এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • হেদুয়ার ধারে (দ্বিতীয় খন্ড) - ১৬ 

    Anjan Banerjee লেখকের গ্রাহক হোন
    ১৬ নভেম্বর ২০২৪ | ১৭৭ বার পঠিত | রেটিং ৪ (১ জন)
  • ( ১৬ )

    বিভূতিবাবু ভাবেন ঠিক কত বয়স হল তার। বোধহয় বাহাত্তর হল। আর বছর তিনেক বাঁচলেই যথেষ্ট। তারপর ভাবলেন, বাঁচা মরা যদি মানুষের হাতে থাকত তা'লে তো আর চিন্তা ছিল না। শুধু বাঁচা মরা কেন কোন কিছুই কি মানুষের হাতে আছে। সেই হিসেবে জীবন এবং জগৎ দুটোই সমান অর্থহীন এবং অসার। বিভূতিবাবু বাট্র্যান্ড রাসেলের নামই শোনেননি। কিন্তু তার মতোই বিভূতি দত্তর মনে হল এ জীবনের অধিকাংশ সমস্যা আমরা যতটা গুরুত্ব দিই ততটা গুরুত্ব পাবার যোগ্যই না। মিছিমিছি ভেবে ভেবে হয়রাণ হই। কেউ তরতরিয়ে মগডালে গিয়ে চড়ে, কেউ হাঁ করে তাকিয়ে থাকে মুখ ওপরে করে, তালিও মারে। যে যার ভূমিকায় পার্ট করে যায়। যাকে যা রোল দেওয়া হয়েছে সে সেটা করে যায় ঠিক থিয়েটারের মতো। রোল পছন্দ না হলেও করে যেতে হবে। যাকে দারার রোল দেওয়া হয়েছে, সে ঔরঙ্গজেবের রোল চাইলে কি পাবে? যাকে যে রোল দেওয়া হয়েছে উয়িং-এর আড়ালে অদৃশ্য হয়ে যাবার আগে পর্যন্ত তাকে সেই রোলটাই করে যেতে হবে। কোন পার্ট করতে না চাইলেও রেহাই নেই, মানে পালাবার পথ নেই। এক নিষ্ঠুর প্রক্রিয়া বলা যেতে পারে। বিভূতিবাবু শুয়ে শুয়ে আপনমনে হাসেন। তিনি ভাবলেন, এতে মঙ্গলময় কিস্যু নেই, প্রকৃতির স্বেচ্ছাচারী কাজ কারবার। কোন মানেই হয় না, পাগলের কারবার। পাগল না শয়তান কে জানে শালা ...

    এই সময় রমাদেবী ঘরে ঢুকলেন। ঢুকে দেখলেন বিভূতিবাবু চিত হয়ে শুয়ে সিলিং-এর দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছেন আর বিড়বিড় করে কি সব বলছেন। শেষ কথাটা কানে এল -- কে জানে শালা ...
    রমা বললেন, ' কি হল ... কি বকবক করছ ? '
    বিভূতিবাবু একটু অস্বস্তিতে পড়ে গেলেন।
    ---- ' না কিছু না ... জপ করছিলাম একটু ... '
    রমাদেবী আর কথা বাড়ালেন না। বললেন, ' তা ভাল। এই বয়সে একটু জপ ধ্যান করা ভাল ... '
    তিনি বিছানার এক ধারে বসে বললেন, ' রামকান্ত বোস স্ট্রিটে যেও মাঝে মাঝে। ওদের একটু খোঁজখবর নিও। বাবা চলে যাবার পর থেকে ও বাড়ি যাওয়া তো ছেড়েই দিয়েছ ... '
    ---- ' হ্যাঁ তা ঠিক ...', বিভূতিবাবু স্বীকার করলেন।
    ---- ' যেও মাঝে মাঝে ... কি ভাবছে ওরা ... '
    ---- ' হ্যাঁ হ্যাঁ, কালকেই যাব ... এখন চুপ কর, ঘুম পাচ্ছে '
    রমাদেবী আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়লেন।
    একটু পরে বললেন, ' ঘুমোলে নাকি ? '
    ---- ' না। কি হয়েছে ? '
    ---- ' বলছি যে আমাদের পুরী গেলে হয় না ক'দিনের জন্য। মনটা খুব টানছে। নীচের ছেলেগুলোকেও সঙ্গে নিলে ভাল হয়। আমাদের খুব সুবিধে হয় ... '
    ---- ' তা ঠিক ... দেখি কি করা যায় ... মিতাকে বলা হবে নাকি ? '
    ---- ' না না ... ওকে জানানোর দরকার নেই। পরের মেয়ের দায়িত্ব কে নেবে ? একবার গেছে ঠিক আছে ... বারবার নেওয়ার দরকার কি ? '
    বিভূতিবাবুর কোন জবাব পাওয়া গেল না। শুধু মৃদু নাসিকা গর্জন শোনা যাচ্ছে।
    রমাদেবী দুহাত জড়ো করে কপালে ঠেকিয়ে ইষ্টদেবতাকে স্মরণ করে পাশ ফিরে শুলেন।

    চিন্টু খুব মন দিয়ে হাঁদাভোঁদা পড়ছিল। বাঁটুল দি গ্রেটটা জমিয়ে রেখেছে এর পর চেখে চেখে পড়বে বলে। চিন্টুর মা মেঝেতে মাদুর পেতে ঘুমোচ্ছে। বাবা অফিসে গেছে। চিন্টু বারান্দায় গিয়ে শুকতারা খুলে বসেছে। এরপর আসবে টারজান। টারজানের গল্প পড়তে চিন্টুর ভীষণ ভাল লাগে। তারও টারজানের মতো হতে ইচ্ছে করে। চিন্টুর মর্নিং স্কুল। দুপুরবেলায় হোমওয়ার্ক করে। হোমওয়ার্ক করা হয়ে গেলে গল্পের বই পড়ে।
    বাবাও তাকে অনেক গল্প বলে। সুন্দরবনের বাঘের গল্প বলে, কত ভূতের গল্প বলে। তার একটা দিদি আছে। তার সকালে না, দুপুরে স্কুল।
    সে এখন স্কুলে। দিদি ক্লাস এইটে পড়ে। তারা বাগবাজারে গিরীশ এভিনিউতে একটা বাড়ির দোতলায় থাকে।
    বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে কিংবা বসে কত লোকজন দেখা যায়। আরও কত কি দেখা যায়। রাস্তার ওপারে টু বি দোতলা বাস দাঁড়িয়ে থাকে লাইন দিয়ে। চিন্টু এখানে বসে গল্পের বই পড়ে। বাড়িতে চিন্টুর ঠাকুরমা আছে। দাদু আর নেই। তাদের ছেড়ে চলে গেছে একবছর আগে।
    চিন্টুর মামার বাড়ি হেদুয়ায়, রামদুলাল সরকার স্ট্রিটে। মামার বাড়ি গেলে চিন্টু মেজমামার সঙ্গে হেদুয়ার জলে সাঁতার কাটা দেখতে যায়। চিন্টুর খুব ভাল লাগে হেদুয়ায় সাঁতার কাটা দেখতে।
    সে বলে, ' মেজমামা আমাকে সাঁতারে ভর্তি করে দেবে ? '
    ভাগ্নে অন্ত প্রাণ মেজমামা সুদর্শন নিয়োগী বললেন, ' সে তো করাই যায় কিন্তু অত দূর থেকে তুই আসবি কি করে রোজ ? তা'লে তোকে এখানে থাকতে হয় ... '
    চিন্টু প্রতিবারই ঠিক যুক্তিসঙ্গত কোন উত্তর খুঁজে পায় না। চুপ করে থাকে। সে বুঝতে পারে মামারবাড়িতে থাকলে তার স্কুলে যাওয়ার অসুবিধা কথা।
    চিন্টুর মামারবাড়ি ঠিক রামদুলাল সরকার স্ট্রিটে নয়। বিডন রো -এ। তিনপুরুষের পুরণো বাসিন্দা।
    বিভূতিবাবুর সঙ্গে ভালরকম পরিচয় আছে সুদর্শন নিয়োগীর। হেদুয়া থেকে ভাগ্নের সঙ্গে ফেরার পথে সুদর্শনের দেখা হয়ে গেল বিভূতিবাবুর সঙ্গে।
    ---- ' কি ... হেদো থেকে ? এরা কবে এল ? '
    ---- ' এই ... কাল এসেছে। রবিবার চলে যাবে ... '
    ---- ' ও ... তা ভাল। কেমন আছ খোকন ? '
    চিন্টু একগাল হেসে বলল, ' ভাল '
    ---- ' বেশ বেশ ... '
    তারপর সুদর্শনের দিকে তাকিয়ে বলল, ' তা ... তোমার ব্যবসা কেমন চলছে ? '
    ---- ' ওই চলছে আর কি ... বাজার নেই তেমন। কাজ কারবার তো শুধু পুজোর সময়। প্রফিট কিছু থাক না কর্মচারীদের মাইনে তো দিয়ে যেতে হচ্ছে ... '
    ---- ' তাই তো ... তাই তো ... '
    ---- ' জামাকাপড়ের দোকান .... পুরোপুরি সিজনাল ... '
    ---- ' হ্যাঁ ... তাই তো ... তোমার দুই ভাই তো ভাল পোস্টে চাকরি করে ... '
    ---- ' হুঁ ... '
    ---- ' একদিন এস না বাড়িতে। গল্প করা যাবে ... '
    তারপর চিন্টুর গাল ধরে বললেন। ' তুমিও এস খোকন ... কেমন ... '
    চিন্টু বিভূতিবাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে ঘাড় নাড়ল।
    সুদর্শনকে বললেন, ' তুমি তো বিয়ে থা করলে না। যাক ভালই... '
    ---- ' হ্যাঁ, দরকার কি ... এই তো ভাল আছি ... '
    ---- আচ্ছা ঠিক আছে ... এস একদিন ... '
    বিভূতিবাবু চলে গেলেন।

    চিন্টু যেতে যেতে তার মেজমামাকে বলল, দাদুটা খুব ভাল ... '
    ---- ' কি করে বুঝলি ? '
    ---- ' দাদুর গায়ে কেমন যেন ধূপের গন্ধ ... '
    ---- ' তাই নাকি ? '
    ---- ' হ্যাঁ ... '
    সুদর্শন ভাবল, ' শিশুরা কত কি বুঝতে পারে। আমরা বড়রা ওসব গন্ধ টন্ধ পাই না ... '
    ---- ' তুই আর কারো গায়ে এরকম ধূপের গন্ধ পাস ? '
    চিন্টু সুদর্শনকে অবাক করে দিয়ে বলল, ' হ্যাঁ ... জুলির গায়ে ... '
    ---- ' জুলি কে ? '
    ---- ' আমাদের মিনিটা ... '
    ---- ' মিনি বেড়াল ? '
    ---- ' হ্যাঁ ... আমার সঙ্গে রাত্রে শোয়। আমি রাত্রে হিসু করতে উঠলে ওও ওঠে। আমি শুলে আবার এসে শোয় ... '
    ---- ' তোর খুব বন্ধু তো ... '
    চিন্টু মাথা নেড়ে বলল ' হ্যাঁ ... '
    ---- ' এরকম ধূপের গন্ধওয়ালা আর কাউকে পেলে জানাস তো ... '
    চিন্টু আবার মাথা কাত করে বলল, ' আচ্ছা ... '

    ( চলবে )
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। হাত মক্সো করতে মতামত দিন