দেশ স্বাধীন হওয়ার প্রথম কয়েক দশকে ডলারের সঙ্গে টাকার বিনিময় দর অমন রোজ রোজ ওঠানামা করত না। কারণ, ভারতের অর্থনীতি নেহেরু-ইন্দিরার আমলে নিয়ন্ত্রিত ছিল। আমাদের টাকার গাঁটছড়া বাঁধা ছিল ব্রিটেনের পাউন্ড-স্টার্লিং এর সঙ্গে। অর্থাৎ বিনিময় দর ছিল 'ফিক্সড' বা পূর্ব নির্ধারিত।
তারপর আবাদী কংগ্রেসে বলা হল ভারতের অর্থনীতির চরিত্র হবে ‘মিশ্র’, খানিকটা ‘ সমাজতান্ত্রিক ধাঁচের’। আজকের ছেলেপুলেরা বলবে ‘হাইব্রিড’। কিন্তু তাতে পাবলিক সেক্টরের বেশি গুরুত্ব ছিল। প্রাইভেট সেক্টর ছিল সৎছেলে। দেশের পরিকাঠামো নির্মাণে, যেমন রাস্তাঘাট, বন্দর, বিমান, প্রতিরক্ষা – টাটা বিড়লার নাক গলানোর সুযোগ ছিল না। আজকের প্রাইভেট-পাবলিক-পার্টনারশিপের (পিপিপি) কথা তখন মুখে আনা যেত না, পাপের ভয় ছিল ।
বামপন্থীদের মনোজগতে ছিল এরকম ধারণা-- প্রাইভেট সেক্টর, মানে ব্যক্তি-মালিকানা, অর্থাৎ পুঁজিবাদ। আর পাবলিক সেক্টর, মানে সরকারি মালিকানা, অর্থাৎ প্রায় সমাজবাদ। ফলে বীমা/ব্যাংক ব্যবসায় সরকার নিয়ে নেওয়ায় ওঁরা দু’হাত তুলে আশীর্বাদ করলেন। রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ এবং আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদ শব্দগুলো ওঁদের অমরকোষে ছিল না।
কী আর বলব, ট্রেনের ডাইনিং কার এবং স্টেশনের কেটারিং –সব রেলওয়ে দপ্তরের। গোড়ায় চিনেমাটির প্লেট ও টি-পট, পরে এল স্টেনলেস স্টিলের বাসনকোসন। এখনকার মত ছোট্ট একটি মোচার খোলের ডিজাইনে এলুমিনিয়াম ফয়েলে মোড়া খাবার নয়। যারা আনত তাদের দেখে মনে হয়ত এয়ার ইন্ডিয়ার মহারাজার ভাইপো। এখনকার পোষাকে শোলে সিনেমার জেলের কয়েদির কথা মনে হয়।
রেডিও বলতে আকাশবাণী, বেশ সম্ভ্রান্ত-- কোন মির্চি, ধনিয়া, জিরা নয়। টেলিভিশন বোলে তো দূরদর্শন। চব্বিশ ঘন্টা খবর ছিল না। ছেলেপুলে রোজ চার পাঁচটা করে সিনেমা দেখতে পেত না। সন্ধ্যেবেলা নিয়ম করে বইমুখে বসে যেত। তবে অনুরোধের আসর ছিল, বিবিধ ভারতী ছিল, রেডিও সিলোন ছিল।
তখন সিনেমা হলের সামনে চার আনায় ফিল্মের গানের বই বিক্রি হত। হলদেটে কাগজে, ভুল ছাপা—তাতে কার কী এলো গেলো। আর পাওয়া যেত সচিত্র প্রেমপত্র,নতুন চাকরের কীর্তি এবং কাশ্মীরি কোকা পণ্ডিত বিরচিত ‘সচিত্র কোকশাস্ত্র’।
তাতেই উঠতি বয়সে গায়ে দিত কাঁটা এবং নিষিদ্ধ ফলের আস্বাদ পেয়ে ‘ঘুমের মধ্যে কাঁদতে কাঁদতে আমরা তখন যুবক’ হতাম। তখন সিনেমায় চুম্বন দেখানো নিষিদ্ধ ছিল। নায়ক-নায়িকার ঠোঁট এগিয়ে আসত—তারপরেই জাম্পকাট করে দুটো পায়রার ঠোঁটে ঠোঁট, অথবা পর্দা জুড়ে ফুটে থাকা ফুলে মৌমাছি বা ভ্রমরের উৎপাত। আমরা গুনগুন করতাম—ভঁওরা বড়া নাদান হ্যায়!
সেসব কবে চুকেবুকে গেছে। এই ক্ষেত্রে এসে গেছে ‘আচ্ছে দিন’ গত শতাব্দীর শেষেই। আর আজ তো অন্তর্জালের জমানায় বায়োলজি, জিওগ্রাফি সবই হাতের মুঠোয়। ১৯৯৩ সালে মনমোহন নিয়ে এলেন খোলা বাজারের অর্থনীতি। অর্থাৎ সব কিছু ঠিক করে দেবে বাজারের ওঠানামা।
এখন রুপিয়া মুক্ত, ফ্রি এক্সচেঞ্জ রেট।
অতএব টাকার বিনিময় দর এখন ডলারের সঙ্গে আলাদা, ইউরোর সঙ্গে আলাদা, রুবলের সঙ্গেও আলাদা। সব নির্ভর করে দুটো দেশের মধ্যে ব্যবসার স্তর, জিডিপি, আর্থিক স্থিতি কত শক্তপোক্ত –এইসব দিয়ে।
ফের ভাট বকছি। কাজের কথায় আসি।
সন ১৯৬৬-৬৭। আন্তর্জাতিক বাজারে ভারতের ব্যালান্স অফ পেমেন্ট সমস্যা বিকরাল রূপ ধরেছে। কারণ, তখন ভারত খাদ্যে এবং আরও বেশ কিছু বিষয়ে আত্মনির্ভর ছিলনা। ফলে বিদেশ থেকে, মূলতঃ আমেরিকা থেকে, গম এবং অন্যান্য ভোগ্যপণ্য এবং টেকনোলজি আমদানি করতে হত। সে তুলনায় রপ্তানি খুব কম। ফলে পাওনাদার আমেরিকার চাপে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী শচীন চৌধুরি ডলারের সম্পর্কে টাকার বিনিময় মূল্য ৫৭% কমিয়ে দিয়েছিলেন।
ফলে ১ ডলারের বিনিময় মূল্য ৫ টাকার জায়গায় ৭ টাকা ছাড়িয়ে গেল। অর্থনীতির বইপত্তর বলে এর ফলে ভারতের রপ্তানী বেড়ে যাবে। কারণ আমেরিকা ১ ডলার দিয়ে ভারতের ৫ টাকা মূল্যের কাঁচামাল কিনছিল, এবার ওই ১ ডলার দিয়েই ৭ টাকার মত মাল কিনতে পারবে।
বামপন্থীরা ছি-ছি করলেন। শচীন কিন্তু চিন্তাধারায় লিবারাল বামপন্থী ঘরানার অর্থনীতিবিদ। বোম্বের বিখ্যাত ‘ইকনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলি’ ম্যাগাজিনটি ১৯৪৯ সালে ইকনমিক উইকলি নামে উনিই শুরু করেছিলেন।
এখন এক ডলারের বদলে ভারতীয় টাকার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে বিরাশি টাকা। তাতেও কেউ ছি-ছি করে না।
এদিকে ভারত মাত্র দু’বছরের ব্যবধানে প্রতিবেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে দু’দুটো যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল। ১৯৬২-৬৩তে চিন , এবং ১৯৬৫তে পাকিস্তান। দেশে মূল্যবৃদ্ধির জোয়ার এল। তারপর ১৯৭১ সালে ইন্দিরা পাকিস্তানকে দু’টুকরো করলেন।
ইয়াহিয়া খাঁ, টিক্কা খাঁ এবং জুলফিকার আলি ভুট্টোর পাকিস্তানকে ‘ঘর মেঁ ঘুসকে’ ঠ্যাঙালেন।
আমেরিকার সপ্তম নৌবহরের যুদ্ধ- জাহাজ ‘এন্টারপ্রাইজ’ বঙ্গোপসাগরে ঢুকছিল। ইন্দিরা স্যামচাচাকে চোখ রাঙালেন। পিএল ৪৮০ যোজনায় আমেরিকা থেকে গম, জোয়ার, বাজরা আসা বন্ধ হল।
এদিকে দেশে মুদ্রাস্ফীতি যে নিয়ন্ত্রণের বাইরে।
আমরা কলেজে জার্মানির বিশ্বযুদ্ধের সময়ের হাইপার-ইনফ্লেশন এবং সেই নিয়ে নানান চুটকি গল্প শুনতে লাগলাম। আমাদেরও কি সেই দশা হবে?
এমন সময় বম্বে গ্রুপ অফ ইকনমিস্টদের চল্লিশজন ১৯৭৪ সালে ইন্দিরা গান্ধীকে খোলা চিঠি লিখলেন, নেতৃত্বে ডঃ পি আর ব্রহ্মানন্দ এবং সি এন ভকিল। ওঁরা অর্থনীতির ভরাডুবির আশংকার কথা বলে ইন্দিরাকে অনুরোধ করলেন বাজারে টাকার যোগান কমাতে। তার মধ্যে প্রধান হল ১০০০, ৫০০০ এবং ১০০০০ টাকার নোট তুলে নেয়া। তাতে কালোবাজারি এবং মজুতদারদের টাইট দেয়া যাবে।
ইন্দিরা শোনেন নি। উনি তখন বিরোধীদের টাইট দিতে ব্যস্ত। ফলে আমরা পেলাম দু’বছরের জরুরি অবস্থা—১৯৭৫ থেকে ১৯৭৭। আর পেলাম গ্রামীণ ব্যাংক যার গালভরা নাম রিজিওনাল রুর্যাল ব্যাংক বা আর আর বি। এবং আমার মত অপদার্থের দল চাকরি পেল। এটা না বলে খালি ইন্দিরার নিন্দে-মন্দ করলে ধর্মে সইবে?
কিন্তু আমি সামান্য আদার ব্যাপারী। আমার এতসব বড় বড় জাহাজের খবরে কী দরকার?
একটু সম্পর্ক রয়েছে।
সেই যে পাণ্ডেজি আমাকে হাতে গরম প্র্যাকটিক্যাল ব্যাংকিং শেখাবে বলে ল্যাঙোট কষে আজা- আজা বলে ময়দানে নামল তাতে আমার প্রাণ ওষ্ঠাগত। একদিনও হিসেব মেলে না। মানে শুরু করেছিল ক্যাশের টেবিলে বসিয়ে।
পে-ইন-স্লিপ বা হলুদ রঙা জমা পর্চি গ্রাহকের হাত থেকে নিয়ে নোট মিলিয়ে জমা কর। আর উইড্রয়াল ভাউচার বা সাদা রঙের ‘নিকাসী প্রপত্র’ (কদাচিৎ চেক) নিয়ে লেজারে খাতেদারের (অ্যাকাউন্ট হোল্ডার) সাইন মিলিয়ে তাকে গুনে গুনে টাকা দাও। শুধু তাই নয়, ডিপোজিট হোক বা পেমেন্ট, কোন কোন মূল্যের টাকা (৫০০, ১০০, ৫০, ২০, ১০, ১) এবং কয়েন ( ১ টাকা, আট এবং চার আনা, মায় ১০ এবং ৫ পয়সা অব্দি) মোট রাশির পাশে তাদের বিবরণ নির্দিষ্ট কলামের খোপে লিখতে হবে।
দিনের শেষে রিসিট এবং পেমেন্টের যোগফলের পাশাপাশি ওই সমস্ত টাকার বিবরণের কলামের আলাদা করে যোগ করে যোগ ফল মেলাতে হবে। এই শেষ নয়, ব্যাংকের সিন্দুকের থলির দিনের শুরুতে যা ছিল তার সঙ্গে সারাদিনের জমা যোগ করে তার থেকে মোট পেমেন্ট বা ভুগতান বিয়োগ করে দেখ হাতে কত টাকা রইল।
এইবার ক্যাশ মেলাও। দেখে নাও-- ওই ফাইনাল ব্যালান্স টাকা সত্যি সত্যি তোমার কাছে আছে? নাকি কিছু গরমিল! মানে কাউকে ভুল করে বেশি দিয়েছ বা কারও থেকে কম নিয়েছ?
গরমিল হলে খোঁজ খোঁজ! কে সেই সৌভাগ্যবান গ্রাহক। যাও তার বাড়ি, সে যদি অস্বীকার করে তবে বুদ্ধি খাটিয়ে তার থেকে আদায় করে আনো।
কিন্তু খালি ফাইনাল ক্যাশ ব্যালান্স আর তোমার সিন্দুকে যা আছে তার মূল্যমান মিলে যাওয়াই যথেষ্ট নয়। প্রত্যেকটি ধরণের টাকার সংখ্যাও মেলাতে হবে। তারপর গুণে গেঁথে আলাদা আলাদা প্যাকেট করে তাতে স্লিপ লাগিয়ে তারিখ ও দস্তখত করে ম্যানেজারকে দিয়ে চেক করিয়ে অবশেষে ব্যাংকের সিন্দুকে ভরে নিজের একটা চাবি দিয়ে বন্ধ করতে হবে।
শেষে ম্যানেজার মহোদয় তাঁর চাবি এবং একটা মাস্টার কী লাগিয়ে সেদিনের মত ক্যাশের ঝামেলা শেষ করবেন।
হে ভগবান! মনের ভিতরে নির্মলেন্দু চৌধুরি গেয়ে ওঠেন—‘ও আমার দরদী! আগে জানলে তোর ভাঙা নৌকায় চড়তাম না’।
তা সেই হিসেব আমার কোনদিন মিলত না। একমাস হতে চলল, কোন উন্নতি নেই। টাকা মেলে তো পয়সা মেলে না। আবার কোন কোন দোকানদার টাকার ভাঙানি চাইতে আসে। তাঁকে দিয়ে তো দিলাম। কিন্তু এক্সচেঞ্জ রো’ তে কী কী নোট দিয়েছে আর কী কী দিলাম সেসব ঠিক মত না লিখলে ফাইনাল ব্যালান্সে গরমিল হবেই হবে।
দিনের শেষে আমার অবস্থা হয় ‘কী পাইনি তার হিসাব মিলাতে মন মোর নহে রাজি’।
ব্যাংক ম্যানেজার আগরওয়াল স্যার সদয় হয়ে পাণ্ডেকে বলেন রিসিট/পেমেন্ট রেজিস্টারে ‘কয়েন’ কলামের পাশাপাশি স্কেল দিয়ে লাইন টেনে আট আনা, চার আনা, দশ পয়সার কলাম খিঁচে দাও! আর রায়, তুমি ডিটেইলস্ ভাল করে লিখো।
কলকাতার হায়ার সেকেন্ডারিতে অংকে লেটার মার্কস্ পাওয়ার অহংকার ছত্তিশগড়ের অজ পাড়াগাঁয়ের ব্যাংকে এসে ‘মিট্টি মেঁ মিল গয়া’।
আহা! ‘আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণধূলার তলে’।
আর তখনই ব্যাপারটা আমার চোখে পড়ল।
জাবদা রেজিস্টারের বাঁয়ে রিসিট এবং ডাইনে পেমেন্টের পাতায় নোটের বর্ণনা শুরুই হচ্ছে যথাক্রমে দশহাজার, পাঁচ হাজার, এক হাজার এবং পাঁচশো দিয়ে। প্রথম জানলাম দশ-পাঁচ-এক হাজারি টাকাও হয়! এই ব্যাংকে আসা ইস্তক ওই কলমগুলো খালি পড়ে থাকে। খালি দুয়েকবার পাঁচশো টাকার নোট দেখেছি।
হঠাৎ একদিন রিজার্ভ ব্যাংকের সার্কুলার ভায়া স্টেট ব্যাংক হয়ে আমাদের কাছে এল, যার সারমর্ম হলঃ
এতদ্বারা জনসাধারণকে সূচিত করা হইতেছে যে আগামী মাসের অমুক তারিখ হইতে দশ-পাঁচ-এক হাজারি এবং পাঁচশো’র নোট আর্থিক লেনদেনের নিমিত্ত লীগ্যাল টেন্ডার হিসেবে স্বীকৃত তথা গণ্য হইবে না।
সঙ্গে পোঁ ধরল আমাদের ব্যাংকের সার্কুলারঃ গ্রামীণ ব্যাংকের সমস্ত শাখাকে নির্দেশ দেয়া হইতেছে উক্ত তারিখের পূর্ব উপরোক্ত মূল্যের নোট প্রাপ্ত হইলে তাহা যেন অবিলম্বে নিকটস্থ ভারতীয় স্টেট ব্যাংকের শাখায় জমা করা হয়। উক্ত তারিখের পর কেহ কোন গ্রাহক হইতে বন্ধ হওয়া নোট জমা নিলে তাহা সম্বন্ধিত কর্মচারি/অধিকারীর ব্যক্তিগত দায়িত্ব হইবে।
আমরা সতর্ক হলাম। কিন্তু ওই তারিখের মধ্যে এল কুল্লে দুটো দশ, তিনটে পাঁচ এবং সাতটি এক হাজারী নোট, বেশিরভাগ সেই ঠাকুর সায়েবের সৌজন্যে। নিন্দুকে বলে উনি গত নির্বাচনে ভোটে দাঁড়িয়েছিলেন জেতার আশায় নয়, একটি বিশেষ দলের ভোট কাটতে। তার পুরষ্কার স্বরূপ অন্য দল থেকে যা উপঢৌকন পেয়েছিলেন এই ক’টি নোট তার অবশিষ্ট স্মৃতিচিহ্ন। এতদিন প্রাণে ধরে খরচ করেন নি।
এই হল স্বাধীন দেশের প্রথম ডিমনিটাইজেশন। তাতে দেশের কোন উবগার হয়েছিল সেটা বুঝি নি, কিন্তু চর্মচক্ষে দশ এবং পাঁচ হাজারি নোট একবার দেখতে পেলাম। পরে সেসব গায়েব হয়ে গেল। কিন্তু একহাজারি রইল।
ফের এল ৮ নভেম্বর, ২০১৬ সালের রাত আটটা। মোদীজির গেরিলা কায়দায় আচমকা ঘোষণা। তারপর কী হইল জানে শ্যামলাল। তফাত শুধু ১৯৭৮ সালে কাউকে লম্বা লাইনে দাঁড়াতে হয়নি, কেউ মারা যায় নি।
আমার ক্লান্তি দেখে স্যারের দয়া হল বোধহয়।
বললেন—রায়, আপনি ক্লার্ক-কাম-ক্যাশিয়ারের চাকরি করছেন না। আপনার নিযুক্তি হয়েছে ম্যানেজারের পদে। আপনার ক্যাশে আর বসতে হবে না। ব্যাপারটা মোটামুটি বুঝে গেছেন তো? বাকি কালে কালে হবে।
এখন আপনি আগামী পরশু ফিল্ড ভিজিটে যাবেন। পান্তোরা বাজারে হাট বসে শুক্রবারে।
মুখ দিয়ে অনায়াসে বেরিয়ে এল ‘বক্সীগঞ্জে পদ্মাপারে’।
কিছু বললেন?
না স্যার, আপনি বলুন।
শুনুন, ওটা স্থানীয় কুড়ি কিলোমিটারের মধ্যে সবচেয়ে বড় হাট, চারপাশের সব গ্রাম থেকে লোক আসে, বিক্রেতারাও এসে দোকান লাগায়। ওদের ভেতর অনেকে আমাদের ঋণী, কারও কারও কিস্তি বাকি পড়েছে। সময়মত চেপে না ধরলে পাকা ডিফল্টার হয়ে যাবে।
আমি প্রমাদ গুণি।
--স্যার ওদের আমি কী করে চিনতে পারব? আর কতদূরে সেই পান্তোরা বাজার?
--চিন্তা করবেন না। আমাদের চাপরাশি গোরেলাল আদিত্য সবাইকে চেনে জানে। এখান থেকে ২৪ কিলোমিটার দূরে। রাস্তা তৈরি হচ্ছে। তাই সাইকেলে দু’ঘন্টা। ও যাবে ব্যাংকের পুরনো সাইকেলে। আপনাকে দোকান থেকে ভাল সাইকেল ভাড়ায় পাইয়ে দেবে। ফিরে এসে ভাড়ার রসিদ জমা করবেন।
আপনি সাইকেলে অভ্যস্ত তো?
মনে মনে ভাবি, দুটো বছর ভিলাই থেকে সাইকেলে দুর্গ জেলার সরকারী কলেজে নিয়মিত যেতাম। তবে দূরত্ব ১৪ কিলোমিটার আর রাস্তাটা ঝাঁ -চকচকে পিচের।
পরের দিন।
গোরের সহায়তায় লোন লেজার দেখে দেখে বিভিন্ন গ্রামের ঋণীদের একটা লিস্টি বানিয়ে একটা ব্যাগে রাখি, সঙ্গে রিকভারি বুক, কার্বন পেপার আর একটা ডট পেন। ফিল্ডে রিকভারি করলে রিকভারি বুক থেকে কার্বন কপি ছিঁড়ে ঋণীর হাতে দিতে হবে।
আর একটা ছোট ক্যাশ বাক্সে টাকা ভরে তালা লাগাতে হবে।
ফিরে এসে ব্যাংকের সময় সেই রিকভারি বুক দেখে লেজারে লোন অ্যাকাউন্টে এন্ট্রি করতে হবে। প্রত্যেকটি লোন অ্যাকাউন্টের ইন্সপেকশন কার্ডে এন্ট্রি করতে হবে। ভিলেজ ইনস্পেকশন রেজিস্টারে কমেন্ট লিখতে হবে।
মা গো! কেন যে এত লফড়া? একটা লোক লোনের কিস্তি জমা করেছে, তার এত জায়গায় এন্ট্রি? এই নাকি স্টেট ব্যাংক কালচার! এঁয়ারা বোধহয় কাগজপত্রে বেশি ভরসা রাখেন। বহুবছর পরে রায়পুর জেলার এক জনপদের পড়শি একটি মঠের সন্ন্যাসী আমাকে শিখিয়েছিলেন গুপ্তজ্ঞান।
আমি তখন সেখানের ব্র্যাঞ্চ ম্যানেজার। এক মাড়োয়ারি ব্যবসায়ি ছোটু শেঠ লোন নিচ্ছে হোসিয়ারি আইটেমের জন্যে। দেখি ওর গ্যারান্টার জনৈক গেরুয়াধারি সন্ন্যাসি, ওর গুরুদেব।
অপরাধের মধ্যে আমি ওনাকে জিজ্ঞেস করলাম—মহারাজ, এই যে আপনি লোন ডকুমেন্টের এতগুলো কাগজে – ডিমান্ড প্রমিসরি নোট, লেটার অফ গ্যারান্টি ইত্যাদি ইত্যাদি—ফটাফট দস্তখত করে দিলেন, তার গুরুত্ব বিষয়ে সম্যক অবহিত তো?
উনি আমার দিকে এমনভাবে তাকালেন যেন কোন আজব চিড়িয়াকে দেখছেন। পরে বুঝেছি ওনার ইজ্জতে গ্যামাক্সিন কেস। অর্থাৎ -কে এই অর্বাচীন যে দশদিশার সমস্ত গাঁয়ের গুরুঠাকুর বিপুল মহারাজকে চেনে না? তাঁর মহিমার সঙ্গে পরিচিত নয়?
সন্নাটা! সন্নাটা!
তারপর উনি বললেন—শোন হে ম্যানেজার, তুমি বোধহয় নতুন এসেছ। ওই সব দস্তখত করার মানে হল যদি ছোটু শেঠ ব্যাংকের পয়সা না দেয়, ডিফল্টার হয়ে যায় তাহলে ব্যাংক আমার থেকে টাকা আদায় করবে। দেখছ তো, আমি ব্যাংকের আইন-কানুন ভালই জানি। তবে তার চেয়ে ভাল করে জানি নিজেকে।
তুমি আমার হাতের দশ আঙুল আর পায়ের দশ, একুনে বিশটি আঙুলের গায়ে ভুসো কালি মাখিয়ে ব্যাংকের কাগজ পত্তরে টিপছাপ লাগিয়ে নাও। আমি যদি মনে করি টাকা দেব না তাহলে ব্যাংক আমার থেকে এক পয়সাও আদায় করতে পারবে না।
আমি হাতজোড় করি।
--আরে না মহারাজ। আমার ঘাট হয়েছে। আমি জানি, আপনার শিষ্য ছোটু শেঠ কথার খেলাপ করবে না।
কেটে গেল কয়েক মাস।
হঠাৎ শেঠের কিস্তি বাকি পড়তে শুরু হল। খবর পাঠালে বলে—ভাববেন না, সব হয়ে যাবে।
আমি বিরক্ত হই—হবে তো বুঝলাম, কবে? আর আমি না ভাবলে বকায়া লোন নিয়ে কে ভাববে? পাড়ার লোকে? চটেমটে ওকে নোটিস দিলাম।
কিছুদিন পর হেড অফিস থেকে একটি প্রেমপত্র পেলাম, তাতে সংলগ্ন একটি হাতে লেখা কমপ্লেন।
তার নিগলিতার্থঃ
ছোটু শেঠের দরকার ছিল দেড় লাখের লোন। ম্যানেজার রায় রিলিজ করেছে এক লাখ আর এখন বাকি পঞ্চাশ হাজার রিলিজ করার শর্ত হিসেবে দশহাজার টাকা কমিশন চাইছে। বলছে দেড়লাখ লোন দিতে হলে পনের হাজার, মানে দশ পার্সেন্ট কমিশন দেয়াই দস্তুর।
পুরনো গ্রাহক, তাই কমসম করে দশ চাওয়া হচ্ছে।
রায় আরও বলেছে –হেড অফিসে ওর ভাল ‘পঁহুচ’ আছে। কমপ্লেন করে কেউ ওর একগাছিও ছিঁড়তে পারবে না।
আমি সামান্য ব্যবসায়ী। এত টাকা কোত্থেকে দেব? পাঁচ অব্দি রাজি ছিলাম। কিন্তু রায়সাহেবের এক গোঁ।
আমার মাথায় বজ্রাঘাত। এ তো ডাহা মিথ্যে। হঠাৎ মাথায় এক হাজার ওয়াটের লাইট জ্বলে উঠল। সোজা মোটর সাইকেল চালিয়ে গেলাম মহারাজের মঠে। উনি তখন বাগানের পরিচর্যায় ব্যস্ত।
--দেখুন, মহারাজ আপনার শিষ্যের কাণ্ড। বলুন, এখন কী করা উচিত?
উনি মুচকি মুচকি হাসছেন। বললেন— ছোটু ওর স্বধর্ম পালন করেছে। এবার আপনার পালা। আপনি আমাকে নোটিস দিন। আপনার স্বধর্ম পালন করুন।
--মানে?
--একটা গল্প শুনুন। একজন ব্রহ্মচারী পুকুরে চান করতে গিয়ে দেখল জলে একটা বিচ্ছু ডুবে যাচ্ছে। আহা রে কেষ্টর জীব! সে হাতে করে জল থেকে বিচ্ছুটাকে তুলে নিল। তক্ষুণি বিচ্ছু ওর হাতের তেলোয় হুল ফুটিয়ে দিল।
ছটফট করতে করতে সে গেল গুরুর কাছে। গুরুদেব, খুব শিক্ষা হয়েছে। আর কখনও যদি বিচ্ছুর প্রাণ বাঁচাই! এমন অকৃতজ্ঞ!
গুরু স্মিত হেসে বললেন—বৎস, ভুল করছ। স্বধর্ম বিস্মৃত হচ্ছ। দেখ, হীনযোনি বিচ্ছু নিজের স্বধর্ম ভোলেনি। উপকারীকেও ডংক মেরেছে। তুমি কেন তোমার স্বধর্ম—জীবে দয়া- বিস্মৃত হবে?
আমি এই পিজে’র প্রাসংগিকতা বুঝতে পারলাম না। ছোটু শেঠের স্বধর্ম কী? ব্যাংকের পয়সা মেরে দেয়া? তাগাদা করলে ফলস্ কমপ্লেন?
মহারাজের হাসি আরও চওড়া হল।
--আরে ও হল বণিক।
বণিকপুত্র লিঙ্গবৎ। অগ্রে নম্র, কর্মে দৃঢ়, পুনঃ নম্র।
লিঙ্গের স্বভাব কী? প্রথমে শান্ত নম্র; মতলবের সময় উত্থিত এবং দৃঢ়। উদ্দেশ্য সাধিত হলে পুনঃ নম্র। বণিকেরও তাই।
বানিয়া প্রথমে বলবে – আরে জিনিস পছন্দ হচ্ছে তো লিয়ে যান, লিয়ে যান,!
টাকা কে চাইছে? কিন্তু মাস ফুরোতেই তাগাদা দেবে। ক্রমশঃ ভাষা কর্কশ এবং উগ্র হবে। টাকা আদায় হলে ফের সেই নরম এবং নম্র ব্যবহার—লিয়ে যান, সাহেব! পয়সার কথা ভাববেন না।
এবার আপনি ম্যানেজার সাহেব গ্যারান্টারকে—মানে আমাকে-- নোটিস দিন। স্বধর্ম পালন করুন।
আমার মাথা ঘুরতে থাকে। শেষে কাতর স্বরে বলি—মহারাজ, এই চুহা-বিল্লি খেলায় আমি পেরে উঠবো না। আমি নির্দোষ, কিন্তু আমার ইমেজে দাগ লেগে যাবে। ট্রান্সফার আটকে যেতে পারে অথবা অনেক দূরে বাজে কোন ---।
উনি হাত তুলে বরাভয় মুদ্রা দেখান।
--শুনুন রায়। হম রাস্তা বাতলাতে হ্যাঁয়। ছোটু কাল ব্যাংকে গিয়ে এক লাখ টাকার লোন চুক্তা করে দেবে। আপনি আগামী সপ্তাহে ওকে দেড় লাখ টাকার নতুন লিমিট স্যাংশন করে দিন। তার আগে নিয়ম মেনে ওর দোকানে গিয়ে স্টক চেক করুন, পাঁচ লাখের বেশি মাল পাবেন।
সাপও মরবে, লাঠিও ভাঙবে না। আপনার ব্র্যাঞ্চ ম্যানেজারের জামাও একেবারে টিনোপাল দেয়া শ্বেতশুভ্র হয়ে যাবে।
--কী ভাবে?
--ছোটু শেঠ আপনার হেড অফিসে একটা চিঠি পাঠাবে। তাতে থাকবেঃ
“আমি কখনও ম্যানেজারের নামে কোন নালিশ করি নাই। আমার নামে যে শিকায়ত পত্র গিয়াছে তাহা জালি, উহাতে যে হস্তাক্ষর তাহা আমার নহে।
বলিতে চাহি –ম্যানেজার শ্রীরায় নিষ্কলংক স্বভাব। যে সকল ডুপ্লিকেট ব্যাপারীকে লোন দিতে অস্বীকার করিয়াছেন তাহাদেরই কেহ অসূয়াপরবশ হইয়া উক্ত দুষ্কর্ম করিয়াছে।
আপনারা ব্যাংকের দলিল -দস্তাবেজের সহিত আমার আসল হস্তাক্ষর মিলান করিয়া নিশ্চিন্ত হউন, ইহাই প্রার্থনা”।
(চলবে)