ঝুলন্ত লোক
আজকাল ধর্মতলার মোড়ে গেলেই লোকটার সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে বলে ভাবে কৌশিক। ঠিক যখন মোড়টার সিগনালগুলো লাল হয়, যখন রাইটার্সের দিকে কৌশিক যায়, যখন মেট্রোর দিকের পুরোনো বাড়ির কাঠের সিঁড়িগুলো নিঝুম হয়ে থাকে রাত্রের দিকে, ওখান দিয়ে কেউ তখন ওঠেনা বলে, তখন লোকটা বিপজ্জনকভাবে ঝুলতে থাকে। বিধান মার্কেটের ঠিক সামনেটায়। লোকটা একা আসেনা। এলে সঙ্গে করে একটা তামাশা নিয়ে আসে। অনেক লোক ঘিরে থাকে তাকে। বেশ কয়েকটা ঘোড়া থাকে। তাতে লালমুখো সাহেবগুলো। একজন ঘোড়ার উপরে চেপেই চিৎকার করে বলতে থাকে লোকটা ১২টা খুন, ২টো ধর্ষণ এবং ৭টা ডাকাতি করেছে।বাকি দেশীয় লোকগুলো, কৌশিকের মতন চামড়ার রঙ সব, তারা ঠেলাঠেলি করতে থাকে একে অপরকে।
প্রথমদিন
প্রথম দিন কৌশিক ওকে দেখেছিল এমন এক রাতের দিকেই। সবে মদ খেয়ে বেরিয়েছে একটা বার থেকে, লোকটা ওর বাইকের সামনে এসে ঝুলতে থাকলো। কৌশিক, মাথায় হেলমেট নিয়ে প্রথমে বার কয়েক কাঁচ মুছেছিলো। বৃষ্টির রাত ছিল। ভেবেছিল ভুল দেখছে সে। তারপরে মনে পড়লো সেও শুনেছে এসপ্ল্যানেড অঞ্চলে কিছু কিছু ভূত আছে। তবে সাধারণত তারা থাকে পুরোনো সাহেবি বাড়িগুলোতে। সে যাই হোক, এ যেভাবে শূন্যে ঝুলছে তাতে ভূত না হয়ে যায়না। কৌশিক অফিস থেকে বেরিয়েছিল মাল খাবে বলে। সেখানে মাল খেয়ে-টেয়ে সদ্য ঠিক করেছে সে আর কোনো বাওয়ালে যাবে না। একে দেখে তার প্রথমে ইচ্ছে হয়েছিল এর মধ্যে দিয়েই বাইকটা চালিয়ে দেয়, তারপরে বাওয়াল করবে না বলে থামলো। বাইকটা দাঁড় করিয়ে লোকটার দিকে তাকালো।
সেদিন বাওয়াল
সন্ধেবেলাতেই সে তার এক কলিগকে থ্রেট করেছিল। বিষয়টা ছিল একটি মেয়েকে নিয়ে। মেয়েটি কিছুদিন হল জয়েন করেছে মার্কেটিং-এ। গোটাটাই ঢপের বিষয়। তার কোম্পানিটাই আসলে একটা ঢপের কোম্পানি। নাম কে সি অ্যান্ড সন্স লিমিটেড কোম্পানি। কাজের মধ্যে সবই পড়ে, আবার কিছুই আসলে পড়েনা। তারা রেসর্ট থেকে ফার্ম সবেতেই আছে। সম্প্রতি একটি খবরের কাগজ এবং একটি কেবল টেলি চ্যানেলও করেছে। কৌশিক নিজে এখানে আছে আই টি হেড হিসেবে। যোগ্যতা? কিছুই না। তার শ্বশুর তাকে কাজটা পাইয়ে দিয়েছে। সেখানেই সমস্যা হয়েছে তার। দিল্লীর কোম্পানির কাজটা ছেড়ে আসার পর থেকে এখানে এসে আসলে তার কিছুই কাজ নেই। সারাদিন বসে বসে কিছু হিসেব-নিকেশ করা, ইদানীং আবার কিছু মেল ড্রাফট করা ছাড়া তার আর কোনো কাজ নেই। অথচ সে নামে আই টি হেড। তাকে তার শ্বশুর বলেছিল কোম্পানিতে অনেক চুরি-চামারি, দুর্নীতি ইত্যাদি হচ্ছে, সেগুলো ঠেকানো তার কাজ। সেই অনুযায়ী সে এসে যখন সেখানে জয়েন করে তখন বেশ কিছু কাজ করতে চেষ্টা করে। কোনোটাই হয় না। উল্টে যেটা হয় সেটা হল তার কাজের ক্ষেত্রে একধরণের ডিমোশনই হয়েছে। দিল্লীতে তাকে মাইনে কম দিত, কিন্তু স্টেনোগ্রাফার বানিয়ে দেয়নি এই ভাবে।
মেজাজ ও মেয়েছেলে
আজকে তার মেজাজটা এই একটা লেটার ড্রাফটিং নিয়েই চড়েছিল। আজ নিয়ে চতুর্থ দিন তাকে তার কোম্পানির এম ডি ডেকে পাঠিয়েছে লেটার ড্রাফট করার জন্য। মেজাজটা তেতো হয়েইছিল। মেলটা করে সে একটা সিগারেট খাবার জন্য অফিসের বাইরে আসে। ঠিক সেই সময়েই মেয়েটা এসে তাকে ধরে। আচমকাই ধরেছিল তাকে। সাধারণত সে মেয়েদের সঙ্গে খুব একটা স্বচ্ছন্দ না। নিজের বৌ ছাড়া সে অন্যদের নিয়ে মাথাও ঘামায়না। বৌ-কে নিয়ে আলাদা করে মাথা ঘামানোর কারণ হল তার আদুরেপনা এবং ঘ্যানঘ্যানে চরিত্র। তার বাবার পয়সা আছে সেটাই তার এ সমস্ত কাজের উৎস। সারাদিনে অফিসে ক্রমাগত ফোন করে চলা, বাড়িতে প্রায় প্রতি কথায় মায়ের সঙ্গে সমস্যা ক্রিয়েট করে রাখা এছাড়া কাজ নেই তার স্ত্রী-র। এমনকি ছেলেকে খাওয়াতেও তার অনীহা। সে পারেনা নাকি! ছেলের বয়স এখন দুই। দিদিমা এবং ঠাকুমার কাছেই বড় হয়ে গেল সে।
এবারে মেয়েটি তাকে ধরায় সে কিছুটা তোতো আমতা আমতা করে কথা শুরু করে। মেয়েটির সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে তার একটু অস্বস্তিও হচ্ছিল। মেয়েটির বুকের কাছটা বেশ কিছুটা কাটা। অনেকটা বুক দেখা যায় ঝুঁকে থাকলে। মেয়েটা প্রথমে তার কাছে এসে আগুন চায়। তারপরে সিগারেট ধরিয়ে একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে সটান তাকিয়ে বলে,
- আপনাকে ঠিক কতটা বিশ্বাস করা যায়?
এ সব জটিল প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলে কৌশিক তো প্রেম করেই বিয়ে করতো, তাকে সম্বন্ধ করে বিয়ে করতে হতই না। সে চোখ নামিয়ে বলে,
-আমি ঠিক বুঝলাম না।
-সোজা প্রশ্ন এটা! এর মানে হচ্ছে আপনাকে আমি যদি কিছু বলি তাহলে সেটা আপনি আপনার পেটের মধ্যে রাখতে পারবেন কিনা! নাকি চারপাশে ফেচকে বেড়াবেন?
-হঠাৎ এত লোক থাকতে আমি কেন?
-কারণ বাকিরা কথা বলার সময়ে কেউ আমার চোখের দিকে তাকায় না, বুকের দিকে তাকিয়ে থাকে।
কৌশিক আরো অস্বস্তিতে পড়ে যায়। চোখটা সরিয়ে নেয় মেয়েটার চোখ থেকে।
-কী বলবার আছে বলে ফেলুন, আমাকে কাজে বসতে হবে!
-কাজ? ও যা আছে তাতে আপনার এত কাজ দেখানোর দরকার নেই। আমারও এই অফিসে অন্তত আটদিন হয়ে গেল।
কৌশিকের মাথাটা জ্বলে ওঠে মেয়েটার কথা বলার ভঙ্গিমায়। একে তো গায়ে পড়ে কথা বলছে তায় আবার এই সব কথা। সে একটা কড়া উত্তর দেবে মনস্থ করে। মেয়েছেলেদের এত স্পর্ধা তার সহ্য হয় না। কিন্তু তবুও সহ্য করতে হয়। বাড়িতে বৌ-এর, এখানে এখন এর! শালা, বালের জীবন পুরো। মেয়েটার মোবাইল বেজে ওঠে। কলার টিউনে গানটা হল, হ্যায় তুঝে ভি ইজাজৎ...! ওটা মিসকল ছিল।
কর লে তু ভি মোহাব্বত
মেয়েটাকে উত্তর দেবার আগেই মেয়েটা ঘুরে চলে যায়। সে খানিক বোকার মতন দাঁড়িয়ে থাকে। যেন কিছুই হয়নি এমন ভান করে মেয়েটা অফিসের দরজা ঠেলে ঢুকে যায়। কৌশিক খানিক দাঁড়িয়ে থেকে তারপরে অফিসে ঢোকে। অফিসে ঢুকতেই তার চোখ যায় মেয়েটির দিকে। একটি কিউবিকলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। হাত থেকে ফোনটা নামানো। আলো এসে পড়ছে বাইরের জানলা থেকে মেয়েটার মুখে। নরম একটা কমলা আলো। বিকেলের দিকে যাচ্ছে সূর্যটা। মেয়েটা ঠোঁট কামড়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। কিছু ভাবছে যেন! কৌশিক যেতে যেতেই আড়চোখে দেখছিল। কিন্তু তার যাওয়া হয় না। তার পথ আটকে দাঁড়িয়ে আছে সৌমিত্র রায়। একের নম্বরের হারামি মাল। একসময়ে কোন কাগজে ছিল। তারপর বিভিন্ন ঘাটের জল খেয়ে এখানে। নামেই মার্কেটিং হেড, কিন্তু কিছুই করার মুরোদ নেই। প্রত্যেকবার মাইনে তৈরি করার সময়ে কৌশিক দেখে এই মালটা তার অধস্তনদের থেকে বেশ কিছু কমিশন পাচ্ছে। অথচ অধস্তনরা সকলেই নাকি ইনকম্পিটেন্ট। তাই তাদের কাউকেই পার্মানেন্ট করেনা সৌমিত্র। দুই তিন বা চার মাস পরে একটা জোর বাওয়াল হয়, আর সেই ছেলেটির চাকরি যায়। এর আগে দুটি মেয়ে এসেছিল। তারা দুদিন কাজ করেই হাওয়া হয়ে গিয়েছিল। এমনকি একজন মাইনেও নেয়নি বা নিতে আসেনি। অফিসের গল্প হল সৌমিত্র তাদের শুতে বলেছিল তার সঙ্গে। এবারের মেয়েটি সেই হিসেবে ছ’দিন বেশি আছে। গল্পটা এখন হচ্ছে অফিসে যে সৌমিত্র তাকে শোয়াতে পেরেছে শেষপর্যন্ত। তাই এ আছে। সৌমিত্র তার সামনে দাঁড়িয়ে। মুখে হালকা একটা সার্কাস্টিক হাসি। কৌশিক লোকটাকে একদম পছন্দ করে না। একদিন যদি সুযোগ পায় তাহলে এটাকে লাথি মারতে সে ত্রিশ সেকেন্ডও সময় নেবে না।
দাঁত এবং হাসি এবং জিঘাংসা
- অফিসে একটা মেয়ে না থাকলে ভাল লাগে বলুন?
কথাটা বলে সৌমিত্র তার দিকে চেয়ে ইঙ্গিতপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। ঠোঁটের কোণে ঝুলছে নোংরা ঝুল মাখা একটা হাসি। একটা মাকড়সার জাল যেন আটকে রেখেছে মাছিকে। মাছিটা বিপজ্জনক দুলছে।
- আমাকে বলছেন?
কৌশিক একটু থেমে বলে।
- চারপাশে এখন কেউ নেই যে আর!
কৌশিক একবার সৌমিত্রের দিকে চেয়ে তাকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে যায়। সৌমিত্র তার হাত ধরে।
- আরে ইয়ার, Why are you so agitated all the time?
- Sorry! What’s your point exactly?
- Nothing dude! Nothing…
কৌশিক চলে যাবার জন্য পা বাড়ায়। তারপরে ঝোঁকের মাথায় থামে আবার। বলে,
- আমরা just colleague, OK? Just-! এই সব আলোচনা আমার সঙ্গে আর কখনো করবেন না।
বলে যেতে যায় সে। সৌমিত্র থামায়।
- অফিসে জামাই হলে কত সমস্যা না? মেয়েদের পাছাও আড়চোখে দেখতে হয়।
চিড়বিড় করে জ্বলে কৌশিক। সকলেই একটু দূরত্ব রাখে তার থেকে। সে জামাই হিসেবেই পরিচিত এখানে। পিছনে তাকে সকলেই জামাই বলে। এটার মধ্যে একটা অন্য গন্ধ আছে। সে যে নিজের যোগ্যতায় পায়নি এটা সকলেই দেখায় পরস্পরকে। তাকেও বোধহয়। তার গায়ে লাগে। বৌ-এর জন্য এখানে আসতে হয়েছে তাকে। নইলে তার নিজের ইচ্ছে ছিল না তত। সে কখনো শ্বশুরকে বলেনি মাছের ভেড়িটায় আমাকে নিন বা আপনার অন্য ব্যবসায় জায়গা দিন। শ্বশুর তাকে এইভাবে মামাশ্বশুরের ব্যবসায় আনবে তাও ভাবেনি। তার এখন গায়ে জ্বালা হয়।
- It’s none of your fucking business, you bastard! অফিসের মধ্যে এটা বললে বলে, নইলে গাঁড় মেরে দিতাম।
কৌশিকের চেহারাটা বেশ ভাল। সহজে তাকে ঘাঁটানোর কথা কেউই ভাববে না।
- আর হ্যাঁ, আমি যার জামাই তার আবার ভেড়ীও আছে মাছের, জানো তো? মেরে পুঁতে দিলে কলকাতায় কেউ টেরও পাবেনা।
হেঁটে চলে যায় কৌশিক। একটু হালকা লাগছে তার।
শ্বশুর,জামাই,ব্যবসা
তার কিছুক্ষণ পরেই তার শ্বশুরের ফোন এসেছিল। আসতোই।
সৌমিত্র, এম ডি-র লোক। এম ডি অফিসে ডিরেক্টরদের লোক আছে এটা পছন্দ করেনা। নিজেও স্বস্তিতে থাকেনা। প্রচুর গরমিল থাকে হিসেবে তাদের। সময় মতো কোনো ডাটা এক্সেল শিট-এ ওঠেনা। ভাউচারে সই হয়ে যায় কিন্তু সেই ভাউচার হারিয়ে যায় আবার। অডিট এসে ধরলে বলে আসলে খুচরো মাছ বিক্রি করে যে টাকা হয় তার বিল আর কে দেবে! অথচ কোটি কোটি টাকা মাছের বিক্রিতে নাকি আসে। এমন সব গল্পের মধ্যে বেশ কিছু টাকা চলে যায় এম ডি-র পকেটে। তার লোকদের খেয়ে-খাইয়েও তার ভালই থাকে। কিছু করার নেই। কোম্পানিটাই জালি। ব্রিটিশ একটা কোম্পানির এক বড় মাথা আছে এই কোম্পানির বোর্ডে। তার মামাশ্বশুর আছেন ব্রিটিশ কোম্পানিটিতে। তারা কেউ কারোর সঙ্গে এমনিতে ব্যবসা করেনা, অথচ দুই কোম্পানির দুই বড় মাথা পরস্পরের কোম্পানির বোর্ডে আছে। কি হয়? দুজনে দুজনের জন্য ঘুরিয়ে টাকা কামায়। এখানকার বাজারে সরকার চাষের জন্য যে মাল কেনে, যেমন বীজ,সার ইত্যাদি, সেই মাল কেনা প্রভাবিত করে মামাশ্বশুর। মন্ত্রী-সান্ত্রী নেতাদের সঙ্গে তার ভালই যোগাযোগ। আবার ওখান থেকে সমাজসেবার জন্য ফান্ড আসে মামাশ্বশুরের এন জি ও-তে। কোটি কোটি টাকা আসে। মাঝে মাঝে পাঁচড়া, তালদি, ধুবুলিয়াতে পোলিও শিবির, এইডস সচেতনতা, হুইলচেয়ার দানের আসর বসে। ব্যাস্! দুপক্ষই আরামে আছে। এম ডি এসব সামলায়। তাই তাকে সরায় না মামাশ্বশুর। ইদানীং হাতের বাইরে যেতে পারে বলে কৌশিককে বসিয়ে রেখে চাপ সৃষ্টি করে রাখা হয়েছে। তাছাড়া এম ডি-র যে পার্সোনাল সেক্রেটারি, কৌশিকের বৌ বলেছে সেটাও মামাশ্বশুরের ফিট করে দেওয়া। এম ডি তাকে নিয়ে এখানে ওখানে লীলা করে, সে সব রেকর্ড করা থাকে। এম ডি আবার এই বোর্ডের একজন ডিরেক্টরের জামাই এবং বর। মানে তার শ্বশুর এবং বৌ দুজনেই আছে বোর্ডে। লে ক্যাচাল!
শ্বশুর ফোন করে শুধু তাকে বলেছিল অফিসটা কাজের জায়গা, মাস্তানির না। ভেড়িতে মাস্তানি লাগে, সেখানে গেলে তার নাকি বিচি টাকে উঠে যাবে। সত্যিই, শ্বশুর তাকে প্রথমবার বিচি কথাটা বলে। এর আগে যতবার সে জামাই ষষ্ঠিতে গ্যাছে ততবারই তাকে লুচি খাইয়েছিলো।
ঝুলতে ঝুলতে লাইব্রেরী
কৌশিক ঠিক করে সে আর বাওয়ালে যাবে না। কারণ বাড়ি গেলে তার আবার বৌ এর সঙ্গে লাগবেই আজ। সে লাগবে না কিছুতেই। তাই সে মাল খেয়ে মাথা ঠান্ডা করে যাচ্ছিল এসপ্ল্যানেড থেকে। গা হাত পা ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল তার কিছুক্ষণ আগেই। তখনই লোকটা ঝুলতে ঝুলতে তার সামনে এসে পড়েছিল। সে লোকটার মধ্যে দিয়েই বাইকটা চালিয়ে দেবে ঠিক করে। তারপরে ভাবে সে বাওয়াল করবে না। তাই সে বাইকটাকে বিধানমার্কেটের শহীদমিনারের দিকের ঠিক সামনেটায় পাশ করে রেখে দেয়। লোকটা ঝুলতে ঝুলতে তাকে দেখে কিছুক্ষণ। তারপরে নেমে আসে। তার সামনে এসে একটা সিগারেট চায়। সে কিছুটা নির্লিপ্ত হয়েই সিগারেট দেয় তাকে একটা। নিজেও একটা ধরায়।
- ওরা আমাকে যে ভাবে ফাঁসি দেবার ব্যবস্থা করছে সেটাকে বলে শর্টড্রপ।
কৌশিক দেখে একটা গরুর গাড়ি এসেছে। সেটাকে বিধান মার্কেটের দিকের একটা গাছের নিচে দাঁড় করানো হচ্ছে।
- ওটাতে আমাকে ঝোলানো হবে। নিচের গরুর গাড়িটা সরে যাবে। আমি ঝুলে যাব একটু। ওই দেখ, সঙ্গে যে সব লোকজন আছে তার মধ্যে আমার বন্ধু-বান্ধবও কিছু আছে। তাদের বলা আছে যে আমি ঝুলে পড়লেই যেন আমার পা দুটো ধরে তাদের যে কেউ ঝুলে পড়ে। তাতে আমার ঘাড়টা খুব তাড়াতাড়ি ভেঙে যাবে। মরতে বেশিক্ষণ সময় লাগবে না।
কৌশিক সিগারেটে টান দিতে দিতে দেখে।
- ব্রিটেনে ১৮৭২ অব্দি এই কেদ্দানিটা চলতো। কিন্তু এতে করে বেশ কজন আসামী বেঁচে যায়। ফাঁসীর দড়িতেও মরেনি বলে, তাদের মৃত্যুদন্ড রদ করতে হয়। তাই এটা আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে যায়।
- আপনি জানলেন কী করে এত?
- ন্যাশনাল লাইব্রেরী, আগে যেটাকে ইম্পেরিয়াল বলতো-
সিগারেটে টান দেয় লোকটা।
- মানে?
- আরে ধুর! ওটা আগে এখানেই ছিল। ওই কে সি দাসের আগে। এখনও খবরের কাগজ আর ম্যাগাজিন সেকশনটা এখানেই আছে। এরপরে জিজ্ঞেস কোরোনা আপনি ইংরেজি জানলেন কী করে?
কৌশিক ঠিক এটাই ভাবছিল।
- আসলে এতবছর এখানে ঝুলে থাকতে থাকতে আমি কেমন একটা লাইব্রেরী হয়ে গেছি নিজে। অতীত, ভবিষ্যৎ- কত কি যে আছে, আর কে যে পড়বে, কে জানে?
- কী করতেন আগে, মানে যখন বেঁচে ছিলেন?
আশেপাশের রাস্তা দেখতে দেখতে কৌশিক প্রশ্ন করে। রাস্তার লোক সব চলে যাচ্ছে যে যার মতন। কেউ তার দিকে তাকিয়েও দেখছে না। তবু কেউ যাতে তাকে অন্য কিছু না ভাবে সেইজন্যেই কৌশিক খুব অস্পষ্ট করে বিড়বিড় করে কথা বলছে। এমন ভাবে বলছে যেন লোকে ভাবতে পারে সে আসলে ব্লু টুথ-এ কথা বলছে।
- শ্বশুরের সেরেস্তায় বসতাম। ব্যাস্, এই আর কি! তোমার মতই।
কৌশিক চমকে তাকায় তার দিকে। এমন সময় টুংটাং করে শব্দ হয়। তার মোবাইলে মেসেজ। কৌশিক দেখে।
- r u lonesome 2ngt?
এটা কে? চেনা নাম্বার না। কেমন ঘেঁটে যায় কৌশিক। লোকটা জানলো কি করে সেও শ্বশুরের ব্যবসায় আছে? এটা কার এসএমএস? কি হচ্ছে এসব?
- মেয়েটা করেছে হে!
-অ্যাঁ?
- দেখ দেখ।
কৌশিক আবার দেখে নাম্বারটা। কিছুতেই মনে করতে পারেনা।
-আরে দূর ফোন করে দেখ! আচ্ছা গাধা।
কৌশিকের এবারে একটু রাগ হয়। যতই ভূত হোক, এইভাবে কথা বলার কি আছে?
- ঠিক আছে ঠিক আছে! আপনি বিরাট চালাক হলে ফাঁসিতে ঝুলতেন না বুঝলেন? আপনিও কম গাধা না।
- হা হা হা হা হা...! খাসা বলেছ মাইরি। আমাকে চন্দনা বলতো এ কথা। বলতো বুদ্ধি থাকলে আমি নাকি বৌ-এর খেয়ে মৌ মারিয়ে বাঁচতাম। চন্দনা আমার বাঁধা মেয়েছেল ছিল। খুব ভালবাসতো। সত্যি বলতে ওই আমাকে যা ভালবাসতো। আর সব হারামিপনা করতো।
- আচ্ছা আপনি সত্যি ডাকাতি করতেন নাকি? এই সব যা বললো, সেই খুন-জখম, লুট-তরাজ, ধর্ষণ করতেন?
- হ্যা হ্যা। কী যে বল!
- তা হলে?
- ওসব ওয়াটসন আর আমার শ্বশুরের কাজ।
- সে কী? কেন?
- আরে চন্দনা ছিল গাঁয়ের বাগদি ঘরের মেয়েছেলে। বেধবা। তা আমি তাকে রাখছিলাম বেশ। এমন সময় ওয়াটসন এল।
- কোন গ্রাম?
- সুতানটি।
- মানে কলকা-
- হ্যাঁ হ্যাঁ! কলিকাতা,সুতানটি আর গোবিন্দপুরের সুতানটি।
- আচ্ছা!
- ওয়াটসন কালেক্টর ছিল। শ্বশুর তখন নুন আর মশলা চালান দেয়। আর মাঝে মাঝে খিদিরপুরের হাটে দাস বেচে। সব ব্যবস্থাই সরেস। তো ওয়াটসনের সঙ্গে খুব ভাব হয়েছিল। সাহেব মাল-মুদ্দো খেত খুব। শালা শ্বশুর প্ল্যান লাগালো আমার চন্দনাকে দিয়ে দেবে। আমিও এঁড়ে গেলাম।
টুংটাং। আবার মেসেজ।
- Wanna fuck? Then come to ma place! To know ma place gimme a call sweet! (চোখ মারার স্মাইলি)
- ধুর, মেয়েছেলেরা এত করে ডাকলে চলে যেতে হয়।
- না মানে, এ কি সেই?
-ফোন করো না ছাতা?
- করছি। আপনার গল্পটা?
- গল্প?
- না মানে তারপরে?
- লেগে গেল জোর। একরাত্রে শ্বশুর জিদ ধরলো। বললো চন্দনাকে নিয়ে আমি যখন এত ঝামেলা করছি তখন আমার বৌ-কেই পাঠাবে সাহেবের কাছে। ভালই হবে। ফর্সা নাতি হবে। হলে আমি বাপ হিসেবে লোক জানবে।
- সে কী?
- হ্যাঁ রে ভাই, সব ব্যবসা।
- তারপরে?
- বৌ-কে বললাম। বৌ নাক কুঁচকে বললো, ইস্ ওদের গায়ে গন্ধ থাকে, চান করেনা।
- অ্যাঁ!
- হ্যাঁ। আসলে আমিও তো শুই না ওর সাথে না? খিদে থাকে শরীরের।
- মানে আপনি ব্যবস্থা করলেন বৌ-কে বলে?
- না তো কি চন্দনাকে দেব? তুমি শালা নদের নিমাই।
আবার টুংটাং।
- Wat s wrong? dnt u hav hot rod?
- ধ্যার শালা, ফোন করো এবারে।
ফোন করে কৌশিক। সে-ই। ফোনটা ধরলো এবং বললো,
- হ্যাঁ আমিই মেসেজ করেছি। অ্যাড্রেসটা এসএমএস করছি, চলে এস।
এসে গেল ঠিকানা। সঙ্গে কী ড্রিঙ্ক নেবে তা জানতে চাওয়া। কৌশিক Rum খাবে। কৌশিক ঠিক করে নিয়েছে যে বাওয়াল করবে না। সে গিয়েই দেখবে। আধঘন্টা পরে যেতে বলেছে। ভবানীপুরের ঠিকানা। কৌশিকের হাতে সময় আছে। আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে লোকটাকে বললো,
- তারপরে?
লোকটা হাঁটা দিয়েছে ততক্ষণে। মানে কিছুটা হেঁটে গিয়ে শূন্যে দুলতে দুলতে গরুর গাড়ির উপর উঠে দাঁড়ালো। কৌশিক কিছুটা গেল ওর সঙ্গে।বললো,
- গল্পটা?
- এই সাহেবের বাচ্চাটা ওয়াটসন।
- কিন্তু এটা কেন হচ্ছে?
- আরে কেন আবার? কিছুই বোঝোনা দেখি। আমার বৌ-কে নিয়ে ও শোবার পরে ভেবে দেখলাম আজ বৌ-এ এসেছে শ্বশুর। কাল আবার চন্দনা চাইবেনা তার কী মানে? তাই একদিন রাত্রে দিলাম কুপিয়ে শ্বশুরকে।
- সে কী?
- হ্যাঁ রে ভাই। শালা, বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মী না, বসতে ছেনালি।
ঘোষণা হচ্ছে লোকটার অপরাধের। এগুলো সত্যি না। ওকে ফাঁসিয়ে দেবার জন্য এগুলো বানিয়েছে ওয়াটসন। ওর শ্বশুরের ব্যবসাটা নিয়ে নেবে এই করে। আর বৌ-কেও রক্ষিতা করে নেবে হয়তো। কৌশিক বলে,
- তাহলে?
- কী তাহলে?
- মানে আমার কী হবে?
- যাও যাও বাইক স্টার্ট কর!
লোকটা মুচকি হেসে ফাঁসিতে ঝুলে যায়।
কৌশিক বাইকটা স্টার্ট করেছিল।
আজকাল নীনার বাড়ি যাবার সময়ে সে একবার ধর্মতলা আসার চেষ্টা করে। মেয়েটার নাম নীনা। লোকটার থেকে তার ভবিষ্যৎ-এ কী হবে জানা দরকার! লোকটা নিজেকে লাইব্রেরী বলেছিল। অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যত-এর লাইব্রেরী। বলেছিল ধর্মতলায় এই মোড়ে ঠিক না, বেশিরভাগ ফাঁসি হত ফাঁসি লেন-এ। যা কালে কালে হয়েছে ফ্যান্সী লেন। ধর্মতলায় এই মোড়ে ফাঁসি বিশেষ ঘটনা হলে হয়। তারটা বিশেষ ঘটনা। বলে একটা কেত নিয়েছিল বটে। বাতাসে আড়মোড়া ভেঙে দুলে উঠেছিল। ও ভাবে দুলতে তারও খারাপ লাগবে না, কৌশিক ভেবে দেখেছে।