অপ্রণীতঃ তু মাৎস্যন্যায়ান উদ্ভাবয়তি।
বলীয়ান্ অবলং হি গ্রসতে দন্ডধরাভাবে।
(অর্থশাস্ত্র)
অর্থশাস্ত্রের মাৎস্যন্যায় বিষয়ক এই উক্তিটি যদি আপনি বুঝতে চান, তাহলে এরকম কিছু কল্পনা করুন। ধরুন আপনার ভাই দিল্লির কিষাণ মোর্চায় সামিল ছিল। এখন এক বছর পর আপনার শহরে কোন অশান্তি হল। তার সঙ্গে আপনার আর আপনার ভাইয়ের কোনো সম্পর্কই নেই। কিন্তু সন্ধ্যায় পুলিশ আপনার বাড়িতে এল, আপনার ভাইয়ের নামে নোটিশ ঝুলিয়ে দিল, কিন্তু আপনার বাড়ি ভেঙে দিল।
আপনি জিজ্ঞাসা করবেন, ভাই, এটা কোন ধরনের বিচার? অর্থশাস্ত্রে একেই বলা হয়েছে মাৎস্যন্যায়: বড় মাছ ছোট মাছকে গিলে খায়। অর্থাৎ জোর যার মুলুক তার। বন্য জীবনের মর্যাদার সঙ্গে অপরিচিত মানুষ কখনও কখনও একে বন্য বিচার বলে। এই বিচারের আধুনিক রূপই হল বুলডোজার বিচার।
এর কার্যপদ্ধতি বোঝার জন্য, ১২ জুন এলাহাবাদে জাভেদ মোহাম্মদের বাড়ি ভেঙে ফেলার গল্পটি আগে বুঝতে হবে। এলাহাবাদের মানবাধিকার সংগঠন এবং কর্মীদের মধ্যে একজন পরিচিত মুখ, জনাব জাভেদ মোহাম্মদ যিনি “ওয়েলফেয়ার পার্টি অফ ইন্ডিয়া”-র সঙ্গে যুক্ত। এই দল এবং এর সহযোগী সংগঠন জমাত-এ- ইসলামী প্রধানত মুসলমানদের মধ্যে কাজ করে। কোনো হিংসামূলক কাজের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ এই সংগঠনগুলোর নামে নেই। জাভেদ মোহাম্মদ নিজে একজন বিশিষ্ট নাগরিক, অনেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এবং শহরের সব শান্তি কমিটির সঙ্গে বৈঠকে তিনি অংশগ্রহণ করে থাকেন। ২০২০ সালে, তিনি নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে সামিল হন। তার মেয়ে আফরিন ফাতেমা সক্রিয়ভাবে শিক্ষার্থী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত।
জাভেদজির মতে, শুক্রবারের নামাজের পর শহরে ঘটে যাওয়া ঘটনার সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই। এমনকি পুলিশ ও বিক্ষোভকারীদের মধ্যে সংঘর্ষের সময় তিনি ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন না। সকাল থেকে শহরের উত্তেজনা অনুমান করে, সকাল ১১টা ১২ মিনিটের সময় (বিশৃঙ্খলার ৩ ঘন্টা আগে) তিনি তার ফেসবুকে লিখেছিলেন: “যদি কোনো বিষয় নিয়ে সরকারের সঙ্গে কথা বলার বা জানানোর থাকে, তবে সবচেয়ে ভালো উপায় হল নিজেদের কথা বা দাবি একটি স্মারকপত্রের মাধম্যে সময় নিয়ে আধিকারিকদের কাছে পৌঁছে দেওয়া। এই শহর আজীবন শান্তিপ্রিয় থেকে এসেছে। পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির উপর নজর রাখুন যাতে আমরা আল্লার কাছে শান্তি চেয়ে শান্ত ভাবে জুম্মার নামাজ পড়তে পারি। আইনের মধ্যে থেকে মতামত জানানোর অধিকার সকলের আছে। আমরা সকলে মিলে স্মারকপত্র তৈরি করে, জেলা আধিকারিকের মাধ্যমে রাজ্য সরকার ও কেন্দ্র সরকার এবং রাষ্ট্রীয় আধিকারিকদের পাঠাতে পারি। কেউ যেন অযথা রাস্তায় ভিড় করবেন না যাতে অঞ্চলের কোনো ভোগান্তি হয়। সকলে জুম্মার নামাজ পড়ে বাড়ি গিয়ে প্রার্থনা করুন যেন এলাকায় শান্তি ও ভালোবাসা বজায় থাকে। দয়া করে পোস্টটি শেয়ার করুন।” আপনি কি মনে করেন এটা কোন দাঙ্গাবাজের ভাষা?
জুম্মার নামাজের পর আন্দোলনকারীরা রাস্তায় এসে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে এবং সন্ধ্যায় পুলিশ জাভেদ মোহাম্মদকে এই অশান্তির প্রধান আসামী বানিয়ে দেয়। ওই দিন রাতেই তাকে হেফাজতে নেওয়া হয়, পরে পুলিশ বাড়িতে এসে তার স্ত্রী ও ছোট মেয়েকে থানায় নিয়ে যায়। মেয়েদের ছেড়ে দেওয়া হলেও তাদের বাড়িতে যেতে দেওয়া হয়নি। শনিবার সন্ধ্যায় আদালত কক্ষ বন্ধ হলে পুলিশ তার বাড়ির বাইরে নোটিশটি সাঁটিয়ে দেয়। নোটিশে বলা হয়েছিল, এটি একটি অবৈধ নির্মাণ। তড়িঘড়ি করা নোটিশে এমন গল্পও বানানো হয়েছে যে, আসলে এক মাস আগে জাভেদ মোহাম্মদকে বাড়ির অবৈধতার বিষয়ে নোটিশ দেওয়া হয়েছিল, যার ভিত্তিতে তিনি শুনানিতে হাজির হননি। পরিবারও জানে না বিষয়টি। তাকে বাড়িটি পরের দিন অর্থাৎ রবিবার সকাল ১১টার মধ্যে খালি করে দেওয়ার আদেশ দেওয়া হয়েছিল, যাতে বাড়িটি ভাঙা যায়। সেটাই হয়েছে। রোববার গণমাধ্যম ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে বাড়িটি ভেঙে ফেলা হয়।
আশ্চর্যের বিষয় জাভেদ মোহাম্মদ এই বাড়ির মালিক ছিলেন না। বাড়িটি তার স্ত্রীর নামে ছিল যেটি তিনি তার মামার কাছ থেকে পেয়েছিলেন। পরিবারের কাছে সরকারি রশিদ রয়েছে যাতে মালিকের নাম স্পষ্ট লেখা রয়েছে। সম্পত্তি কর এবং অন্যান্য শুল্ক যথাসময়ে সম্পূর্ণ পরিশোধ করা হয়েছে। বাড়িটি যদি অবৈধ ছিল, তাহলে এতগুলো কাগজপত্র এল কীভাবে? আশেপাশের সব বাড়ি ছাড়া শুধু একটি বাড়ি কেন ভাঙা হল? ভুল নামে নোটিশ দেওয়ার বিষয়টি প্রকাশ্যে আসার পরও বাড়ি ভেঙে ফেলা হল কেন?
সত্যটা সবাই জানে। সকলেই জানে যে অবৈধ নির্মাণের গল্প মনগড়া, শুধুমাত্র ফাইলের জন্য তৈরি করা হয়। এটা সবাই জানে যে বিজেপি সরকার মুসলমানদের শিক্ষা দিতে প্রকাশ্যে তার নেতৃত্বকে দমন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যে মাথা তুলবে তাকে চূর্ণ করতে হবে। বুলডোজার বিচারের এই প্রক্রিয়াটি উত্তরপ্রদেশ থেকে শুরু হয়েছিল, তারপরে মধ্যপ্রদেশের খারগোন, দিল্লির জাহাঙ্গীরপুরি, তারপর উত্তরপ্রদেশের কানপুর এবং এখন প্রয়াগরাজে দৃশ্যমান। ডজনখানেক জায়গায় দেখা না গেলেও চলছে। এই ধ্বংসযজ্ঞের দৃশ্য উৎসাহের সঙ্গে তুলে ধরছে মিডিয়া। অফিসাররা এটাকে কৃতিত্ব হিসেবে তুলে ধরছেন, নেতারা নিজেদের ছাতি ফোলাচ্ছেন। আর আদালত চোখ বুজে বসে আছে।
টিভিতে বুলডোজার বিচার দেখতে দেখতে মানুষ নিঃস্পৃহভাবে বলছেন: আমরা যদি আইনের সঠিক পথে শাস্তি দিতে চাই, তবে কয়েক বছর লেগে যাবে, তাই দাঙ্গাকারীরা যদি তাড়াতাড়ি শাস্তি পায়, তাতে দোষ কী? জাভেদ মোহাম্মদের উদাহরণ এর উত্তর দেয়। এক, বুলডোজার বিচারে কোনো নিশ্চয়তা নেই যে দাঙ্গাবাজ ধরা পড়বেই। পুলিশ প্রশাসন যদি অভিযোগকারী এবং বিচারক দুইই হয়ে যায়, তাহলে কাকে কখন ধরা হবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তদন্তের আগেই যদি শাস্তি দেওয়া হয়, তাহলে ভুল শোধরানোর সুযোগ থাকে না। একবার বুলডোজার মুখে রক্তের স্বাদ পেলে, কবে কার নম্বর আসবে কেউ বলতে পারে না। আজ আমরা টিভিতে বুলডোজার দেখে সাধুবাদ জানাচ্ছি। কালকে যদি বুলডোজার আমাদের বাড়িতে এসে পৌঁছায়, কে আমাদের বাঁচাবে? বুলডোজারের অজুহাতে দেশের কোটি কোটি মানুষকে আতঙ্কিত করার এই অভিযান দেশের ঐক্যে কী প্রভাব ফেলবে? আজ ক্ষমতায় নেশার চুর হয়ে থাকা মানুষ এ প্রশ্ন ভাবতে প্রস্তুত নয়।
এখন এই মাৎস্যায়নের হাত থেকে দেশকে বাঁচানোর একটাই আশা। দেশের বিচারব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থা বজায় রাখতে হলে সুপ্রীম কোর্টকে অবিলম্বে ও স্বতঃপ্রণোদিত বিচারের মাধ্যমে বুলডোজারের যথেচ্ছাচার বন্ধ করতে হবে। আদালতের অনুমতি ছাড়া কোনো ধ্বংসযজ্ঞ ঘটবে না, এমন নিয়ম করতে হবে। বিধি-বিধানকে একপাশে রেখে বাসস্থান ভাঙা কর্মকর্তা এবং নির্দেশ দেওয়া নেতাদের ব্যক্তিগতভাবে দায়ি করে শাস্তি দিতে হবে। সুপ্রিম কোর্ট চাইলে জাভেদ মোহাম্মদের এই মামলাকে উদাহরণ হিসেবে গ্রহণ করাতে পারে।