গঙ্গাপুত্র সাদর অভ্যর্থনা করেছেন মথুরা দূতের। বিদুরকে বসিয়ে বৈঠকও করেছেন। কিন্তু যা করেননি তা হল, মথুরাদূতকে জরাসন্ধের আক্রমণের ক্ষেত্রে কৌরব সাহায্যের পরিপূর্ণ নিশ্চয়তা দান। বিদুর সম্পূর্ণ সহমত ছিলেন না এ বিষয়ে। কিন্তু কিছুটা গঙ্গাপুত্র এবং কিছুটা ধৃতরাষ্ট্রের কথা ভেবেই এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি। তিনি জানেন একটি দৌত্যে কিছু শেষ হয়ে যাচ্ছে না। আর অপেক্ষা বস্তুটা সম্পর্কে তাঁর খুব একটা অনাগ্রহও নেই, যদি তা প্রয়োজনীয় হয় তাহলে।
দেবব্রতের যুক্তিটি খুব পরিষ্কার। তিনি চাননা জরাসন্ধের সঙ্গে যেচে শত্রুতা করতে। জরাসন্ধের অনুসারী গোষ্ঠীটি খুব একটা ছোটও না। বহু পূর্ব দেশীয় রাজারা তার অনুগামী এবং যাদবদের একাংশের মধ্যেও তাঁর প্রভাব অবশ্যই আছে। কাজেই খোলাখুলি বৈরিতার প্রয়োজন নেই। আবার যাদবদের নতুন শাসন এবং শাসককে স্বাগত জানাতেও তাঁর দ্বিধা নেই। তিনি যাদবদের মিত্র অবশ্যই। শুধু যুদ্ধ-সংক্রান্ত কোনো বোঝাপড়া করতে গেলে তাঁদের অসুবিধে। বেশ কিছুকাল হল হস্তিনাপুর পররাজ্য আক্রমণ এবং দখল করা ছেড়ে দিয়েছে। সে নিজে আক্রান্ত না হলে যুদ্ধ তার কাম্য নয়। লোকক্ষয়, ধনক্ষয় তার কাম্য নয়। তাই যুদ্ধের বিষয় থেকে নিজেদের দূরেই রাখছেন। দূত যেন যাদবদের গণকে একথা বলেন যে হস্তিনাপুর মিত্রকে অভিনন্দন জানাচ্ছে নতুন ব্যবস্থার জন্য। এবং কামনা করছে যে যুদ্ধ বা হত্যার যেন আর কোন প্রয়োজন না পড়ে তাঁদেরও। তাঁরাও যেন সুখে সমৃদ্ধিতে বসবাস করেন। যদুগণ যেন যুদ্ধ ও তার অত্যাচার ব্যাতিরেকেই জীবনে চলতে পারেন।
ধৃতরাষ্ট্রেরও কথা অনেকটা এমনই। শুধু পার্থক্য হল ধৃতরাষ্ট্রের একটি গোপন ভাবনা আছে, বা সেই ভাবনা যে বিদুর এবং দেবব্রতের কাছে গোপন তাই ধৃতরাষ্ট্র ভাবছেন এবং তাঁরা দুজনেই এমন ভাবতে দিচ্ছেন তাঁকে। সেই ভাবনার কেন্দ্রে আছে কুন্তীর সঙ্গে যাদবদের সম্পর্ক। যাদবরা যদি কৌরবদের সাহায্য লাভ করে তাহলে তারা আরো শক্তিশালী হবে। সে ক্ষেত্রে যদি জরাসন্ধের চূড়ান্ত পরাজয় হয় তাহলে যাদবদের অবস্থান উত্তরাপথের রাজনীতিতে আরো গুরুত্বপূর্ণ হবে। তখন কুন্তীর পুত্রদের জন্য তারা যদি দাঁড়ায় তাহলে দুর্যোধনের জন্য বিপদ। যদিও যুধিষ্ঠির জন্মসূত্রে বড় তাহলেও সিংহাসন সেই পাবে এমন কোনো মহান ভাবনা ধৃতরাষ্ট্রের মাথায় নেই। আর সেটা যে নেই তা মধ্যম পাণ্ডবকে বিষ দেবার পরে আর কোনো ভাবেই বিদুর বা গাঙ্গেয়র অজানা থাকার কথা না। কিন্তু গাঙ্গেয়র বা বিদুরের মনোভাব ধৃতরাষ্ট্র সর্বাংশে বুঝতে পারছেন না। দুজনের কেউই ভীমের হত্যার চেষ্টা নিয়ে কোনো রকম উচ্চবাচ্য করেননি।
সেদিন দুর্যোধনের এবং অন্যান্য কৌরব ভ্রাতাদের সঙ্গে খেলতে গিয়েছিল ভীম নদীর ধারে। সেখানেই দুর্যোধন তাকে সুস্বাদু নানান খাদ্যের প্রলোভন দেখায়। ভীম, বহুদিন ধরেই বিদুরের আশ্রয়ের সাধারণ খাবার খেয়ে খেয়ে ক্লান্ত। সে ভোজন রসিক। সেখানে এমন আমন্ত্রণ নিয়ে তার খুব একটা ভাবার কারণ ছিল না। ভাবেওনি সে। সেই খাবার খাওয়ার পরেই তারা দুর্যোধনেরই প্ররোচনায় নদীর জলে সাঁতার কাটতে নেমে অচৈতন্য হয়ে পড়ে। সে যদি মারা যেত তাহলে একরকম ছিল, কিন্তু ফিরে এসেছে সে। এই ফিরে আসাও কীভাবে হয়েছে তা পরিস্কার করে ধৃতরাষ্ট্র বা কৌরব শিবির জানে না। সেখানে এই বিষয়ে পাণ্ডবদের সর্বাধিক সুহৃদ বিদুর জানবে না তা হতেই পারে না। এবং গাঙ্গেয় - তিনি জানবেন না হস্তিনাপুরে এমন কিছু হয়ে যাবে এ কথা ভাবাই যায় না। আর কিছু না হোক বিদুর তাঁকে জানাবে নিশ্চই। তাহলে দুজনেই নিশ্চুপ কেন? এই হিসেব ধৃতরাষ্ট্রের মিলছে না। মিলছে না মন্ত্রী কর্ণিকেরও। বালক দুর্যোধন ভাবতে পারে এঁরা হয়ত ভীত, কিন্তু অতটা মূর্খামি ধৃতরাষ্ট্র বা কর্ণিক করবেন না।
গাঙ্গেয়কে বিদুর আলাদা করে কিছুই বলেননি। সে কথা ধৃতরাষ্ট্রের জানার কথা না। তিনি জানেনও না। কুন্তী যখন জানাতে বলে তখন বিদুর বলেন,
- গাঙ্গেয় যা জানার নিজেই জানবেন, তাতেই পাণ্ডবদের মঙ্গল।
যুধিষ্ঠির জানতে চায়,
- তাত, এমন কেন বলছেন?
- যদি আমি এ বিষয়ে অভিযোগ জানাই তাহলে উনি ভাববেন আমি পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে যাচ্ছি। সেটা হস্তিনাপুরের জন্য উনি পছন্দ করবেন না। সে কারণেই দীর্ঘকাল নিজে বৈষ্ণব হওয়া সত্ত্বেও গোপনে সাহায্য করেছেন কংস বিরোধীদের, কিন্তু হস্তিনাপুরকে জড়াননি তাতে। এমনকি এখনও তিনি কিন্তু হস্তিনাপুরকে সরাসরি জড়াতে দিলেন না। এমন হলেন গাঙ্গেয়। তোমার মাতা জানালে ভাববেন নিজ পুত্রের সিংহাসন লাভ নিয়ে তিনি অত্যন্ত ভাবিত। তাই এই ক্রুর অভিযোগ জানাতে গিয়েছেন। কিন্তু নিজে জানলে সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা করবেন।
- কিন্তু পিতামহকে এমন তো মনে হয়নি তাত!
- পুত্র যুধিষ্ঠির, মানুষ অতি জটিল চরিত্রের। সে তার নিজের অভিজ্ঞতার আলোতেই সব দেখে থাকে। গাঙ্গেয়, বহুকালাবধি হস্তিনাপুরের সিংহাসনারূঢ়দের নানান আচরণ দেখছেন। দেখছেন এই এক রাজবংশের মধ্যে সম্পর্কের বিচিত্র জটিলতা। মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র মহারাজ পাণ্ডুর প্রতিনিধি হয়েও স্ববশে সিংহাসন চান এ কথাও তাঁর অজানা না। হস্তিনাপুরের নিয়ম বা রাজত্বের নিয়ম যদি এমন হত যে মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র সত্যিই এ সিংহাসনের প্রকৃত অধিকারী হতে পারেন তাহলে গাঙ্গেয় স্বয়ং তাঁকে সে অধিকার দিতে সক্রিয় হতেন। তিনি আমাদের সকলের শুভার্থী। এবং মনে রেখ তিনি পক্ষপাতী এই ভাবনাটিকে সযত্নের পরিহার করে চলেন। তাঁর আচরণে পক্ষপাত যাতে কখনো প্রকাশ না পায় তা নিয়ে তিনি অতীব সতর্ক। ভীমকে যখন এখানে আনা হয় তখন বিষের কোনো প্রকোপ আর অবশিষ্ট নেই। কাজেই তাঁকে দেখানোর মত চিহ্ন ছিল না। আর কিছু বনবাসীর সাক্ষ্যে তিনি দুর্যোধন ভীমের খাদ্যে বিষ মিশিয়েছিল এ কথা মেনে নেবেন না। বনবাসীরা সামান্য মদ্য বা মাংসের বিনিময়ে মিথ্যা সাক্ষ্যেও প্ররোচিত হতে পারে এ কথা তিনি জানেন। সুতরাং যা প্রমাণ করার উপায় নেই তা নিয়ে তাঁকে না বলাই ভাল।
কুন্তী মন দিয়ে শুনছিলেন। তাঁর এই দেবরটি শান্ত, অথচ কী প্রখর ধী-সম্পন্ন তা আবারও যেন বুঝতে পারছিলেন। পুত্রদের প্রখর জীবনাশঙ্কার মধ্যেও তাঁর মনে হচ্ছিল এই গোটা হস্তিনাপুরে কেউ যদি সত্যিই তাঁকে এবং তাঁর সন্তানদের রক্ষা করতে পারেন তাহলে ইনিই পারবেন!
- উনি নিজে জানবেনই একথা কি বলা যায় নিশ্চিত হয়ে?
প্রশ্নকর্তা নকুল। দাদার সঙ্গে সঙ্গে এই বালকটিও ক্রমশঃ নানান শাস্ত্রে দক্ষ হয়ে উঠছে। আর দক্ষ হচ্ছে প্রসাধনে। পঞ্চ ভ্রাতার মধ্যে সেই নিজ রূপ সম্পর্কে অতি যত্নশীল। এখনও কথা বলার সময় তার গ্রীবাভঙ্গীটি দেখার মতন।
বিদুর হাসলেন। সারাদিনের অনেক ক্লান্তি পেরিয়ে এসেছিলেন তিনি। এই রাত্রের অন্ধকারের কাছে তিনি নিজেকে সঁপে দিতে পারলে খুশি হতেন। তার বদলে একদিকে এই বালকদের এবং তাদের মাতা, আর অন্যদিকে গাভালগণ তাঁকে ব্যাস্ত রেখেছে। তবু সেই ক্লান্তি পেরিয়েও হাসি এল। বালকের সহজ প্রশ্ন তাঁকে আরো একবার মনে করালো এখনো সব কিছুই শুধু জটিল-কঠিন নয়। এখনো কিছু সরল ভাবনা আছে। হস্তিনাপুরের রক্ষার কঠিনতম দায়িত্ব যিনি নিজের কাঁধে রেখেছেন তাঁকে কতটা চক্ষুষ্মান হতে হয় তা এই বালক কি করে জানবে? তাঁর কত অজস্র চোখ-কান ছড়িয়ে আছে দেশের ভিতরে আর বাইরে তা এই বালক কী করে জানবে? তাই এ সহজ প্রশ্ন!
- জানবেন। তাঁর অগোচর কোনো কিছুই থাকতে পারে না এখানে। অন্তত এখনো তাই সত্য।
- তাহলে এখন করণীয় কী?
কুন্তী নিদ্রাবিভোর ভীমের মাথায় হাত বুলিয়ে প্রশ্নটা করলেন। এখনো কিছু দুর্বলতা শরীরে আছে বলে তাঁর সন্তানটি ঘুমিয়ে পড়েছে। আহা, এসে প্রথম কথা বলেছিল,
- মা, আমি আর খাবার লোভ করবো না।
তারপরে তিনি যখন বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরেছিলেন তাকে তখন বলেছিল,
- বুকটা না জ্বলে গেছিলো মা, জান! কী কষ্ট হচ্ছিল! মনে হচ্ছিল ফেটে যাবে এইবারে। আমি যখন ডুবে যাচ্ছি তখনো - তখনো ভাবছিলাম -
থেমে গেছিলো বলতে বলতে। কুন্তী কিছু বলার আগেই প্রশ্ন করেছিল অর্জুন,
- কী ভাবছিলে দাদা?
- নাহ, থাক!
সর্বকনিষ্ঠ সহদেব, তার হাতের খেলনা গো শকটটা রেখে ভীমের হাতটা ধরেছিল। বলেছিল,
- মেজদা, তোমার এখনো ব্যথা?
কুন্তীর রুক্ষ চোখেও জল এসেছিল। কিছুই না থাক তাঁর, তাঁর সন্তানরা আছে তো! সমব্যাথী সন্তানরা পরস্পরের। মায়ের চোখের জল যুধিষ্ঠিরও দেখেছিল। সে কিছু বলার আগেই অর্জুন আবার জানতে চাইলো,
- কী ভাবছিলে মেজদা?
অর্জুন নিজের প্রশ্ন ভোলে না কখনো। যা চায় তা নিশ্চিত চায়।
- ভাবছিলাম দুর্যোধনও তো আমার ভাই-ই হয় না মা? আমাকে মারতে কষ্ট হল না ওর?
কুন্তী! হা কুন্তী! একক মাতৃত্ব কখন যে নিষ্ঠুর অভিশাপ হয়ে ওঠে! এই সহজ বালকের দলকে তাঁকেই জানাতে হবে ক্ষমতার কোনো আত্মীয় হয় না? রক্ষা করেছিল সর্বাণী। এগিয়ে এসে ভীমের হাত ধরে বলেছিল,
- চল তো বাছা, অনেকক্ষণ আমি জল গরম করে বসেছি। ভাল করে নিমপাতার জলে স্নান করাই তোমাকে। নইলে ওই মুখের ভেতর আর বাইরের ফোঁড়া যাবে না।
ভীমকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে সর্বাণী নিয়ে চলে গিয়েছিল। তখনো কুন্তী ভেবেছিলেন, তাহলে কী করণীয় তাঁর, তাঁদের। তখন বিদুর ছিলেন না। এখন আছেন।
- স্বাভাবিক জীবন যাপন করা দরকার। কিছুই হয়নি এমনভাবে চলতে হবে। শুধু কিছু অনুশাসন প্রয়োজন।
যুধিষ্ঠির জানতে চায়,
- কী অনুশাসন তাত?
- আজ থেকে কেউ একা কোথাও যাবে না। একা কিছু করবে না। কাউকে না কাউকে সঙ্গে রাখতেই হবে। আর হ্যাঁ, যা ঘটেছে তা কোনো ভাবেই আলোচনা করা যাবে না কারোর সঙ্গেই।
অর্জুন এতক্ষণ চুপ করে ছিল। এবারে সে জানতে চায়,
- আর দুর্যোধনের কী হবে? কী হবে তার ভাইদের?
বিদুর বালকের চোখে দেখলেন এক ঝলসানো ক্রোধ! অর্জুন সোজা তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে। রেখাটা গাঢ় হল মাত্র। বিভাজন ঠেকানো সম্ভব হবে বলে মনে হচ্ছে না। কৌরব বংশ একত্রিত হলে যা হতে পারতো তা শুধু কষ্টকল্পনা এখন থেকে। ওই বালকের ক্রোধ বলে দিচ্ছে গৃহযুদ্ধের দামামা বেজে গেল। এখন এই বালককে আপ্তবাক্য শুনিয়ে লাভ কি? অথচ তিনি বিদুর। দুর্যোধন তাঁরও ভ্রাতুষ্পুত্র, ঠিক এঁদেরই মতন। মহারাজ পাণ্ডু আর মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের বিবাদেও তিনি কিন্তু পক্ষ নেননি কোনো। শুধু পাণ্ডবদের ন্যায্য অধিকারের জন্যই কুরুসভায় দাঁড়িয়েছিলেন। তাহলে এখন তাঁকেও কি পক্ষ নিতেই হবে? গাঙ্গেয়র মতন তিনি যে এড়িয়ে যেতে পারছেন না। গাঙ্গেয় তাঁর মতন সম্পর্কের, মোহের অথবা প্রেমের বাঁধনে যে বাঁধা নেই। তিনি, ধর্মবেত্তা বিদুর যে প্রথম প্রেমের কাছে সদা সমর্পিত, তাঁর কী হবে?
মাথায় হাত রাখলেন এগিয়ে গিয়ে। অর্জুনের প্রশ্নশীল চোখ এখনো তাঁর হাতের তালুর নীচ দিয়ে তাঁকেই ছুঁয়ে আছে। বললেন,
- তারা মারাত্মক বড় অন্যায় করতে গেছিল। দেবতাদের পরম করুণা যে সে অন্যায় হতে পারেনি। তবু আমি বলবো, ভাইদের ভাই বলেই মনে করার চেষ্টা কর অর্জুন।
- তাহলে কি অন্যায়কে মেনে নেব বলছেন তাত?
কঠোর প্রশ্ন শিশুর মুখ থেকে এলে চাবুকের মত লাগে। বিদুর জানেন কুন্তীর দুটি চোখ তাঁর দিকে তীব্র দৃষ্টিতে চেয়ে। কিন্তু তাঁকে পারতেই হবে। তিনি পিতা এবং তাত। তিনি এই সকল বালকদের পিতাসমান। এদের জন্য প্রকৃত শিক্ষাদানই তাঁর কর্তব্য। গাঙ্গেয়, যখন জানবেন সব তখন এমন ভাবেই ভাববেন। আজকের এই দাগ যদি সময় মিলিয়ে দেয় সেই আকাঙ্খাই করবেন। কুরু-পাণ্ডব উভয়েই হস্তিনাপুরেরই অংশ। তারা যুদ্ধমান হলে ক্ষতি হস্তিনাপুরের।
- অর্জুন, ন্যায়-অন্যায় বিবেচনা অতি সরল নীতি সমূহ। তুমি যখন তূণ থেকে বাণটি নিচ্ছ এবং ধনুতে যোজন করছো তখন বান ও ধনু ছাড়াও লক্ষ্যকে ভেদ করতে আরেকটি বিষয়ে মন দিতে হয়। সেটা কী?
- পিতামহ বলেছিলেন মধ্যিখানে থাকে বায়ু। তার গতিবেগ না বুঝলে বাণ লক্ষ্যে পৌঁছবে না।
- হ্যাঁ। তেমনই ন্যায় আর অন্যায়ের মধ্যে থাকে সময়। তার চরিত্র এবং কার্য না বুঝলে দুটোর অর্থ প্রকৃত নিরূপণ কঠিন। এখানেও আজ তারা যে অন্যায় করেছে তা আজীবন করে যাবে এমন নাও হতে পারে। তাদের মধ্যেও ক্ষমতার ক্রুরতা পেরিয়েও শুভ বুদ্ধির বিকাশ ঘটতে পারে। সময়ই জানিয়ে দেবে সব। অন্তত এমন অপরাধ আর হওয়ার আগেই শাস্তি নিয়ে ভাবাটা ঠিক হবে না।
- কিন্তু তাত -
- অর্জুন, তাত আমাদের একমাত্র অভিভাবক হস্তিনাপুরে যাঁকে আমরা সম্পূর্ণ বিশ্বাস করে থাকি।
যুধিষ্ঠির বলে উঠলো।
- হ্যাঁ বড়দা, কিন্তু -
- তাহলে তিনি যখন বলছেন সময়ের প্রয়োজন এক্ষেত্রে, সমস্ত কিছুকে বিবেচনা করতে, তখন তা মেনে নেওয়াই আমাদের কর্তব্য নয় কি?
যুধিষ্ঠিরকে অমান্য করা অর্জুনের স্বভাবের মধ্যে পড়ে না। সে চুপ করে গেল। কুন্তী তাকিয়ে আছেন তাঁর দিকে। এতক্ষণে বিদুর তাকালেন কুন্তীর দিকে সরাসরি। কুন্তী তাঁর ক্লান্ত চোখ ধীরে ধীরে সরিয়ে নিলেন। আর ভাবতে ভাল লাগছে না তাঁর। বিদুরের উপরেই ছাড়া থাক ভাবার ভার।
কিন্তু গাঙ্গেয় কুন্তীর মতন ছাড়তে পারেন না। তিনি জানলেন এবং ভাবলেন। তাঁর দূত ছুটলো পাঞ্চালে। কৃতবর্মার ভগ্নিপতির সঙ্গে দেখা করার দরকার তাঁর। কুরু-পাণ্ডবের যুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছে এমন ভাবনা তিনি প্রশ্রয় দিতে একদমই রাজি নন। এত কাল যে বংশকে তিনি সেবা করে এসেছেন সে বংশ তাঁর বর্তমানে এমন একটা অবস্থায় দাঁড়াবে আর তিনি দেখবেন বসে বসে? সময়? সময়ের অপেক্ষা তিনি তখনই করেন যখন সময়ের ঘাড় ধরার সময় হয় না। এ ছাড়া তিনি সময়ের অপেক্ষা করেন না। তিনি গাঙ্গেয়, নদীর স্রোতধারা যেমন জানেন, তেমনি জানেন বাঁধ দিতে-ও।