সন্দেহে পিটিয়ে মেরেছিলো। নিশ্চয়ই সব ডাক্তার ছাত্ররা এটা করেনি। অনেকেরই এতে আপত্তি ছিল। কিন্তু অন্যদের ভয়ে কিছু বলতে তো পারেনি। এই যে যাদবপুরে হোস্টেলে প্রাইভেসি নষ্ট হওয়ার যুক্তিতে সিসিটিভি বসাতে দেওয়া হলো না। কারো কারো গায়ের জোরের সামনে মাথা নত তো করতে হলো। এরা অন্য ছাত্রদের ওপর, জুনিয়র ডাক্তারদের উপর, থ্রেট করবে না, হতে পারে? খোঁজ নিলে দেখা যাবে নিজের ইচ্ছায় নয়, থ্রেটের কারণে কতজন জুনিয়র ডাক্তার অবস্থানে অংশ নিতে বাধ্য হয়েছেন।
আর জি কর, এনআরএস এসব তো বড় বড় ক্ষেত্র। চন্দননগর মহাকুমার ছোট হাসপাতাল। সেখানে নামি দামি ভালো মেডিসিনের ডাক্তার আসেন। কিছুদিনের মধ্যেই মারধর খেয়ে চলে যায়। কেউ থাকেন না। তালিকায় নামিদামি ডাক্তার আছেন। ডক্টর জেএন নসিপুরি, ডক্টর এস ডি রায়, ডক্টর অলোক ঘোষ, ডক্টর সুজিত মিত্র, কে নেই তালিকায়। এরা কেন থাকেন না? কেন এদের মার খেতে হয়? কারণ এলাকায় এক বা একাধিক ডাক্তার আছেন, হাসপাতালে ভালো মেডিসিনের ডাক্তার এলে তাদের স্বার্থ বিঘ্নিত হয়। তাই এরা কোন না কোন ইস্যুতে এদের ওপর হামলা চালায়। এটারই চরম রূপ ছিল রানাঘাটে ডাক্তার চন্দন সেনের খুন হওয়া। মনে রাখবেন এসব আশি নব্বই এর দশকের কথা। তখন বাম শাসন, আর চন্দননগরে দুজন মন্ত্রী, শ্রী রাম চট্টোপাধ্যায় ও শ্রী ভবানী মুখোপাধ্যায়। আমরা দেখেছি তখন নেতা ডাক্তার অঞ্জন পান, ডাক্তার অমিত পান, ডাক্তার তাপস সেন। কাকে দূরে পাঠাতে হবে, কাকে কাছে আনতে হবে জানতেন তাপস সেন।কথায় কথা বাড়ে। অসুস্থ অবস্থায় একবার চন্দননগরের এক নেতা ডাক্তার কে দেখাচ্ছি। কদিন পর জেলা অফিসে গেছি। নেতা মহিতোষ নন্দী বললেন, তুমি আর ডাক্তার পাওনি, অমুকে পার্টি করে, নেতাগিরি করে, ও ডাক্তার না। ওর বউ ডাক্তার। এই সব নেতারা আই এম এ চালায়, একে বসায় ওকে দাঁড় করায়।
থ্রেট কালচার বহুদিনের পুরনো। ১৯৯১ / ১৯৯২ নাগাদ রাজাবাজার সায়েন্স কলেজে একজন ছাত্র ট্রাম লাইনে দুর্ঘটনায় মারাত্মক আহত হল। ছাত্ররা আহত কে নিয়ে সোজা এনআরএস এ পৌঁছালো। সেখানে অহেতুক চিকিৎসা বিলম্বিত হল। তখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বিখ্যাত নিউরোলজিস্ট ডক্টর ভাস্কর রায় চৌধুরী। কিছু ছাত্র উপাচার্যের শরণাপন্ন হল। ছাত্রটি শেষ অবধি বিনা চিকিৎসায় মারা গেল। লালবাজারের এক পুলিশ কর্তা নির্মল দাসের নির্দেশে লাঠি চার্জ হলো। রাজাবাজারের ছাত্ররা অন্যান্য সব ক্যাম্পাসের ছাত্রদের কাছে আবেদন নিয়ে পৌঁছালো। তারা উপাচার্যের কাছে বিক্ষোভ দেখাবেন। হাজরা ক্যাম্পাসে রাজা বাজার থেকে আসা দুই ছাত্রকে এসএফআই ইউনিয়নের ছেলেরা লিফলেট বিলি করতে বাধা দেয়। তাদের জোর করে হাজরা ল কলেজের একটি ঘরে নিয়ে গিয়ে সারাদিন আটকে রাখে। আমি সেদিন এই নিগ্রহ প্রতিরোধ করতে পারেনি ঠিকই। কিন্তু ওদের দুজনের সঙ্গে আমিও থেকে যাই। ওদের আশ্বাস দিই যে "তোমাদের কোন ক্ষতি হবে না। এটা আমারও ক্যাম্পাস।" সন্ধ্যায় তাদের ছাড়া হয়েছিল।
আজ যখন কলেজগুলোতে নির্বাচিত ছাত্র সংসদের দাবি করা হচ্ছে, তখন মনে করিয়ে দিতে চাই বাম আমলে কোন কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজে নির্বাচন হতো না। নির্বাচন হতো, কিন্তু প্রতিপক্ষকে মনোনয়নপত্র জমা দিতে দেওয়া হতো না। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ ছাড়া সর্বত্র এস এফ আই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী। সেই থ্রেট কালচারের রিলে রেস চলছে আজ। বেশ মনে আছে হাজরার ক্যাম্পাসে ইতিহাসের এনসিয়েন্ট ইন্ডিয়া বিভাগে ডিএসও র ছয় জন প্রার্থীপদ প্রত্যাহার করেনি। তারা ছিল আশপাশের স্থানীয় ছেলে মেয়ে। ভয় দেখিয়ে কাজ হয়নি। ওই ছটা আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছিল, আর ছটিতেই এসএফআই পরাজিত হয়েছিল। নির্বাচনের আগে সরকারি কর্মচারীদের পোস্টাল ব্যালট পেপার কো-অর্ডিনেশন কমিটি নিজেরাই সংগ্রহ করে নিত। তারপর সমিতির অফিসে বসে ছাপ্পা দিয়ে সেগুলো জমা দেওয়া হতো। এও ছিল আর এক রকমের থ্রেট কালচার।
এই যে শুনি প্রায় সকলের কথায় এবং লেখায় জানতে পারছি যে জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনটা স্বাস্থ্য ব্যবস্থার গোড়া ধরে নাড়া দিয়েছে। ক্ষমতার বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস জুগিয়েছে। ক্ষমতা টিকে থাকে ভয় দেখানোর মধ্য দিয়ে। সে সরকারি ক্ষমতাই হোক বা ফার্মা মাফিয়া হোক। জুনিয়র ডাক্তাররা ক্ষমতার চোখে চোখ রেখে কথা বলার সাহস জুগিয়েছে, ভয় ভেঙে দিয়েছে। তাই যদি সত্যি হয় তাহলে ডাক্তারবাবুরা এত ভীত আতঙ্কিত কেন? আর সত্যি বলতে কোন নিরাপত্তাই কিস্যু নয়। বড় জোর আপনি আক্রান্ত হলে, পরবর্তীকালে তদন্তের স্বার্থে ফুটেজ দেখে কিছু সন্ধান পাওয়া যেতে পারে। এর বেশি কিছু না। কেউ তো হাসপাতালের আড়াইশো সিসিটিভির পর্দায় বসে বসে মনিটরিং করবে না। এসবই পরবর্তী পদক্ষেপের স্বার্থে। আর নিরাপত্তারক্ষী নিরাপত্তা বাহিনীর কথা, একজন প্রধানমন্ত্রী তার বাসভবনে নিজের নিরাপত্তা রক্ষির দ্বারা আক্রান্ত হলেন। অর্থাৎ কোন চক্র যদি কিছু ঘটাবে বলে বৃহৎ পরিকল্পনা তৈরি করে, তাহলে নিরাপত্তা রক্ষী দিয়ে তা ঠেকানো যায় না। শুনলাম নিরাপত্তা রক্ষীদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগকে সুপ্রিমকোর্ট এবং জুনিয়র ডাক্তাররা মানতে চায় নি। তা আমি বলি কি দেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা চলছে চুক্তিভিত্তিক অগ্নিবীর দিয়ে। পুরুলিয়ায় থাকাকালে দেখেছিলাম বেলকুড়ি, বেলিয়াতোড় এই সমস্ত স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলিতে চুক্তিভিত্তিক ডাক্তার নিয়োগ, সেই বাম আমলে ই। তার মানে তো দেশ , গ্রামীণ জনতার স্বাস্থ্য কোনটাই নিরাপদ নয়। এমনকি আপনারা যে সব স্কুল কলেজ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করলেন সেখানেও তো বহু সংখ্যক চুক্তিভিত্তিক শিক্ষক অধ্যাপক নিযুক্ত আছেন। আমার তো মনে হচ্ছে যতটা না ভয় দূর করলেন, নিজেরা তার চেয়ে বেশি ভয়ে জড়োসড়ো। এখন তো সর্বত্র পৌরসভা ব্যাংক ট্রাফিক পুলিশ ডিএম অফিস সর্বত্র চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ। আমজনতা নাগরিক তো তাহলে কোনভাবেই নিরাপদ নয়।
এবার বলি আমাদের মত বেলা বারোটার বাজারে পোকা কাটা বেগুনের যারা ক্রেতা তাদের নিরাপত্তাহীনতার কিছু ছবি :
১) এমার্জেন্সিতে একজন ৬৮ বছর বয়স্ক পেশেন্ট এসেছে। তার কথায় জড়তা (slurring) হচ্ছে। সেই সঙ্গে উচ্চ রক্তচাপ (blood pressure high), আরো সমস্যা হলো পেশেন্টের খিঁচুনি (convulsion) হচ্ছে ও সেই সাথে মুখ দিয়ে সাদা ফেনা (white foaming) উঠছে। আই সি ইউ তে সে সময় রয়েছে নব্য এমডি করা ডাক্তারবাবু। তিনি পরিস্থিতি বুঝে উঠতে পারছেন না, কি করবেন, কি বলবেন, দিশেহারা। এই পেশেন্টকে যে ডাক্তারবাবু দেখেন ও আইসিইউতে পাঠিয়েছেন সেই সিনিয়র কনসালটেন্ট কে ফোন করেও পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি তো তখন চেম্বার করছেন। পেশেন্টের সমস্যা বেড়ে চলেছে। হাতে সময় কম। পরিস্থিতি দেখে বুঝে অগত্যা সিস্টার নিজেই দায়িত্ব নিলেন। পেশেন্টকে left lateral side করে শুইয়ে দেওয়া হল। কারণ ওই সময় যে ভমিটিং ও ফোমিং হচ্ছে তা শ্বাসনালীতে ঢুকে শ্বাসবন্ধ যাতে না হয় তার জন্য এই ব্যবস্থা। এরপর ১৪ নম্বর (সরু) সাকশন ক্যাথিটার দিয়ে সাকশন করে নাক মুখের ভেতর পরিষ্কার করা হলো। তারপর অক্সিজেন মাস্ক দেওয়া হলো। পেশেন্ট খুব ছটফট করছিল (restless), তাই পেশেন্টকে ঘুম পাড়ানোর জন্য সিডেসিভ ইনজেকশন, তারপর এন্টি কনভালশন ইনজেকশন levipil 1gm stat দেওয়া হলো। পরবর্তী দুদিন এই ইঞ্জেকশনই দিনে দুবার করে চালাতে বলা হলো। একে একে রাইলস টিউব, ক্যাথিটার করানো হলো। সিটি স্ক্যান অফ ব্রেন করা হলো। এবিজি (arterial blood gas) করতে দেওয়া হল। অনুমান করা হলো সিভিএ (cerebral vascular attack). পরে সিনিয়র কনসালটেন্ট ডাক্তারকে নব্য ডাক্তারটি ফোন করে সমস্ত রিপোর্ট জানায়। সিনিয়র ডাক্তার বলেন "কি কি করেছো বলো?" সে নার্সের দেওয়া এডভাইসগুলি আওড়ে গেলো। সিনিয়র ডাক্তার বলেন "গুড! ওয়েল ডান। রাইট ডায়াগনোসিস!" আর নব্য ডাক্তার ফোন নামিয়ে রেখে, নার্সকে বলে "থ্যাংক ইউ সিস্টার। এ যাত্রা আপনি বাঁচালেন। ভাগ্যবানের বোঝা ভগবানের বয়।" সিস্টার নিশ্চয়ই মনে মনে বলেছিলেন "ভূতের বোঝা"।
২) আমার বাড়িতে রাজমিস্ত্রি র কাজ করে অভিমুন্য। তার পেটের ব্যথা সার্জন গলব্লাডার স্টোন ডায়াগনোসিস করেছেন। কিছু প্রি অপারেটিভ প্যাথলজিকাল টেস্ট দিয়েছেন, ইসিজি করতে বলেছেন । অভিমুন্য যে সমস্ত হার্টের ওষুধপত্র খায় সেগুলো প্রেসক্রিপশনের পাশে লেখা আছে। ইউ এস জি রিপোর্ট উল্লেখ আছে। ডাক্তারবাবু সমস্ত রিপোর্ট দেখে অপারেশনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। পরদিন নার্সিংহোমে ভর্তি হতে বলেছেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম অপারেশন কবে হবে। সে বলল কালকেই হবে, বেলা দশটার পর। আজ রাতে লিকুইড খেতে বলেছে। কাল সকাল থেকে কিছু না খেতে বলেছে। আমি বললাম তুমি যে এই ওষুধগুলো খাও ডাক্তারকে বলেছো? সে বলল হ্যাঁ। একবার ভাবুন। নিয়মিত ইকোস্পিরিন খায়, ক্লপিডগ্রিল খায়। সেই ওষুধগুলো তাকে বন্ধ করতে বলেনি। অথচ প্রেসক্রিপশন এর পাশে সেগুলো নোট করা আছে। পরদিন যার অপারেশন তাকে টেট ভ্যাক নিতে বলেনি। আমি ওই নার্সিংহোমে ফোন করে জানালাম, অপারেশনটা দু-তিন দিন পেছাতে হবে। এরমধ্যে ওষুধগুলো বন্ধ করে টেট ভ্যাক দিয়ে নতুন ডেট নেওয়া হলো। প্রি অপ চেকআপ তাহলে কি হয়েছিল? নিরাপত্তা আছে কোনো রোগীর?
৩) আমি এ ব্যাপারে সচেতন ছিলাম কেন সেটা বলি। আমি দেখেছি আমি নিজে হার্টের রোগী নাইট্রো গ্লিসারিন ২.৬, ক্লপিডগ্রিল ৭৫ , এ্যাটোরভাসটাটিন ১০, ইকোস্পিরিন ৭৫, নিকোরান্ডিল ৫, এসব খাই। ডাক্তারবাবু আমাকে একটা অ্যানজিওগ্রাম (সিএজি) করে নিতে বলেছে। কলকাতার নামি প্রতিষ্ঠান যারা নাকি সারাক্ষণ আমাদের জন্য জেগে আছেন, ওভার ফোন অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিলাম। পরদিনই চলে যেতে বলল। গিয়ে অ্যানজিওগ্রাম হয়েও গেল। কিন্তু তারপর আমার ডিসচার্জের আগে চ্যানেলটি যখন হাত থেকে খুলতে গেলো বিকেল বেলায়, কিছুতেই রক্ত বন্ধ হচ্ছিল না। বিছানার চাদর রক্তে ভেসে যায়। চেপে ধরে বসে আছে একজন সিস্টার। মোটা মোটা স্যান্ড ব্যাগ হাতের উপর চাপিয়ে দিল। যাহোক শেষ অবধি সামলে গেল। কিন্তু বিপদটা তো এড়ানো যেত। যদি একবার বলতো তিন দিন ওই রক্ত তরল রাখার ওষুধগুলো বন্ধ রাখতে। তারপর সিএজি করবে। মহাভারত অশুদ্ধ হতো না। অশুদ্ধ হতো, তাই সেটা বলেনি, বলল কালকেই চলে আসুন। কেন বলেনি সেই গল্পটাই এবার বলি।
৪) এনজিওগ্রাম করার পর আমার বাড়ির লোকজনকে ডেকে আপ্রাণ বোঝানোর চেষ্টা করা হলো। কি ভয়ংকর কঠিন অবস্থা একটা সিডি দেওয়া হল। বলা হলো ১৪ জায়গায় ব্লকেজ আছে। এর মধ্যে তিনটি ৯৮ থেকে ১০০ শতাংশ। এই পেশেন্ট কে বেড থেকে নাড়ানো যাবে না। একে বাইপাস সার্জারি (সিএবিজি) করতেই হবে। আপাতত ভর্তি থাক, আপনারা চাইলে সিডি নিয়ে অন্যত্র সেকেন্ড থার্ড অপিনিয়ন নিতে পারেন। কিন্তু পেশেন্ট নাড়াবেন না। বাড়ির লোক শোনেনি এসব কথা। প্রায় জোর করে আমাকে ওদের খপ্পর থেকে ছাড়িয়ে আনে। ওই সিডি পরের দিন দেখলেন এসএসকেএমের থোরাসিক সার্জন ডঃ উদয়নারায়ন সরকার। জানালেন ঠিকই, চোদ্দটা ব্লকেজ আছে, কিন্তু তিনটের বেশি গ্রাফটিং করা যাবে না। যেগুলো ১০০% এর কাছাকাছি সে রকম তিনটে। তবে সঠিক নিয়ম অনুযায়ী, লাস্ট যেদিন পেইন হয়েছিল তার ঠিক ছয় সপ্তাহ পর সার্জারি হবে। অতএব আপাতত বেড রেস্ট। কোনভাবেই যেন পেইন রেকার না করে। এখানেই প্রশ্ন, ওই নার্সিংহোম এসব সতর্কতা ছাড়াই আমাকে অপারেশন করতে চেয়েছিল কেন? কোন সতর্কতা ছাড়াই আমার এনজিওগ্রাম পরদিনই করা হল কেন? কারণ একটাই, কাস্টমার আর কোথাও পালিয়ে যাবে। তাই তাকে যে কোন মূল্যে ধরে রাখার চেষ্টা। এভাবে রোগীর নিরাপত্তাকে প্রায়োরিটি না দিয়ে, খদ্দের ধরার নিম্নমানের চেষ্টা। আমার অপারেশন হয়ে যাবার পরেও ওই নার্সিংহোম একের পর এক ফোন করেছে, চিঠি পাঠিয়েছে, কেন অপারেশন করাচ্ছি না। আসলে একটা খদ্দেরের হিসেব মিলছে না ওদের। জুনিয়র ডাক্তারবাবুরা এর বিরুদ্ধে সরব হবেন না?
৫) আমার স্কুলের এক ছাত্র। সে এমবিবিএস পাশ করে এখন হাউস স্টাফ হাসপাতালে। সেই সঙ্গে সে জানালো কলকাতার নামি বেসরকারি হাসপাতালে, বাইপাস সার্জারির পর যে ২৪ ঘন্টা গুরুত্বপূর্ণ মনিটরিং চলে, ও সেই ডিউটি দেয়। আমার সিএবিজি হয়েছে শুনে জানালো অপারেশন পরবর্তী ২৪ ঘন্টা খুব গুরুত্বপূর্ণ। পেশেন্ট ভেন্টিলেশনে থাকে, এ সময় কড়া নজরে রাখতে হয়। আমি সেই কাজটাই করি, মোটা টাকা দক্ষিণা পাই। ও নিজেই বলল যে নিয়ম অনুযায়ী একজন থোরাসিক সার্জন এই মনিটারিং করার কথা। হাসপাতালগুলো ব্যবসা করে। ২৪ ঘন্টা থোরাসিক সার্জন রাখতে গেলে ঢাকের দায়ে মনসা বিক্রি হয়ে যাবে। তাই আমাদের দিয়েই কাজ চালায়। কাগজে পত্রে সই সাবুদ করে থোরাসিক সার্জন। কি বুঝলেন? রোগীর নিরাপত্তা ঠিক কতটা? থোরাসিক সার্জন তার আইন বাঁচানোর জন্য যা করার করবেন। কিন্তু পেশেন্ট বাঁচবে কি? আপনারা কার নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত?
৬) হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পরেও আমার গল ব্লাডার স্টোন অপারেশন বিলম্বিত হলো। কারণ ভাগ্যিস অ্যানেস্থেসিস্ট যখন শুনলেন আমি সার্টালাইন ৫০ ও থাইরক্সিন সোডিয়াম ১০০ নিয়মিত খাই। তিনি অপারেশন বন্ধ রাখলেন। দুদিন ওষুধ দুটো বন্ধ রাখার পর, তারপর গলস্টোন অপারেশন হলো। ওটি তে নিয়ে গিয়ে আরেক সমস্যা। আমার বাড়ি থেকে কাগজে বড় বড় অক্ষরে লিখে দেওয়া আছে, রেগল্যান ইনজেকশন এলার্জি হয়। তথাপি রেগল্যন দেওয়ার জন্য প্রস্তুত। বায়নাদার শিশুর মত আমিও একঘেয়ে বলেই চলেছিলাম রেগল্যানে আমার এলার্জি, আমার এলার্জি তাই শেষ পর্যন্ত সেটা দেওয়া হয়নি। রেগল্যন, পেরিনর্ম সিডি তে আমান্ন ভয়ানক রকম সমস্যা তৈরি হয়। মুখ বেঁকে যায়, চোয়াল লক হয়ে যায়, জিভ অসাড় হয়ে ভেতর দিকে ঢুকে যেতে চায়। ভাবুন দেখি, কি বিরাট সমস্যা হতে পারত! হ্যাঁ গো, জুনিয়র ডাক্তারবাবুরা, রোগীর নিরাপত্তায় কত ফাঁকফোকর ভাবতে পারছো?
৭) আমার পিঠে একটু শক্ত মতো ফোলা একটা অংশ। যার ভেতর থেকে মাঝে মাঝে দুর্গন্ধযুক্ত সাদা তরল বেরিয়ে আসে। ডাক্তার বাবু দেখে বলেছেন ওটা সিবেসিস গ্ল্যান্ড থেকে সিস্ট ফর্ম করেছে। আরেকটু বড় হলে সার্জেন দেখিয়ে নেবেন। আমাদের জেলার ভালো অভিজ্ঞ সার্জন দেখলেন। বললেন মামুলি অপারেশন। এক বেলাও ভর্তি থাকতে হবে না। সকাল আটটায় অপারেশন হলো, দুপুরে এগারো টায় ছেড়ে দিল। আমাকে বাড়িতে আনতে গিয়ে বাড়ির লোকের নাজেহাল অবস্থা। সারাটা পথ বমি করতে করতে ঘরে এলাম। এসেও বেসিনের কাছে চেয়ার পেতে আচ্ছন্নের মতো বসে আছি। মাঝে মাঝেই বমি করছি। একজন ডাক্তারবাবুকে ফোন করলাম। তিনি শুনে বললেন, কালিদা এটা কি করলেন। সম্পূর্ণ অ্যানেস্থেসিয়া করা হয়েছে যাকে, তাকে ভর্তি না রেখে ছেড়ে দিলেন! তাও আবার তিন ঘন্টার মধ্যে! এটা মারাত্মক অফেন্স। জুনিয়র সিনিয়ার আমার কাছে সব একাকার দায়িত্বজ্ঞানহীন ডাক্তার।
৮) অফেন্সের তখনো আরও বাকি ছিল বুঝিনি। নিয়ম অনুযায়ী পাঁচ দিন পর সেই সার্জনের কাছে গেলাম। তিনি আমার সেলাই কেটে দিলেন। একজন নার্সকে বললেন ড্রেসিং করে দিতে। জানালেন বাড়িতে গিয়েও দু চার দিন এনএস আর বিটাডাইন লোশন দিয়ে ক্ষতস্থান পরিষ্কার করে নেবেন। ক্ষতস্থান পিঠে তাই আমি দেখতে পাই না। আমার বাড়ির কাজের মেয়ে সুফিয়া, সে ই ড্রেসিং করে দেয়। সে বলল, মামি বুঝতে পারছি না, দুটো কালো কালো ফুটকি, কাঁটার মত। তুলোয় বাঁধছে। আমি সাহস করে বললাম, তুলো দিয়ে একটাকে ধর, ধরে টান। দেখিস একসাথে দুটোকে ধরবি না। সুফিয়া অনেক ভয়ে ভয়ে, দেখো মামা শুনলে বকবে, কিন্তুু কিন্তু করে একটা ধরে টান দিলো। বঁড়শির মত আকৃতি একটা ক্যাট গাট বেরিয়ে এলো। হারামজাদা ডাক্তার সেলাইটা কেটেছে, সুতোটাও বের করেনি। কি ডাক্তার বাবুরা, পেশেন্ট পার্টি কত অসহায় একটুও ভাববেন না?
৯) প্রথম যখন রেগলান ইঞ্জেকশন নেওয়ার পর চোয়াল শক্ত হলো জিভ আড়ষ্ট হয়ে ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে। ডাক্তার বাবু এসে বলেছিলেন এটা তেমন কিছু না, পেশেন্টের মানসিক সমস্যা। এরপরেও অসংখ্যবার নানাবিধ সমস্যায় পেশেন্ট যখন ডাক্তার বাবুর কাছে গেছে, ডাক্তার বলেছেন, এটা মানসিক সমস্যা। এই মানসিক সমস্যা শুনে শুনে একসময় আমি ভাবতে থাকি, সত্যিই বুঝি আমার মনের রোগ। গিয়েছিলাম একজন সাইক্রিয়াটিস্ট এর কাছে। তিনি মন দিয়ে সব শুনছিলেন। যখন শুনলেন যে আমার ঘরে একটা সাতফুট সাপ ঢুকেছিল, তার ফোঁসফোঁস আওয়াজ শুনে আমি ভাবছি ওটা আমার মনের রোগ। একসময় সাপটা যখন আমার পায়ের উপর নিঃশ্বাস ফেলেছে, তখন তাকিয়ে দেখছি বিশাল এক সাপ। এটা শুনে সাইক্রিয়াটিস্ট ডাক্তার বাবু ভয়ংকর রেগে গেলেন। বললেন, এমবিবিএস পড়তে গিয়ে থার্ড ইয়ারে চারটে সেমিস্টারের একটা সেমিস্টারের অর্ধেক পড়েন Medicine and allied subjects (Psychiatry, Dermatology) এরা মূর্খ ডাক্তার। মানসিক কারণে হরমোন এনজাইমের নানা বিচিত্র ক্ষরণ হয়। এই ক্ষরণটা মানসিক না বায়োলজিকাল। এরা শুধু মূর্খ নয়, এরা ক্রিমিনাল। একজনের আত্মবিশ্বাস এমন তলানিতে এনে দিয়েছে যে তার ঘরে একটা জলজ্যান্ত সাত ফুট সাপ, আর সে ভাবছে এটা আমার মনের ভুল। আমার ফোন নাম্বারটা রাখুন, এরপর যে ডাক্তার এ কথা বলবে আমার ফোন নাম্বারটা দেবেন। মাননীয় জুনিয়র ডাক্তারগণ আমরা পেশেন্ট হিসেবে কি ভয়ংকর নিরাপত্তাহীন কখনো ভেবেছেন?
১০) , আমার দিদির, একটু পরিশ্রম করলে, সিঁড়ি দিয়ে উঠতে নামতে খুব হাঁফ ধরে। বিশ্রাম নিলে কমে যায়। একদিন অর্থোপেডিক ডাক্তার বাবুর চেম্বারে কিছু ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ করার সময় তার শ্বাসকষ্ট খুব বেশি বেড়ে গেলো। যেটা অস্বাভাবিক। বোঝাই যাচ্ছে শরীরের সর্বত্র রক্ত ও সেই সাথে অক্সিজেন পৌঁছাচ্ছে না। তাই হাঁফ ধরছে। সন্দেহের তালিকায় প্রথমেই হার্ট। ডাক্তার বাবু তখনই ওই পলি ক্লিনিকেই একজন কার্ডিওলজিস্টকে দেখাতে পাঠালেন। তিনি ভালো করে দেখলেন, ইসিজি করলেন। তারপর অ্যাডভাইস করলেন -- টিএমটি। তাছাড়া tab Tanormin50 প্রতিদিন জলখাবারের পর একটা । ডাক্তার বাবু সন্দেহ করছেন IHD.(ইসকিমিক হার্ট ডিজিজ)। সমস্যা হলো, টিএমটি করতে গিয়ে দিদি মাত্র ৪৭ সেকেন্ড ওয়াক করেছেন, তারপর অসুস্থ বোধ করেন। এর ফলে টিএমটি রেজাল্ট ইনকনক্লুসিভ, কোনো সিদ্ধান্ত মূলক নয়। এরপর কার্ডিওলজিস্ট একজরশনাল ইকো করতে বললেন। অন্য ডাক্তারের মত হলো একজরশন তো পেশেন্ট নিতে পারছে না। তার চেয়ে অ্যাঞ্জিওগ্রাম (সিএজি) করা বাঞ্ছনীয়। একটা বিভ্রাটের মধ্যে পড়লো, ডাক্তার পেশেন্ট উভয়েই।
আমার ছাত্রী অভিজ্ঞ নার্স। হাসপাতালে ডাক্তারবাবু দের সকলের কাছে অবারিত দ্বার। মুস্কিল আসান হলো চেষ্ট স্পেশালিস্ট ডাঃ কুণাল স্যার। স্যারকে নির্ভয়ে সে বললো, স্যার, আগে কম ব্যয়ে, কম কষ্টের একটা পালমনারি ফাংশন টেস্ট (পিএফটি) করে দেখে নিলে হয় না? ফুসফুসেই হয়তো কম অক্সিজেন ঢুকছে। অর্থাৎ গোড়ায় গলদ হতেও পারে। স্যার তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে প্রথমে বললেন, বেশি ওস্তাদ হয়ে গেছিস, সব বুঝে গেছিস। তারপর প্রশ্রয়ের দৃষ্টিতে একটু হাসলেন। এবার স্যার প্যাডের পাতায় পিএফটি অ্যাডভাইস লিখে দিলেন। জানা গেল, স্বাভাবিকের প্রায় অর্ধেক, ৪৮ শতাংশ কম অক্সিজেন ঢুকছে। বাতাস প্রবেশের পথগুলো বাধা প্রাপ্ত হচ্ছে। কিছু ইনহেলার, নিয়মিত শ্বাসের ব্যায়াম, আর প্রয়োজন মতো লাঙ ইনফেকশনের ক্ষেত্রে Doxofyllin অ্যাডভাইস করলেন। একই সঙ্গে অল্প হাঁটাচলা, অতিরিক্ত একজরশন না করা, খোলা মেলা হাওয়া বাতাসের মধ্যে থাকা, আর ইসকিমিক হার্ট ডিজিজ কে মাথায় রেখে অ্যাটরভাস্টাটিন ১০, ক্লপিডগ্রেইল ৭৫ ও নাইট্রোগ্লিসারিন ২.৬ প্রেসক্রাইব করলেন। এই প্রেসক্রিপশন বিগত ৫/৬ বছর ধরে ফলো হচ্ছে। তাহলেই বুঝুন পেশেন্ট হিসেবে আমরা কতটা নিরাপদ। সবাই তো কুনাল স্যার নন, আর অভিজ্ঞ নার্স ই বা কোথায়?
১১) একটি ঘটনাও কষ্ট কল্পিত নয়। নিজে ভুক্তভোগী। হাসপাতালে ভর্তি ছিলাম। জ্বর, কাঁপুনি ও খিঁচুনি নিয়ে পেশেন্ট এলো রাত্রে। মুখ দিয়ে গলগলিয়ে রক্ত। এতো এতো কটন নিয়ে আরএমও মুখে ঠেসে ধরছে। রক্তে ভিজে উঠেছে। ফেলে দিয়ে আবার নতুন কটন। আরএমও দিশেহারা। এলেন একজন তৎপর নার্স। একটা স্টিলের চামচ কাৎ করে দুপাটি দাঁতের ফাঁক দিয়ে ঢুকিয়ে চাপ মারতেই মুখ হাঁ হলো। টাঙ বাইট বন্ধ হলো। তারপর কটন দিয়ে চেপে ধরে রাখতেই রক্তপাত বন্ধ। শুরু হলো চিকিৎসা। আমি অবাক। কত বলবো? সন্তান সম্ভবা মা। ফ্লুইড ডিসচার্জ হচ্ছে। সোজা কথায় জল ভাঙছে। এমারজেন্সি ওটি হবে। অ্যানেস্থেসিস্ট বেড সাইড টিকিট দেখে অবাক। ছোট্টো করে লেখা inhaler since...... । নিয়ম অনুযায়ী আরো অনেক আগে থেকেই ইনহেলার বন্ধ করে, নেবুলাইজার অভ্যাস করানো। আর প্রয়োজনমতো অক্সিজেন সাপোর্ট দেওয়া। সেসব কিছুই হয়নি। ইনহেলার শব্দটাকে প্রেসক্রিপশনে বড় বড় অক্ষরে হাইলাইট করা উচিত ছিল। যাই হোক ওটি হলো না। পেশেন্টকে মেডিকেল কলেজে রেফার করা হলো। এসব তো ডাক্তার বাবুদের কীর্তি।
১২) আমি কার্ডিয়াক বাইপাস সার্জারির পর নিয়মিত চেক আপ করাই ডাঃ চক্রবর্তী র কাছে। একবার হলো কি, ডক্টর চক্রবর্তী রাজ্যের বাইরে ছিলেন। বাধ্য হয়ে একজন ভিন্ন কার্ডিওলজিস্ট দেখালাম। তিনি দেখলেন, আমার ইকো কার্ডিও হয়েছে মাত্র এক মাস আগে। তথাপি তিনি আর একটা ইকোকার্ডিও করতে বললেন, লাখোটিয়া বা নার্সিসাস থেকে। আমি তাকে প্রশ্ন করেছিলাম আপনার ক্লিনিক্যাল ফাইন্ডিংস এর সাথে এই ইকো কি সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়? অথবা হতে পারে এই ইকোর রিপোর্টটা পরস্পর অসঙ্গতিপূর্ণ। নতুন একটা ইকো করানো যেতেই পারে। কিন্তু তার উদ্দেশ্যটা কি? আশ্চর্যের ব্যাপার দেখেছি, এই ডাক্তার ইকোর প্লেট গুলো দেখলেন না। রিপোর্টেও ইজেকশন ফ্যাক্টর টা দেখলেন, আর কিছুই দেখলেন না। তথাপি আর একবার ইকো করতে বললেন অথচ পোস্ট সিএবিসি রিপোর্ট হিসেবে ইজেকশন ফ্যাক্টর 58 খুব একটা খারাপ কিছু নয়। আমি নতুন করে ইকো করাইনি এবং পুরনো প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী ওষুধ খেয়ে গেছি। ওনার প্রেসক্রিপশনে লেখা ছিল "Do not substitute the medicine", এমন কথা ছাপার অক্ষরে লেখা যায়? কোন কোন ডাক্তারবাবু আছেন পেটের ব্যথা হলেও ব্রেনের সিটি স্ক্যান করান। তেমন ডাক্তার কোথায়? আমার বন্ধুর দৃষ্টি শক্তিতে সমস্যা হচ্ছিল তীব্র। দক্ষিনে শংকর নেত্রালয়ে ঘুরে এসেছে। কলকাতা মেডিকেল কলেজের আই স্পেশালিস্ট ডক্টর চ্যাটার্জী একটি মেডিকেল ক্যাম্পে শুধুমাত্র অপথালমোস্কোপি দিয়ে দেখে বললেন, আপনার চোখের সমস্যার কারণ চোখ নয়। পিটুইটারি তে সমস্যা আছে। একজন নিউরো সার্জন দেখান। এরপর তিনি পার্ক স্ট্রিটের পার্ক নার্সিংহোম গেলেন পিটুইটারিতে টিউমার অপারেশন হলো। তারপর চোখ সম্পূর্ণ সুস্থ। হ্যাঁ, এটাই হলো নিরাপত্তা।
১৩) পরিবারের অন্যের কথা বলি, ভালোমতো ইম ব্যালেন্স হচ্ছে। চলতে গেলে, রাস্তা পেরোনোর সময়, ঘাড় ঘোরাতে গেলে, একটু উঁচুতে তাকাতে গেলে, মাথা ঘুরে যাচ্ছে। জেনারেল ফিজিশিয়ান খুব স্বাভাবিকভাবে পাঠালেন ঘাড়ের এক্সরে করতে। দেখা গেল বাড়াবাড়ি রকমের সার্ভাইকাল স্পন্ডেলাইসিস। C7 হাড়টি এনলার্জ করেছে। সার্ভাইক্যালের কার্ভেচারটা অলমোস্ট স্ট্রেট হয়ে গেছে। ডাক্তার বাবু বললেন ট্র্যাকশন দিতেই হবে। অর্থোপেডিক সার্জন দেখান। অর্থোপেডিক দেখে জানালো স্পন্ডিলাইটিস সিরিয়াস। কিন্তু তার জন্য এত সমস্যা হচ্ছে না। একজন ইএনটি দেখান। ইএনটি স্পেশালিস্ট দেখে শুনে একটা ইএনজি করতে দিলেন, আর অডিওমেট্রি টিমপনোমেট্রি। ইএনজি রিপোর্ট সিভিয়ার পেরিফেরাল ভেস্টিবুল লিজেন লেখা হলো। ডান কানে ঠান্ডা জল বা গরম জলের রেসপন্স সম্পূর্ণ জিরো। ডাক্তারবাবু দেখে বললেন একজন নিউরো মেডিসিন দেখাতে। নিউরোলজিস্ট সব শুনে একটা এমআরআই করতে বললেন ইকো থেকে। এমআরআই রিপোর্টেও বিশেষ কিছু পাওয়া গেল না শুধু হাইড্রোসিফালাস এর কথা বলা ছিল। মজার ব্যাপার হলো, এই এতজন ডাক্তার কেউ কিন্তু কোন ওষুধ লিখছেন না, শুধুই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে। অতঃপর পরিচিত একজন জেনারেল সার্জেন বললেন, ইমব্যালেন্স এর প্রধান প্রধান কারণগুলো কম-বেশি সবই আপনার আছে। কিন্তু কোনটাই প্রবল নয়। তিনি বললেন ইমব্যালেন্স কমানোর জন্য অন্তত ভার্টিন ১৬ এবং একটা সফট কলার তো দেওয়াই যায় সেটা না দিয়ে সকলেই পরীক্ষা নিরীক্ষা করছেন তিনিই প্রথম প্রেসক্রিপশনে ভার্টিন ১৬, মিথাইকোবাল, আর সফট কলার ব্যবহারের এডভাইস দিলেন। দেখিয়ে দিলেন সাধারণ ঘাড়, আর, চোখের ব্যায়াম। সমস্যা কালক্রমে কমে আসলো। আমার জীবন জুড়ে আছে এমনি ভালো ডাক্তার ও ডাকাতের গল্প কথা।
১৪) জানেন আমি আর ডাক্তার দেখাই না, মতামত নিই, নিজের যুক্তি বুদ্ধি প্রয়োগ করে সেগুলো যাচাই করি। আমার মায়ের যখন অসুস্থতা ধরা পড়লো ৮৫ বছর বয়সে, দেখা গেল সময় জ্ঞান থাকছে না। সকাল না রাত্রি, বিশ্বাস করানো যাচ্ছে না। আমার ছাত্রী অভিজ্ঞ নার্স বলল, দিদার সোডিয়াম পটাশিয়াম ব্যালেন্স নষ্ট হয়ে গেছে। তো নুন চিনি র জল খাওয়াও, হসপিটালে নিয়ে এসো। স্যারকে দেখিয়ে নাও। এরপর হাসপাতালে দুদিন ভর্তি রাখলো। একটা সিটি স্ক্যান করে জানালো শারীরিক সমস্যা বিশেষ কিছু নেই। বয়স জনিত সমস্যা। মস্তিষ্কে অনেকটা অংশেই গ্রে ম্যাটার শুকিয়ে গেছে, সাদা হয়ে গেছে। সোজা কথায় যাকে বলে ভীমরতি। বাড়ি নিয়ে যান। এটা নার্সিং ম্যানেজমেন্ট করলেই চলবে। বাড়ি এসে একটু একটু করে বিভ্রাট বাঁধলো। ঠিকমতো বলতে পারেনা, টয়লেট বিছানায় করছে। ছাত্রী বলল ক্যাথিটার করে দিই। তা না হলে দিদার বেডশোর হয়ে যেতে পারে। এরপর যখন যেমন সমস্যা হয় ছাত্রী পরামর্শ দেয়। রাতের পর রাত বকবক করে, ননস্টপ। হেলোপেরিডল নাকে ড্রপ বা মুখে ড্রপ দাও। বেশিদিন ক্যাথিটার হয়ে গেছে, একটা এন্টিবায়োটিক কোর্স চাই, যাতে ইনফেকশন না হয়। একবার টেটভ্যাক দেওয়া হলো। মাসান্তে ক্যাথিটার পাল্টানো। মাঝে মাঝে ক্যাথিটার ক্ল্যাম্প করে রাখা। কখন রাইলস টিউব হবে, কখনও মুখে খাওয়ানো হবে তাও করা হলো। একবার শরীর ফুলে গেল। ল্যাসিকস ইঞ্জেকশন দিতে হবে। ডাক্তার স্তব্ধ। রক্ত নিতে আসা প্যাথলজির কালেকশন বয় ভেন পাচ্ছে না। সূঁচ ফোটালেই জল বেরোচ্ছে। অবশেষে ছাত্রী এলো। বলল যেখানে মাসল সবচেয়ে কম সেখান থেকে ভেন খুঁজতে হবে এবং পায়ে আঙ্কেলের উপর থেকে রক্ত সংগ্রহ করল। আবার ইনজেকশন দিয়ে দিল ল্যাসিকস। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১৩ লিটার জল বেরোলো। ইউরো ব্যাগ ঘন ঘন ভর্তি হলো। ছাত্রী বলল, এবার দিদার সোডিয়াম পটাশিয়াম লেভেল কমে যাবে। ট্যাবলেট টলভেপটাম চালু করল চার দিন। এই কাজগুলো সব আমার সাথে কথা বলে আমার ছাত্রীর সিদ্ধান্ত নিত এবং সমস্ত সংকটকে এভাবেই সামাল দেওয়া হতো। আমি ওকে ওপেন হ্যান্ড সাপোর্ট দিয়েছিলাম। একজন ডাক্তার ছিলেন তাকে নিয়ম করে আনা হতো কি কি করা হয়েছে শুনে সেই মতো প্রেসক্রিপশন করে সই করে দিতেন। হাসপাতালে ডাক্তারবাবু যেমন এডভাইসের নিচে সই করেন। একদিন ডাক্তারবাবু জিজ্ঞাসা করলেন সিস্টার, সবই তো আপনি করেন, তাহলে আমাকে খামোকা এতগুলো ফিজ দিয়ে ডেকে আনেন কেন? আমি বলেছিলাম, জানি ও সবটাই করতে পারবে। কিন্তু ডেথ সার্টিফিকেট তো ডাক্তার ছাড়া অন্য কেউ লিখতে পারবে না। আপনাকে প্রয়োজন ডেথ সার্টিফিকেটের জন্য।
ডাক্তারবাবু শুনে খুব হেসে ছিলেন। হাসারই কথা আমরা ডাক্তার দেখাই সুস্থ হওয়ার জন্য নয়, সুচিকিৎসার জন্য নয়। তার জন্য তারাশঙ্করের আরোগ্য নিকেতনের জীবন ডাক্তার আছেন, গ্রামে গ্রামে অসংখ্য হাতুড়ে চিকিৎসক আছেন, আছে ঠাকুমা দিদিমার নিম, কালমেঘ, বাসক, থানকুনি, কালকাসুন্দি, ঘৃতকুমারী, হিংচে, কুলেখাড়া, কেশুত, কুলুত্থ কলাই, পুদিনা ইত্যাদি। তারাই আমাদের গ্রামীণ স্বাস্থ্যকে, এমনকি মফস্বলের স্বাস্থ্যকে বাঁচিয়ে রেখেছে। এই জন্যই গান্ধীজী তার হিন্দ স্বরাজ গ্রন্থে বলেছেন, একজন ডাক্তার অপেক্ষা একজন কোয়াক অনেক বেশি সমাজকে সেবা কার্য সরবরাহ করে থাকে। বাস্তবিকই তাই। তারা সমাজের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে থাকেন। তবে এটা ঠিক, বিচ্ছিন্ন হয়ে শীর্ষে অবস্থান করলেও নাগরিক সমাজের আইনে একমাত্র ডাক্তারই ডেথ সার্টিফিকেট দেওয়ার অধিকারী। তাকে ছাড়া অন্য গতি নেই।