এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক  স্মৃতিকথা

  • ছত্তিশগড়ের গেঁয়ো ব্যাংকঃ স্মৃতির কোলাজ ২০

    Ranjan Roy লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | স্মৃতিকথা | ১৮ মে ২০২৫ | ৫৫৮ বার পঠিত | রেটিং ৪.৭ (৩ জন)
  • ছত্তিশগড়ের গেঁয়ো ব্যাংকঃ স্মৃতির কোলাজ ২০

    জমি অধিগ্রহণঃ ব্যাংকে ব্যাংকে কাড়াকাড়ি

    ছুরি থেকে কোরবা বাসরাস্তার উপরে চারটে গ্রাম অধিগ্রহণ করে বিশ্ব ব্যাংকের টাকায় গড়ে উঠেছে ২১০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার থার্মাল পাওয়ার স্টেশন। গ্রামের পেছন দিয়ে বয়ে গেছে ক্ষীণস্রোতা আহিরণ নদী, আর নদীর ওপারে চার চারটে কয়লা খনি। সেই কয়লা দিয়ে জ্বলছে থার্মাল পাওয়ারের ফার্নেস, সেখান থেকে উৎপন্ন তাপে ঘুরছে প্রচণ্ড শক্তিশালী টার্বাইন এবং সেন্ট্রাল গ্রিডে বিদ্যুতের জোগান
    নিরন্তর।

    এই গ্রামগুলো, অর্থাৎ দররি, চারপাড়া, টাঙ্গামার, নগৈখার, আগে আমাদের খাতক কৃষকদের গ্রাম ছিল। এরা মূলতঃ ভোরিয়া উপজাতির লোক, চাষবাস নিয়ে থাকে। নৃতাত্ত্বিক দিক থেকে বৃহত্তর গোণ্ড আদিবাসীদেরই ছোট অংশ।

    এখন সেখানে গড়ে উঠেছে এক শিল্প নগরী, তাতে আছে চওড়া পিচের রাস্তা, একগাদা স্টাফ কোয়ার্টার, সেন্ট্রাল স্কুল, ছোটখাট স্টেডিয়াম, প্রথমে স্টেট ব্যাংক, পরে পাঞ্জাব ন্যাশনাল, ইউকো ইত্যাদি। সিনেমা হল। কফি হাউস এবং বিভিন্ন বিপণি।

    গাঁয়ের লোক অবাক বিস্ময়ে দেখে—কত রকম লোকজন, কত রকম ভাষা আর সবার চলনবলন কেমন আলাদা। বেশির ভাগ লোক জমি দিয়ে বদলে পুরনো রেজিস্ট্রির দরে ক্ষতিপূরণের টাকা নিয়ে চলে গেছে আরও দূরের বসতি খুঁজতে।

    তবে বেশ কিছু লোক প্ল্যান্টে চাকরি পেয়েছে—চৌকিদারের, চাপরাশির, রোড রোলার অপারেটরের, জমির পাটোয়ারিগিরির, রঙের মিস্ত্রি, ঢালাই মিস্ত্রি ইত্যাদি। ওদের বাচ্চারা এখানকার সরকারি স্কুলে নামমাত্র মাইনেয় ভর্তি হয়ে পড়তে যায়। ছোট হাসপাতালটি মন্দ নয়। সার্জন, গাইনি, ফার্মেসি—সবই আছে।

    সে তো কয়েক বছর পরের কথা। তার আগে আসুন, ফিরে যাই ১৯৭৮ সালের গ্রীষ্মকালে।
    এই এলাকাটা কিঞ্চিৎ পাথুরে, তায় জমির নীচে পাওয়া গেছে বিশাল কয়লার আকরের খোঁজ। তাই এই অঞ্চলে গরমের সময় আগুন ছেটানো গরম।
    আবার শীতের দুটো মাস একেবারে হি-হি শীত।

    এই গ্রামের পুরুষানুক্রমে বাস করা ভোরিয়া আদিবাসীর দল রাষ্ট্রের প্রয়োজনে হারাবে তাদের পিতৃপুরুষের ভিটে, আঙিনার কুয়ো, রান্নাঘরের পেছনে ঘরের মেয়েদের যত্নে গড়ে তোলা ‘কোলাবারি’ বা কিচেন গার্ডেন। বদলে যা টাকা পাবে তাতে এদিকে সমান জমি পাবে না। তবে অনেক দূরের অনাবাদী এলাকায় কিছু জমি কিনতে পারবে।

    কিন্তু হাতে কাঁচা টাকা এলে তুমি কার! কে তোমার! সম্পন্ন ঘরের লোকজন ভাবে ট্রাক কিনে কয়লা সাপ্লাইয়ের ব্যবসা শুরু করবে, কেউ ভাবে আর একটা বিয়ে করবে।
    বর্তমান স্ত্রী যে সন্তান দিতে অক্ষম! কিন্তু কবি কবেই বলে গেছেন - ‘নিশার স্বপন সুখে সুখী যে কি সুখ তার! জাগে সে কাঁদিতে”।
    এদেরও কিছুদিন পরে সেই হাল। লাভের গুড় পিঁপড়ে খেয়ে গেছে! আমও গেছে, ছালাও গেছে।

    কিন্তু তার আগে যা হল — সেই কথা বলি।

    তিনটে ব্যাংক প্রতিযোগিতায় নেমেছে—কোরবার স্টেট ব্যাংক এবং সেন্ট্রাল ব্যাংক, আর আমাদের গ্রামীণ ব্যাংক। সে একেবারে ভোটের মতন ধুন্ধুমার কাণ্ড! সেসব দিনে সমস্ত ন্যাশলাইজড্‌ ব্যাংকের জমা টাকায় দেয় সুদের হার একই থাকত, সেভিংস হোক বা টার্ম ডিপোজিট।

    সেট ঠিক করত কে? রিজার্ভ ব্যাংক, আবার কে!
    ইন্দিরা গান্ধীর ব্যাংক রাষ্ট্রায়ত্তকরণের পর দশটা বছরও হয়নি যে!
    তাহলে কী দিয়ে সম্ভাবিত খাতকদের লোভ দেখিয়ে টেনে আনা যাবে?
    গ্রাহক সেবা বা কাস্টমার সার্ভিস দিয়ে।

    দেখুন, স্টেট ব্যাংক বলছে — আমাদের ব্যাংক হল ভারত সরকারের ব্যাংক। সেই ইংরেজ আমল থেকে। এখানে সরকার টাকা রাখে।
    তোরা যে চেক পাবি, সেও আমাদের চেক। এই দ্যাখ, কী লেখা আছে? পড়তে শিখিস নি? এই মাস্টার বা গুরুজিকে দিয়ে পড়িয়ে নে।
    বড় বড় করে লেখা আছে “স্টেট ব্যাংক অফ ইন্ডিয়া”!

    গ্রামীণ ব্যাংক? ওরা যদি ব্যাংক হয় তো আরশোলাও পাখি। সবে হাঁটতে শিখেছে। দুধের দাঁত পড়েনি। ওদের কাছে বেশি টাকা থাকে না।
    সপ্তাহে দু’দিন আমাদের কাছে এসে টাকা নিয়ে যায়। কেন? ওদের দরজায় বন্দুকধারী সিকিউরিটি নেই।
    তোরা এত টাকা পাবি, বড় জায়গায় রাখ।

    ওদের কাছে রাখলে পরে যদি কিছু হয়ে যায়! বড় গাছে নৌকো বাঁধতে হয়।

    গ্রামীণ ব্যাংকের প্রচারঃ তোরা স্নান করতে কোথায় যাস, সমুদ্রে নাকি পাড়ার পুকুরে?
    খাবার জল কোত্থেকে আনিস? বাড়ির কুয়ো থেকে নাকি দশ কোশ দূরের নদী থেকে?
    স্টেট ব্যাংকে যাবি? ওরা খুব বড় ব্যাংক, একেবারে সমুদ্র। যা কাল গিয়ে নিজের চোখে দেখে আয়। এত ভীড়, থই পাবি না।
    ওখানে সব বড় মানুষের ভীড়। টাকা তুলতে গেলে চেক কাটতে হয়, কিন্তু ইংরেজিতে। পারবি?
    আরে তুই তো বুড়ো আঙুলের টিপছাপ দিস। তোকে ওখানে সারাদিন দাঁড় করিয়ে রাখবে।

    বিয়ে হয়ে গেলে যেমন ভাঙাহাটে বরযাত্রীদের কেউ খোঁজ নেয় না, তেমনই একবার টাকা জমা হয়ে গেলে স্টেট ব্যাংক তোদের আর খোঁজ নেবে না।

    আমরা ছোট ব্যাংক ঠিক। তবে আমাদের সাইনবোর্ড গুরুজিকে দিয়ে পড়িয়ে নে। দেখ “ভারত সরকার দ্বারা প্রায়োজিত”। মানে আমরাও দিল্লি সরকারের।
    আর এই দেখ, লেখা আছে “গ্রামীণ ব্যাংক”, অর্থাৎ দেহাতি বা গেঁয়ো ব্যাংক। মানে ভারত সরকার এই ব্যাংক তোদের জন্যেই খুলেছে।
    কেন?

    স্টেট ব্যাংক হল শহুরে ব্যাংক। দ্যাখ না, ওদের সব শাখা শহরে।

    আমাদের এখানে টাকা তুলতে গেলে হিন্দিতে কাগজ ভরতে হবে। লিখতে না জানলে ব্যাংকের স্টাফ ফরম ভরে দেবে।

    স্টেট ব্যাংক এসব করবে?
    সরকারের ইচ্ছে গ্রামীণ জনতার টাকা গ্রামীণ ব্যাংকে জমা থাকবে।
    সরকার হল ভগবানের মত। ঠাকুরের কথা শুনতে হয়, নইলে!

    তবে স্টেট ব্যাংকের ‘কাস্টমার এন্টারটেইনমেন্ট’ ফান্ডের পকেট বড়।
    আমাদের ব্যাংক মাত্র দেড়বছর হল খুলেছে, কোন পকেটই নেই।

    ওরা গাঁয়ে গেলে লোকজনকে, বিশেষ করে গাঁয়ের ওপিনিয়ন লীডারদের কথায় কথায় চা-বিস্কুট খাওয়ায়; ভরা দুপুরে গাড়ি করে বাড়ি পৌঁছে দেয়।
    আমরা পুওর রিলেশন। একটু দূরে দাঁড়িয়ে দেখি, আর মনে মনে ভক্তিগীতি গাই — “কবে হবে আমার শুদ্ধ প্রাণমন, কবে যাব আমি প্রেমের বৃন্দাবন’!

    আমাদের টিমে পাঁচজন অফিসার, প্রোবেশনে রয়েছে। আর আমাদের গুরুদেব স্টেটব্যাংকের থেকে ডেপুটেশনে আসা স্কেল ওয়ান অফিসার সত্যদেব বোস।
    উনি দুপুর দেড়টা নাগাদ আমাদের ফৌজি কায়দায় দাঁড় করান। পেট ভরা আছে? জল খাওয়া হয়েছে? কাঁচা পেঁয়াজ কেটে পকেটে রেখেছ? গামছা নিয়েছ মুখ বাঁধতে? মাথায় কাপড়ের টুপি?
    এসব হল গরম হাওয়া বা লু’ থেকে বাঁচতে টোটকা।

    সন্ধ্যেবেলা অভিযান থেকে ফেরার সময় জয়সওয়াল হোটেলে ঢুকে আগে গরম চা, তার খানিকক্ষণ পরে শরীর জুড়োলে তবে জল খাওয়া। উনি বলেন—হ্যারিকেন যখন জ্বলে তখন তার গরম কাঁচের গায়ে বৃষ্টির ফোঁটা পড়লে কেমন চড়চড় করে ফাটে দেখিস নি?

    না, আমরা ওসব দেখি নি। কিন্তু গত সপ্তাহেই কোরবার সেই হোটেলে ঢুকতে গিয়ে দেখি পাবলিকের ভীড়।
    বারান্দায় একজন পুলিশ কনস্টেবল দেয়ালে হেলান দিয়ে পা ছড়িয়ে বসে আছে। নিষ্পলক উদাস দৃষ্টি, বন্দুকটা মাটিতে শোয়ানো।
    জানতে পারলাম আধঘন্টা আগে মারা গেছে।
    ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে বাইক চালিয়ে গরম হাওয়ার থাপ্পড় খেয়ে হোটেলে ঢুকে চায়ের অর্ডার দিয়ে সোজা টেবিলে রাখা জলের গেলাস তুলে ঢকঢক করে খেয়েছে। তা
    রপর এই কাণ্ড, থানায় খবর গেছে।

    তবে বোস স্যারের কিছু নিজস্ব কায়দাকানুন আছে। উনি দুপুরে অন্তরঙ্গ বৈঠক করতে আগে সেই গাঁয়ের কার কত জমি যাচ্ছে তার থেকে গড়পড়তা জমির দরে গুণভাগ করে আন্দাজ করে নেন — কে কী রকম টাকা পাবে। সেখানে কোন বড় মানুষের আঙিনায় গিয়ে বলেন — খাটিয়া পেতে দে।
    তারপর সেই খাটিয়ায় বসে নিজের শার্ট খুলে গেঞ্জি গায়ে বসে শুরু করেনঃ
    কস গা গৌটিয়া? এদারে কেইসে করবে? কৌন ব্যাংক মা যাবে?
    কী গো মোড়লের পো! এবার কোন ব্যাংকে? (কাকে ভোট দেবে সুরে)

    সন্ধ্যেবেলা সৈয়দ বলে – আচ্ছা, উনি কারও বাড়ি গিয়ে তার আঙিনায় বসে আগেই শার্ট খুলে ফেলেন কেন? আমার কেমন অস্বস্তি লাগে।
    -- তুই এসব চাল বুঝবি না। গ্র্যাজুয়েট হয়েছিস মুম্বাইয়ে, মাস্টার্স করেছিস দিল্লিতে।
    বোস স্যার কোলকাতার বাঙালি নন, খাস ছত্তিশগড়িয়া! প্রথম জীবনে বাস ডিপোতে বুকিং করার কাজও করেছেন। আগে স্টেট ব্যাংকের ক্লার্ক ইউনিয়নের গোটা মধ্যপ্রদেশের ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন।
    একদম মাটির গন্ধ শোঁকা লোক, তুই বুঝবি না।

    -- সব শুনলাম। কিন্তু এর সঙ্গে জামা খুলে ফেলার কী কানেকশন?
    -- রায়, তুই আদ্দেক কোলকাতা, আদ্দেক ছত্তিশগড়। তুইই বল।
    -- বলব? আসলে উনি গ্রামীণ পরিবারের সঙ্গে অন্তরঙ্গ হতে চান। তাই জামা খোলেন।

    -- এটা কোন কথা হল? কী যে বলিস পাগলের মত। পাক্কা বইহা আদমি।
    -- কোন সংস্কৃত মন্ত্র বলেছি কি? আরে মানুষ যত ঘনিষ্ঠ হয় তত জামাকাপড় খোলে। বিয়ের পর একজন অচেনা নারীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে মানুষ কী করে ? জামাকাপড় খোলে। উনিও সেই ফর্মূলা লাগাচ্ছেন।
    দেখবি, গৌটিয়া যদি বেশি পাত্তা দেয়, তাহলে উনি আরও ঘনিষ্ঠ হবেন। পেন্টুল খুলে হাফপ্যান্ট পরে বসবেন।
    -- স্যার যদি জানতে পারে! কেন জানবে? তোরা যদি চুকলি করিস তবে না!

    মিশ্র চশমার ফাঁকে মুচকি হাসে।
    -- আরে উনি কিছু মনে করবেন না। শোন তাহলে, সেদিন আমাকে নিয়ে বিলাসপুরে স্টেট ব্যাংকের মেইন ব্র্যাঞ্চে গেছলেন। উনি পুরনো ইউনিয়নের নেতা, সবাই ভীড় করে এল—বিশেষ করে মেয়েরা।
    উনি একজনকে টার্গেট করলেন। -- কিঁউ, তোমার সেই তেনার কী খবর? টিকে আছে? নাকি ছুঁয়ে-টুয়ে কেটে পড়েছে?
    আরে তুমি আমাকে চান্স দিয়ে দেখতে! তোমার লাইফ বানিয়ে দিতাম।

    বোস স্যার দু’দিনের ছুটিতে। ভাবীজি বিলাসপুরের নার্সিংহোমে ভর্তি।
    আজ আমাদের লীডার মিশ্র। একটা বড় গাঁয়ের পেমেন্ট হবে। আদ্দেক পেমেন্ট মেয়েদের নামে।
    স্টেটব্যাংক আটঘাট বেঁধে মাঠে নেমেছে। এক ট্রাক ভরে গাঁ থেকে মেয়েদের তুলে এনে কোলিয়ারির পেমেন্ট অফিসের পাশের মাঠে বসিয়ে রেখেছে। পাহারা দিচ্ছে ওদের চাপরাশি, আমাদের ঘেঁষতে মানা।
    গায়ে পড়ে মেয়েদের সঙ্গে আলাপ করলে পুরুষেরা আপত্তি করবে, তাছাড়া অফিসারেরা কথা বললে মেয়েরা ঘোমটা টেনে মুখ ঘুরিয়ে নেবে।

    বুদ্ধি দিল মিশ্র এবং সৈয়দ।
    -- রায়, তোকে এখানে কেউ চেনে না। একবার চেষ্টা করে দেখ। আমরা আমাদের চাপরাশিকে এক বাণ্ডিল বিড়ি দিয়ে ওদের চাপয়াশির সঙ্গে গল্প করতে পাঠাচ্ছি।

    আমি ঘরে গিয়ে বালতিতে ফেলে রাখা ময়লা পাজামা-কুর্তা এবং হাওয়াই চটি পরে চলে আসি।
    তারপর অনভ্যস্ত হাতে একটা বিড়ি ধরিয়ে দু’বার কেশে মাটিতে বসে থাকা মহিলাদের নিজের পরিচয় দিয়ে বলি আমার নাম মঙ্গলরাম। এদিকে নতুন একটা ব্যাংক খুলেছে, গ্রামীণ ব্যাংক -- আমি তার চাপরাশি।
    তারপর ধীরে ধীরে গল্প শুরু হয়। আমাদের সেট ডায়লগ ঝাড়ি। তিন মহিলার মন গলে যায়।
    ওরা বলে – ঠিক আছে, কিন্তু আমাদের মাথা হল ভলপহরিন বাঈ, ওকে বোঝাও দিকি! তাহলেই কাজ হবে।

    ভলপহরিন নামে বিশাল, কিন্তু ছোটখাটো চেহারার নরমসরম অথচ কড়া ধাতের মাঝবয়েসি মহিলা। ভলপহরি বলে পাহাড়ি গাঁয়ের মেয়ে, তাই অমন নাম।
    সে সব শুনে খিঁচিয়ে ওঠে — এ, এখন তো সব মিঠি মিঠি ভাল ভাল কথা শুনছি। তিনমাস পরে তোদের ব্যাংকে গেলে যদি চিনতে না পারিস? মুখ ঘুরিয়ে নিস? সারাদিন রোদ্দূরে বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখিস?
    বুঝে যাই, নির্ঘাৎ আগে স্টেট ব্যাংকে গিয়ে এমন অভিজ্ঞতা হয়েছে। তখন কাছেপিঠে একটাই ব্যাংক ছিল।

    -- শোন মাতারাম, শোন দাঈ! তোদের মা বলে ডেকেছি, আমি তোদের ছেলে। যদি তোদের অসম্মান হয় তাহলে আমাকে দুষ্টু ছেলে ভেবে সবার সামনে গালে দুটো চড় কষিয়ে দিস্‌।

    সবাই হেসে ওঠে। পরিবেশ হালকা হয়। হাসি শুনে ভলপহরী বাঈয়ের মরদ হাজির হয়। আমি বিপদের আশংকায় কেটে পড়ি।

    একটু পরে মিশ্র এসে বলে — আমি পুরুষদের মধ্যে ক্যাম্পেন করতে গেছলাম।
    ওদের নেতা বলল, তুই চলে যা সাহেব। তোদের চাপরাশি এসে খুব ভাল করে বুঝিয়ে গেছে। আর দরকার নেই।
    সন্ধ্যের মুখে মেয়েদের চেকের সত্তর ভাগ গ্রামীণ ব্যাংক পেল, আর পুরুষদের তিরিশ ভাগ।
    তবে সবগুলো গ্রাম মিলিয়ে দেখলে আমরা পেয়েছি মোট পেমেন্টের পঁচিশ ভাগ আর স্টেটব্যাংক পঁচাত্তর।

    আকবর বাদশাহের বিরুদ্ধে পুত্রসম সেলিমের বিদ্রোহ ব্যর্থ। কিন্তু চেয়ারম্যান ডেকে বললেন — স্টেটব্যাংকের সঙ্গে কম্পিটিশন? স্বপ্নেও ভাববেন না। আপনারা তো পঁচিশ পার্সেন্ট ডিপোজিট এনেছেন। পনের-কুড়ি আনলেও খুশি হতাম।
    এসব যুক্তি হিসেবে সঠিক। কিন্তু দিল হ্যায় কী মানতা নহীঁ।

    তিনমাস পরে ভলপহরী বাঈ এসেছে ওর স্বামী এবং কয়েকজন সখীর সঙ্গে, টাকা তুলতে। আমাকে শার্টপ্যান্ট পরে চেয়ার-টেবিলে বসে কাজ করতে দেখে ওদের চোখ কপালে।
    আমি তো-তো করছি, মিশ্র বলল – ও এখন প্রমোশন পেয়ে সাহেব হয়ে গেছে।
    ওরা মিশ্রকে আশীর্বাদ করে বলল — বনে করে হস্‌! ভাল করেছিস, চাপরাশিকে সাহেব বানিয়ে দিয়েছিস। লোকটা ভাল।

    যাহোক, আমাদের বোসস্যারের স্টেটব্যাংকে ফেরত যাওয়ার দিন ঘনিয়ে এল। আমরা কোরবার হোটেলে পার্টি দিলাম। সবার মন খারাপ। উনি যে খিস্তি করারও গুরুদেব। একটা ডিফল্টার লোক এসে লোনের পাওনা টাকা জমা না করে বিরাট লেকচার দিচ্ছিল।
    উনি চুপচাপ সবটা শুনে বল্লেন — ওরে, আমি তিন বাচ্চার বাপ। আমাকে বৌয়ের সঙ্গে শোয়া শেখাতে এসেছিস?

    ওনার তাকিয়া কলাম বা ক্যাচফ্রেজ ছিল — “নান লাইক”!
    বড়ে গোলামের গান নিয়ে কথা উঠলে উনি বলবেন — ইয়েস, বাট নান লাইক কিশোর কুমার!
    ভিন্নু মানকড়ের কথা উঠলে বলবেন — ইয়েস, বাট নান লাইক কপিল দেব!

    প্রতিমাসে একটা করে হিন্দি জাসুসি নভেল কিনে আনতেন আর পড়া হলে আমাদের দিয়ে দিতেন।
    সৈয়দ একবার ক্যাশ ভেরিফিকেশন করতে দুটো ব্রাঞ্চে গেল। ফিরে এলে বোস স্যার রিপোর্ট চাইলে ও বলল — আমি প্রথমে জোধা বাঈয়ের ব্রাঞ্চে গেছলাম, তারপর আনারকলির ব্রাঞ্চ হয়ে ফিরলাম।

    আমরা হেসে উঠলাম। ওই দুই ব্রাঞ্চের ম্যানেজার দুই তরুণী — একজন পৃথুলা, অন্যজন তন্বী শ্যামা শিখরিদশনা।
    উনি কড়া চোখে তাকিয়ে বললেন — মিস্টার, আজকাল খুব জবান চলা রহে হো! খুব জিভ চলছে দেখছি!

    আমাকে নাটক করতে যাওয়ার জন্যে ছুটি দেন নি। বলেছেন — ঘরে শুয়ে ঘুমোলে ছুটি দেব, নাটক-ফাটক নয়।

    একবার মাসের শেষে বাড়ি যাব, টাকা নেই। সবাই বলল — স্যারের কাছে চেয়ে দেখ। উনি বাবা মায়ের ব্যাপারে খুব ইমোশনাল। প্রতিমাসে আলাদা করে টাকা পাঠিয়ে দেন।
    আমি একটা কাগজে লিখলাম “রায় কো ঘর জানে কে লিয়ে পঁচিশ রুপিয়া কী জরুরত”। সেটা একটা কার্ডবোর্ডে পেস্ট করে টেবিলে দুটো লেজারের ফাঁকে দাঁড় করিয়ে দিলাম।
    উনি খানিকক্ষণ পরে দোতলার রেসিডেন্স থেকে নামলেন।

    সবাই হাসি চেপে রেখে দেখছে। কথা বলতে বলতে হঠাৎ চোখ গেল ওদিকে।
    -- এ ক্যা তামাশা হ্যায়? হটাও উসকো।
    তারপর কাগজটা হাতে নিয়ে দেখলেন। হুঁ, কত চাই? পঁচিশ? দিলেন পঞ্চাশ টাকা।

    যাওয়ার দিন সবার গলা ধরে গেছে।
    উনি পরিবেশ হালকা করতে বললেন — তোদের সঙ্গে আবার দেখা হবে। দু’বছর পর নতুন কোলিয়ারি খুলছে। খুব বড় পেমেন্ট।
    আমি আসব স্টেট ব্যাংকের টিম নিয়ে, তোদের নাকানি চোবানি খাওয়াবো।
    মিশ্র বলে – কী করে? সব দাঁও - প্যাঁচ তো আপনি হাতে ধরে শিখিয়ে যাচ্ছেন।
    -- উঁহু, গুরু নিরানব্বইটা শেখায়, একটা লুকিয়ে রাখে। সেইটা দেখাব।

    আমি লেকচার ঝাড়ি — স্যার, শিষ্যাদ্‌মিচ্ছেৎ পরাজয়ম! ভাল গুরু সবসময় চান শিষ্যের কাছে হার মানতে। চাইবেন শিষ্য গুরুকে ছাড়িয়ে যাক। এটাই ভারতীয় ট্র্যাডিশন।
    -- ভাগ, যত উলটো পালটা কথা! সংস্কৃত জানি না বলে আগড়ম বাগড়ম বকে ফান্ডা দেখাবি — ভুলে যা!
    আর এই যে রায়! গ্রামের লোককে বলব — এর চালচলন দেখ, ব্যাংক ম্যানেজার না বইহা! বদ্ধ পাগল একটা।
    কোন কাজের না, খালি বকবক করে। ব্যস্‌ এতেই কাজ হবে।

    আমি হাসি।
    -- স্যার আমার ঠাকুমা শিখিয়েছিলেন, ‘গুরু হাগে নইয়া, ত শিষ্য হাগে চালএ উইঠ্যা’।
    গুরু যদি উবু হয়ে বসে পায়খানা করে, তো শিষ্য হাগে ঘরের চালে উঠে!
    আর আমি আপনার শিষ্য তো বটি!
    পরিবেশ হালকা হয়ে যায়। গাড়ি হর্ন দিচ্ছে। উনি হাত নেড়ে উঠে বসে পড়েন।

    আমরা কোরাসে চেঁচাই — নান লাইক মিঃ বোস!
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ধারাবাহিক | ১৮ মে ২০২৫ | ৫৫৮ বার পঠিত
  • আরও পড়ুন
    লাল রঙ - Nirmalya Nag
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • অপু | 2402:3a80:1983:fb89:278:5634:1232:***:*** | ১৯ মে ২০২৫ ০০:৫৪731472
  • এটা বই করা হোক রঞ্জন দা... দাবি জানালাম...
  • হীরেন সিংহরায় | ১৯ মে ২০২৫ ০১:০৬731474
  • অতি উত্তম, ভ্রাতঃ রঞ্জন, যথারীতি। সাধু।

    দুয়েকটা কথা মনে এলো। ষ্টেট ব্যাঙ্ক তো গ্রামীণ ব্যাঙ্কের মাতৃ স্থানীয়া, দুহিতার সঙ্গে বিবাদ করবে কেন? তুমি হয়তো একবার বুঝিয়েছিলে, ভুলে গেছি।

    আমাদের সময়ে ষ্টেট ব্যাঙ্কে ছিল ভারত সরকারের সকল কাজের কাজি, আদান প্রদানের একমাত্র সেরেস্তাদার, নায়েব। কিন্তু তুমি আর আমি যখন কাজে ঢুকেছি, ষ্টেট ব্যাঙ্কে ভারত সরকারের মালিকানা তখন ৬০% এবং ১৯৬৯ সাল থেকে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে মালিকানা ১০০%, অর্থাৎ ব্যাঙ্ক অফ বরোদা বা পি এন বি বেশি সরকারি ! আমরা এই তথ্যটি নীটলি এড়িয়ে যেতাম !

    তোমার লেকচার হয়তো অধুরা, সর্বেভ্য জয়মিচ্ছেন্তু পুত্রাৎ শিষ্যৎ পরাজয়ম (ঈশ ভুল হলেও সংস্কৃত ঝাড়ছি দেখে আমাদের স্কুলের পণ্ডিত মশায় কি খুশি হতেন)। পিতা ও গুরু পুত্র ও শিষ্যের নিকট পরাজয় ইচ্ছা করেন। পুত্রকে ডিলিট করো না ।

    ব্যাঙ্কের বাজারে সেলস মার্কেটিঙের হাড্ডাহাড্ডি লড়াই একই ব্যাপার, সে বিলাসপুর হকা আর বার্সেলোনা বুদাপেস্ট হোক। কান্না হাসির দোল দোলানো বাজেট বানানোর খেলা। 
     
    পু - শিবাংশুর রিজয়েনডারের অপেক্ষায় রইলাম
  • অপু | 2402:3a80:1983:fb89:278:5634:1232:***:*** | ১৯ মে ২০২৫ ০১:২৫731475
  • শ্রদ্ধেয় হীরেন দা, গুরুচন্ডালীর দোকান থেকে আপনার "ইউরোপের ডায়েরী" সংগ্রহ  করেছি।
     
    গুরু তে বিচ্ছিন্ন ভাবে বেশ কয়েকটা লেখা পড়েছিলাম। বেশ ভালো  লেগেছিল। 
     
    তাই সংগ্রহে রাখলাম। আবার প্রথম থেকে পড়বো
  • হীরেন সিংহরায় | ১৯ মে ২০২৫ ০১:৫৪731476
  • অশেষ ধন্যবাদ! মতামত জানানোর ঠিকানা আমার হোয়াটসএ‍্যাপ
     
    ০০ ৪৪ ৭৮৮৭ ৬২৬৭৩০
  • অপু | 2402:3a80:1983:fb89:278:5634:1232:***:*** | ১৯ মে ২০২৫ ০২:২৩731477
  • ঠিক আছে হীরেন দা।
  • Ranjan Roy | ১৯ মে ২০২৫ ০৭:২৯731483
  • হীরেনদা,
    আপনি 100% সঠিক।
  • শিবাংশু | ১৯ মে ২০২৫ ১১:৩৭731487
  • রঞ্জনের এই সিরিজটি দুয়েকটা কিস্তি এলে পড়ে ফেলি এবং অপেক্ষা করি। ততঃ কিম? তিনি যে রকম বলেছিলেন তা অনুযায়ী বিশতম কিস্তিটিই অন্তিম ভাগ হতে পারে। 

    আমার পিতৃদেব ছোটোবেলায় কলাশিল্প হিসেবে 'অভিনয়'-এর ফান্ডা বোঝাতেন একটা ছোটোগল্পের প্রসঙ্গ এনে। গল্পটি সম্ভবত নরেন্দ্রনাথ মিত্রের রচনা। আমার বাবা-মা দুজনেই ছিলেন নরেন্দ্রনাথের একনিষ্ঠ মুগ্ধ পাঠক। তাঁদের পুত্রও তাই। গল্পটির আখ্যান হলো, কখনও একজন মহিলা এক চিত্র পরিচালকের কাছে এসে আর্জি জানান তিনি খুবই দুরবস্থায় পড়েছেন। তাঁকে ছবিতে একটা সুযোগ করে  দিতে হবে। তিনি এও খবর পেয়েছেন, পরিচালকের আগামী ছবিটি একজন দুঃখী মেয়ের গল্প নিয়ে তৈরি হবে। অভাবের সঙ্গে তার লড়াই, সামাজিক নিপীড়ন ও অবিচারের  চাপ ইত্যাদি অভিনয়ের মাধ্যমে দর্শকের কাছে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে হবে। পরিচালক তখন কিঞ্চিৎ দ্বন্দ্বের মধ্যে ছিলেন। তাঁর নিয়মিত নায়িকা তখন একটু স্টার হয়ে গেছেন। পরিচালকের সঙ্গে তকরার করেন। নবাগতা মহিলাটি যথেষ্ট প্রিয়দর্শন, শিক্ষিত এবং স্মার্ট। প্রার্থিত ভূমিকাটিতে মানিয়ে যাবেন। তিনি একটি দৃশ্য, যেখানে মেয়েটি তাঁর স্বামী ও  আত্মীয়দের থেকে অত্যাচারিত হয়ে বিলাপের ঢং-এ সংলাপ বলবে , মহিলাকে বুঝিয়ে দিলেন। যাকে বাংলায় 'সিচ্যুয়েশন' বলে। নবাগতা বললেন তিনি বাড়িতে একটু অভ্যাস করে আসবেন। তার পর পরীক্ষা দেবেন। পরিচালক তাঁকে পরপর তিন দিন সুযোগ দিলেন। কিন্তু নবাগতা কিছুতেই পর্দায় নিজেকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে পারলেন না। যদিও এই সব কাণ্ড তাঁর বাস্তব জীবনে নিত্য ঘটে থাকে। শেষে পরিচালক তাঁর নিয়মিত নায়িকাকে ডাকলেন।  তিনি তখন 'স্টার'। উগ্র বেশভূষা, কৃত্রিম জেল্লায় মুখর এক অভিনেত্রী। নবাগতা ভাবলেন, ইনি কী করে কঠিন বাস্তবের এই ট্র্যাজেডি  ফুটিয়ে তুলতে পারেন? স্টার অভিনেত্রী পরিচালকের কাছে 'সিচ্যুয়েশন' জানতে চাইলেন।  পরিচালক একটি মাত্র বাক্য়ে বুঝিয়ে দিলেন তিনি কী চান। কয়েক পলক মাত্র সময় নিয়ে অভিনেত্রী সেটে দৃশ্যটি এমন ভাবে অভিনয় করে দেখিয়ে দিলেন যে নবাগতা নিজেও আবেগে অশ্রুসজল। যাপনের 'বাস্তবতা ' আর অভিনয়ের 'বাস্তবতা 'র মধ্যে যে  ফারাক, জীবন ও শিল্পের  মধ্যে তফাতটিও এক রকম। 

    আমার অভিজ্ঞতা অনুযায়ী স্টেট ব্যাংক ও পোষ্য গ্রামীণ ব্যাংকগুলির ব্যবসায়িক ভাবমূর্তির মধ্যে বাস্তব যাপনের নানা জটিল সমীকরণ কাজ করে। কৃষকের দাওয়ায় খাটিয়াতে বসে জল চাইলে সম্ভাব্য গ্রাহকের থেকে অবশ্যই সহানুভূতি পাওয়া যায়। কিন্তু আমাদের বর্ণবাদী সমাজে অধিকাংশ মানুষের মনেই 'বড়ো সাহেব'দের প্রতি জন্মগত যে 'সমীহ' কাজ করে তার জোরে 'বহিরাগত ' হলেও স্টেট ব্যাংক বাজি মেরে দেয়। কারণ 'টাকাপয়সা ' একটা সিরিয়াস ব্যাপার। সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত পুরুষরা নেয়। তাদের কাছে 'সটেট' ব্যাংকের 'মর্যাদা ' অন্য পর্যায়ের।  

    একটা গল্প হলেও সত্যি থাকুক এখানে। ব্যক্তিগত ভাবে 'শাখাপ্রবন্ধক' হিসেবে আমার প্রথম ব্রাঞ্চটি ছিলো শহরের মাঝখানে একটি নিবিড় বসতির  মধ্যে। সেটি ছিলো বণিকদের এলাকা। বাড়ির পুরুষরা সকাল সাতটার মধ্যে লক্ষ্মীদেবীর আহ্বানে নির্গত হয়ে যেতেন। ফিরতেন অর্ধেক রাত পোয়ালে। বারোটা থেকে দুটো পর্যন্ত ব্রাঞ্চে গৃহলক্ষ্মীদের অবিরাম গতায়াত। আপাতভাবে তাঁরা মস্তো কোনও ব্যবসা নিয়ে আসতেন না। কিন্তু সুযোগ পেলেই ম্যাঞ্জার সাহেবের কাছে জনান্তিকে শাশুড়ি, জা, ননদের নামে কিছু অভিযোগ জানিয়ে যেতেন। তখন আমারও কম বয়স। খুব সাবধানে থাকতে হতো। কারণ সেই সব মহিলারা ছিলেন পঞ্জাবি ও  সিন্ধি সম্প্রদায়ের। ডাকসাইটে সুন্দরী তাঁরা।  একদিন ওই পাড়ার এক মোড়ল ধরনের  মস্তো বণিক, যিনি সচরাচর ব্যাংকে আসতেন না। ছেলেপুলেরাই আসাযাওয়া করতো। আমার চেম্বারে বসে বেশ কিছুক্ষণ খেজুর করলেন। আমিও মলাই মারকে চায়, বিস্কুট খাইয়ে তাঁর অভ্যর্থনা করলুম। তখনও পঞ্জাবি বলার অভ্যেসটা সামান্য বেঁচে ছিলো। ওঠার সময় তিনি পৃথুল হাত দুটি সামনে বাড়িয়ে বললেন, জনানাদের থেকে শুনতে পাওয়া যায় ম্যাঞ্জারসাব  বহুত মিলনসার,  হমেশা মুস্কুরাতা ইনসান। অব মেরা ভি য়কীন হো গয়া। এর পর ব্যবসা পাওয়াটা কুইড প্রো কো।  

    সবই জীবনের বাস্তবতা আর শিল্পের বাস্তবতার ফারাক। হীরেনদার আদেশে 'পণ্ডিতি ' লেখা ফেলে রেখে খানিকক্ষণ খেজুর করলুম। পাঠকরা মার্জনা করবেন। তিনি যেটা বিশ্ব মানচিত্রে করে দেখিয়েছেন, সেখানে  আমার মাঠ শুধু ভারতবর্ষ। আর রঞ্জনের লেখা নিয়ে কীই বা বলি? বন্ধুদের নিয়ে 'নেপো' করতে ঠাকুর মানা করেছেন।  :-)
  • Ranjan Roy | ১৯ মে ২০২৫ ১৩:১২731492
  • জহাঁ চার ইয়ার মিল গয়ে  তো----
     
    একটা কথা। 
    আমার ভুলে 17 এবং 18 তে একই লেখা পোস্ট হয়েছে। ফলে যেটা 20, সেটা আসলে 19।
    হ্যাঁ, লাটাই গোটানোর সময় হয়েছে।
    মনে হচ্ছে আরও তিনটে কিস্তি লাগবে।
  • রমিত চট্টোপাধ্যায় | ১৯ মে ২০২৫ ১৩:৩০731493
  • সিরিজটা খুব ভালো হচ্ছে। এত অল্পে মেটালে চলবে না। আরো বেশ কিছু গল্প লিখুন।  এই দাবি+অনুরোধ রইল পাঠকদের তরফ থেকে।
  • r2h | 134.238.***.*** | ১৯ মে ২০২৫ ২৩:০৮731519
  • আমার একটা প্রস্তাব আছে - রঞ্জনদা, শিবাংশুদা, আর হীরেনবাবু একটা যৌথ লেখা নামান, একটা পূর্ণাঙ্গ বইয়ের গঠন মাথায় রেখে।

    কথোপকথন/ আড্ডার ধাঁচে - প্রস্তাব, উত্তর, প্রতিউত্তর।
    বিষয়বস্তু অবশ্যই অর্থনীতি ঘিরে - প্রাচ্য পাশ্চাত্য, নগর গ্রাম ইত্যাদি নানান স্তর, বৈপরীত্য ঘিরে।
    জটিল বিষয়, কিন্তু লেখকদের কব্জির জোরের কাছে কিছু না।

    প্রয়োজনে একটা কনফারেন্স কল করে ছকে নিন, গুপুদের সহায়তা লাগলে আদেশ করুন।
  • swapan kumar mondal | ২০ মে ২০২৫ ০৭:৪৫731526
  • এতো বড় বড় লোক কত ভাল ভাল কথা বলেছে। প্রতিবারের মত বলি 'লা জবাব' পরের কিস্তির প্রতিক্ষায় থাকবো।
  • হীরেন সিংহরায় | ২০ মে ২০২৫ ১২:২২731527
  • r2h
     
    এবার বই মেলার সময় আমরা তিনজন একত্রে বসেছি। বুঝেছি আমি ষ্টেট ব্যাঙ্ক রূপ হস্তির একটি পা দেখেছি , শিবাংশু তার মাথায় চড়ে চালনা করেছে রঞ্জন সেই হস্তির ওড়ানো ধুলো বালি মেখে গ্রামে গঞ্জে ছেয়ে গেছে ! শিবাংশু তার অনন্য মুক্তো ছড়িয়ে দেয় অত্যন্ত সাধাসাধি করলে তবেই !   কবে থেকে তাকে বলছি  শুধু পায়ে ধরতে বাকি ,  আমরা  তিনজন যুগলবন্দী নয় ত্রিপল বন্দি লিখি । মুশকিল হল শিবাংশু এখন সাহিত্যের উচ্চতম  মার্গে বিহার করে । তাকে স্থায়ী ভাবে পাড়ার রকে টেনে বসানো শক্ত । তবে গণ দাবি বা পাবলিক প্রহারের ভয় যদি দেখানো যায় ।
  • শিবাংশু | ২০ মে ২০২৫ ১৫:৪৪731529
  • @হীরেনদা,  
    হুতো আমার 'প্রাচীন ' যুগের স্নেহাস্পদ। নেই নেই করেও আঠেরো-ঊনিশ বছর হয়ে গেলো। এক মেধাময় পারিবারিক পরম্পরার উত্তরসূরি। তার মন্তব্যটি দেখেই আমি কিঞ্চিৎ ত্রস্ত ছিলুম। আপনার 'ব্রাহমোস' এবার আছড়ে পড়লো বলে।  যেখানে বাঘের ভয়... ইত্যাদি , 

    সত্যি বলতে আমার আলমা মাটেরের সঙ্গে ঊনচল্লিশ বছরের ওতপ্রোত অস্তিত্ত্ব  আমাকে 'মানুষ' করেছে। আমার প্রিয়তম স্বদেশ-কে সত্য অর্থে চিনিয়েছে। চ্যাটজিপিটি-র ঊর্ধ্বে যে ভারতবর্ষ,  তার যে  মানুষজন  আমাকে আশিরনখর মুগ্ধ করে রাখে, তার সন্ধান দিয়েছে।  তাকে কেন্দ্র করে আড্ডা দিতে পারার সাধ খুবই থাকে। কিন্তু আমার অনুজরা যেমন কটাক্ষ করে  'শিবাংশুদাকে  চার লাইন লিখতে গেলে চব্বিশ পাতা  পড়াশোনা করতে হয়' সেটাই মূল বালাই। প্রতিশ্রুত লেখাজোখার চাপ বড্ডো বিব্রত রাখে। 

    জুয়ান-জং, ইবন বতুতা বা ত্যাভার্নিয়ের-র বর্ণনা যে ভাবে পড়ি, আপনার লেখাগুলি পড়ার সময় আমার সেই অভিনিবেশ কাজ করে।  হাতিম অল তাই-এর মতো কতো কতো অজানা জগৎ-এর খোঁজ এনে দেন আপনি। আর রঞ্জন তাঁর লেখায় মেধার অকারণ  'ঝলক' ব্যাপারটি কতো সহজে আড়াল করে রাখেন, তাও আমার কাছে শিক্ষণীয় বিষয়।  হাতের কাজগুলো একটু সামলে যদি একটু অবসর পাই, সেই আশা নিয়ে ঘর করি,   
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যুদ্ধ চেয়ে প্রতিক্রিয়া দিন