এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • হেদুয়ার ধারে ( দ্বিতীয় খন্ড ) - ২৫ 

    Anjan Banerjee লেখকের গ্রাহক হোন
    ১০ ডিসেম্বর ২০২৪ | ১২৭ বার পঠিত
  • ( ২৫ )

    বাংলায় রাষ্ট্রপতির শাসন হল আবার। এই নিয়ে দুবার। অজয় মুখার্জীর সরকার দু দুবার গড়াগড়ি খেল। এখানে স্থায়ী একটা সরকার যে কবে হবে কে জানে। এর মাঝে অবশ্য প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ মুখ্যমন্ত্রী হয়ে ক' মাস ঠেকা দিলেন বছর খানেক আগে। ডামাডোলের অবস্থা একেবারে।

    জৈষ্ঠ্য মাস পড়ে গেছে। দুপুরবেলায় ঠা ঠা রোদে কুকুরগুলো ধুঁকছে। হেদোর পুকুরে জল ছাড়া হয়েছে নতুন করে। টইটুম্বুর সাঁতারের পুকুর। ওয়াটারপোলো খেলছে পাকা সাঁতারুরা।
    গঙ্গাপ্রসাদ নেয়ে এল দুপুরবেলায় হেদুয়ার জলে নেমে। অনেকক্ষণ জলে গা ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। রোদের কি তাপ, গা পুড়ে যাচ্ছে একেবারে। ক'জন দিব্যি জামা কাপড় কাচছে পুকুরের ধারে বসে। সেন্ট্রাল আর ন্যাশনাল দুটো ক্লাবেই তালা মারা এখন। দুটো লোক ছাতা মাথায় দিয়ে বেথুন কলেজের সামনে দিয়ে বিবেকানন্দ রোডের দিকে যাচ্ছে। নকুড়ের দোকানের সামনে চাপা কলের জল বেরিয়ে যাচ্ছে কলকল করে। সুরেশ্বর মল্লিক ভাত খেতে বসেছেন বেলা একটার সময়। আজকাল আর তেমন খেতে পারেন না। কখনোই তেমন খিদে হয় না। অল্প একটু ভাত খেলেন শুক্তো আর মাগুর মাছের ঝোল দিয়ে। তার স্ত্রী বললেন, ' একবার ডাক্তার দেখিয়ে নিও ... লিভারটা কেমন আছে কে জানে ... অত্যাচার তো কম হয়নি ... '
    সুরেশ্বর তার স্ত্রীর প্রস্তাব উড়িয়ে দিয়ে স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গীতে বললেন, ' আরে দূর দূর ... ডাক্তার আবার কি করবে। কত দেখলাম, এমনিই ঠিক হয়ে যাবে ... অত ভেবনা তো ... '।

    বিভূতিবাবু অনেকদিন পর রামকান্ত বোস স্ট্রিটে তার শ্বশুরবাড়ি গেছেন। দুপুরের খাওয়াটা ওখানেই সারলেন তার প্রিয় খাদ্য বিউড়ির ডাল আর আলু পেঁয়াজ পোস্ত দিয়ে। কুমড়ো ফুলের বড়া হয়েছিল। বড়ি দিয়ে ট্যাংরা মাছের ঝোল হয়েছিল। বড়ি দিয়ে ট্যাংরা মাছের ঝোল বিভূতিবাবুর খুব ভাল লাগে। আর ছিল কাঁচা আমের অম্বল। খেয়ে দেয়ে বিভূতিবাবু একটা লম্বা ভাত ঘুম দিলেন। বাইরে ঝাঁ ঝাঁ রোদ্দুর। কোথায় যাবেন এখন। শ্বশুরমশাই মারা যাবার পর এই বোধহয় প্রথম এলেন। তার শালার বৌরা কিন্তু জামাইবাবুর যত্নের ত্রুটি করেনি।
    বিভূতিবাবুর যখন ঘুম ভেঙে বিছানায় উঠে বসলেন নিস্তেজ সূর্য তখন আকাশের পশ্চিম দিকে বোঁচকা গোছাচ্ছে।
    বড় ছেলে রেডিও খুলে দিয়ে গেল। মজদুর মন্ডলীর আসর শুরু হয়েছে।

    বিভূতিবাবুর মনটা খারাপ হয়ে গেল। কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগতে লাগল হঠাৎ। তার শ্বশুরমশাই এই সময়ে বিছানায় কাত হয়ে বসে মজদুর মন্ডলীর আসর, কৃষিকথার আসর এই সব শুনতেন প্রত্যেকদিন। তারপর মন দিয়ে খবর শুনতেন। কলকাতা ক-এ স্থানীয় সংবাদ শেষ হয়ে গেলেই প্রফুল্লবাবু বলতেন, ' বিজয়া রেডিও টা বন্ধ করে দাও তো ... '। ছেলের বউ আসত, মারফি রেডিওর নব ঘুরিয়ে বন্ধ করে দিত।
    তারপর বিভূতিবাবুর দিকে ফিরে বলতেন, ' শরীর স্বাস্থ্যের দিকে নজর রেখ। চারদিকে শুধু ভেজাল আর ভেজাল। বাংলায় একটা সরকার হল না ঠিকমতো। এর চেয়ে তো প্রফুল্ল সেনই ভাল ছিল ... '
    বিভূতিবাবু এসব নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামান না।
    তিনি প্রতিবারই তার স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গীতে বলতেন, ' হ্যাঁ তাই তো ... বলার কিছু নেই ... এইভাবে যে ক'দিন চলে আর কি ... '
    তিনি এরপর ' আমি তা'লে এগোই বাবা ... রাত হয়ে যাচ্ছে ... ' বলে ছাতাটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়াতেন। ছাতাটা তার সঙ্গের সাথী।
    ---- ' আচ্ছা বাবা, এস এস ... সাবধানে যেও ... কাল আসছ তো ... '
    এসব টুকরো টুকরো স্মৃতি আড়ামোড়া ভেঙে উঠে বসতে লাগল।
    বিভূতিবাবু ভর সন্ধেবেলায় বিষণ্ণ আবেশে আচ্ছন্ন হয়ে চুপ করে বসে রইলেন। সন্ধেবেলায় পাশের বাড়িতে কে তিনবার শাঁখ বাজাল।
    একটু পরে বিজয়া এসে বলল, ' এই নিন জামাইবাবু ... কি এত ভাবছেন ? '
    বিভূতিবাবু ' না কিছু না ... দাও ... ', বলে হাত বাড়িয়ে চায়ের কাপটা নিলেন। নিয়ে এটাও মনে পড়ল, এ বাড়িতে এই সময়ে এলে তিনি প্রফুল্লবাবুর সঙ্গে ঠিক এই সময়েই চা খেতেন। কেউ কেউ চলে গেলে জীবনটা বড় ফাঁকা ফাঁকা লাগে সন্ধেবেলায় হেমন্তের শস্যক্ষেত্রের মতো। সে অতল শূন্যতা হিমেল বোবা দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। আর কখনও ভরাট হয় না সে গহ্বর এ পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে থাকতে।

    কমল সাহা বোসপাড়া লেন দিয়ে কাঁটাপুকুর লেনের দিকে যাচ্ছিল। ওখান থেকে ডানদিকে ঘুরে মনীন্দ্র কলেজের দিকে যাবে। শর্ষে তেলের একটা পাইকারি হিসেবের মাল কেনার খরিদ্দার আছে। ভাল দাম দেবে বলে মনে হচ্ছে। কমল ভাল ঘাঁতঘোঁত জানে। সে শুধু যোগাযোগটা করিয়ে দিয়ে কমিশন খাবে। অনেকে আবার এটাকে দালালি বলে। কমলের অবশ্য তাতে কিছু আসে যায় না। যত সব ফালতু লোক। নিজেরা কিছু করতে পারে না, ফালতু কাঠি করে লোকের পেছনে।

    এমনিতে কিন্তু কমলের অতি বড় শত্রুও তাকে খারাপ লোক বলতে পারবে না। সকলের সঙ্গেই কমলের ভাল সম্পর্ক। কংগ্রেস পার্টিও করে। এ এলাকায় পার্টির একজন মাতব্বর বলা যায় কমলকে।

    সে যাক, এখন কমল হেলেদুলে কাঁটাপুকুর লেনের দিকে যাচ্ছিল। যেতে যেতে চোখে পড়ে গেল রাস্তার মুখে। আরে একি !

    গীরিশ এভিনিউয়ের সেই মেয়েটা, স্বাতী না কি যেন নাম, দাঁড়িয়ে আছে মাথা নীচু করে লজ্জা লজ্জা হাসি মাখানো মুখে। তার সামনা সামনি দাঁড়িয়ে সেই ক্যাপ্টেন, সাগর যাকে খুব রগড়ানি দিয়েছিল বোরোলীন হাউসের পাশে। কমলের এও নজরে পড়ল ক্যাপ্টেনের সেই দুটো বন্ধু খানিকটা দূরে ঘোরাফেরা করছে।
    কমল ভাবল, এ তো জমাটি খেল দেখছি। একেবারে লায়লা মজনু। এও ভাবল, সত্যি কথা ... যার যেথা মজে মন, কিবা হাড়ি কিবা ডোম।
    কমল চলা থামাল না। যেতে যেতে হরিপ্রিয় পালের বাড়ির সামনে গিয়ে পড়ল। ভাবল, মন যার যেখানেই মজুক, সাগরকে খবরটা জানিয়ে দেওয়া তার কর্তব্য। সাগরের কাল আসার কথা আছে তার কাছে।

    ( চলবে )
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভ্যাবাচ্যাকা না খেয়ে মতামত দিন