বিক্ষিপ্ত ছিল মনটা গান্ধারীর। এই সকালেই প্রাসাদের উত্তর দিকের তোরণে জনসমাগম প্রচুর। বিভিন্ন বাজনার ধ্বনি ভেসে আসছে সেখান থেকে। কেন তিনি জানেন! আরো সেই কারণেই মনটা তেতো হয়ে আছে তাঁর। বহুবার বোঝাবার চেষ্টা করেছেন ধৃতরাষ্ট্রকে।কিন্তু তিনি বুঝতে চাইলে তো! একটু পরেই একটা বীভৎস চিৎকার এসে তাঁর সমস্ত চেতনা গ্রাস করে নেবে। তারপরে বহুক্ষণ অসাড় থাকবেন তিনি। এতটাই অসার থাকবেন যে মহারাণী সত্যবতীর খাস দাসী অলকার আনা যে সংবাদ সদ্য শুধু গ্রহণ করেছেন তার নিহিতার্থও তাঁকে ভাবাবেনা আর! কেন? কেন এই খেলা? এ কি শাস্তি? কার শাস্তি? শুধু যার হচ্ছে তার? নাকি যারা যারা এই শাস্তিতে আমোদিত হচ্ছে তাদেরও শাস্তি? মত্ত রণহস্তীর কষ বেয়ে গড়াতে থাকবে মদ, আর তার আক্রমণ থেকে বাঁচতে প্রাণভয়ে ঘেরা অঙ্গনের বিভিন্ন প্রান্তে দৌড়াদৌড়ি করবে কিছু মানুষ। একেক জনের একেক অপরাধ। ডাকাতি থেকে রাজনৈতিক বিরোধ বিভিন্ন।কিন্তু শাস্তি একই, মৃত্যুদণ্ড! সে মৃত্যু হবেই। তাদের দৌড় বাঁচাতে পারবে না তাদের। উপস্থিত জনতা বেজায় আমোদ পাবে তাদের সেই মরণপণ বাঁচার খেলায়। হাতের লম্বা লম্বা লাঠিগুলো দিয়ে খোঁচাবে তাদের। বাজনা বাজাবে নানারকম। তুড়ি-ভেড়ি থেকে নানান শব্দ আর্তচিৎকারের সঙ্গে মিশে এক অকথ্য কষ্টের রূপ নেবে তাঁর মস্তিষ্কে। কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হবে। তিনি দ্রুত হাঁটছিলেন। কঞ্চুকী তাঁর হাত ধরে আছে।
দুর্যোধনকেও এই খেলা দেখাতে বসেন ধৃতরাষ্ট্র। তাঁর বক্তব্য এটা ক্ষত্রিয়দের দেখাই দরকার। যুদ্ধ, মৃত্যু, রক্তপাত এসব তার জীবনের অঙ্গ। কাজেই এ তার শিক্ষার অংশ। ধৃতরাষ্ট্র শোনেন আর্তচিৎকার আর দুর্যোধন দেখে। গান্ধারী বলতে পারেন না কথাটা ভুল। তাঁরা ক্ষত্রিয় বলেই তো শাসন করছেন! কিন্তু শাসন যখন অসহায়কে হত্যা করে, তা সে বিচার বা যুদ্ধ যে নামেই হোক, তা তিনি সহ্য করতে পারেন না। সারাজীবন এত অধর্মাচরণ দেখে এসেছেন যে আর ভাল লাগেনা তাঁর। এ খেলা কোথায় নিয়ে যেতে পারে মানুষকে তা তিনি হাড়ে-মজ্জায় বুঝেছেন। নিজের দেশের কথা মনে পরে তাঁর। এই উপমহাদেশের প্রত্যন্ত অংশে থাকা অঞ্চল।কিছুকাল অন্তরই বাইরে থেকে যাযাবর, দস্যু বা অন্য গোষ্ঠী আক্রমণ করে এসেছে। বারেবারে রাজ্য শাসন পাল্টে গেছে। কত যে মিশ্রণ হয়েছে তার শেষ নেই। আর সেই রাজ্য সুরক্ষিত রাখতে প্রতিদিনই শাসনতন্ত্র বহু বহু অধর্ম আচরণ করে চলেছে। এই দোয়াব এবং উত্তরাপথের অন্যত্র প্রচলিত ধর্মের-আচরণের সঙ্গে কোনো মিল নেই তার। এ নিয়ে কম কথাও শোনেননি তিনি, এই হস্তিনাপুরে বধূ হিসেবে আসার পর থেকে। মাঝে মাঝে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন। তাঁকে করুণা করে আনা হয়েছে এখানে, একথাটা মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে অহরহ। ধৃতরাষ্ট্রই বেশী করেছেন। সত্যবতী তুলনায় এত নির্মম না। তাঁর ভয় নেই যে গান্ধারী হাতের বাইরে চলে যেতে পারে। কিন্তু ধৃতরাষ্ট্রের আছে বিলক্ষণ।
অথচ গান্ধারী জানেন এই বংশের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক অনেকযুগের।সেই সম্পর্ক জ্ঞাতিপরম্পরায় চলে আসছে।প্রতিবারেই অবশ্যই বিবাহ সম্পর্ক হয় না, কিন্তু জ্ঞাতিসুলভ আত্মীয়তা থাকেই। সেই আত্মীয়তার সূত্র ধরেই রাজনৈতিক সম্পর্কও বজায় থাকে। প্রাচীন কথন বলে রাজা পুরুর সন্তানদের মধ্যে কুরুরাও যেমন পড়েন, তেমনই পড়েন এই গান্ধাররাও। হ্যাঁ,গান্ধারদের সীমান্তবর্তী রাজ্য বলে কুরুদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার দায় বেশীই। সময়ে-অসময়ে কুরুদের শক্তি তাঁদের রাজ্যকেও সুরক্ষিত রাখবে। রাজা সুবল সেই কারণেই কিছুটা আগ বাড়িয়েই কন্যার বিয়ে ধৃতরাষ্ট্র অন্ধ জেনেও দিতে সম্মত হয়েছেন। তবু কি কৌরবদের লাভ নেই? তারাও জানে এমন একটি মিত্র তাদের সীমান্ত অঞ্চলে থাকলে তারা অনেক নিরাপদ বহিরাক্রমণ থেকে। কিন্তু গান্ধারীর এতে লাভ হয়নি।তাঁকে শুনেই যেতে হয়েছে এই বিয়েতে তাঁর সন্মান বেড়েছে পরিবার সমেত। তাঁর কর্তব্য স্বামীর সেবা করা মন দিয়ে ইত্যাদি ইত্যাদি। আজ যখন মহারাণী সত্যবতী এ প্রাসাদ ছেড়ে চলেছেন তখনও একই কথা তাঁকে শুনে আসতে হয়েছে। অলকার কথা তাঁর মগজে রেখাপাত করবে কি করে? একটু আগেই শ্বশুরের কাছে যা শুনেছেন তাতে তাঁর আশঙ্কা বেড়েছে বই কমে নি।
ব্যাসের কাছে গিয়েছিলেন তাঁর কর্তব্য জানতে। গান্ধারী জানেন একমাত্র ব্যাসই আজ বলতে পারেন তিনি কি করবেন! একদিকে অস্থির স্বামী, ক্ষমতার লোভ যার প্রতিদিনের নিদ্রা হরণ করেছে এবং যা চলে যাবার ন্যুনতম সম্ভাবনাতেও যিনি সংসারে প্রবল অশান্তির সৃষ্টি করছেন, অন্যদিকে কুন্তীর কাছে তাঁর আবার এক পরাজয় ঘনিয়ে আসা। তিনি নিজে এই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় উৎসুক ছিলেন না একদিন। আজ আর সেই দিন নেই। বাধ্যত তিনিও এর অংশ এখন। যেদিন কুন্তীর প্রথম সন্তান জন্মাবার খবরে ধৃতরাষ্ট্রের প্রবল অসন্তোষ এবং তার পরের তুমুল কুৎসিত ব্যবহার কল্পনা করে তিনি শঙ্কিত হয়েছিলেন, গর্ভপাত করতে গিয়েছিলেন, সেদিন এই ব্যাসদেবই তাঁকে বাঁচিয়েছিলেন। এই পরিবার শুধু না, তাঁকে গর্ভপাতের অপরাধে গোটা সমাজচ্যুত হতে হত। এতদিনে তাঁর ঠাঁই হত কোনো এক শ্বাপদশঙ্কুল অরণ্যের একটি পর্ণকুটীরে। এত দিন তিনি জীবিত থাকতেন কিনা সেখানে তাও এক কথা বটে! মুহুর্তের ক্রোধ, ক্ষোভ, অসহায়তা তাঁকে উন্মাদ করে দিয়েছিল। একদিকে মহারাণী সত্যবতী, অন্যদিকে ব্যাসদেব তাঁকে সেদিন ফিরিয়ে এনেছিলেন নিশ্চিত ধ্বংসের হাত থেকে। সেই গর্ভপাতের ঔষধকে ব্যর্থ করতে পেরেছিলেন ব্যাস। তাঁর পিতা পরাশরের গবেষণা সঞ্জাত ঔষধির মাধ্যমে জন্মও দিতে পেরেছিলেন গান্ধারীর সন্তানদের। সে পাপের কথা মনে করলে গান্ধারী শিউড়ে ওঠেন আজ নিজেই। তিনি সেইসব ভ্রুণহত্যা করতে গেছিলেন যারা আজ তাঁরই আঙিনায় খেলে বেড়ায়।
এর প্রায়শ্চিত্ত করতে গান্ধারী কয়েকটি সন্তানের জন্মের পরে একে একে সব মিলিয়ে শতসংখ্যক পুত্র এবং একটি কন্যাকে আপন করে নিয়েছেন। এদের পিতৃ-মাতৃ পরিচয় গোপন আছে সকলের কাছেই। ধৃতরাষ্ট্র ছাড়া জানেন শুধু ব্যাস, সত্যবতী, ভীষ্ম, বিদুর। ব্যাসদেব সকলকেই বেঁধেছেন মন্ত্রগুপ্তির শপথে। ধৃতরাষ্ট্র বিরোধ করেননি। প্রথমত, গান্ধারীর গর্ভাবস্থায় একটি বৈশ্যকন্যাকে নিয়ে তিনি যা করেছেন তারপর থেকে তাঁর পক্ষে এ বিষয়ে কিছু বলা সম্ভব হয়নি। ওই কন্যার গর্ভজাত যুযুৎসুকে পুত্র পরিচয় দেবার স্বীকৃতি আদায় করেই থেমে গেছেন। তাছাড়া গান্ধারী ভ্রাতা শকুনির কাছেও কৃতজ্ঞ অন্তত এই একটি বিষয়ে। তিনি ভগ্নীপতিকে বোঝাতে পেরেছেন তাঁর শত পুত্র মানে বিপুল শক্তির উৎস আসলে। পান্ডুর এক পুত্র সেখানে কি আর এমন! তাছাড়া প্রজাপুঞ্জের কাছে এ তো সবচেয়ে বড় প্রমাণ যে তিনি আদপে পান্ডুর চেয়েও অনেক বেশী পরিমাণ পুরুষ। শক্তির কথায় ধৃতরাষ্ট্র সব মেনে নিতে পারেন! কাজেই এটাও মানতে অসুবিধা হয়নি। সবচেয়ে অবাক বিষয় ধৃতরাষ্ট্রের আচরণে কখনো বোঝাও যায়না এরা তাঁর সন্তান না। বরং গান্ধারীর আচরণ যুযুৎসুর প্রতি সর্বদাই যাতে মাতৃসুলভ থাকে তা গান্ধারীকে মনে রাখতে হয় খুব নিয়ম করেই।
তবু তারপরেও তাঁর সংসারে কিছুকাল শান্তি সত্যি এসেছিল। দুরন্ত বালকের দল চঞ্চলতায় ভরে রেখেছিল তাঁর প্রাসাদ কোণ। তিনিও তৃপ্ত ছিলেন। কিন্তু আজ এই কুন্তীর পঞ্চপুত্র সমেত আগমন তাঁর সকল শান্তিকে ধ্বংস করবে এ তিনি স্পষ্ট বুঝতে পারছেন। ধৃতরাষ্ট্র আরো চঞ্চল আরো ক্রুর হয়ে উঠছেন। মন্ত্রী কণিক এবং জ্যোতিষী বার্ণিকের সঙ্গে সর্বদা মত্ত আলোচনায়। এমনকি আজ যে একসঙ্গে শত অপরাধীর মৃত্যুদন্ড হচ্ছে তাও তাঁর এই অস্থিরতার প্রকাশ মাত্র। তাই গিয়েছিলেন ব্যাসের কাছে। কুন্তীর সন্তানদের নিয়ে সন্দেহ আছে সকলের। ব্যাস শুনে স্মিত হাস্য করে খানিক চুপ করে রইলেন। তারপরে কম্বুক কন্ঠে যা বললেন তাতে গান্ধারীর আর কিছুই বলার থাকেনা। সত্যিই তো, এ বংশে কার জন্ম নিয়ে সন্দেহ নেই? কার আচরণ নিক্তিতে মেপে ধর্মসম্মত বলা যায়? তিনি নিজেও তো অধর্মের পথে গিয়েছেন একদিন। তাঁর এবং ধৃতরাষ্ট্রের শতপুত্রর কাহিনীও লোক জানেনা তেমন। তাহলে? গান্ধারীর উত্তর দেবার কিছুই ছিল না। ব্যাসই বললেন আবার। সমাজের কাজ সমাজ করবে, ধর্মের রক্ষা করবেন তিনি। সমাজের কাজ এ নয়। এই কঠিন কাজ কিছু মূঢ়মতির জন্য তিনি রেখে দেবেন না। গান্ধারী এ বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারেন যা প্রকৃত ধর্ম তাই পালিত হবে।
ফিরে এসেছেন গান্ধারী। তিনি তাঁর প্রাসাদ কক্ষের মধ্যবর্তী উপকক্ষে এখন। এই দেওয়াল অতিক্রম করে কোনো শব্দ আসবেনা তাঁর কাছে। ওই নৃশংস শব্দ তাঁকে আর জ্বালাবে না। দ্বারী প্রতিহারিণী তাঁকে সহসা জানালো দুর্যোধন এসেছে। দুর্যোধন? বালক দ্রুত পদে প্রবেশ করলো তাঁর কক্ষে। মায়ের কোল জড়িয়ে ধরলো তিনি থামানোর আগেই। তারপরে স্পষ্ট বিনীত স্বরে বললো,
-সুসংবাদ এনেছি মাতঃ।
-কি সংবাদ পুত্র?
-পিতাকে অনুরোধ করে আমি আজ সকল প্রাণদণ্ড স্থগিত করিয়েছি।
-সে কি?
চমকিত হলেন গান্ধারী। একি সংবাদ? তাঁর এই জ্যেষ্ঠ পুত্রই বা জানলো কি করে তিনি এর জন্য কষ্ট পান? কেন করেছে সে এ কাজ?
-পিতৃব্যর মৃত্যুকাল চলছে। এখন শোকের সময়। এর মধ্যে রাজ্যের প্রজাদের একজনেরও শোকের কারণ হওয়া উচিত হবে না।
-তোমাকে এ কথা কে শেখালো পুত্র?
-এক শ্রমণ। আজ আমাদের যাবার পথে আমার রথের কাছে এসে সে একথা বলে গেছে আমাকে। পিতা অনেক আগে চলে গিয়েছিলেন। আমি ভ্রাতাদের নিয়ে যাচ্ছিলাম তাঁর সমীপে।
-কে সেই শ্রমণ?
-জানিনা মাতঃ। আমি প্রশ্ন করার আগেই তিনি ভীড়ের মধ্যে মিলিয়ে গেলেন।
গান্ধারীর বিস্ময় বাঁধ মানছেনা। এ কি কান্ড?
-মাতঃ, আপনি খুশী?
এ প্রশ্ন আজ গান্ধারীকে কেউ জীবনে প্রথম করলো! সেই গান্ধারীকে যিনি অন্যান্য মায়েদের মত সন্তানদের কখনো স্বচক্ষে দেখেননি; কাপড়ে ঢাকা চোখদুটো আকুল হলেও না। যিনি তাদের শুধু স্পর্শ করেছেন, ঘ্রাণ নিয়েছেন, তবু চোখ মেলে দেখার কথা ভাবতেও পারেননি, সকলের প্রতি, এমনকি নিজের প্রতিও গাঢ় অভিমানে, সেই গান্ধারীর থেকেই আজ তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র জানতে চাইছে তিনি খুশী কিনা! এমন সুখ তাঁর সইবে তো?