কুন্তী যখন সত্যবতীর কক্ষে এসে পৌঁছেছিলেন তখন আচার্য্য গণিকাপুত্র অপেক্ষায় ছিলেন তাঁর। ইনি মধ্যবয়স্ক এক পুরুষ। হস্তিনাপুরেরই গণিকা অঙ্গীরার গর্ভে জন্ম। নৃত্য, গীতাদিতে কুশল এবং পরচিত্ত বিষয়ক শিক্ষায় বিশেষজ্ঞ ইনি। গণিকাদের এই শিক্ষা দিয়ে থাকেন। রাজপরিবার এঁকে বৃত্তি দেয় এবং এঁর কাছ থেকেই গণিকা সংগ্রহ করে কুমার থেকে বিদেশী অতিথিদের সেবার জন্য। এছাড়া এনার একটি বিশেষ কাজ হল গণিকাদের মধ্য থেকে গুপ্তচর নিয়োগ। কুন্তীর কাছে সংবাদ নিয়ে যাবেন ইনি নিজে। সত্যবতীর পরামর্শক্রমে কুন্তীপুত্রদের নৃত্য শিক্ষা দিতে ইনি নিযুক্ত হচ্ছেন। নৃত্যশিক্ষা যুদ্ধবিদ্যা শিক্ষার জন্য আবশ্যকীয়। একসঙ্গে দুই কার্যই সম্পাদিত হবে এঁর দ্বারা। কুন্তীর সঙ্গে যথোপযুক্ত পরিচয়ের পরে ইনি বিদায় নিলেন। কিন্তু কুন্তীর মধ্যে ভাবনাটা আরো চারিয়ে গেল। সত্যবতী রাজ্য ছেড়ে যাচ্ছেন বটে বাণপ্রস্থে, কিন্তু তিনি যে মহারাণী সত্যবতী তা ভুলে যাচ্ছেন না। অন্দরমহলে গান্ধারীর প্রভাবকে খর্ব করার জন্য রেখে যাচ্ছেন ব্যবস্থা। ধৃতরাষ্ট্রকে সামলাবেন গাঙ্গেয় এবং বিদুর যৌথভাবে বা এককভাবেই। আর গান্ধারীকে সামলাতে এই ব্যবস্থা।
শহরের উপান্তে যে বন সেই বনেই থাকবেন আপাতত সত্যবতী। হস্তিনাপুর গঠনের কাল থেকে এই অরণ্যকে রাজঅধিকারের মধ্যে আনা হয়েছে। এখানে হিংস্র পশু নেই। যে কয়টি ছিল, সেগুলিকে হত্যা করা হয়েছে। তৃণভোজী হরিণজাতীয় কিছু পশু ছাড়া এখানে আর কিছুই নেই। আগে এই বনকে ব্যবহার করা হত কুমারদের মৃগয়াক্ষেত্র হিসেবে। এক্ষেত্রে নিয়ম হচ্ছে হিংস্র পশুগুলিকে নখ-দন্তহীন করে ছেড়ে রাখা হবে। সে কাজ করবে রাজভৃত্য নিষাদরা। কুমাররা রথে, পদব্রজে সেই পশুগুলি শিকার করবেন, সাহসের চর্চা করবেন। বিচিত্রবীর্য্য যখন কুমার তখনও এই অরণ্যে সিংহ এবং ব্যাঘ্র মজুত ছিল। এমনকি কুমার পান্ডুও এখানে একটি সিংহ শিকার করেছেন। ছিল বনশূয়োর-ও। আজ সেসবও নেই। পান্ডু নিজে ওই অরণ্যে শিকার করার অভ্যাস ছেড়ে দিয়ে আরো বন্য অরণ্যে চলে গিয়েছেন, কিন্তু তাঁর বা গাঙ্গেয়র আদেশে হস্তিনাপুরের অতিথিরা এখানে নিরাপদে পশু শিকার করতেন। সেই অরণ্যেই রাজপরিবারের বয়স্কদের বাণপ্রস্থের ব্যবস্থা হয়েছে। কালে কালে এই অরণ্য ছেড়ে অন্যত্রও এঁরা গমন করতে পারেন অবশ্যই, কিন্তু সে এঁদের ইচ্ছাধীন বিষয়। প্রাসাদ জীবনে অভ্যস্ত এই নারীরা সকলেই মানিয়ে নিতে পারবেন এমন নাও হতে পারে। সত্যবতী পারবেন না, একথা ভাবা যায় না, কিন্তু সত্যি বাকী দুই রাণীকে নিয়ে সমস্যা আছে। ছোটরাণী অম্বালিকা আসবাসক্ত। তাঁর এই নেশা রোগের চেহারা নিয়েছে। রাজবৈদ্য তাঁর চিকিৎসা করছেন। সেই কারণেই নগরের নিকটবর্তী স্থানে থাকাই বাঞ্ছনীয়। অন্তত সত্যবতী স্থান নির্বাচনের ক্ষেত্রে এই কারণ-ই দেখিয়েছেন। এতে করে তাঁর নগরের নিকটে বাস করা এবং রাজ্যের ব্যবস্থা সম্পর্কে খবর রাখা, দরকারে তাতে হস্তক্ষেপের সুবিধাও বজায় রাখলেন।
আরো একটা কারণ আছে যা সত্যবতী এবং ব্যাস কেউই নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেননি। সেই কারণ হল পাঞ্চালের বিরোধ প্রসঙ্গ। কুরুদের পাশে বাস করা পাঞ্চালদের সঙ্গে কুরুদের বিরোধ প্রাচীন সময়ের। ঋক্বেদের দশ রাজার যুদ্ধের সময়েও ছিল সে বিরোধ। রাজা সুদাসকে মিলিত আক্রমণের কথা রয়েছে সেই কাহিনীতে। কিন্তু সত্যবতী এবং ব্যাস দুজনেই জানেন এ কাহিনী আদতেই আরো নবীন সময়ের। মহারাজ পুরুরবা আইলার বংশের এক শক্তিমান নরপতি ছিলেন তনসু-পুত্র ল্লীনা। তাঁর থেকেই জন্ম মহারাজ দ্যুষ্মন্তের। দ্যুষ্মন্তের শকুন্তলা-জাত সন্তান হলেন মহারাজ ভরত। যাঁর পুত্র ভুমন্যু আবার জন্ম দেবেন আরেক নরপতি আজমেনিড-এর। আজমেনিড-এর তিন রাণীর গর্ভে হয়েছিল ছয় সন্তান। ধুমিনির গর্ভে রিক্ষ, নিলির গর্ভে দ্যুষ্মন্ত ও পরমেষ্ঠিন, কেশিনীর গর্ভে জহ্নু, জল এবং রূপিণা। ভুমন্যু, জনশ্রুতি বলে গান্ধারেরও পশ্চিমের যাবনিকদের সন্তান। ঋষি ভরদ্বাজ এঁকে তুলে দিয়েছিলেন মহারাজ ভরতের হাতে। তাই মহারাজ ভুমন্যুর পুত্রের আজমেনিড-এর মত যাবনিক নামকরণ। মহারাজ আজমেনিডের স্ত্রী-দের মধ্যেও ছিল এই বিরোধ। ধুমিনিও যাবনিকা। অন্য দুই পত্নী নিলি ও কেশিনীর সঙ্গে তাই তাঁর-ও ছিল বিরোধ। তাঁর-ই পুত্র ঋক্ষ যখন বসলেন কুরু শাসনে তখন সে বিরোধ সুস্পষ্ট আকার নিয়েছে। কেন না দ্যুষ্মন্ত ও পরমেষ্ঠিন প্রতিষ্ঠা করেছেন পাঞ্চাল দেশ। পিতা রাজ্য বিভাজনে তাঁদের দিয়েছিলেন পাঞ্চাল। জল এবং রুপিণা কোনো রাজ্যলাভ করেননি। কিন্তু পরবর্তীকালে জহ্নু পুত্র কুশিকারা কান্যকুব্জ রাজ্য স্থাপন করবেন। এই বিভেদ-এ এঁদের ভূমিকা হবে নগণ্য। আজমেনিড এর পুত্রদের বংশ পাশাপাশি দুটি রাজ্যে বসবাস করলেও বন্ধু হবে না। তারা তা হয়ওনি।
ঋক্ষর পুত্র সম্বরণ যখন শাসন করছিলেন তখন প্রবল মহামারী, দুর্ভিক্ষে দেশ জনবিহীন হয়ে পড়ে। রাজ্যশাসন দুর্বল হয়ে পড়ে। সেই অবস্থায় পাঞ্চাল আক্রমণ করে তাঁদের। সম্বরণ সপরিবারে, আত্মীয়স্বজন সহ পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। সিন্ধুর পশ্চিম পর্বতমালার দিকে যে ধারা তার তীরে পার্বত্য অঞ্চলে গড়ে তোলেন তাঁদের নতুন রাজ্য। দুর্ভেদ্য এক দুর্গে বসবাস করতে শুরু করেন। কথিত যে পাঞ্চালদের দশ অক্ষৌহিণী সৈন্যের কাছে তাঁরা কিছুতেই দাঁড়াতে পারেননি। সেই থেকে যতকাল না বশিষ্ঠ্য বংশীয় এক বশিষ্ঠ্য যিনি বেদব্যাসের প্রপিতামহ, তিনি তাদের সাহায্যে আসেন ততদিন তাঁদের আর ওই স্থান ত্যাগ করে নিজেদের রাজ্য পুনরুদ্ধার করা হয়নি। বশিষ্ঠ্য সম্বরণের বংশের আরেক সম্বরণের সঙ্গে বিয়ে দিলেন সৌর বংশীয় ইক্ষ্বাকু রাজকন্যা তপতীর। তপতী নদীর ধারে হল সেই বিয়ে।
ইক্ষ্বাকু বংশের গুরকূল বশিষ্ঠ্যেরা। এককালে সূর্য ও সোম পূজক ছিলেন তাঁরা। ব্যাসের পিতা পরাশরের মন্ত্রও আছে সূর্য ও অগ্নি বিষয়ে ঋক্বেদ-এ। কিন্তু ধীরে ধীরে এই সূর্য ও সোম পুজোর চল কমতে থাকে লোকসমাজে। অবতারবাদের জন্ম হয়। দেহাতীত কিছুকে মানা জনসমাজের পক্ষে সহজ হচ্ছিল না। তখন রামের অবতারবাদ তাঁরা সমর্থন করেন। পাশাপাশি সমর্থন করেন কঠোর বর্ণাশ্রম। ভরদ্বাজ কুলপুরোহিতদের সমর্থনে পাঞ্চালরা আবার কঠোর বর্ণাশ্রমের বিরোধী। বেদকে তাঁরা অভ্রান্ত বলেও মানেন না। সমাজ ব্যবস্থা হিসেবে বর্ণাশ্রমকে তাঁরা মেনে চললেও যা মানেন না তা হল জন্মসূত্রে বর্ণ নির্ণয়। এ নিয়ে বিরোধের ফলে বশিষ্ঠ্যদের এবং বর্ণবাদী বৈষ্ণবদের প্রচার-প্রসার বাধা পাচ্ছিল। এ বিরোধ চরমে উঠলো যখন পরাশরের পিতা শক্তিকে হত্যা করেছিল কল্মষপাদ বিশ্বামিত্র গোত্রের প্ররোচনায়। পিতা পরাশর বশিষ্ঠ্যদের বাহিনী বানিয়ে বনচর রাক্ষস নিধনে মেতেছিলেন। অথচ সেই বনচরেরা বশিষ্ঠ্যদের অনুগত দীর্ঘ্যকাল। সেই কারণেই প্রপিতামহ বশিষ্ঠ্য তাঁকে থামান। কেন না বিভেদ তৈরী হচ্ছে তাঁদের অনুগতকূলে। তাঁরা এভাবে দুর্বল হয়ে যাবেন, বিশ্বামিত্র বংশীয়দের উদ্দেশ্য সাধিত হবে। বিশ্বামিত্ররা আজ অনেক দুর্বল। কিন্তু অধুনাকালে ভরদ্বাজদের সঙ্গেও এমন বিরোধ চলছে তাঁদের।
তাই শক্তি বাড়াতে এই রাজনৈতিক পদক্ষেপ। রাজা সম্বরণ জয় করলেন পূর্ব রাজত্ব। বশিষ্ঠ্যরা এখানেও কূলগুরুর মর্যাদা পেলেন। পাঞ্চালদের শত্রু ভরদ্বাজদেরও শত্রু। আবার উল্টোটাও সত্য বশিষ্ঠ্যদের জন্য। এমন অনুমান যে পিতা পরাশরের আশ্রমে যে আক্রমণ হয় যাতে তাঁর পা চিরকালের জন্য আঘাতপ্রাপ্ত হয় সেই আক্রমণের পিছনে রাক্ষসদের সঙ্গে ছিল চ্যবন, ভরদ্বাজ দুই গোষ্ঠীরই প্ররোচনা। বিশেষ করে কুরুরাজ্য যখন বাড়তে থাকে, মহারাজ কুরুর খ্যাতি বাড়ে, দেশ কুরুজাঙ্গাল নামে পরিচিত হয়, কুরুর সদ্ব্যবহারের এবং দার্শনিক ঋষি সুলভ শাসনের জন্য তাঁর সাধনা ক্ষেত্রকেও জনসমাজ কুরুক্ষেত্র বলে মর্যাদা দিতে শুরু করে তখন থেকে আরো বিরোধ বাড়ে। ভরদ্বাজরা একে দ্যাখে তাদের ভরতবংশীয়দের মূল নীতির থেকে বশিষ্ঠ্যদের প্ররোচনায় বিচ্যুতি হিসেবে।
মহারাজ কুরু পাঁচটি নীতি প্রণয়ন করেছিলেন। তাকে বলে কুরু ধর্ম। এই ধর্মে দীক্ষা নিতে শপথ নিতে হত।
আমি জীব হত্যা করবো না।
যা আমাকে দেওয়া হয়নি তা আমি নেব না।
নীতি বহির্ভূত যৌন কর্মে লিপ্ত হব না।
আমি অসত্য কথন বর্জন করবো।
যে নেশা আমার মস্তিষ্ককে গ্রাস করে সেই নেশা করবো না।
এই পঞ্চপথ নিয়েই প্রশ্ন ভরদ্বাজদের। অহিংসা দ্বারা কি রাজ্য শাসন হয়? যদি যা দেওয়া হয়নি তা না নিতে হয় তাহলে কুরুরা যুদ্ধ করে কেন? মহারাজ কুরুর সময়ের থেকে ছোটখাট নানা যুদ্ধ তারা করেছে। যৌনকর্মের গোটাটাই তো অনৈতিক কুরুদের। তাদের রাজা শান্তনু এক নারীকে পেতে নিজের পুত্রকেই সিংহাসন থেকে তাড়িয়ে দিল। এত কামার্ত সে রাজা! অসত্য? কুরু রাজ্য চালাতে কি শুধু সত্য দিয়েই চলে নাকি সব? শান্তনুর কাম নিয়ে কি জনসাধারণ সত্য জানে? না কি তাকে গাঙ্গেয়র বিপুল স্বার্থত্যাগ দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়? নেশাসক্ত শান্তনু থেকে বিচিত্রবীর্য্য কে ছিল না? নেশা না করলে এক রাজা গিয়ে এক জেলের মেয়েকে মহারাণী করে আনে, অমন পুত্র বিসর্জন দিয়ে?
এসব নিন্দার ঝড় ক্রমাগত উঠেছে পাঞ্চালে। কুরু রাজ্যের পানশালাতেও উঠতে থেকেছে। একটা সময় এমন দাঁড়ালো যখন ব্যবস্থা ভেঙেই পড়ে বুঝি। পাঞ্চালের এক সেনানী উগ্রযুদ্ধ পৌরব পাঞ্চালের তৎকালীন রাজাকে সরিয়ে সিংহাসন দখল করেছিল। মহারাজ শান্তনুর মৃত্যুর পরে সে চাইলো সত্যবতীকে। সে কার্ষ্যপণে কিনে নেবে সত্যবতীকে। সত্যবতী দাসের ঘরের মেয়ে। তার ক্রয়-বিক্রয়ে সমস্যা কি? চেদী রাজা উপরিচর বসু-র এক জেলের মেয়ের গর্ভে সত্যবতী আর মৎস্যরাজ বিরাটের জন্ম দেওয়ার কাহিনী শুধু বানানো। এ সব শান্তনুর পুরোহিতরা বিরাটের সঙ্গে মিলেই বানিয়েছে। ও সব কাহিনী সে মানে না। দাসী 'কালি'-কে সে কিনে নেবে। 'কালি' সত্যবতীর বাল্যনাম। সেই নামেই তাকে দাবী করে গাঙ্গেয়র কাছে সে দূত পাঠালো। নইলে সম্বরণের মতন কুকুরতাড়া করে কুরুদের তাড়িয়ে দেওয়া হবে। গাঙ্গেয়, অমিতবিক্রম গাঙ্গেয় সেই পৌরবকে হত্যা করেছিলেন যুদ্ধে। পাঞ্চালের বর্তমান রাজা দ্রুপদ পৃশত-এর সন্তান। সেই পৃশত উগ্রদুদ্ধের মৃত্যুর পরে পুনরায় দখল করেন রাজ্য।
এখন যখন সত্যবতী হস্তিনাপুর ছাড়ছেন তখন তাঁকে মনে রাখতে হচ্ছে যে পাঞ্চালের সকলেই তাঁর প্রতি প্রসন্ন নয়। অরণ্যে নিরাপত্তা বিধান করার জন্য থাকবে না বাহিনী। বাহিনী দিয়ে নিরাপত্তা বিধানের চেষ্টা হলেও জনসমাজে, কুরুগণের মধ্যে, অরণ্যচারী ঋষি-মুনিদের মধ্যে প্রবল অসন্তোষ জন্মাবে। কুরু রাজ্যের মহারাণী বর্ণাশ্রম ধর্ম ক্ষুণ্ণ করছেন এবং বাণপ্রস্থকে অশুচি করছেন বলে অভিযোগ আসবে। এ অভিযোগ বর্ণাশ্রমধর্মের ঘোর সমর্থক বশিষ্ঠ্য বংশীয়দের পক্ষে নেওয়া সহজ হবে না। ব্যাস তাই এ নিয়ে কোনো কথাই তাঁকে বলেননি। কুরু কূলের পক্ষেও এ কাজ সম্ভব না। দেবব্রত নিজেও বাহিনী অনুমোদন করতে নৈতিক সম্মতি জানাবেন না। তিনি জানেন এ প্রথা অলঙ্ঘ্যনীয়। এতে ধৃতরাষ্ট্র কি একটু বেশি খুশি হবে? মনের মধ্যে প্রশ্নটা উঁকি যে দেয়নি একবারও তা নয়। কিন্তু উপায় কী? তাই নিজের নিরাপত্তা ব্যবস্থাও তাঁকে ভেবে নিতে হচ্ছে। অন্তত প্রাসাদের ভেতরের খবর থাকলে বাইরেরটা তিনি সামলাতে চেষ্টা করবেন।
কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন তাঁর সন্তান। কিন্তু সেও বোধহয় মনে করে তিনি বহুকাল ধরেই এই বংশের বিষয়ে অযথা ব্যস্ত। কুরুকূলের সমস্যার সমাধান তাদের বা বিশেষ করে পুরুষদের হাতে ছেড়ে দেওয়াই উচিত ছিল। কখনো মুখে না বললেও তিনি বুঝেছেন। কোথাও তাঁর পুত্রও মনে করে যে নারীরা যেহেতু সংসারের অন্দরমহলেই নিয়োজিত এবং যেহেতু তাদের শিক্ষা-দীক্ষা কম তাই তাদের পক্ষে সম্ভব না রাজ্য-চালনা। সংসারে নারীর স্থান কমে গিয়েছে। শুধুমাত্র নির্দিষ্ট গন্ডীর মধ্যেই তার সবকিছু। নেহাতই সত্যবতী নারীদের মধ্যেও স্বতন্ত্র, তাই তাঁকে এর আগে সরাসরি কখনো কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বলেননি থেমে যেতে। এবারে বললেন। সত্যবতীও বুঝতে পারছেন যে সময়কাল বড়ই জটিল। হস্তিনাপুর আজ যে আবর্তে মগ্ন হচ্ছে সেখানে সত্যবতী প্রাসাদে থাকলে তাঁকেও সরাসরি পক্ষ নিতে হবে। সে কাজ খুব ভাল হবে না তাঁর নিজের জন্যও, সেও তিনি বুঝেছেন। গণের সভায় কুন্তীর সন্তানদের অধিকার আপাত নিশ্চিত হয়েছে মাত্র, কিন্তু উত্তরাধিকার নিশ্চিত হতে এখনো বহু পথ। ধৃতরাষ্ট্র এত সহজে ছেড়ে দেবে না। ব্যাস তাঁর পুত্র-পৌত্রাদির মধ্যেকার সংঘর্ষে জড়িয়ে থাকবেন তাতে অস্বাভাবিকতা কিছুই নেই। কিন্তু সত্যবতী জড়িয়ে থাকলে তাঁকে ক্ষমতালুব্ধ ছাড়া আর কিছুই ভাবার সম্ভাবনা নেই কারোর।
তিনি কি ক্ষমতালুব্ধ? কেন আছেন এতকাল এই প্রাসাদে? দাসরাজা তাঁর সন্তানরা যাতে কুরু সিংহাসনে বসে তা নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন। তিনিও বোঝেন পিতার উদ্দেশ্য। মহারাজ শান্তনুর কাম তাড়না আজ নয় কাল যদি ফুরিয়ে যায় তাহলে তাঁর কন্যাকে দূরে ছুঁড়ে ফেলতে কতক্ষণ! রাজা-রাজরারা কেমন হয় তা বোঝা লোকজ্ঞানে খুব দুরূহ কিছু তো না! সে শাসন নিশ্চিত হয়ে গিয়েছে তো! তাঁরই সন্তান-সন্ততিদের এখন এই রাজত্ব। দেবব্রতের বংশধারা শেষ। শান্তনুর ধারাও শেষ। যা আছে তা পরাশরের ধারা। তাহলে?
-অভ্যাস, রমণী, অভ্যাস।
আপনমনেই বলে ওঠেন এক এক সময়ে আজকাল। কুরু রাজত্বে, কুরু রাজপ্রাসাদে, কুরু সংসারে এতটাই নিমজ্জিত ছিলেন যে চোখ তুলে দেখার সময় হয়নি তাঁর। তার মধ্যেই বিপর্যয়ের স্রোত আচ্ছন্ন করে রেখেছে তাঁর দৃষ্টি। সামনের সমস্যাকে দেখবেন না নিজের ভবিষ্যত নিয়ে ভাববেন? কাল তার রথ চালিয়ে গিয়েছে। তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করে গিয়েছেন একটি সবল, সুস্থ রাজ্য গড়ে তুলতে। লোকে যে তাঁকে এখনো দোষ দেয় গাঙ্গেয়র থেকে রাজ্য কেড়ে নেবার জন্য! তিনিও জানেন যে মহারাজ শান্তনুকে ধরেও এই বংশ গাঙ্গেয়র মতন শাসক কখনো পায়নি। মহারাজ কুরু যেমন ধার্মিক, নিষ্ঠ শাসক, তেমনই একজন হতেন গাঙ্গেয়। কিন্তু তাঁর পিতা হতে দেননি, শান্তনু হতে দেননি, তিনিও হতে দেননি। বাকী দুজনেই এখন জাগতিক উত্তরের সীমার বাইরে। তিনি যে আছেন! তাই না এতকাল...। হায় রে, হায় রে! সুখের ছদ্মবেশে কখন যে দুঃখ এসে দাঁড়ায় মানুষ তা টেরও পায় না। সুখের মালা গলায় দুলিয়ে চলতে গিয়ে অকস্মাৎ অনুভব করে, এ মালা সুখের না, এ মালার বড় ভার। তিনিও ব্রাহ্মণ ঋষি পরাশরের সঙ্গিনী হতে না পারার দুঃখকে রাজরাণী হবার সুখ দিয়ে একদিন ঢাকতে গিয়েছিলেন। শান্তনুকে প্রত্যাখ্যান করতে গিয়েও মনে হয়েছিল সঙ্গোপনে, এও একরকম প্রতিশোধ হবে। পরাশর, দূরগামী পরাশরের বংশ যে বংশের কূলগুরু তাদেরই প্রাসাদে তিনি দাঁড়াবেন। রাজেন্দ্রাণী হয়ে পরাশরকেও বুঝিয়ে দেবেন তিনি এতটাও ফেলনা ছিলেন না।
কী ভেবেছিলেন আর কী হল! রাজেন্দ্রাণীকে আজ কাঙালিনীর মতন ছেড়ে যেতে হবে সব। তাঁরই পুত্র, পরাশর গর্ভজাত ব্যাসই তাঁকে সেই সূক্ষ প্রতিশোধের দুর্ভেদ্য বর্ম খুলিয়ে দাঁড় করিয়ে দেবে তাঁর নিজেরই সামনে। তাহলে কি পুত্রও তাঁকে অপরাধী করে রেখেছিল? দূরগামী পরাশর আজ তো আরো দূরে। মানুষের সীমানাও ছাড়িয়ে গিয়েছেন।
-কার প্রতিশোধ কার জীবনে বিষ বুনলো তবে?
আয়না জানতে চায়। আয়নার সামনে খুব কম দাঁড়ানোর অভ্যাস তাঁর। এখন তো আরোই দাঁড়াতে পারেন না। আয়না তাঁকে দেখে মুখ টিপে হাসে যে! তাঁকে নীরব এই প্রশ্নে পর্যুদস্ত করে, ব্যঙ্গ করে। আয়নাকে এড়িয়ে সন্তর্পণে দাঁড়িয়েছিলেন কুন্তীর মুখোমুখি। এই নারীও কি প্রতিশোধ চায়? কন্যাবেলার অবহেলা, এয়োস্ত্রী জীবনের প্রহসনের প্রতিশোধ? এ কি তাঁরই ছায়া, অন্য এক ছায়া?