- পুরুষ যখন সৃষ্টি করলেন তখন তিনি চিন্তন থেকে সৃষ্টি করলেন। তিনিই শুধু পারেন ‘নেই’ থেকে ‘আছে’তে রূপান্তর ঘটাতে। পুরুষকে জানতে গেলে চিন্তাকে জানা প্রয়োজন।
চিন্তা? চিন্তাকে জানা যে প্রয়োজন তা তার থেকে ভাল আর কে বুঝবে? যা কিছু হল কিছুদিন ধরে সে সব তো সত্যিই অচিন্ত্যনীয়। কিশোরটি সরোবরের ধারে বসে একটি একটি করে ঢিল ছুঁড়ছিল। আর যখন সরোবরের বুক থেকে সেই ঢিলের তরঙ্গ মুছে যাচ্ছিল তখন আবার আরেকটি ঢিল ছুঁড়ছিল। কিছুক্ষণ আগে ঋষি সন্দীপন যজ্ঞাগ্নি প্রস্তুত করতে করতে বলছিলেন এই কথা। চিন্তাও তো এমন। আসে আর মুছে যায়। কিন্তু তরঙ্গের মতন সম্পূর্ণ শূন্য হয়ে যায় না। কিছু থাকে, কিছু মুছে যায়। এই আশ্রমে এসে তার অতীত প্রায় ঝাপসা। কিন্তু এই দুপুরগুলোতে যমুনা তীর, তার উতল হাওয়া, তাদের নানান কান্ড-কারখানা সে সবের কিছু স্মৃতি এখনো তার মনে আসে। অথবা রাতের নিধুবন, জ্যোৎস্না, বাঁশি তাকে এখনো ডাকে রাতেই। যখনই সে একা থাকে তখনই তাকে দূর থেকে আসা শীতল বাতাসের মতন ছুঁয়ে যায় এই সব। তার অন্য একটা জীবন ছিল। একদম অন্য।
- গোপিনী সখীদের ধ্যান করলেই চলবে, ওদিকে যে গর্গ মুনি এসে উপস্থিত।
সুদামার বলার ঢঙটাই এমন। তার কথা শুনলে কোনো মতেই তাকে আশ্রমিক বলে ভাবার উপায় নেই। সেই গ্রাম্য তরলতা, কথায় কথায় আদিরসের ঠাট্টা-ঠিসারা, আর ভাবখানা যেন সেই তার একমাত্র অভিভাবক।
- ঋষি গর্গ এসে গিয়েছেন?
- হ্যাঁ। এবং এসে থেকেই তোমার খোঁজে আকুল। দেড়েল বুড়ো না হলে গোপিনী বলেই মনে হত।
হাসে কিশোর। গর্গের তার প্রতি টান সুপ্রসিদ্ধ। কিন্তু বলদেব কই? উঠে পড়ে সে। সন্দীপন মুনির আশ্রমের আর পাঁচটা বালকের মতন সে নয়। তাকে সে ভাবে দেখাও হয় না। খুব দ্রুতই তাকে শিক্ষা সমাপন করে চলে যেতে হবে। সুদামা তার নিত্যসঙ্গী। সুতরাং যখন সে এবং বলদেব এখানে এসেছে তখন সুদামা আসবেই। এসেওছে। শুধু সুদামা আর বলদেবের মন যে পঠন-পাঠনে নেই তা বুঝতে খুব সমস্যা হবার নয়। আশ্রমের বাকি বালক এবং কিশোরেরা তাদের থেকে কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখেই চলে। যখন কথাও বলে তখন আড়ষ্ট এবং কিছুটা সমীহ থেকে কথা বলে। তাদের কারোর সঙ্গেই আলাদা করে খুব একটা সম্পর্ক তৈরি হয়নি। তারা এখানে আসার আগেই তাদের খ্যাতি এসে পৌঁছেছে। তাই এই দূরত্ব।
দিনের বেশি অংশটাই বলদেব শরীর চর্চা করে বেড়ান। বাকি সময়টাতে, বিশেষ করে রাতে তাঁর কাজ হল নানান নেশার উপকরণ আবিষ্কার করা। সঙ্গী তাঁদের যদুকূলের প্রহরীরা। সেই প্রহরীরা অক্লান্ত। সারা রাত বলদেবের সঙ্গে নানান অভিযান করে এসেও দিনে তাদের ঘুম নেই প্রায়। এই এখনো তারা ধারে-কাছেই কোথাও আছে অক্লান্ত চোখ মেলে তার দিকে। তাদের রক্ষার দায়িত্ব যদুগণ দিয়েছে এই প্রহরীদের। সুতরাং সময় কোথায় তাদের বিশ্রামের!
চলতে চলতে কিশোর ভাবে আজ ঋষি গর্গের সঙ্গে এদের নিয়ে কথা বলবে সে। তার অস্বস্তিও লাগে বেশ। এত চোখের ভিড়ে নিঃসঙ্গতা হারিয়ে যায়। যে বদল তার চারপাশে ঘটে গেল তার জন্য যে সে সর্বাংশে প্রস্তুত ছিল এমন তো নয়! তার নিজের সঙ্গে সময় চাই। ঋষি গর্গকে বলে সে এদের আজই বিদায় দেবে। নিজেদের নিরাপত্তা নিজেদের করতে শেখা উচিত। এভাবে অন্যান্য সকল রাজা বা রাজবংশীদের মতন নিজেদের জন্য নিরাপত্তা-রক্ষী নিয়ে চলা তার পোষাবে না। বলদেব তার কথায় না করবে না। ঋষি না মানতে চাইলে তার হাতে যথেষ্ট যুক্তি আছে। কংসের তো অত অত রক্ষী ছিল নিরাপত্তার জন্য, কিন্তু তাকে যখন তারা দুই ভাই বধ করলো প্রকাশ্য রাজসভায়, তখন কি তারা বাঁচাতে পেরেছিল, না চেয়েছিল? তারা নিজেদের বাহুবলের ভরসাতেই যখন কংসের ব্যূহে ঢুকেছিল প্রাণ সংশয় জেনেও, তাহলে এখনো তারা এখানে টিকতে পারবে। একমাত্র সুদামাই যা তাদের মধ্যে কিছুটা দুর্বল শারীরিক শক্তিমত্ততায়। কিন্তু সাহসের অভাব তারও নেই। কাজেই নিজেদের ভার তারা নিতে অবশ্যই সক্ষম। শুধু একবার নিজেদের মধ্যে কথা বলা দরকার।
- সুদামা, একটা আলোচনা ছিল। কিন্তু ভ্রাতা বলদেবকে কোথাও দেখছি না!
- সে এখন টেনে ঘুমোচ্ছে। হাঁড়িয়া না কী যেন একটা খেয়েছে!
- আজকেও?
- তার আর আজ-কাল!
- ভ্রাতা বলদেব মাঝেমধ্যে বিবেচনা বস্তুটা হারিয়ে বসেন, এই হচ্ছে সমস্যা।
- আচ্ছা, এই ভ্রাতা-ভ্রাতা করাটা কেন ধরেছ বলতো?
- কেন? ভ্রাতাকে ভ্রাতাই তো বলবো।
প্রশ্নটা একটু আচমকাই এসেছে। কিশোর যে খুব প্রস্তুত ছিল না তা বলাই বাহুল্য।
- কিন্তু এতকাল তো দাদা দাদা-ই বলতে। হঠাৎ এখন ওই অং বং চং-দের মতন বিশুদ্ধ সংস্কৃত ছাড়া কথাই বলনা দেখছি।
হাসি ফোটে কিশোরের মুখে। সুদামা, তার আবাল্য বন্ধু। কিশোরের কোনো পরিবর্তন তার নজর এড়িয়ে যাওয়াটা বেশ কঠিন কাজ। কিন্তু একটা আরো পরিবর্তন আছে যা সুদামা নিজেও দেখছে না। বা হয়তো দেখতে চাইছে না।
- সে তো তুই-ও এখন তুমি তুমি ছাড়া কথা বলিস না!
সুদামা একটু চুপ করে যায়। তার চোখদুটো একটু তাড়াতাড়িই পিটপিট করতে থাকে। যখন সুদামা একাগ্র হয়ে কিছু ভাবে তখন তার চোখ তাড়াতাড়ি পাতা ফ্যালে। সুদামা চারপাশ দেখে নেয়। তারপরে কিছুটা চাপা স্বরে বলে,
- দ্যাখো ভাই, তোমরা দু-ভাই এখন অনেক অন্যরকম ব্যাপার। তুমি এখন আর আমাদের গাঁয়ের কিষণ নও, আর দাদা এখন আর বলুয়া নয়।
- তাহলে কী আমরা?
হালকা হাসে সুদামা। বলে,
- তোমরা দুজন আমাদের বড় গর্বের কৃষ্ণ-বলরাম এখন। যাদবদের মুকুটমণি।
- হুঁ!
কৃষ্ণ বোঝে এই ‘মুকুটমণি’ বিশেষণটা মথুরায় থাকাকালীন বারেবারে শুনে শুনে সুদামার কানে লেগে গেছে। তারই ব্যবহার করলো এখন। সে-ও হাসলো এবারে। বললো,
- তা হলে তুই যখন আমাকে আর তুই বলতে পারিস না মুকুটের মণি বলে, তখন আমিই বা কি করে দাদাকে এখন শুধু দাদা বলি! ও তো প্রাকৃতের ব্যবহার হয়ে যাচ্ছে তাই না? ভ্রাতা বলা অভ্যাস না করলে জায়গা মতন বলতে পারবো না যে!
- গুরুদেব অবশ্য এমন সব কথাই বলছিলেন সেদিন তোমাকে। সবই অভ্যাসের বিষয়। অভ্যাস করলে বিনা জলেও মাছ বাঁচবে কিছুক্ষণ।
- তা বাঁচবে কিনা জানিনা! মানে দেখিনি কখনো। কিন্তু অভ্যাস না করলে আমাদের মথুরা ত্যাগ করে এখানে আসা এবং আমাদের উপর যদু বংশের সমস্ত ভরসার মর্যাদা দেওয়া হবে না।
- ঠিক ঠিক।
কথা বলতে বলতে তারা হাঁটার গতি দ্রুত করে। কৃষ্ণই আগে আগে পা চালায়। বলদেবকে পাওয়া যখন যাচ্ছেই না তখন আর সুদামার সঙ্গেও আলাদা করে কথা বলে লাভ নেই। সেই কথা বলবে যা বলার। তারপরে দুজনকেই না হয় বুঝিয়ে দেবে সময় মতন। বলদেব কিম্বা সুদামা কেউ-ই তার কথা ফেলে দেবে না এ তার জানা আছে। তারা হাঁটতে থাকে। আশ্রমের যত কাছাকাছি আসছে ততই জোরদার হচ্ছে মন্ত্রোচ্চারণের শব্দ। অরণ্যের এই এক মহিমা। যত দূরের শব্দও স্পষ্ট শোনা যায় তা গ্রামে বা নগরে থাকলে সম্ভব না।
ঠিক একই সময়ে তাদের নিয়েই কথা হচ্ছিল ঋষি গর্গ এবং সন্দীপন মুনির মধ্যে। গর্গ এদের পাঠাভ্যাসের সংবাদ নিচ্ছিলেন। বলদেব বা সুদামা ততটা মনোযোগী নয়, এই আক্ষেপ সন্দীপনের। শুনে তিনি স্মিত হাসলেন। এ তাঁর জানাই আছে। তিনি মৃদু কন্ঠে বললেন,
- মুনে, একই জাতীর প্রতিটি তৈলবীজ একই মানের তৈল উৎপাদন করে না। পিষ্ট তারা একই কলে হতেই পারে, কিন্তু মান আলাদা আলাদাই হবে। আবার দেখুন রেড়ির তেলের বীজ অথবা সরিষার তেলের বীজ আলাদা আলাদা তেলই তবু তৈরি করে। অর্থাৎ রেড়ির বীজের যতই পার্থক্য থাক, তারা শেষত রেড়ির তেলই বানাবে। সরষেও তাই। উল্টোটা হবে না।
- কথাটা সত্যি মহর্ষি।
- এরাও পৃথক হয়েই উঠবে। কিন্তু ছাঁচ যদি একই বীজের হয় তাহলে গুণমানের কিঞ্চিত তারতম্যে কৃষ্ণ-বলরাম যা হবে তা সুদামা কখনোই হবে না। এ কথাও নিশ্চিত।
তিনটি কিশোর, একই গ্রামের ছেলে। প্রায় সমবয়স্কও বটে। কিন্তু তিনটে জীবন পৃথক হবে। শিক্ষালয়ের ছাঁচে পড়ে দুটি কাছাকাছি থাকবে, আরেকটির সঙ্গে তাদের দূরত্ব খুব কমবে না। এ কি শিক্ষা ব্যবস্থার সমস্যা? নাকি কিশোরদের যে বংশে জন্ম তার শিক্ষা-দীক্ষার সুবিধা-অসুবিধে? নাকি আদতে শাসনই শিক্ষাকে সেই ছাঁচটাই বানাতে সাহায্য করছে যা খুব বেশি গভীরে যেতে অসমর্থ? এই দুই প্রাজ্ঞ ঋষি মেনে নিয়েছেন একে সত্য বলে যে দুটি বীজ পৃথক বলে দু-তরফের শিক্ষাও পৃথক হবে। শিক্ষা পৃথক হলে সমাজে তাদের অবস্থানও পৃথক হবে।
কিন্তু পাঞ্চালের আর এক গুরু কৃপবর্মার ভগিনীপতি নিজে কিন্তু তা মানেননি। তাই তাঁর সঙ্গে বিরোধ হয়েছে পাঞ্চালের রাজার। সেই বিরোধ তাঁর জীবনের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে এখন। তিনি অসম অবস্থাকে অতিক্রম করে পাঞ্চালের রাজার সমতায় পৌঁছে দেখাতে চান এ সত্য না। তাই তাঁর কাছে যখন গাঙ্গেয়র দূত পৌঁছল তখন কালবিলম্ব না করেই তিনি রওনা দিলেন হস্তিনাপুরের পথে। পাঞ্চালে তিনি গুরু-ও নন এখন, আর হস্তিনাপুরে তাঁর করায়ত্ত্ব হতে পারে সব। গো শকটে সমস্ত তল্পিতল্পা তুলে দিয়ে, নিজে চললেন পায়ে হেঁটে। অন্তত পাঞ্চাল দেশ তিনি হেঁটেই পেরোবেন। এ তাঁর জন্মভূমি। আজ যাচ্ছেন, কবে ফিরবেন তা তাঁর জানা নেই। হাতে একমুঠো ধুলো নিয়েছেন নিজের পৈতৃক ভিটের। কপালে ঠেকিয়ে বলেছেন,
- যদি আমার তূণে আমি প্রকৃত শিক্ষা ভরে থাকি, তাহলে একদিন এই ভিটে ত্যাগের কারণ যে, সে উপযুক্ত শিক্ষা পাবেই পাবে। হে পিতৃপুরুষগণ, অধম দ্রোণকে এই আশীর্বাদ করুন সে যেন জীবন থাকতে তার ব্রতচ্যুত না হয়।