এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • হেদুয়ার ধারে ( দ্বিতীয় খন্ড ) - ৩৪

    Anjan Banerjee লেখকের গ্রাহক হোন
    ০৬ জানুয়ারি ২০২৫ | ১৩৪ বার পঠিত
  • ( ৩৪ )

    প্রতিবিম্ব দেশে ফিরে এসেছে। ছেলে স্কটিশ চার্চ স্কুলে ভর্তি হয়েছে। শশীকলার মতো দিনে দিনে বেড়ে উঠছে ছেলে। স্কুলে দিয়ে আসা, নিয়ে আসার কাজটা সুমনাকেই করতে হয়। সে আবার পরমানন্দবাবুর বাড়িতেই ফিরে গেছে। অলোকেন্দুবাবু মাঝে মাঝে এসে দেখে যান। তিনি চান তার ছোট মেয়ের যেন কোনরকম অসুবিধে না হয়। তার এই ঘড়ি ঘড়ি খোঁজখবর নেওয়াটা সুমনা ঠিক নিতে পারে না। কেমন একটা অস্বস্তি বোধ করে। তার মনে হয় এতে প্রতিবিম্বকে ছোট করা হচ্ছে। সে ভাবে, প্রতিবিম্বর মতো ছেলের জন্য যে শ্বশুরবাড়ির কোন সাহায্য লাগে না এটা বাপি কেন যে বোঝে না। কিংবা অলোকেন্দুবাবু হয়ত সবই বোঝেন। কিন্তু বাবা মার কাছে তাদের ছেলে মেয়েরা কখনও বড় হয় না। যতটা পারা যায় আগলে রাখতে চায় শাবকদের। মনে থাকে না শাবকরা এত বছরে বেড়ে উঠেছে অনেক। তারাও মাতা পিতা হয়ে গেছে। তাদের আত্মসম্মানবোধ তৈরি হয়েছে, বিশেষ করে বিয়ের পর মেয়েদের। সুমনা কি আর তার সেই আদুরে সুমনা আছে।

    আজ ফেব্রুয়ারি মাসের কুড়ি তারিখ। ফরওয়ার্ড ব্লকের নেতা নেতাজীর সহকর্মী ও স্বাধীনতা সংগ্রামী হেমন্ত বসু খুন হয়ে গেলেন টাউন স্কুলের সামনে প্রকাশ্য দিনের আলোয় খোলা রাস্তায় লোকজনের চোখের সামনে।

    অমল রাস্তাতেই খবরটা পেল। ন্যাশনাল ভ্যারাইটি স্টোর্স সহ ও তল্লাটের সব দোকান পাট ঝপাঝপ বন্ধ হয়ে গেল। আজ আর অফিস যাওয়া যাবে না মনে হচ্ছে। হাতিবাগান এবং শ্যামপুকুর এলাকা থমথমে ছায়ায় ঢাকল। পুলিশে পুলিশে ছয়লাপ। এখনও জানা যায়নি অবশ্য কারা মারল।
    রামধন মিত্র লেনে অমলের পাশের বাড়ির হিরন্ময় কাবাসি বললেন, ' কোনদিন জানা যাবে না দেখে নিও ... '
    অমলের মা বললেন, ' হায় ভগবান ... ওরকম দেবতুল্য মানুষটা ... আহারে ... আরও কত কি দেখতে হবে ... '
    সঞ্চারী বাড়িতে ঢুকে বলল, ' ধর্মতলায় কাজ ছিল ... আজ আর বেরব না ... দেখি কাল কি হয় ... কি যে সব শুরু হয়েছে না ... '
    নিখিল স্যারের কথা মনে পড়ল অমলের। স্যার বেঁচে থাকলে এখন কি বলতেন খুব জানতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু জানার কোন উপায় নেই আর।

    মাণিকলাল চ্যাটার্জীদের বাড়ির অ্যাংলো সুইস দেওয়াল ঘড়িটা চলছে এখনও। মানে ঠেকা দিয়ে যাচ্ছে আর কি। কিন্তু আগের মতো দম নেই আর । সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে পারছে না। পিছিয়ে পড়ছে মাঝে মাঝে। বোঝা যাচ্ছে, ও বুড়ো হয়েছে। তা সত্তর বছর তো হবেই । আর কত টানবে। দম ফুরিয়ে আসছে। দম ফুরিয়ে আসছে ঘড়িবাবু নরেন পালেরও। তার শরীরেও মরচে পড়তে লেগেছে। এখন আর চাবি পকেটে নিয়ে আগের মতো ঠিক ঠিক সময় মেনে হাজির হতে পারেন না চ্যাটার্জী বাড়িতে। বুড়ো অ্যাংলো সুইস ধুঁকতে থাকে। পলে পলে পিছিয়ে পড়তে থাকে আদত সময়ের থেকে।

    সৌদামিনীদেবী অবসর পেলেই অপলকে তাকিয়ে থাকেন তার শ্বশুরবাড়ি প্রবেশের সময়ের চনমনে নবীন সঙ্গীটির দিকে। সৌদামিনী ভাবেন, ঘড়িটা হয়ত তাকে সঙ্গী করেই বিদায় নেবে এ পৃথিবী থেকে। তার বোধহয় আর বেশি দেরি নেই। কথাটা মনে হতেই কেমন অদ্ভুতভাবে শিরশির করে উঠল সৌদামিনীর সারা শরীর।
    সন্ধে নেমে আসছে। তিনি ধীরে ধীরে গা তুলে শ্লথ পায়ে হেঁটে গিয়ে ঘরগুলোর আলো জ্বালাতে লাগলেন। কোথা থেকে রেডিওর গান ভেসে আসছে, 'আমি যামিনী, তুমি শশী হে ভাতিছ গগন মাঝে ... '। দেওয়াল ঘড়িতে টং টং করে ছটা বাজল। সঠিক প্রহর জানাল কিনা কে জানে। দিনের আলো তো মুছে গেছে বেশ খানিকক্ষণ। মালতী মাজা বাসনগুলো রান্নাঘরে তুলে দিয়ে বলে গেল, ' চললাম মা ... কাল আসতে দেরি হবে ... বলে গেলাম ... বাসন রেখে দিও ... '

    মাসখানেক পরে তুমুল শঙ্কার ডঙ্কা বেজে উঠল বরানগর অঞ্চলে। সকালের দিকে বাজার করে ফেরার সময় নির্মল চ্যাটার্জী খুন হয়েছে রাস্তার মধ্যে লোকজন ভরা রাস্তায়। মুখে জানা গেল, নির্মল নাকি চেনা জানা ছেলেগুলোর হাতে ঘেরাও থাকা অবস্থাতেই ঠান্ডা মাথায় ওদের সাবধান করেছিল, ' তোরা কিন্তু বিরাট ভুল করতে যাচ্ছিস ... আমাকে মারলে কিন্তু আগুন জ্বলে যাবে। তোরা কেউ বাঁচবি না ... সব শেষ হয়ে যাবি ... এ ভুল করিস না ... '
    ওরা তবু সাবধান হয়নি। 'খতম' শেষ করে ওখান থেকে হাঁটতে হাঁটতে চলে গেল। নির্মল চলে গেল, সঙ্গে করে বোধহয় ছিঁড়ে নিয়ে গেল একটা বেপরোয়া দিশাহীন সহিংস রাজনৈতিক ইতিহাসের পাতা।

    সেদিন রাত থেকে শুরু হল ভয়ঙ্কর প্রতিশোধের তান্ডব। বাড়ি বাড়ি থেকে ছেলেদের টেনে টেনে বার করা হতে লাগল নির্বিচারে বাবা মায়ের চোখের সামনে থেকে। নির্মলবাবুর কথা অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেল। ওরা বিলীন হয়ে যাবে কিনা সেটা ভবিষ্যত বলবে। কিন্তু এই মুহুর্তে পরিস্থিতি জমাট গম্ভীর ।
    এলাকার লোকেরা কোনরকমে রাতটা কাটিয়ে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে সকাল হতেই অন্য কোথাও আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে গিয়ে উঠল।
    চাটার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট মণিলাল চ্যাটার্জী পরিবার নিয়ে বাগবাজারের গোপীমোহন দত্ত লেনে মামার বাড়ি এসে হাঁফাতে হাঁফাতে বললেন, ' সিচুয়েশান ইজ গ্রেভ ... সিচুয়েশান ইজ গ্রেভ ... সাঙ্ঘাতিক অবস্থা ... নির্মলকে মেরে মারাত্মক ভুল করেছে ওরা ... কি হবে এখন ... একেবারেই সেফ ফিল করছি না ... '
    আশি বছর বয়স্ক বড়মামা ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বললেন, ' আরে ... ঠান্ডা হ ... ঠান্ডা হ ... অত হুটোপাটি করছিস কেন ... দুদিনে সব জুড়িয়ে যাবে। কত দেখলাম ... দেখ না, সামনের বছর ইলেকশান ... কংগ্রেসের ওপর ভরসা রাখ... '

    কংগ্রেস পার্টির অন্ধ সমর্থক বড়মামার পক্ষে কথাগুলো নিত্যনৈমিত্তিক। কিন্তু মণিলালবাবু ভেবে পেলেন না যে তার আশু সমস্যার সমাধান এই মুহুর্তে কিভাবে হবে। ওদিকে তো নিশ্চয়ই রক্তের স্রোত বইছে।

    রাত আটটার সময় সুভাষরা তাস খেলতে বসেছে। বিনয় বলল, ' বরানগরের ওদিকে নাকি কি একটা গন্ডগোল হয়েছে। ঘরে একটা রেডিও থাকলে খবরটা শোনা যেত ... '
    অতীশ বলল, ' নে নে ... তাস ফেল তাস ফেল ... গন্ডগোল তো হচ্ছে গন্ডগোল মেটাবার জন্যই ... '
    দুর্বার বলল, ' হার্টের কুইন ... পাস ... '

    ওদিকে সিঁথির বাড়িতে অঞ্জলি বলল, ' গতিক সুবিধের নয় বুঝলে ... চল আমরা দত্তবাবুদের ওখানে চলে যাই ... বড় টেনশন হচ্ছে ... '
    নিতাইবাবু বললেন, ' আরে দূর ... পাগল নাকি... এই সময়ে কেউ বাড়ি খালি রেখে যায় নাকি ! কোথা থেকে কি হয়ে যাবে ... চুপ করে বস তো ... ভয়ের কিচ্ছু নেই ... আমাদের কি আছে এতে ... যাদের ব্যাপার তারা বুঝবে ... '

    হেদুয়ার জলে মনের আনন্দে একপাল ছেলে এসে দাপাচ্ছে পরদিন সকাল সাতটার সময়। সূর্যের আলো ঝিকমিক করছে গাছের পাতায়। মাণিকতলায় প্রাণবন্ত বাজার বসেছে যথারীতি। খবরের কাগজওয়ালারা মহাব্যস্ত হয়ে এ গলি সে গলি ছোটাছুটি করছে বাড়তি কাগজ বিক্রির আশায়।
    সুমনা ছেলেকে অঙ্ক করাতে বসল। আগের পরীক্ষায় দুটো অঙ্ক ভুল করেছে। এমন করলে তো হবে না।

    ( চলবে )
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ক্যাবাত বা দুচ্ছাই মতামত দিন