এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • হেদুয়ার ধারে (দ্বিতীয় খন্ড) - ২

    Anjan Banerjee লেখকের গ্রাহক হোন
    ২২ অক্টোবর ২০২৪ | ৯৩ বার পঠিত
  • ( ২ )

    শিবতোষবাবুর প্রায় পঁয়ষট্টি বছর বয়েস হল। তবে, শরীর স্বাস্থ্য এখনও মোটামুটি ভালই আছে।
    তার সারাক্ষণের চিন্তা রাত্রিকে নিয়ে। সাগরের সঙ্গে তার সম্পর্কটা এখনও সঠিক রূপ পেল না।
    ইদানীং রাত্রির স্কুলের কাজের চাপ খুব বেড়েছে, বিশেষ করে বছরে চারবার করে গাদাগাদা হরেক প্রকারের টেস্টের খাতা দেখা। সে বলে, ' বাবা তুমি অত চিন্তা ক'র না ... কিছুদিনের মধ্যেই আমরা বিয়ে করে নেব ... '
    ----- ' আরে ... কিছুদিন কিছুদিন করে তো পাঁচবছর পেরিয়ে গেল। তোদের দুজনেরই তো বয়েস বাড়ছে নাকি ? তাছাড়া এরকমভাবে থাকা ভাল দেখায় না। লোকেও কতরকম কথা বলে। সাগর কি বলছে এ ব্যাপারে ? '
    ---- ' ও তো রাজি আছে। আমিই একটু দোনামোনা করছি ... ' রাত্রি বলে।
    ----- ' কেন দোনামোনা কেন ? '
    ----- ' ওর তো এখন সব দিক দিয়েই সময়টা খারাপ যাচ্ছে। সময়টা তো এখন একটু অন্যরকম ... ফিনান্সিয়ালি আর একটু সেটলড না হলে ঠিক ... '
    শিবতোষবাবু হতালভাবে বলেন, ' কি মুশ্কিল .... ওঃ ... কেউ তো আর অনন্তকাল বসে থাকতে পারে না। জীবন আর ক'দিনের ... ফুরিয়ে যেতে ক'দিন লাগে বলতো ... '
    রাত্রি শিবতোষের উৎকন্ঠা অনুভব করতে পারে।
    সে কোন তর্কাতর্কির মধ্যে যায় না। রান্নাঘরে আলু চচ্চড়িতে খুন্তি নাড়তে নাড়তে শান্ত কন্ঠে বলে, ' ঠিক আছে, সাগরের সঙ্গে কথা বলে দেখছি ... ফাইনাল একটা ডিসিশান নিতে হবে এবার ... হয় এস্পার নয় ওস্পার... '

    শিবতোষ এ ধরণের কথায় এখন আর মোটেই আশ্বস্ত হন না। রাত্রির মুখে এসব কথা বহুবার শুনেছেন তিনি। তিনি অনর্থক আর কথা না বাড়িয়ে রেডিওটা খুলে দিয়ে বিছানায় শরীর ফেলে দিলেন। মানে, শুয়ে শুয়ে রেডিওয় স্থানীয় সংবাদ শুনবেন। খবর পড়ে শোনাচ্ছেন দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়। যুক্তফ্রন্ট সরকারের মুখ্যমন্ত্রী অজয় মুখোপাধ্যায় নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে তার ক্যাবিনেট মন্ত্রীদের মিটিং ডেকেছেন। শিবতোষবাবু মনে মনে ভাবলেন, ' কি আর হবে ...উনি তো বছর দুই আগেও অনেক চেষ্টা চরিত্র করেছিলেন। কি হল কাঁচকলা ! ক'মাস টিকল সরকার ... এবারেরটাই বা ক'দিন টেঁকে কে জানে। তবে ভদ্রলোক কিন্তু সৎ লোক বটে। স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন। তবে আসল কথাটা হল কি, বেশি ভাল, ভাল নয় ... '

    খবর শুনতে শুনতে শিবুবাবুর ঝিমুনি আসে। রাত্রি আলু চচ্চড়ি নামিয়ে ঢেকে রেখে এ ঘরে এসে দেখে শিবতোষবাবূর মৃদুস্বরে নাসিকা গর্জন হচ্ছে। তিনি চিৎ হয়ে শুয়ে আছেন বুকের ওপর দুহাত রেখে। দৃশ্যটা কেমন যেন লাগল রাত্রির। দেবদুলালবাবুর খবর পড়া প্রায় শেষ হয়ে এল। পূর্ব পাকিস্তানে বিড়ি শিল্পের ওপর কি একটা কর চাপানোর খবর দিয়ে উনি খেলার খবরে গেলেন। কলকাতার লীগ ফুটবলে মোহনবাগান আর উয়াড়ির খেলার রেজাল্টটা জানিয়ে দিয়ে খবর শেষ করলেন উনি। রাত্রি রেডিওটা বন্ধ করে দিল।
    রেডিওর আওয়াজ থেমে যেতেই শিবতোষবাবুর ঘুম ভেঙে গেল। তিনি ঘুমেল চোখ মেলে রাত্রির দিকে তাকিয়ে বললেন, ' অ্যাঁ ...কি ... কি হল ... '
    রাত্রি বলল, ' কিছু হয়নি। খাবে এখন ? রুটিগুলো গরম আছে ... '

    নিখিলবাবুর কোচিং ঘরে সাগর বসেছিল। সকাল ন'টা বাজে এখন। আজ ছুটির দিন। ঘরে আর কেউ নেই এখন।
    সাগর বলল, ' এটা কিন্তু পার্টির লড়াইই হয়ে যাচ্ছে ... মারছে ঠিকই কিন্তু ঠিক লোককে মারা হচ্ছে না। একদম উল্টোপাল্টা হাতুড়ি মারছে। কোথাকার ঘা কোথায় পড়ছে কেউ দেখছে না। মোটেই পেরেকের ওপর পড়ছে না ... আমার ছোট বুদ্ধিতে যা বুঝি ...।'

    নিখিলবাবু জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইলেন নীরবে।
    খানিক পরে বললেন, ' আমি অনেক কথা চিন্তা ভাবনা করেছি কিন্তু এই অ্যাঙ্গেলে কখনো চিন্তা করিনি। সত্যি কথা বলতে কি এই পসিবিলিটা আমার চিন্তায় ছিল না। আমার লক্ষ্য হল একটা গণজাগরণ ঘটানো। এই ঘুণধরা পচাগলা সিস্টেমকে উপড়ে ফেলার উপলব্ধি তৈরি করা প্রতিটি নাগরিকের মধ্যে। শ্রেণীসংগ্রাম, শ্রেণীশত্রু এসব এক একটা অর্থহীন বাক্যবন্ধ। আসল দরকার হল সিস্টেমসংগ্রাম। ক্যানসারাস সিস্টেমের মূলে কুঠারাঘাত। কিন্তু এসব কি হচ্ছে ? দেশের ক'জন মানুষের আত্মিক যোগ আছে এতে ... '
    ---- ' ঠিক বলেছেন স্যার ... খুব চিন্তায় পড়ে গেছি। নানারকম চিন্তা আসছে মনে। রামমন্দিরের ওমপ্রকাশ আগরওয়াল নাকি থ্রেট পেয়েছে, শুনেছেন নাকি ? ' সাগর বলে।
    ---- ' নাতো ... কি হয়েছে ? '
    ---- ' কারা ওমপ্রকাশের মুন্ডু নেবে বলেছে। বলেছে মনোরঞ্জনের মুন্ডু নিয়েছি, এবার তোর নেব ... মনোরঞ্জন মানে শ্যামপুকুর থানার ওই যে এস আই ....'
    ---- ' হ্যাঁ হ্যাঁ ... বুঝেছি। ওই এক্সট্রিমিস্ট গ্রুপের কাজ এসব। দে আর কমপ্লিটলি বিরেফট অফ আইডিয়াজ। দিস ইজ নট অ্যাট অল দি ওয়ে। দে আর লিডিং দেমসেলভস টু অ্যাবসোলিউট রুইন ... '
    সাগর বুঝতে পারল নিখিল স্যার সম্পূর্ণ আত্মস্থ অবস্থায় আছেন। তার উপস্থিতি বিস্মৃত হয়েছেন।
    নাহলে এত ইংরিজি টিংরিজি বলতেন না।
    সে বলল, ' সেটাই তো কথা। এখন, জানি না আপনার ভবিষ্যদ্বাণী মিলবে কিনা .... '
    নিখিল স্যার আরও কি বলতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু বলা হল না। স্বামীকে বগলদাবা করে কাবেরী এসে ঢুকল। কাবেরীকে দেখতে বেশ বেগবতী স্রোতস্বিনীর মতো সজল সরস লাগছে। তার সিঁথি সাবেক প্রথায় রক্তিম সিঁদুরে রাঙানো। এত সিঁদুর সজ্জা আজকাল দেখা যায় না।
    ওরকম ডাকাবুকো মেয়ে এত সিঁদুর মেখে ব্যক্তিগত দাম্পত্যবন্ধনের বিজ্ঞাপন করে বেড়াচ্ছে
    এটা বেশ আশ্চর্যের মনে হল নিখিল ব্যানার্জীর।
    তিনি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন কাবেরীর দিকে।

    কাবেরী বলল, ' কেমন আছেন স্যার ? সংসারে বাঁধা পড়েছি, আসার সময় করে উঠতে পারিনা।
    কিছু মনে করবেন না ... '
    ---- ' না না ... মনে করব কেন ? এই যে এলি সময় করে এটাই তো যথেষ্ট ... তাই বা ক'জন করে ... '
    ---- ' অন্যদের কথা তো আমি বলতে পারব না, কিন্তু আমার তো আপনার কাছে না এসে কোন উপায় নেই ... '
    নিখিল স্যার হেসে ফেললেন। বললেন, ' তাই নাকি ? এরকম ব্যাপার ? '
    নিখিলবাবু গৌতমের দিকে তাকিয়ে বললেন, ' শুনছ কি বলছে ? ঈর্ষা হচ্ছে না ? '
    গৌতম হেসে বলল, ' না স্যার ... ও ওরকমই ... '
    নিখিলবাবু কাবেরীর দিকে তাকিয়ে বললেন, ' সে নয় বুঝলাম। কিন্তু টানটা কিসের শুনি ...'
    কাবেরী কে জানে কেন অন্য দিকে তাকিয়ে বলল, ' সেটা যদি বুঝতে পারতাম তা'লে তো হয়েই গিয়েছিল .... '

    ( চলবে )

    **************
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। সুচিন্তিত মতামত দিন