গাছটায় ফুল ধরবে এবার। ডালগুলোতে কেমন একটা শুকনো ভাব এসেছে। এরপরেই একেবারে লাফিয়ে জীবন্ত হয়ে দাঁড়াবে থোকা থোকা লাল ফুল নিয়ে। বছরের পর বছর দেখেই চলেছেন গাঙ্গেয়। সকাল বেলায় শস্ত্রাভ্যাস সেরে বসেন এসে এই গাছগুলোর কাছে। মৃদু মৃদু হাওয়া আসে প্রায় সারাবছর যমুনার তীর থেকে। কখনো কখনো খুব গরমে বা ঝড়ের দিনে বন্ধ হয়ে যায় হাওয়া। কিন্তু সে সব দিন খুব কম। এই অঞ্চলের জলবায়ু বেশ চরমপন্থী। শীতের দিকে যাচ্ছে এখন সময়। এখনই সকালে বেশ ঠান্ডা জমে আসে। তেল মাখা গায়ে কিছক্ষণ বসে থাকার পরে তাঁরও মনে হয় একটু শীত করছে বোধ হয়। নিজের মনেই হাসেন দেবব্রত। কম বয়সে যখন শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা হবার লোভ মনকে আচ্ছন্ন করে রাখতো তখন নিয়ম করে বছরে অন্তত চারমাস চলে যেতেন হৃষিকেশে। প্রতিদিন সূর্য বন্দনা করে স্নান করতেন ওই তীব্র স্রোতস্বিনী বরফ গলা জলের ধারায়। শরীরকে বশ না করতে পারলে কিছুতেই শ্রেষ্ঠ হওয়া যায় না।
হৃষিকেশ তাঁর মাতৃসন্দর্শনের স্থান। হিমাচলবাসিনী গঙ্গা তাঁর মাতা। নদীর নামে নাম। আসলে এটি তাঁদের বংশনাম। গঙ্গা পূজক তাঁরা মাতুলকূলে। তিনি শুনেছেন পিতা শান্তনু তাঁর পূর্ববর্তী সপ্ত ভ্রাতার কাউকেই এ রাজ্যে আনতে পারেননি। তাঁদের মাতুলকূলে সন্তান মাতৃবশবর্তী হবে এটাই প্রথা। সম্পত্তির মালিকও কন্যা। সেই কারণে পিতাকে বিবাহের আগে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ করা হয়েছিল যে যেই মুহূর্তে এই প্রথার বিরুদ্ধতা করবেন সেই মুহূর্তে এই বিবাহ বন্ধন ছিন্ন হবে। এমনিতে এই বংশের কন্যার বিবাহ সমতলের লোকের সঙ্গে দেবার রীতি নেই। মাতার আগ্রহাতিশয্যে সেই প্রথাকে রদ করা হয়েছিল পিতার ক্ষেত্রে। কিন্তু বছরের পর বছর রাজ্য ছেড়ে পিতার পক্ষে থাকা সম্ভব ছিল না বলে মাতা পিতার সঙ্গে এসেছিলেন এই রাজ্যে। শুধু সন্তানের জন্মের পরে উত্তর গঙ্গা অববাহিকার ওই রাজ্য থেকে দূত আসত তাঁদের নিয়ে যেতে। পিতা তাঁর বেলাতেই বিরোধ করেছিলেন শেষে। রাজত্ব এবং বংশ রক্ষার জন্য তাঁরও পুত্র চাই। একদিকে মাতা অন্যদিকে পুত্র। জয়ী হয়েছিল অপত্য স্নেহ, জয়ী হয়েছিল শাসনের দাবী। মাতা গঙ্গা ফিরে গিয়েছিলেন মাতুলালয়ে। কিন্তু লাভ কি হল? পিতা কিছুকাল প্রবল স্নেহের সঙ্গে তাঁকে গড়ে তুলতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু ওই কিছুকালই। এক সময়ে তাঁর রাজঅন্তঃপুর শূন্য লাগতে শুরু করলো। আবার নিয়ম করে বেরোতে লাগলেন মৃগয়ায়। এই ভাবেই একদিন ঘরে এলেন সত্যবতী।
লোকে বলে জিতেন্দ্রিয় তিনি। লোকে বলে পিতার জন্য বিপুল স্বার্থত্যাগ করে যে দৃষ্টান্ত তিনি রেখেছেন তাতে তাঁর খ্যাতি থাকবে প্রলয়ের শেষ দিন অবধি। তাঁর আসন বাঁধা থাকবে স্বর্গে। কিন্তু তাঁর অন্তর কি বলে? কেউ জানে না। কর্তব্য আর কর্ম-এই দুই বাঁধনে নিজেকে এমন করে বেঁধেছেন যে লোক তো দূরস্থান নিজেরও শোনার যো নেই নিজের কথা। সারাদিন রাজ্যের নানান কাজে ব্যাস্ত থাকেন। ব্রাহ্মমুহূর্তে শয্যা ত্যাগ করেন। তারপরে পূজা-শরীরচর্চা সেরে দরবারের কাজে যাওয়া। সে কাজ শেষ হলে দ্বিপ্রহরে আহার। আবার ফিরে যাওয়া দরবারে। সন্ধ্যাকালে আহ্নিকাদি সমাপ্তিতে তিনি বসেন পাঠে। দেশ-বিদেশের রীতি-নীতি ধর্মতত্ত্ব, কূটনীতি-অর্থনীতি অধ্যয়ণ করেন। রাজধর্ম কি তা তাঁর মত করে কেউ জানে না এই দোয়াবে। বলা হয় ভারতবর্ষের সকল জনপদে তিনি এ বিষয়ে শ্রেষ্ঠ। তাই বহু সময় সন্ধ্যায় নানান প্রান্ত থেকে আগত কুতুহলীদের সঙ্গেও কাটাতে হয় তাঁকে। রাজ শাসনের সমস্যা সমাধানে তাঁর সাহায্য নিয়ে থাকেন রাজা বা গণ শাসিত অঞ্চলের লোকেরাও। দুই ব্যবস্থা সম্পর্কে তাঁর অগাধ জ্ঞান। সন্ধ্যা শেষ হলে কিঞ্চিত আহার করেন। তিনি স্বল্পাহারি। মাংস, মৎস্য, মদ্য কদাচিত ভক্ষ তাঁর। দেবব্রতর আরেকটি শখ সঙ্গীত। আহারের পর কিছুকাল সঙ্গীতচর্চা করেন। এককালে নৃত্যাদিতেও আসক্তি ছিল। কিন্তু সেই নৃত্যের আসরে নারীর প্রবেশাধিকার নেই। সে আসর হত শুধুমাত্র যোদ্ধা পুরুষের। বিশেষ ভোজসভা হত। সেই সভার আগে হত এই নৃত্যের অনুষ্ঠান। ভাল ধানুকি, গদাযোদ্ধা বা অস্ত্রবিদ হতে গেলে পদসঞ্চারণ খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সেই কাজেই নৃত্যশিক্ষা করতে হয়েছিল তাঁকে। সেই নৃত্যাদি মূলত চর্চা করে এই দেশের আদিম জনগোষ্ঠীরা। সংস্কৃতভাষী আচার্য্যরা এঁদের থেকেই শিখেছেন এই নৃত্য। সেই ধারাকে কাজে লাগিয়েছেন শস্ত্র শিক্ষার। সেই নৃত্যে তাঁর আগ্রহ ছিল। বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পুরুষ নৃত্যশিল্পীরা পরিবেশন করতেন তাঁদের কুশলতা।
এখন আর সে সব হয় না। রাজ্যের নানান কাজে ইদানীং সময় খুব কমে গ্যাছে। রাত্রের আহারের পর বেশী সময়টাই নিয়ে নেয় গুপ্তপুরুষেরা। দেশের ভিতরে বাইরে কি ঘটছে তার গোপন সংবাদ নিয়ে আসে তারা। হস্তিনাপুরের রাজ সিংহাসন নিয়ে সংকট কিছু কিছু সময়ের পরে পরেই তাঁকে ব্যাস্ত করে তোলে এই কাজে। এই দোয়াবের রাজ্যটির গুরুত্ব বেশী ভারতের অন্যান্য রাজ্যগুলোর চেয়ে। এর সমকক্ষ একমাত্র বলা যেতে পারত অযোধ্যাকে। কিন্তু সেই রামও নেই সে অযোধ্যাও আজ আর নেই। দোয়াবের দুই প্রান্তের এই দুই রাজ্যের ক্ষেত্রেই দেখা গ্যাছে রাজ শাসন এসেছে অনেক আগেই। কাশী, কোশল, বৃজি-তে যখন গণের শাসন, মথুরা কিম্বা ভোজে যখন গণের প্রতিনিধি হিসেবে রাজ শাসন তখনই এই দুই অঞ্চলে চলেছে একচ্ছত্র রাজাধিপত্য। গণ অযোধ্যাতে অনেক আগেই গিয়েছে, এখানেও ক্রমশ সে প্রায় অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পরেছিল। পুরুর বংশধারাকে প্রশ্ন করার মত অবস্থান হতেই পারত না যদি না তাঁর পিতা শান্তনুর আমল থেকেই এই রাজ অধিকার নিয়ে সমস্যা শুরু না হত। কিন্তু আজ সে পরিস্থিতিও এসে হাজির প্রায়। সুধন্য, এই হস্তিনাপুরের প্রধান বণিক। এ দেশ ছাড়াও তার বাসস্থান রয়েছে কাশী, কোশল এবং মগধে। রাজা জরাসন্ধের অমাত্য সভায় রয়েছে তার ঠাঁই। জরাসন্ধ জানেন তাঁর রাজচক্রবর্তী হবার বাসনার একমাত্র অন্তরায় আজ হস্তিনাপুর। সরাসরি যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে তিনি চাইছেন না, কারণ দেবব্রত এখনো জীবিত এবং সক্ষম। তাই ছায়াযুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন ক্রমাগত। হস্তিনাপুরে তাঁর প্রধান কুশীলব ওই সুধন্য। সকলেই জানেন, কিন্তু এর সুনির্দিষ্ট কোনো প্রমাণ নেই। তাছাড়া দেশে এমন কোনো আইন নেই যার দ্বারা সুধন্যর অন্য রাজ্যের রাজার মিত্র হওয়া আটকানো যায়।
বণিকরা আজকের দিনে বেশ গুরুত্বপূর্ণ অংশ। রাজার শাসনকার্যে এরা বড় সহায়ক। এর অনেকগুলো কারণ আছে। প্রতিটি কারণই জড়িত অর্থনৈতিক এবং সমরনৈতিক বিষয়ের সঙ্গে। রাজার প্রধান আয় কৃষি থেকে। কিন্তু কৃষির ফলন নির্ভরশীল আবহাওয়ার উপরে। সেচের কাজ বাড়ানো গেলে সম্ভব কিছুটা ফলন বাড়ানো। কিন্তু সে করা খুব সহজ নয়। প্রধান প্রধান নদীগুলো থেকে সেক্ষেত্রে খাল খনন করতে হবে। সেই খাল খননের কাজে লাগবে শ্রম। সেই শ্রম গণের শাসনে স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে অনেকাংশে সম্ভব হলেও রাজ শাসনে তা হয় না। এর কারণ মূলত এখনো অধিবাসীরা রাজাকে স্বাভাবিক ভাবে মেনে নিতে সক্ষম হয়নি। যদিও সূর্য বা চন্দ্র ইত্যাদি বংশের নামে রাজবংশগুলোর পরিচয় হয়েছে, তাঁদের প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে রাজ প্রতিপালিত ব্রাহ্মণেরা নানান আখ্যান নির্মাণ করে প্রমাণ করতে সচেষ্ট হয়েছেন যে রাজা দেব সম্ভূত তবুও লোক সমাজ এতেই সন্তুষ্ট নয়। এটা খুব বোঝা যায় খরা বা বন্যার সময়, বোঝা যায় আকালে, মন্বন্তরে। তাই স্বেচ্ছাশ্রম মাত্রা ছাড়ালে অনিবার্য্য বিদ্রোহ। এই ক্ষেত্রে হস্তিনাপুর কিছুটা সুবিধা ভোগ করে দোয়াবের বাকী রাজ্যগুলোর মতই। কারণ এখানে নদীর ধারেই বেশীরভাগ চাষের জমি। পলিতে সমৃদ্ধ হয় তারা বন্যায়। কিন্তু যে বছর বন্যা হয় সে বছর চাষ থাকেনা। বেশীরভাগ জমিই এক ফসলি। সেই ফসলের উপর নির্ভর করে রাজস্ব। রাজস্বে টান পরলে দুটো রাস্তা খোলা থাকে। হয় যুদ্ধের জন্য ঋণ না হয় শুধু ঋণ। দুটোতেই লাগে বণিকের সাহায্য। আজকাল এমনকি ব্রাহ্মণেরাও যজ্ঞের প্রণামি মুদ্রায় লাভ করলেই খুশী বেশী হয়ে থাকেন। কিন্তু তাঁরা ধনের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ক্রমশ পিছিয়ে পড়েছেন বণিকদের থেকে। রাজা বা ধনাঢ্য সমাজের অনুগ্রহেই তাঁদের ধনলাভ। এককালে তাঁদের যে বিত্ত কার্ত্যবীর্য্য রাজার বংশজদের সঙ্গে ভার্গবদের বিরোধ তৈরী করেছিল আজ আর সেই দিন নেই। সে কালে রাজার প্রাসাদ হত মাটির। আর একালে রাজার প্রাসাদ হয় পাথরের। কেউ কেউ তাতে শ্বেত পাথর বা স্ফটিকও ব্যবহার করেন। যদিও হস্তিনাপুর এখনো বহুলাংশে মাটি এবং কাঠের ব্যবহার বজায় রেখছে তবুও কতদিন এ থাকবে বলা কঠিন। বিলাস বাড়ছে। দেবব্রত ক্রমে ক্রমে দেখেছেন পান্ডু বা ধৃতরাষ্ট্র কেউই বিলাসে কম যাচ্ছেন না। তিনি যে সাধারণ জীবন যাপন করেন তাতে এঁদের আগ্রহ ছিল না। তাই অর্থের প্রয়োজন আরো বেড়েছে। যুগধর্ম এই! একে তিনি চাইলেই অস্বীকার করতে পারেন না। মগধের রাজা জরাসন্ধের সঙ্গে কিছু পাল্লা তো হস্তিনাপুরকে দিতেই হয়। আগের কালের মতন মাটির কেল্লায় থেকে রাজ শাসন করলে প্রজাপুঞ্জই মানবে না। তারা রাজার দারিদ্রকে দুর্বলতা জ্ঞান করবে এবং স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠবে। দেবব্রত দেখছেন গণের শাসনের ক্ষেত্রেও এই হচ্ছে। সেখানে গণের সভাস্থান নির্মিত হচ্ছে বহু ব্যায়ে। যাঁরা গণের সভা-সদস্য তাঁরাও তাঁদের বাসস্থান নির্মাণে ধনের ব্যবহারে কুন্ঠিত হচ্ছেন না। নতুন নীতি হল শাসক যে শাসিতের থেকে আলদা তা আচার-আচরণ-বাসস্থান-সংস্কৃতি সবেতেই প্রমাণ করতেই হবে। নইলে শাসনের দশা হবে কাদায় পরা হাতির মত।
কাজেই ধন চাই রাজকোষে আরো। এই কারণে আজকাল অনেক রাজ্য নতুন পদ্ধতি নিয়েছে। বণিকের বাণিজ্যে অংশগ্রহণ। বণিক মহাসংঘগুলোর সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমেই ঠিক হয় রাজার অংশ কত হবে বাণিজ্যের লাভে এবং সুদ কি হবে! যে বছর ভাল ফসল হয় সে বছরের রাজকোষ থেকে উদ্বৃত্ত অর্থের একাংশ নিযুক্ত হয় এই বহির্বাণিজ্যে। দেশের ভিতরে বাণিজ্য শুল্ক ছাড়াও এই বিনিয়োগ রাজার পক্ষে লাভের রাস্তা। একই ভাবে কারিগর মহাসংঘগুলোর সঙ্গেও রাজার চুক্তি থাকে। কিন্তু লাভ বেশী বণিক সংঘ থেকেই। সুধন্য হস্তিনাপুরের বণিক সংঘপ্রধান। প্রতি বছর রাজকোষে তার জন্যই জমা হয় বেশ কিছু ধন-সম্পদ মুদ্রা আকারে।
এই মুদ্রা আরেক বস্তু। কিছুকাল হল এর চল হয়েছে বাণিজ্যে। এককালের বিনিময়ের মাধ্যমের বাণিজ্য অনেক নিরাপদ হয়েছে এই মুদ্রা ব্যবস্থায়। বিশেষ করে বৈদেশিক বাণিজ্য। পথে দস্যুর হাত থেকে লুকিয়ে এই ধন গোপনে আনয়ন করা সম্ভব। তাছাড়া এই মুদ্রা ব্যবস্থার জন্য আরেকটি পদ্ধতি প্রণয়ন বণিকদের পক্ষে সহজ হয়েছে। সে হল বিনিময়ের প্রতিশ্রুতির মাধ্যম। মুদ্রা আনার ঝুঁকি না নিয়েও অনেকে অর্জিত অর্থের বিনিময়ে নিয়ে আসেন ধাতুর পাত বা চামড়ার পর্চা। সেই পর্চা বা পাত দেশে এসে নির্দিষ্ট ব্যাক্তিকে দেখালেই সেই ব্যাক্তি তার সমতুল্য অর্থ দেবেন ব্যবসায়ীকে। আর এই কাজ করার জন্য তার থেকে নেবেন কিছু অর্থ পারিশ্রমিক হিসেবে। সুধন্য একাজেও এই রাজ্যে প্রথম। এই কার্যের জন্যই তার বিভিন্ন রাজ্যে আবাস। এই যুক্তিকে আজ আর অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু দেবব্রত জানেন এ সব নয়। আসলে ক্রমশ ধনের জোর বেড়ে চলেছে সুধন্যর। সেই ধন দিয়েই সে গড়ে তুলছে তার নিজস্ব জগৎ। খুব ভাল লাগেনা দেবব্রতের। কিন্তু তাঁর করণীয়-ই বা কি! মুদ্রার প্রচলন হয়েছে তাঁর জন্মেরও আগে। প্রতি দেশের সেই মুদ্রামান নির্ধারণের জন্য রাজকোষে থাকা স্বর্ণকেই বেছে নেওয়া হয়েছে। বিগত একশো বছরে মুদ্রা ব্যবস্থা আরো সুস্থিত হয়েছে। আগে যে যেমন খুশী মুদ্রা তৈরী করতে পারত। কিন্তু এখন তা সুনির্দিষ্ট হচ্ছে ক্রমশ। রাজা এবং ধনিক সমাজের একটি স্বল্পাংশ ব্যাতিরেকে বা গণের শাসনে গণের সভা ব্যাতিরেকে যে কেউ মুদ্রা তৈরী করবে তার কঠোর দন্ড হবে। ধনিকদের ক্ষেত্রেও অনুমতি নিতে হবে সংশ্লিষ্ট শাসনের। সুধন্য সেই অনুমতি চেয়েছেন সম্প্রতি। তিনি বিদুরের সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনা করেছেন কিছুকাল। খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ধৃতরাষ্ট্র সুধন্যর বশ। লজ্জার কথা হল তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্ররা সকলেই গুণধর। গান্ধারি যখন গর্ভাবস্থায় তখন এক বৈশ্যাণিকে সুধন্য ধৃতরাষ্ট্রের সেবা করার জন্য আলাদা করে পাঠিয়েছিল। সেই বৈশ্যাণিও অতি সেবাপরায়ণ হয়ে গর্ভিণী হয় ধৃতরাষ্ট্রের দ্বারা। সম্ভবত পান্ডুর কুন্তী ও মাদ্রী দুই বিবাহ, এতে ধৃতরাষ্ট্রের নিজেকে বঞ্চিত মনে হয়েছে। তাই এই কান্ড। যথাকালে সেই বৈশ্যাণির গর্ভে জন্ম নিয়েছে যুযুৎসু নামের পুত্র। সুধন্য সেই যে ধৃতরাষ্ট্রের ঘরে ঢুকেছে আর বেরোয়নি। আজকের এই জটিল সময়ে কুন্তী এবং কুন্তী পুত্রদের নিয়ে যে কোলাহল হস্তিনাপুরে সেই কোলাহলের পিছনেও রয়েছে সুধন্যের হাত। ধৃতরাষ্ট্র বা তার পুত্ররা রাজা হলেই সুধন্যর সুবিধা, সুবিধা জরাসন্ধেরও।
-আর্য্য!
ছেদ পড়লো তাঁর ভাবনায়। তাঁর অঙ্গসংবাহক নিষাদ এসেছে।
-মহারাণী সত্যবতীর দূত এসেছে। মহারাণী আপনাকে একবার স্মরণ করেছেন। রাজসভায় যাবার আগে একবার তাঁর সঙ্গে দেখা করে যেতে অনুরোধ করেছেন
আজ রাজসভা বন্ধ সাধারণের জন্য। তিনি কিছু প্রধান প্রধান ব্যাক্তি এবং অমাত্যকে ডেকে পাঠিয়েছেন কিছু বিষয় আলোচনার জন্য। প্রধান আলোচনা পান্ডুর শেষকৃত্য নিয়েই হবে। বংশধর নির্ণয়ের প্রসঙ্গ তিনি তুলবেন না। ওটা নির্দিষ্ট থাকা ভাল গণের সভার জন্য। এ বিষয়ে তিনি সরাসরি জড়ালে অপক্ষপাতের কথা থাকবেনা। কাজেই মহারাণীর উৎকন্ঠিত হবার কোনো কারণ নেই এমনিতে। তাহলে?
চলবে