যাদবদের শাখাটি রাজা পুরুর বংশের মধ্যে সবচেয়ে আলাদা। তারা দীর্ঘ্যকাল সর্বগ্রাসী রাজতন্ত্রের আওতায় আসেনি। তারা রাজা নির্বাচন করেছে, কিন্তু যিনি প্রজার অনুরঞ্জন করেন সেই অর্থটি বজায় রেখেছে। কংসের পিতা উগ্রসেন রাজা ছিলেন, কিন্তু কংসের মত সর্বময় কর্তৃত্ব তাঁর ছিল না। তিনি শ্রদ্ধাভাজন ছিলেন, ভীতিপ্রদ না। কংসের উচ্ছেদে তাঁর পূনর্প্রতিষ্ঠা ঘটেছে। যারা এই কান্ড ঘটিয়েছে তারা দুই কিশোর, বলরাম এবং কৃষ্ণ। এই দুই কিশোর শূরের এবং ভোজকন্যা মহিষীর পুত্র বসুদেবের সন্তান বলে কথিত। বসুদেব সৌন্দর্য্যের জন্য বিখ্যাত।তাঁর অন্য নাম আনকদুন্দুভি। কথিত তাঁর জন্মকালে দুন্দুভি নিনাদে বিশ্বপরিপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। এবং সংবাদ হচ্ছে বসুদেব বৈষ্ণবদের মধ্যে 'বাসুদেব' উপাধির জন্য মনস্থ ছিলেন। সেই উপাধি তাঁকে বৈষ্ণবদের পুরোধা পুরুষ হিসেবেই প্রতিষ্ঠা করতো। তাঁর বিরুদ্ধে পূর্ব দেশীয় বহু বৈষ্ণব নরপতি রয়েছেন। কংস তাঁদের সমর্থন দৃঢ় করতে এবং নিজের রাজ্যের মধ্যে বৈষ্ণবদের রাজনৈতিক গুরুত্ব বৃদ্ধিকে কমাতে বসুদেবকে বন্দী করেছেন। তাছাড়া শৈব জরাসন্ধের সঙ্গে বৈষ্ণবদের সম্পর্ক মধুর হলেও জরাসন্ধ জানেন তাঁর প্রীতিভাজন নয় এমন কোনো ব্যাক্তি 'বাসুদেব' বলে ভূষিত হলে বৈষ্ণবরা পক্ষ বদলাতে পারে। কেন না ‘বাসুদেব’ বৈষ্ণবদের অবতার পুরুষ।
ভোজ বংশীয় রাজা আহুক অন্ধক গোষ্ঠীর কুকুরের পুত্র। তাঁর বাহিনীর প্রসিদ্ধি এককালে উত্তরাখন্ডে প্রভূত। আহুকের দুই পুত্র, দেবক এবং উগ্রসেন। দেবকের চারপুত্র এবং সাতকন্যা জন্মায়। দেবকী, শান্তিদেবা, সন্দেবা, দেবরক্ষীতা, বৃকদেবী, উপদেবী ও সুনাম্নী এই সাতকন্যার বিবাহ হয়েছিল বসুদেবের সঙ্গে। বসুদেবের আরো ছয় পত্নী ছিলেন পুরুবংশীয়। রোহিণী, মদিরা, ধরা, বৈশাখী, ভদ্রা ও সুনামা। দুই পরিচারিকা সুতনু এবং বড়বা-ও তাঁর পত্নীরূপে পরিগণিত হয়। বসুদেবের জ্যেষ্ঠা পত্নী পুরুবংশীয় রোহিণীর পুত্র রাম বা বলরাম। আর কৃষ্ণ, ভোজ বংশীয় দেবকীর সন্তান। ব্যাসদেব মনোনিবেশ করে এদের বংশবৃত্তান্ত শুনছিলেন। পুরু, ভোজ এই দুই বংশের সঙ্গেই এদের সম্পর্ক আছে। আবার বৃষ্ণি এদের বংশনাম।পুরাণখ্যাত কার্ত্যবীর্য্যার্জুনের হৈহয় বংশের সঙ্গে এদের সম্পর্ক আছে বংশ সূচক যাজ্ঞিক ক্রোষ্টার জন্য। ক্রোষ্টা, যদু পুত্র হৈহয় বংশস্রষ্টা সহস্রদের ভ্রাতা।
দীর্ঘ বিস্তীর্ণ বংশলতিকা মন দিয়ে শুনছিলেন ব্যাসদেব। এই বংশলতিকার মধ্যেই লুকিয়ে আছে তাঁর ভাবনার উপাদান। এই দোয়াবের শাসক যারা তারা সকলেই বংশধারা সূত্রে জড়িত। কিন্তু বিবেচ্য সেটা না, বিবেচ্য হল রাজনৈতিক স্বার্থ। যদু বংশের ক্ষেত্রে তাঁর আগ্রহের পিছনে আরেকটি সূত্র আছে। কুন্তিভোজের পালিতা কন্যা কুন্তী আসলে বসুদেবের পিতা শূরের কন্যা। রাজা উগ্রসেনের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা দেবকের জামাতা বসুদেব তাঁর ভগ্নী সম্পর্কে কতটা উৎসাহী সেটাও বিবেচ্য। পাণ্ডব যুধিষ্ঠির হস্তিনাপুরের সিংহাসনের ন্যায্য উত্তরাধিকারী, এ বিষয়ে তাঁর কোনো সন্দেহ নেই। গাঙ্গেয় যতই অপেক্ষার পক্ষপাতী হোন না কেন,ব্যাস জানেন যদি ভবিষ্যৎ নিদারুণ কোনো দুর্দিন না আনে তাহলে কুরু বংশের রাজত্বের ধারা বইবে পাণ্ডব নদীখাত ধরে। কৃষ্ণ-বলরাম আজ দুই কিশোর। কিন্তু তারা যে কান্ড করেছে তাতে তাদের যদু-নায়কত্বে উত্তীর্ণ হওয়াটা শুধুমাত্র সময়ের অপেক্ষা। পাণ্ডব এবং এই দুই বার্ষ্ণেয় ভ্রাতৃ-স্থানীয়। কেমন হবে এদের সম্পর্ক? কংসের পতনের পরে জরাসন্ধের মুঠি আলগা হয়েছে নিঃসন্দেহে। ভোজ, অন্ধক, বৃষ্ণিরা আবার জরাসন্ধের গ্রাসে যেতে চাইবেনা। তারা রুখে দাঁড়াবে। জরাসন্ধও জানেন যে এই যাদবেরা আদতে অত্যন্ত স্বাধীনচেতা। কংস তাদেরই একজন ছিল। তার শাসনকে এরা তবু একরকম ভাবে নিয়েছিল, কিন্তু সরাসরি জরাসন্ধের শাসনের চেয়ে মৃত্যুও এরা শ্রেয় জ্ঞান করবে। তাহলে? এক জটিল যুদ্ধ পরিস্থিতি লেগে থাকবে ওই অঞ্চলে। কেন না জরাসন্ধ এর প্রতিশোধ নিতে কসুর করবে না। এই জন্যেই কদমের আসা তাঁর কাছে। তিনি, গাঙ্গেয়র সঙ্গে মিলে কুরুদের প্রভাবিত করুন জরাসন্ধের বিরুদ্ধে যুদ্ধপ্রচেষ্টায়। পরোক্ষ সাহায্য, যা এতদিন ধরে গাঙ্গেয় করে এসেছেন তা দিয়েই শুধু চলবে না। আরো সাহায্য চাই। সে সাহায্য করতে গেলে জরাসন্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে হবে কুরুদের। সে অবস্থানে তাঁদের রাজী করানো দরকার। তাছাড়া ব্যাসের সন্তান এখন সিংহাসনে। তাই...!
তাই? ব্যাসদেব যে হস্তিনাপুর ছেড়ে এসেছিলেন সেই হস্তিনাপুর আজ নিশ্চই আরো জটিল আবহাওয়া ধারণ করেছে।এই খবর নিশ্চই পৌঁছেছে কুন্তী, ভীষ্ম, বিদুর এবং সর্বোপরি ধৃতরাষ্ট্রের কাছে। সে এখন নিশ্চই ভাবছে কুন্তীর এই শক্তিবৃদ্ধি পাণ্ডবদের লাভ। সে কেন সাহায্য করবে যাদবদের? কদম বিশ্রাম নিতে গিয়েছেন রাত্রির দ্বিতীয় যামে, তিনি এখনো বিরামহীন। আশ্রমে আসার পথে দীর্ঘ্য রথযাত্রার ধকল তাঁকে ক্লান্ত করেছিল, কিন্তু এখন সেই শ্রান্তিও টের পাচ্ছেন না উত্তেজনায়। আশ্রমের চতুর্দিকে অগাধ শান্তি। সকলেই বিশ্রাম রত। প্রহরায় রয়েছে কিছু বনবাসী। এঁরা তাঁর আশ্রমের অন্নে প্রতিপালিত। প্রহরা এবং গোধন প্রতিপালন এদের কাজ। জঙ্গলের কাঠের ঢিবি গড়ে আগুণ জ্বলছে আশ্রমের প্রান্ত ঘেঁষে। শ্বাপদ এবং রক্ষদের আক্রমন ঠেকাতে এই ব্যবস্থা। সেই আলোয় দেখা যাচ্ছে কিছুটা। তিনি উঠে পড়লেন তাঁর বিশ্রামাসন ছেড়ে। এখনই একবার চতুরকে চাই তাঁর। হস্তিনাপুরে দূত পাঠাতে হবে।
দূত যখন পৌঁছেছিল হস্তিনাপুর তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে চারপাশে। রাত্রিটা ব্যাসের নির্দেশ মতন দূত গাভালগণ কাটাচ্ছেন বিদুরের আস্তানায়। সেখানে শুনেছেন দুটি সংবাদ। একদিকে মথুরার দূত এসে জানিয়েছেন- মথুরা, কংসের মৃত্যুর পরে জরাসন্ধের বিরুদ্ধে কুরুকূলের মিত্রতার অভিলাষী। অন্যদিকে মধ্যম পাণ্ডব ভীমসেন নিখোঁজ হয়েছেন। আজ দুই দিন কেটে গেল মধ্যম পাণ্ডবের কোনো খোঁজ নেই। কিন্তু প্রথম খবরটি যতটাই প্রকাশ্য দ্বিতীয় খবরটি ততটাই ঢাকা আছে ধোঁয়াশায়। মধ্যম পাণ্ডবকে যে পাওয়া যাচ্ছে না একথা জানেন মাত্র কতিপয় মানুষ। হস্তিনাপুরের সাধারণ্যে এ খবর নিতান্তই জল্পনা-কল্পনা। এই ধরণের জল্পনায় যাঁরা তাৎক্ষণিকভাবে উত্তেজনা বোধও করেন তাঁরাও জানেন এর কোনো মানে নেই। প্রতি সপ্তাহে রাজবাড়ির অন্তঃপুরের বা রাজ শাসনের নতুন নতুন কীর্তি সম্পর্কে এমন খবর বাজারে এসেই থাকে। তার মধ্যে কোনোটা সত্যি আর বেশিটাই গুজব মাত্র।
গাভালগণের সামনেই বিদুরের সঙ্গে কথোপকথন হচ্ছিল তামসের। তামস বিদুরের আস্থাভাজন গূঢ়পুরুষ। তাঁর একটি আশ্রম আছে হস্তিনাপুর নগরের থেকে সামান্য দূরেই। শব সাধনা করে থাকেন তিনি, এমনই জনশ্রুতি। ব্রাহ্মণেরা বেজায় ক্রুদ্ধ তাঁর উপরে। কিন্তু প্রমাণ নেই কোনো। কারণ যে অরণ্যে তিনি সাধনা করেন সেটি দুর্গম। সামান্য অংশ জুড়ে বিদ্যমান ওই অরণ্যেই হিংস্র জন্তু নাকি প্রচুর। তাছাড়াও রয়েছে নাগেরা। তারা হস্তিনাপুরকে ঘিরেই আছে প্রায়। উত্তর দিক ছাড়া সবদিকেই রয়েছে অরণ্য এবং নাগেদের গ্রামগুলো রয়েছে তার গভীরে। শবর, নিষাদরাও রয়েছে। তাদের মধ্যে ছড়িয়ে আছে তামসের চরেরা। অরণ্যের গভীরের খবর আনার কাজ এই চরেদের। আবার রাজা, রাজকুমার বা অভিজাতরা কেউ শিকারে গেলে এরাই তাদের পথপ্রদর্শক হয়ে থাকে। রাজা বা রাজকুমারদের শিকারের জন্য কোনো অনুমতি লাগে না। কিন্তু অভিজাতদের শিকারে যেতে হলে রাজানুমতি লাগে। তামস বলছিলেন,
- বিষক্রিয়া মোক্ষম হবার আগেই জলের মধ্যে ডুবে যাওয়ায় জল খেয়েছিল বালকটি। সেই জলই কিছুটা লঘু করে দেয় বিষক্রিয়া। তারপরে নাগেরা যখন দেহটি ভাসতে দেখে উদ্ধার করে তখন তারা প্রথমেই সেই জল বের করে দেয়। তারপরে তাদের নিজস্ব কিছু ঔষধ প্রয়োগ করে-টরে। কিন্তু গোটাটাই ঘটেছে যথাযথ সময়ে। নইলে-
থেমে যায় তামস। এরপরে আর বলার কিই বা আছে? নইলে মধ্যম পাণ্ডব এই ধরাধাম ছেড়ে এতক্ষণে বিদায় নিয়েছে। কুরু বংশের সিংহাসন দখলের লড়াইতে প্রথম মৃত হিসেবে নাম হয়ে যেত। গাভালগণ পেশাগতভাবে সুত। তিনিও দেখেছেন বালকটিকে। শক্তপোক্ত চেহারা। গঠনে নাগেদের অনস্বীকার্য্য প্রভাব আছে। নাগপুরুষের ঔরসে জন্ম ভীমের। মহর্ষি ব্যাসও শুনেছেন নাগপুরুষের কথা। মহর্ষিকে ঔর্ব্ব্যই জানিয়েছিলেন নাগপ্রধান পবনের ঔরসে এই জন্ম। হস্তিনাপুরের নিকটের অরণ্যের নাগেরা সে কথা জানে। তাই নাগেরাও বালককে নিজেদের আত্মীয় বলে খাতির-যত্ন করেছে। বলশালী চেহারা এবং শরীর সর্বাংশে সুস্থ বলেই ওই তীব্র বিষ সহ্য করতে পেরেছে। বিষের পরিচয় নাগেরাই বলেছে। গুঞ্জা ফলের বিষ। দু থেকে তিনদিনের মধ্যে কাজ করে। গাভালগণ জানেন এ বিষ সবচেয়ে সহজেই পাওয়া যায়। গঙ্গার অববাহিকা জুড়ে ছড়িয়ে আছে গুঞ্জা গাছের ঝোপ। সূর্যালোকের দেশে যেখানে যেখানে এই গাছের ঝোপ হবে তা দ্রুত ছড়াবে। ফলে এ বিষ পাওয়া তুলনামূলক সহজ।
বিদুর জানালার কাছে দাঁড়িয়ে ছিলেন নিশ্চল। শুনছিলেন তামসের কথা, কিন্তু মন পড়ে ছিল অন্যত্র। এই জীবনের কত খেলা এখনো বাকি, কত কি দেখতে হবে কে জানে! স্রেফ গুঞ্জার বদলে যদি অতিবিষের প্রয়োগ হত? হস্তিনাপুরের ভেষজাচার্য্যের ঘরে জমানো আছে সে বিষ। সম্ভবত ধৃতরাষ্ট্রের এবং মন্ত্রী কর্ণিকের মনে হয়েছে কোনো ভাবে যদি পরে ভীমের দেহ পাওয়া যায়, যদি বনের মাংসাশীতে খেয়ে না ফ্যালে সে দেহ তাহলে জানা যেতেও পারে কোন বিষের প্রভাব পড়েছে। স্বয়ং ভিষগাচার্য্য পরাশরের শিষ্য ছিলেন। তাঁর জানার পরিমাণ বিপুল। এবং এই ভিষগাচার্য্যের ভাঁড়ার থেকে তাঁকে বা গুপ্তপুরুষদের না জানিয়ে বাইরে কোনো বিষ আনা যাবে না। এ আদেশ স্বয়ং দেবব্রতের দেওয়া। কাজেই সাবধানতা অবলম্বন করেই গুঞ্জা ফলের প্রয়োগ। নাগেদের ভ্রাম্যমান দলের নজরে যদি যথাসময়ে ভীমের ভাসমান দেহটি না পড়তো তাহলেই তো হয়ে এসেছিল। সুতরাং পরিকল্পনার দিক থেকে খুব একটা ভুল হয়নি।
- তুমি এ বিষয়ে যে সব শবর বা ব্যাধেরা জানে তাদেরকে সতর্ক করে দাও তারা যেন এ নিয়ে কথা না বলে।
বিদুর এতক্ষনের নীরবতা ভঙ্গ করলেন। তামস এক মুহুর্ত নিশ্চুপ থেকে বললো,
- কিন্তু তারা কি শুনবে? মানে হাঁড়িয়া একবার পেটে পড়ে গেলে-
- বোঝাও! তাদের ভালর জন্যেই নীরবতা দরকার। হস্তিনাপুরের কুমার বিষাক্রান্ত। এমন বিষে আক্রান্ত যে বিষ ব্যবহার করে শিকারী নিষাদ, শবররা। তাহলে সন্দেহ কার দিকে যাবে?
-আজ্ঞে ওদের দিকেই।
-কিন্তু যদি কেউ নাই জানে যে কুমার ভীমসেনকে বিষপ্রয়োগে হত্যার চেষ্টা হয়েছিল তাহলে কেউ এ নিয়ে কথাই বলবে না তাই না?
গাভালগণ তাকালেন বিদুরের দিকে। সত্যিই কি ঠান্ডা মাথার মানুষ এই আচার্যপুত্র! এর মধ্যেই ভেবে নিয়েছেন কি করণীয়। কুরুবংশের ভেতরের লড়াই-এর কথা এখনি বাইরে এলে চলবে না। অথচ বাইরে আসাটাও বন্ধ করা দরকার। সবচেয়ে সহজ পন্থা এটাই ছিল। উৎসমুখেই যদি সংবাদকে আটকে দেওয়া হয় তাহলে তার প্রবাহ হবে না। তামস বিদায় নিল। গাভালগণ এতক্ষণ চুপ করে বসেছিলেন। এবারে তাঁর দিকে তাকালেন বিদুর। বললেন,
- শাসনের বাস্তবতা একটি বিচিত্র প্রক্রিয়া তাই না আচার্য্য?
-ঠিক বুঝলাম না গুরুপুত্র।
- শাসনের বাস্তবতা বলতে কী বোঝায় আচার্য্য?
- শাসনের বাস্তবতা অর্থ হল শাসিতের এবং শাসকের সামগ্রিক পরিস্থিতির মূল্যায়ন।
- তারপরে?
- সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ।
- সেখানেই বৈচিত্র্য আসে তাই না?
- আমাকে আরেকটু পরিস্কার করে না বললে আমার পক্ষে বোঝা খুব সম্ভব নয় আচার্য্য। আমি, আপনার বা আচার্য্যদেবের মতন প্রখর বুদ্ধিমান যে নই।
- সামগ্রিক পরিস্থিতি কী দিয়ে তৈরি?
- সামগ্রিক পরিস্থিতি মানে নিয়ত ঘটমান যা কিছু পারিপার্শ্বে তা!
- আচার্য্য বৃহস্পতি ঘটনা বিষয়ে হয়তো জোর দিতেন, কিন্তু শুক্রাচার্য্য ঠিক এইভাবে বিষয়কে দেখবেন বলে মনে হয় না তাই না?
- কেন?
- ঘটনার আলাদা কোনো মানে আছে কি দ্রষ্টা ছাড়া?
- আজ্ঞে দ্রষ্টা ছাড়া ঘটনা তো ঘটেও।
- ঘটে, কিন্তু দ্রষ্টা ছাড়া ঘটে চলা ঘটনা স্বীকৃত হয় কি?
- না।
- তাহলে যদি দ্রষ্টা ঘটনাকে স্বীকার না করে তাহলে কি আর ঘটনার অস্তিত্ব থাকে?
- অর্থাৎ একটি খুন হল এবং একজন দেখলো। কিন্তু সে দেখলো বলে মানলো না বলে এবং অন্য কেউ জানলো না বলে খুনটা অস্বীকৃতই থেকে গেল। এই তো?
- তাহলে আপনি কম বুদ্ধি সম্পন্ন মোটেও নন আচার্য্য!
বিদুর হাসেন।
- সাধারণ বাস্তবতার সঙ্গে শাসনের বাস্তবতা কখনো মেলে না। মেলে না বলেই সাধারণ বাস্তবতা থেকে ইতিহাস তৈরি হওয়া খুব সমস্যাজনক কাজ।
বিদুর বলেন। গাভালগণ ভাবেন কথাটা নিয়ে। বিদুর বলেন,
- আপনি একটু বিশ্রাম নিন আচার্য্য। কাল সকালে আমরা পুনরায় সাক্ষাৎ করবো। এখন একটি বিশেষ কাজ আমার সম্পন্ন করা উচিত।
- অবশ্যই গুরুপুত্র!
অভিবাদন করে বিদুর বেরিয়ে যান। বাইরে রাত গভীর হয়েছে। শাস্ত্রী মহাশয় কিছুক্ষণ আপন ভাবনার মধ্যে ডুবে গেছিলেন। চটক ভাঙলো কতগুলো পাখির ডাকে। সম্ভবত তারা আক্রান্ত। হয় বাসায় সাপ উঠেছে অথবা প্যাঁচা। কান পাতলেন তিনি। না, পেঁচা না। কারণ তার কোনো শব্দ শোনেননি তিনি। তাহলে সাপ। এখানে অজগরের উপদ্রব বেশি তা তিনি জানেন। শব্দহীন অমেরুদন্ডীটি আততায়ী হিসেবে অত্যন্ত নির্মম। একদম সামনে হাজির না হলে সে যে এসেছে তাই জানা যায় না। প্রকৃতিগতভাবে পাখিগুলি দুর্বল, আর অজগর শক্তিমান। পাখীদের কলরব বাড়তে বাড়তে চূড়ান্ত হচ্ছে। একবার ইচ্ছে হল বাইরে বেরিয়ে দ্যাখেন যদি কিছু করতে পারেন। তারপরে গাভালগণ চলে এলেন জানালা থেকে। প্রকৃতি নিত্য নির্মমতার রাজ্য। তিনি মাথা নাড়লেন। যার যার জীবনের নিরাপত্তা মূলত তার তার হাতেই। তাকেই শিখতে হবে নিরাপদ হতে। নতুবা...!
হ্যাঁ, এও বাস্তবতাই।