১.
অনেক গুলো নুড়ি এখানে ছড়িয়ে আছে। এখানে, ওখানে, সব জায়গায়। মনের মধ্যে, বাইরে, হাতের মুঠোয়, পায়ের পাতার তলায়। নুড়িরা সব জায়গায় থাকে। নিউটন সমুদ্রের তীরে ওদের খুঁজতে যেতেন। কেউ খোঁজে, কেউ খোঁজে না। কেউ পায়, কেউ পায় না। একলা নুড়ি চুপ করে তাকিয়ে থাকে। কাঁদে। ও হয়তো জানেনা একে 'কাঁদা' বলে। একলা নুড়ি। কেউ তাকে শিখিয়ে দেয়নি 'কাঁদা' কী। কারণ কী পাবে কাঁদলে ও কারুর কাছে? যেখানে কেউ নেই সেখানে 'কারুর কাছ' বলে কিছু হয় নাকি? 'কারুর দূর' বলে কিছু হয়?
সন্ধ্যে আসে নীল হয়ে। একটুখানি থিরথিরে অস্পষ্ট ভালো থাকা ছটফটে পাখির মত হুশ করে উড়ে পালায়। পাখিরা কেন কাছে থাকে না? বলতে পারো? নুড়িতলার ঝর্না সব সময় ঝরঝর করে ঝরে পড়ছে। কোথা থেকে আসে এত জল? কোথায় যায়? বলতে পারো?
একটা জায়গা ছিলো কোথায় যেন। জায়গা না দুনিয়া তাও জানি না। সেখানে রোদ্দুর ছিলো, মেঘও। গান করতো একটা বুলবুলি। 'ছিলো','করতো', সবকিছু কী সহজে অতীত হয়ে যায়। সময়ের থেকে বড় জোচ্চোর আর কেউ নেই! সবসময় ভুল বুঝিয়ে যাবে তোমাকে। মিষ্টি কথায় ভুলিয়ে সব কেড়ে নেবে। তারপর একদিন হঠাৎ তুমি তাকিয়ে দেখতে পেলে কবে, কখন যেন সব চুরি গেছে। সময় শুধু ফাঁকা জায়গাটুকুনি রেখে দিয়ে গেছে তোমার জন্য। যাতে বুঝতে পারো কে চুরিটা করলো।
আজকাল খুব সহজে চুরি করা যায় সবকিছু। হেমন্তের গাছের পাতাহীন কাঠি কাঠি ডালপালার ডগায় বৃষ্টির বিন্দু চুপচাপ তাকিয়ে আছে। আজকালকার সবকিছু ঐ বিন্দুদের মত ক্ষণস্থায়ী। একবার জোরে নিঃশ্বাস ফেললেও ঝরে যায়। পরীদের বাচ্চার মত নিষ্পাপ, সরল জলের ফোঁটারা; কত সহজে ঝরে যায়। কেউ এর প্রতিকার করতে পারলো না আজ অব্দি। ভয় এসে ওদের জায়গায় পা উঠিয়ে আরাম করে বসে। ছোটছোট তেলগা সাপের মত ভয়। বড়বড় প্যাঁচানো নীল ড্রাগনের মত ভয়। শেষহীন অতল ভয়, যে এত বড় তার কোনো আকারই হয় না। ভয় বড় বিশ্বাসী লোক। তোমাকে আগলে রাখবে সবসময়।
ভয় বড় দুঃখী লোক। আমি চাই ওর ভালো হোক। আমি ওকে বলি "তোমার মুক্তি হোক"। কে মুক্তি দেবে ওকে? সবাই ওকে ঝাঁটা মেরে তাড়িয়ে দেয়। ছুঁচলো লাঠি দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে রোয়াক থেকে নীচে ফেলে দেয়। ভয় ছোট্ট একটা কান ছেঁড়া, লোমওঠা কুকুর বাচ্চার মত তোমার পায়ে পায়ে ঘুরবে। একবারটি তাকিয়ে দেখে না কেউ ওর দিকে। শুধু তাড়িয়ে তাড়িয়ে দিলে ও ফিরে আসবে না তো কী করবে? আমি ভয়কে বলি "ভালো হোক তোমার, দুঃখী বন্ধু"।
২.
দিন যায়, কাল যায়। ঢেউ ওঠে, ঢেউ পড়ে। চোখের ভুল সবটাই। কেউই যায়না কোত্থাও। দিন, মাস, বছর, জীবন, জোয়ার, ভাঁটা। সবকিছু চোখের ভুল। মনের ভুল। অন্ধ মানুষ কী দেখে কী ভাবে। হয় এক, মানুষগুলো বোঝে আরেক। বোকা মানুষ সব। বোকা নাহলে কেউ সুখ খোঁজে? সুখ জিনিষটা কিনতে প্রচুর দাম দিতে হয়। এমনি এমনিইই পাওয়া যাবেনা কিছুতেই। অ-নে-ক দাম। অথচ মজা এমন, যা দিয়ে তুমি দাম দেবে সেই জিনিষটা মিনিমাগনায় সারাক্ষণ এসে পড়ছে তোমার কাছে। সুখ কিনতে হয় দুঃখ দিয়ে। যন্ত্রণা দিয়েও পাওয়া যায়। কান্না দিয়ে। সেগুলো বিনি পয়সায় ঢের করে পাবে তুমি। নিয়ে যেও সুখ কিনতে। যদি সে বাজারের ঠিকানা জানা থাকে।
দুঃখ এসে ওর সব কিছু উজাড় করে দেয় আমার কাছে। নিঃশেষে। আমার শরীর, মন, সত্তা, তারও আড়ালে আরো যা কিছু অদেখা হয়ে রয়েছে, সব কানায় কানায় ভরিয়ে দেয় দুঃখ। অকূল দুঃখ। আকূল।
সিদ্ধার্থ তখন গভীর সমুদ্রের গভীরতম তলদেশে ধ্যানে থাকেন। সোনালি আলো তাঁর চারপাশের জলকে ছুঁয়ে থাকে। আমি জানতে পাই সিদ্ধার্থ ধ্যানে বসেছেন। দেখা, শোনা, ছোঁয়ার অনেক অনেক উত্তরে সেই জানা। কোনো কথা দিয়ে তার প্রকাশ হয় না।
মন এসে কেঁদে যায় আমার কাছে। জিজ্ঞেস করে "কেন এমন? এমন কেন?" আমি শুধু চুপ করে দেখি ওকে। কোনো কথা দিয়ে এর জবাব হয়না। থের বলেছিলেন "সবাইকেই থাকতে দিও ঘরে। কাউকে দূরে ঠেলে দিও না।" আমি দুঃখকে থাকতে দিই, ভয়কে, কান্নাকে। ওরা ঠেলে ফেলে দেয় আমাকে। আমি কাঁটার ঝোপের ওপরে শুয়ে থাকি। আমি জানতে পারি সিদ্ধার্থ আছেন, কোথাও কোনোখানে।
দুঃখ আমায় দুই হাতে জড়িয়ে থাকে। কত গভীর থেকে সেই দুঃখ উঠে এসেছে তা প্রকাশ করার ভাষা জানা নেই আমার। আমি ভেবে পাই না, একটা মানুষের অশ্রু-গ্রন্থি কত জল তৈরী করতে পারে। আমি সমুদ্র। জল আর নুন। নুন আর জল। আর ঢেউ। শুধু ঢেউ। অতল, অসীম, অশেষ সমুদ্র।
দুশ্চিন্তা ওর যমজ বোন। দুঃখের। ওর পোশাক গাঢ় ছাই রঙের। ওর হাতে একটা ধাতুর যন্ত্র থাকে সবসময়। তাই দিয়ে ও কুরে কুরে কাটে অনেককিছু। র্যাঁদা চালানোর মত। র্যাঁদা চালায় ও, আমার তুলতুলে আঢাকা মনের ওপরে। বিরামহীন। প্রমিথিউসের যকৃতের মত রোজ রাতে ঘুমের সময় সেই মন পুরো হয়ে ওঠে। যাতে পরদিন আবার ঘষে ঘষে কুরিয়ে নিতে পারে দুশ্চিন্তা। বিরামহীন।
আমি হাতের মুঠো আলগা করতে চাই। আমি 'আপন' শব্দটা মুছে ফেলতে চাই। আমি আমার 'আমিত্ব', 'আমাত্ব' সব নিঃশেষে বিলীন করে দিতে চাই। ওরা এসে কানে কানে ফিসফিস করে বলে -- "এত সহজে ছাড়ান পাবে ভেবেছো? ছাড়বো না, তোমাকে ছাড়বো না।" দুঃখ, ভয়, দুশ্চিন্তা। ওরা আষ্টে-পৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে আমাকে। ওদের হিম ঠান্ডা ধাতব হাত আমার হাড়ের মধ্যিখান পর্যন্ত জমিয়ে পাথর করে দিতে চায়। চায়, কিন্তু দেয় না। পাথরের তো ব্যথা লাগে না। ওরা পাথর হতে দেবে না তোমাকে। শুধু জল। ঝরঝর করে সারা দিনরাত ঝরে চলতে পারে যে জল। সমুদ্রের মত, সীমাহীন।
৩.
এই পৃথিবীতে কোমল-মনদের জন্য কোনো জায়গা আছে? তিতির পাখি, খরগোশ ছানা, হরিণ ছানার জন্য? ঝোপেঝাড়ে, ডালপালায় থাকেনা ওরা। মানুষের মধ্যেই আছে; মনগুলো, ভীষণ নরম। কারুর দুঃখ দেখলে একলা একলা কাঁদে। রাগের, তিক্ততার দম বন্ধ করা ঝাঁঝালো ধোঁয়ার মধ্যে থেকে কষ্ট পাওয়া রাগী মানুষকে, তিক্ত মানুষকে হাত ধরে বার করে আনতে চায়। হরিণ ছানা, খরগোশ ছানা, তিতির পাখি, কাউকে চেঁচিয়ে বলতে পারেনা " তোমার কষ্ট তুমি নিজে বুঝে নাও"। প্রকৃতি এদের গলায় স্বর দেননি। দিয়েছেন শুধু অদ্ভুত এক ভাষা, হাওয়ার শিসের মত। অন্য তরঙ্গের মানুষ সে ভাষা বোঝেনা। যাকে বোঝেনা তাকে দূরদূর করে মানুষ। কালি ছেটায়, কাঁটা দিয়ে চেরে ফাঁড়ে, রস চিপে চিপে বোতল ভরে নিয়ে ছাইয়ের গাদায় ছুঁড়ে ফেলে। তাই জিজ্ঞেস করছিলাম, কোনো জায়গা নেই না? কোমল-মনদের জন্য? এই পৃথিবীতে?
৪.
কতকিছু অদ্ভুত ঘটনা ঘটে এইখানে। এই পৃথিবীটাতে। কালো মেঘ চুপচাপ বসে ভাবছিলো আজ সারাদিন। ও কবিতা লেখে। কিম্বা বেহালা বাজায়। আজ সারাদিন সেসব কিছুই না করে শুধু উদাস আনমনে চুপ করে তাকিয়েছিলো। কালো মেঘের ধৈর্য্যের অভাব নেই। জানলার সামনের পাতা না আসা গাছে ঝুপসি বাসা থেকে বারবার বেরোয় ঢোকে এক জোড়া ব্লু জে। কতবার ডাকলো ওরা। মেঘ কারু কথার উত্তর দেয়না। কারু দিকে তাকায়না। ও যে ভাষায় কথা বলে তার জন্য শব্দ লাগেনা, দৃষ্টিও না। অন্য রকম তরঙ্গ আছে এক। তুমি যদি জানো তো বুঝতে পারবে। যে জানে সে জানে। সবাই এর খোঁজ রাখে না। কিন্তু ঐ তরঙ্গ দিয়েও কথা বলেনি আজ সে। একএকদিন চুপ করে থাকতে হয়। যে অনুভুতির কোনো নাম নেই, তার সাথে কথা বলার জন্য অন্য সব ভাষা থেকে ছুটি নিতে হয়। এক একদিন।
তারপর এলো চুপচাপ বৃষ্টি। সব লোকে কত কী বলে। ঝরঝর বৃষ্টি, ঝমঝম। ঝিরঝির, ফিসফিস। সবকিছুই শব্দ দিয়ে বলা। এগুলো ছাড়া অন্য বৃষ্টি নেই ভেবেছো নাকি? আছে। শব্দের বাইরেকার বৃষ্টি। বললাম তো, চুপচাপ। শব্দ করছিলো অন্য একজন। চিমনির ভেতরকার লোহার ঝাঁজরি। ও খুব আস্তে আস্তে নরম করে বলছিলো "টুং টুং টাং।" বৃষ্টির হয়ে চিমনি কথা বলছিলো আজ।
তখন দেখলাম ছবিটা। অদ্ভুত এক আলোয় আঁকা। অমন নরম মায়াবী রং আর কে বানাতে পারে বলো? নিঃশব্দ মেঘ, নিঃশব্দ বৃষ্টি ছাড়া? আলো যে কত ভালোবাসা ভরে আকাশের দিকে তাকিয়েছিলো তা কোনো কথা দিয়ে বোঝানো যায় না। আকাশের দিকে তাকিয়েছিলো। মাটির দিকে। গাছের দিকে। আমার দিকে। আলোর কোমল চোখের মধ্যে আমি আজ অঙ্গুলিমালকে দেখতে পেলাম। তিনি গভীর শান্তি পেয়েছিলেন। যখন সবাই ওঁকে পাথর ছুঁড়ে ছুঁড়ে ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছিলো, তারপরে। আমি 'সত্যি'কে দেখতে পেলাম। আজ। শব্দহীনতায়।
কত কী অদ্ভুত ঘটনা ঘটে। যেগুলো আসলেই অদ্ভুত নয়। আমরা ভাবি অমন। আমরা দেখতে জানি না বলে।
এ তো কবিতা ! নিখাদ শুদ্ধ কবিতা !
এই লেখাটার জন্যেই অপেক্ষা করছিলাম, কেকের এই লেখাগুলোর জন্যেই অপেক্ষা করি।
কেকের এই লেখা পড়ে চুপ করে থাকতে হয়।
কিন্তু... কিন্তু আমি চুপ করে থাকতে পারছি না। কারণ অ্যাডমিন গুলিয়েছে। এটা চার নং পর্ব। হেডিঙে চারই আছে। কিন্তু পর্বের ট্র্যাকারে পর্ব তিন করা রয়েছে। ফলে পাশাপাশি দুটো পর্ব তিন হয়ে রয়েছে।
এহেহে। ঠিক করে দিলাম।
'মেঘপিয়নের ব্যাগের ভিতর মন খারাপের দিস্তা' - মনে পড়ল এই লাইন টা
পড়ে গেছি, কিন্তু কী লিখবো না ভেবে পেয়ে বেরিয়ে গেছি। আবার এসেছি, বেরিয়েছি, রিপিট। তারপর এই লাইনটা পথ দেখালোঃ
একএকদিন চুপ করে থাকতে হয়। যে অনুভুতির কোনো নাম নেই, তার সাথে কথা বলার জন্য অন্য সব ভাষা থেকে ছুটি নিতে হয়। এক একদিন।
কেকে, এই পর্ব পড়ে একেবারে নিস্তব্ধ। এই ধ্যানলীন লেখার প্রতিক্রিয়া তো কথায় বলা যায় না।
সুন্দর
আমি যে নুড়ি নই তাই জেনে কানছি ...
শান্ত প্রকৃতি কত সুন্দরভাবেই না প্রকাশিত। ব্রেভো!
ওহ কবে যে নতুন পর্ব আসবে! উদগ্রীব অপেক্ষায়-
প্রতিভা ঠিক বলেছেন। সত্যিই কবিতা; কবিতা আর ছবি, বড় মায়ায় আঁকা।