এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  প্রবন্ধ

  • গরুর গাড়ি থেকে মোটর গাড়ি

    Sukdeb Chatterjee লেখকের গ্রাহক হোন
    প্রবন্ধ | ০৩ আগস্ট ২০২৪ | ২৫৪ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • গরুর গাড়ি থেকে মোটর গাড়ি

    শহরের তকমা পাওয়ার পরেও, প্রথম দিকে কোলকাতায় রাস্তাঘাট খুব কম ছিল। ছিল কিছু কাঁচা রাস্তা, বর্ষাকালে যার অনেককটিই বেশ কিছুদিনের জন্য অদৃশ্য হয়ে যেত। অষ্টাদশ শতাব্দীতে একটি দুটি করে রাস্তা তৈরি হওয়া শুরু হয়। যদিও তা শহর গড়ে ওঠার জন্য ছিল অপ্রতুল। ১৭০৬ খ্রিস্টাব্দে কোলকাতার তিনটি গ্রামের প্রথম জরিপ হয়। ওই জরিপে দেখা যায় তখন কোলকাতায় মাত্র ২টি স্ট্রিট ও ২টি লেন ছিল। ১৭২৬ সালে দ্বিতীয় জরিপে পাই ৪টি স্ট্রিট এবং ৮টি লেন। ১৭৪২ সালে তৃতীয় জরিপে স্ট্রিট ১৬টি, লেন ৪৬টি এবং বাই লেন ৭৪টি। ১৭৫৬তে তা বেড়ে হল, স্ট্রিট ২৭টি, লেন ৫২টি এবং বাই লেন ৭৪টি। স্ট্রিট, লেন, বাই লেন, যে নামেই সম্বোধন করা হোক না কেন, অধিকাংশ রাস্তাই ছিল কাঁচা এবং অপ্রশস্ত। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ লগ্নে তৈরি হয় ইটের খোয়া দিয়ে বাঁধান কোলকাতার প্রথম বড় রাস্তা, সার্কুলার রোড।

    পথঘাট আর যানবাহন একে অপরের সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। উপযুক্ত পথের অভাবে, অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রায় শেষ পর্যন্ত যানবাহন বলতে ছিল গরু বা মোষের গাড়ি আর পালকী।

    মানুষ থেকে পণ্য, গরুর গাড়ি সব কিছুই বহন করত। শুধু তাই নয়, একসময় ডাক পরিবহণেও গরুর গাড়ির উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। ১৮৪৫ সালে ডাক গরুর গাড়ি, কোলকাতা থেকে লাহোর এবং বোম্বাই থেকে পুনা আর সুরাট পর্যন্ত চলাচল করতে থাকে। ১৮৫০ থেকে ডাক চলাচলের জন্য ঘোড়ার ব্যবহার শুরু হয়। Bullock Train ও ছিল। বেশ কয়েকটি বলদে টানা গাড়ি একটার পিছনে একটা পরপর যেত বলে ওই নাম দেওয়া হয়েছিল। এই গাড়ি গুলো কেবলমাত্র মাল বহন করত। কোলকাতায় নর্থ-ওয়েস্টার্ন বুলক ট্রেন নামে একটি কোম্পানি ছিল।

    গরুর গাড়িতে চেপে লোকে যে কেবল কোলকাতা বা তার আশেপাশে যাতায়াত করত তা নয়, অনেক দূর দূরান্তে যাত্রার ঘটনাও আছে। সালটা ১৮৭৮, বেঙ্গল নাগপুর রেলওয়ে তখনো চালু হয়নি। বিখ্যাত ভাষাবিদ হরিনাথ দের মা এলোকেশী দেবী, শিশু হরিনাথকে নিয়ে তাঁর বাপের বাড়ি আড়িয়াদহ থেকে পাড়ি দিলেন মধ্যপ্রদেশের রায়পুরে তাঁর স্বামী ভুতনাথ দের কাছে। ভূতনাথ তখন রায়পুরে ওকালতি করেন। সহযাত্রী ছিলেন বালক নরেন্দ্রনাথ এবং তাঁর মা ভুবনেশ্বরী দেবী। ভুবনেশ্বরীর স্বামী বিশ্বনাথ দত্ত রায়পুরে অ্যটর্নি ছিলেন। এই এতটা পথ তাঁরা গিয়েছিলেন গরুর গাড়িতে।

    পালকি ব্যয়সাপেক্ষ ছিল, তাই নিম্নবিত্তের বাহন ছিল সস্তার গরু গাড়ি। সাধারণ মানুষ তো বটেই পৌরসভা এবং অন্যান্য অনেক সরকারি দফতরেও গরুর গাড়ির ব্যাপক ব্যবহার ছিল। পৌরসভায় সেই সময় গরুর গাড়ির জন্য একটি বিশেষ বিভাগ ছিল। ঘোড়ার গাড়ি আসার পরেও কোলকাতার রাস্তায় গরুর গাড়ি অনেকদিন বহাল তবিয়তে বিচরণ করেছে। ১৮৬০এর দশকের প্রথমদিকে কোলকাতায় গরুর গাড়ির সংখ্যা ছিল আনুমানিক ৩০০। বিংশ শতাব্দীর প্রথমে সংখ্যাটা ১৬০০ ছাড়িয়ে যায়। এর কয়েক দশক পর থেকে সংখ্যাটা কমতে থাকে এবং একসময় তা কোলকাতার রাস্তা থেকে হারিয়ে যায়।

    গরুর গাড়ি ছাড়া যাতায়াতের জন্য বিকল্প ভরসা ছিল পা। গরিবদের নিজের আর বিত্তবানদের অপরের। গরিবেরা শহর প্রদক্ষিণ করত পায়ে হেঁটে আর বড়লোকেরা ঘুরত পালকিতে, গরিবদের কাঁধে চড়ে। পালকির মত আর একপ্রকার বাহন ছিল, যাকে বলা হত ডুলি। বাহক কম লাগত বলে ডুলিতে খরচ কম পড়ত। ডুলি মূলত গ্রামাঞ্চলেই চলত, কোলকাতায় এর চল ছিল না।

    মধ্যবিত্তরা ঠিকা পালকিতে চড়তেন। ঠিকা পালকির ভাড়া হত মাইলের হিসেবে। মাইল প্রতি ভাড়া ছিল তিন আনা আর সারা দিনের জন্য লাগত দেড় টাকার মত। সময়ের হিসেবে—এক ঘন্টা পর্যন্ত ৬ আনা, এরপর প্রতি ঘন্টার জন্য ৩ আনা, পাঁচ ঘন্টা বা অর্ধেক দিনের জন্য ১ টাকা, নয় ঘন্টা অর্থাৎ একদিনের জন্য দেড় টাকা। এই হার প্রথমদিকের নয়, পরবর্তীকালে একসময় সরকারিভাবে বেঁধে দেওয়া হয়েছিল।

    নিজস্ব পালকির মধ্যে লুকিয়ে থাকত আভিজাত্যের ছাপ। যার যেমন রেস্ত, তার তেমন পালকি। রকমারি তার বাহার। বেহারার সংখ্যাতেও (দুই, চার, ছয়) থাকত বাবুয়ানির প্রচ্ছন্ন প্রকাশ। বেহারা ছাড়াও থাকত হরকরা, পেয়াদা, সোটা-বরদার, মশালচি। ইংরেজরাও এই বাবুয়ানিতে মজে ছিল। কোম্পানির কর্তাব্যক্তিদের নিজস্ব পালকি এবং সর্বক্ষণের জন্য মাইনে করা বেহারা থাকত। নিজস্ব দামী পালকিগুলো এমনভাবে বানান হত যাতে ঝাঁকুনি কম লাগে। ভিতরে পাতা থাকত গদি, থাকত হেলান দেওয়ার জন্য তাকিয়া। পালকির গায়ে থাকত নানা রকমের নকশা। এক একটা বাহারি পালকি তৈরি করতে দুই থেকে তিন হাজার টাকা পড়ে যেত। রাজা মহারাজাদের পালকির কথা আলোচনা থেকে বাদ রাখছি। সোনা, রূপোর নকশা করা চাকচিক্যময় সেই সব পালকি ছিল দুর্মূল্য। জাঁকজমক বাড়তে থাকায় পালকি তৈরি এবং তাতে নকশা করার ব্যবসা উত্তরোত্তর বাড়তে থাকে। দেশী শিল্পীরা তো ছিলই, ইংল্যান্ডের অনেক শিল্পীও এই পেশায় জড়িত হয়ে পড়েন। পুরুষদের যাতায়াতের জন্য এক ধরণের চওড়া চেয়ারের মত চারদিক খোলা পালকি ছিল। এই ধরণের পালকিকে বলা হত ‘তাঞ্জাম’।

    পালকি করে ডাকও নিয়ে যাওয়া হত। ১৭৯৬ সালের ২২ মার্চ পোস্টমাস্টার-জেনারল পালকি ডাকের এই হার বেঁধে দিয়েছিলেন—কোলকাতা থেকে পাটনা- ৪০০ সিক্কা টাকা, কোলকাতা থেকে কাশী- ৫০০ সিক্কা টাকা। মধ্যবর্তী স্থানের জন্য ভাড়া ছিল মাইলে এক টাকা দু’আনা।

    প্রথমদিকে দুলে আর বাগদিরা পালকি বইত। শোনা যায়, মহারাজা নবকৃষ্ণ দুলে-বাগদিদের পরিবর্তে ওড়িয়া পালকি বেহারার প্রবর্তন করেন। অনুমান করা যেতে পারে যে, ১৭৬৭ সালে ‘মহারাজা’ খেতাব পাওয়ার পর তিনি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। ওড়িয়া বেহারাদের পরে আসে হিন্দুস্থানি বেহারা। ওড়িয়া এবং হিন্দুস্থানি বেহারাদের আসার ফলে বাঙালি পালকি বেহারারা হারিয়ে যায়।

    ১৮৫০ সালে একজন হিন্দুস্থানি পালকি বেহারার মাস মাইনে ছিল ৪ টাকা আর একজন ওড়িয়া বেহারার ৫ টাকা। একটা পালকি বইতে ৬ জন হিন্দুস্থানি বেহারা লাগত, ওড়িয়া বেহারা লাগত ৫ জন। উভয়ক্ষেত্রেই খরচ মোটামুটি একই পড়ত। ওই সময় ঠিকার বেহারাদের পালকি ও মজুরি মিলিয়ে দৈনিক দিতে হত এক টাকা চার আনা।, নিজের পালকি থাকলে বেহারাদের মাইনে খাতে খরচ হত ২৫ টাকা আর পালকি ভাড়া করলে খরচ পড়ত সাড়ে সাঁইত্রিশ টাকা। পালকি বেহারাদের বিরুদ্ধে যাত্রীদের উপর জুলুমবাজির অনেক অভিযোগ আসতে থাকায় সরকার একটি নির্দেশিকা জারি করে। ১৮২৭ সালে একদিন দেখা গেল ওড়িয়া পালকি বেহারারা ঘাড়ে পালকি নিতে অস্বীকার করছে। সরকারি নির্দেশিকার বিরুদ্ধে তাদের এই প্রতিবাদ। সরকারি নির্দেশিকায় যাত্রী ভাড়া নির্দিষ্ট ভাবে বেঁধে দেওয়া হল। এছাড়া সব ঠিকা বেহারাকে লাইসেন্স করাতে হবে এবং যাত্রী বইবার সময় সেই লাইসেন্সের তাবিজটি গলায় ঝুলিয়ে রাখতে হবে। সেই তাবিজটি কিনতে হবে নিজের পয়সায়। এ হেন কানুনি ব্যবস্থায় ক্ষুব্ধ হয় পালকি বেহারারা। ক্ষুব্ধ ওড়িয়া বেহারাদের সঙ্ঘবদ্ধ করলেন পাঁচু সুর। তাঁর নেতৃত্বে ময়দানে সভা হল। বেহারারা দল বেঁধে হাজির হল কোলকাতার পুলিস অফিসে। পুলিস কর্তাদের কাছে বক্তব্য পেশ করা হল। কর্তারা কিছু রেয়াত করলেন। জানান হল, লাইসেন্সের তাবিজটির জন্য কোন মুল্য দিতে হবে না। সামান্য কিছু রেয়াত বেহারাদের সন্তুষ্ট করতে পারেনি। লালবাজার থেকে বের হয়ে তারা জমা হল সুপ্রিম কোর্টের সামনে। সেখানে কিছুক্ষণ হৈ হট্টগোলের পর সকলে ফিরে গেল। পরদিন থেকে শুরু হল বেহারাদের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম। কোলকাতা শহরে এটাই ছিল প্রথম ধর্মঘট।

    শহরের লোকজন পড়ল সমস্যায়। কাজকর্ম ব্যাহত হল। ওড়িয়া বেহারাদের কর্মবিরতির সুযোগে ঝাঁকে ঝাঁকে হিন্দুস্থানি রাউনি বেহারা কোলকাতায় আসতে লাগল। কিছু সময়ের মধ্যেই রাউনি বেহারাতে শহর ছেয়ে গেল। ওদিকে চৌরঙ্গির ব্রাউনলো সাহেব ঘটালেন আর এক কাণ্ড। পালকির অভাবে ঘরে বসে থেকে সাহেব হাঁপিয়ে উঠেছিলেন। প্রয়োজন উদ্ভাবনের চালিকা শক্তি। ব্রাউনলো সাহেব আর পাঁচজনের মত বসে রইলেন না। মিস্ত্রি ডেকে তাঁর পালকির নিচে চারটে চাকা জুড়লেন। পিছনের হাতল কাটিয়ে ফেললেন আর সামনের হাতলে জুড়ে দিলেন ঘোড়া। পালকি থেকে হয়ে গেল গাড়ি। সাহেবের নামে গাড়ির নাম হল ‘ব্রাউনবেরি’, নেটিভরা বলত ‘পালকি গাড়ি’। খবরের কাগজে লেখা হল, ‘কলকাতা নগরে ঘোড়া সকল পালকি বাহক হইয়াছে এবং বোধ হয় যে দুই তিন হপ্তার মধ্যে ঘোড়াদেরও সভা হইয়া এক দরখাস্ত উপস্থিত হইবেক। ইহাও অসম্ভব নয় যেহেতুক হিতোপদেশ প্রভৃতি গ্রন্থের মধ্যে ষাঁড় শৃগালাদি কথা কহিয়াছে।’

    সামগ্রিকভাবে পরিস্থিতি বেগতিক দেখে ওড়িয়া বেহারারা কাজে যোগ দিল। ততদিনে শহরে বেশ কিছু ঘোড়ারগাড়ি টগবগিয়ে ছুটছে। পালকির গতি রুদ্ধ করে বেহারার ধর্মঘট পরোক্ষে বাড়িয়ে দিল শহরের গতিকে। ঘোড়ারগাড়ি রাস্তায় নামলেও ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ লগ্নেও শহরে পালকির সংখ্যা যথেষ্ট ছিল। ১৮৫০ সালে সমগ্র বাংলাদেশে ১১৫০০ পালকি বেহারা ছিল। ১৮৯১ সালে কোলকাতায় ৬০৬টি পালকি ছিল আর পালকি বেহারা ছিল ১৬১৪ জন। বিংশ শতাব্দীর জনবহুল রাস্তায় নানান দ্রুতগামী যানের মাঝে বেমানান পালকি ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে যায়।

    অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে কোলকাতার রাস্তায় কিছু ঘোড়ার গাড়ি ঘোরাঘুরি করতে দেখা গেল। সে সব গাড়ি চড়তেন উচ্চ পদমর্যাদার কর্তা ব্যক্তি এবং তাদের পরিবারবর্গ। সাধারণ মানুষ কেবল দেখত, চড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়িত হতে তখনো প্রায় অর্ধ শতাব্দী বাকি। গতির স্পর্শে কোলকাতার চালচিত্র ধীরে ধীরে পালটাতে থাকল। সাহেবদের মধ্যে তো বটেই, স্থানীয় বড়লোকদের মধ্যেও ঘোড়ার গাড়ির চাহিদা বাড়তে থাকে। কোলকাতার রাস্তায় ঘোড়ার গাড়ির বৈচিত্রের শেষ ছিল না। প্রয়োজন, আয়েশ, গঠন, ঘোড়ার সংখ্যা ইত্যাদির ভিন্নতায় তৈরি হত এক এক রকমের গাড়ি।

    চেরোট ছিল বড় আর দামী গাড়ি। এই গাড়ি ব্যবহার করতেন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারী এবং অভিজাত শ্রেণীর লোকেরা। এই গাড়ি ছিল আভিজাত্যের বিজ্ঞাপন। চেরোট ছাড়াও ল্যান্ডো, ব্রুহাম, ভিক্টোরিয়া, ব্যারুশ এর মত আরো কিছু নামীদামী গাড়ি ছিল। Lord Brougham এর নামে নাম রাখা ব্রুহাম ছিল এক ঘোড়ায় টানা বন্ধ গাড়ি। ভিক্টোরিয়া গাড়ির মাথার ঢাকা দুপাশে গুটিয়ে রাখা যেত।

    কাজের ঠিকানায় যাতায়াতের জন্য ছিল অফিস যান আর কেরাঞ্চি গাড়ি। অফিস যান ব্যবহার করত সাহেবরা আর কেরাঞ্চি গাড়িতে চড়ত স্থানীয় কেরানিরা। কেরাঞ্চি গাড়ি একসময় কোলকাতার রাস্তায় অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ইংল্যান্ডের পুরনো ভাড়া গাড়ির মত এই গাড়িও দুটো ঘোড়ায় টানত। কাঠের খাঁচার মত দেখতে এই গাড়িগুলো প্রশস্ত ছিল না। অফিস যাতায়াত ছাড়াও পকেট অনুমতি দিলে অনেকে বেড়ানর জন্যও এই গাড়ি ব্যবহার করতেন। ব্রাউনলো সাহেবের ব্রাউনবেরির মত একই সময়ে এবং একই কারণে বাজারে এল ছ্যাকরা গাড়ি (Hackney carriage)। এক ঘোড়ায় বা দু ঘোড়ায় টানা নীল-কালো রঙের দ্বিতীয় শ্রেণীর আর লাল রঙের তৃতীয় শ্রেণীর গাড়ি। ১৮৭৫-৭৬ সালে কুলিবাজারের(( হেস্টিংস) গ্রিনফিল্ড সাহেব ব্রাউনবেরিকে একটু পরিবর্তিত এবং পরিবর্ধিত করে বানালেন এক নতুন গাড়ি। আবিষ্কর্তার নামে গাড়ির নাম রাখা হল গ্রিনফিল্ড। এ ছাড়াও চলত টমটম,, ফিটন, গিগ, বগি, এক্কার, মত আরো বেশ কিছু গাড়ি। ঘোড়ার সংখ্যা অনুযায়ী গাড়ির নাম ছিল, জুড়ি, চৌঘুরি, আটঘুরি, দশফুকার ইত্যাদি।

    একটু দেখে নেওয়া যাক গাড়িগুলির ভাড়া কিরকম ছিল। যেমন গাড়ি, তেমন ভাড়া। কেবল গাড়ি নয়, ঘোড়াও ভাড়া পাওয়া যেত।
    দুটি ঘোড়ার জন্য দৈনিক লাগত ১০ টাকা আর এক মাসের জন্য পড়ত ১৫০ টাকা।
    চেরোট গাড়ি (দু জন বসার মত)- দৈনিক ২০ টাকা এবং মাসিক ৩০০ টাকা।
    বগি গাড়ি (দু জনের মত)- দৈনিক ৮ টাকা আর মাসিক ১৫০ টাকা।
    একজন বসার মত হলে, দৈনিক ৪ টাকা আর মাসিক ১২০ টাকা।
    এ তো গেল দৈনিক এবং মাসিক ভাড়ার খবর। এবার আসি সময় এবং দূরত্বের মাপকাঠিতে ভাড়ার বিন্যাসে।
    প্রথম শ্রেণীর গাড়িতে এক মাইল পর্যন্ত ভাড়া ছিল আট আনা। এরপর প্রতি মাইল বা তার অংশে ৬ আনা। সময় হিসাবে - পনের মিনিটের জন্য ছিল ৮ আনা, আধ ঘন্টার জন্য এক টাকা, এক ঘন্টার জন্য দেড় টাকা, আধদিন বা ৫ ঘন্টার জন্য ৪ টাকা আর একদিন বা নয় ঘন্টার জন্য ৭ টাকা।
    দ্বিতীয় শ্রেণীর গাড়ি - এক মাইল পর্যন্ত ৬ আনা, এরপর প্রতি মাইল বা তার অংশের জন্য ৪ আনা। সময় হিসেবে-- ফিটন জাতীয় গাড়ির ভাড়া- পনের মিনিটের জন্য ৬ আনা, আধ ঘন্টার জন্য ১২ আনা, এক ঘন্টার জন্য ১ টাকা, পরবর্তী প্রতি ঘন্টার জন্য ৮ আনা, আধদিন বা পাঁচ ঘন্টার জন্য ২ টাকা ৮ আনা, একদিন বা ৯ ঘন্টার জন্য ৪ টাকা।
    ব্রাউনবেরি ধরণের গাড়ির ভাড়া -- আধ ঘন্টার জন্য ৮ আনা, এক ঘন্টার জন্য ১৪ আনা, পরবর্তী প্রতি ঘন্টার জন্য ৮ আনা, আধ দিন বা ৫ ঘন্টার জন্য ২ টাকা ৮ আনা, ৯ ঘন্টার একদিনের জন্য ৪ টাকা।
    তৃতীয় শ্রেণীর গাড়ি -- এক মাইল পর্যন্ত ৩ আনা, এরপর প্রতি মাইল বা অংশের জন্য ২ আনা। সময় হিসাবে - আধ ঘন্টার জন্য ৬ আনা, এক ঘন্টার জন্য ৮ আনা এবং পরের প্রতি ঘন্টার জন্য ৬ আনা।

    এবার দেখা যাক গাড়ি আর ঘোড়া কিনতে কেমন খরচ পড়ত। ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে একটি বগি গাড়ির দাম ছিল ৮০০ থেকে ১০০০ টাকা, পালকি গাড়ি ৯০০ থেকে ২০০০ টাকা আর ল্যান্ডো বা ব্রুহাম ২০০০ থেকে ৪০০০ টাকা। গাড়ির মত ঘোড়াও ছিল নানা জাতের। সেই সময় কোলকাতায় ওয়েলার, আরবী, টাট্টু, স্ট্যালিয়নের মত অনেক ভাল জাতের ঘোড়া বাইরে থেকে আনা হত। স্ট্যালিয়নের দাম প্রায় দু হাজারের কাছাকাছি পড়ে যেত। এরপর আছে ঘোড়ার দানাপানির খরচ, সহিস কোচওয়ানের খরচ। তাই দামী ঘোড়ার ব্যবহার দামী গাড়ি আর দামী মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। ছ্যাকরা আর কেরাঞ্চির মত গাড়িগুলো টানত অপুষ্ট আর দুর্বল ঘোড়া।

    এই প্রসঙ্গে রয়েছে হুতোম প্যাঁচার রসাল টিপ্পনি — কলকেতার কেরাঞ্চি গাড়ি বেতো রোগীর পক্ষে বড় উপকারক, গ্যালব্যানিক সকের কাজ করে। সেকেলে আসমানি দোলদার ছক্কর যেন হিন্দুধর্মের সঙ্গে সঙ্গেই কলকেতা থেকে গাঢাকা হয়েছে — কেবল দুই একখানা আজও খিদিরপুর, ভবানীপুর, কালীঘাট, আর বারাসতের মায়া ত্যাগ কত্তে পারে নি বলেই আমরা কখন কখন দেখতে পাই। “চারআনা!” “চারআনা!” “লালদিকি!” “তেরজুরি!” “এস গো বাবু ছোট আদালত!” বলে গাড়োয়ানরা সৌখীন সুরে চীৎকার কচ্চে,--নবদ্ধাগমনের বউএর মত দুই এক কুটিওয়ালা গাড়ির ভিতর বসে আচেন—সঙ্গি জুটচে না। দুই এক জন গবর্মেন্ট আপিসের ক্যারাণি গাড়োয়ানদের সঙ্গে দরের কসাকসি কচ্চেন। অনেকে চটে হেঁটেই চলেচেন, গাড়োয়ানরা হাসি টিটকিরির সঙ্গে “তবে ঝাকা মুটেয় যাও, তোমাদের গাড়ি চড়া কর্ম্ম নয়!” কমপ্লিমেন্ট দিচ্চে! (গ্যালব্যানিক শক- তৎকালীন কোলকাতায় বাত রোগের চিকিৎসার জন্য ‘গ্যালভানিক শক’ এর ব্যবহার ছিল। লালদিকি-লালদিঘি, বর্তমানের বি-বা-দী বাগ, তেরজুরি- Government Treasury)
    যাত্রাসুখ থাক বা না থাক, তদানীন্তন কোলকাতায় যাত্রী পরিবহণে ঘোড়ার গাড়ির কোন বিকল্প ছিল না।

    গাড়ির চাহিদা ক্রমশ বাড়তে থাকায়, অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিক থেকে তৈরি হতে থাকল গাড়ি বানাবার কারখানা। ১৭৭৫ সালে উইলিয়াম জনসন নামে এক ইংরেজ কোলকাতায় প্রথম ঘোড়ার গাড়ির কারখানা তৈরি করেন। এরপর একে একে এই ব্যবসায় যোগ দেয় এডওয়ার্ড চ্যান্ডলার (১৭৭৬), রবার্ট গ্রেঞ্জ (১৭৮০), জেমস ওয়াটসন (১৭৮৩) এর মত অনেক ছোট বড় ব্যবসায়ি। ১৭৮৩-৮৪ সালে বিখ্যাত স্টুয়ার্ট এন্ড কোম্পানি তাঁদের ঘোড়ার গাড়ির কারখানা তৈরি করেন ওল্ড কোর্ট হাউস স্ট্রিটে। পরবর্তী কালে এদের মুখ্য কার্যালয়ের ঠিকানা হয় বালিগঞ্জ। শেষের দিকে এরা ঘোড়ার গাড়ি ছেড়ে মোটর গাড়ি তৈরি করা শুরু করে। ডাইকস এন্ড কোম্পানিরও ঘোড়ার গাড়ির বেশ নাম ছিল। প্রথমদিকে কাঠ ছাড়া বাকি সব যন্ত্রাংশই ইংল্যান্ড থেকে আসত। পরে সবটাই দেশে তৈরি হতে শুরু হয়।

    গাড়ি নির্মাতা ছাড়াও আর এক শ্রেণীর ব্যবসায়ী ঘোড়ার গাড়ির কারবারে লিপ্ত হন। এদের বলা হত Livery Stable Keeper। এরা গাড়ি বিক্রি করত আবার ভাড়াও দিত। এছাড়া অনেকে নিজের গাড়ি বাড়িতে না রেখে এদের হেফাজতে রেখে দিত। অর্থের বিনিময়ে কোম্পানিগুলি ঘোড়া এবং গাড়ির দেখভাল করত। অর্থাৎ এদের আঙ্গিনাটি ছিল একাধারে শো রুম এবং গ্যারেজ। এই ধরণের ব্যবসায়ীদের মধ্যে ওজনদার কিছু নাম হল — হার্ট ব্রাদার্স, মিলটন কোম্পানি, কুক এন্ড কোং, হান্টার এন্ড কোম্পানি। শেষোক্ত দুই কোম্পানি ঘোড়া ও গাড়ি নিলামও করত।

    শহরের বিকাশের সাথে তাল মিলিয়ে বাড়ছে ব্যবসা বাণিজ্য। চিৎপুর, শোভাবাজার, আহিরিটোলার মত শহরের বেশ কিছু জায়গায় ব্যবসার আড়ৎ গড়ে উঠেছে। রেল পরিষেবা চালু হওয়ার পর শিয়ালদহ স্টেশনে বাইরে থেকে আসছে প্রচুর মালপত্র। স্টেশনে আসা মালপত্র শহরের নানা প্রান্তে পৌঁছানর ব্যবস্থা করাটা হয়ে উঠল নগরকর্তাদের প্রধান সমস্যা। সমস্যার কথা জানানর পর ভারত সরকারের কাছ থেকে ট্রাম চালাবার পরামর্শ আসে। কোলকাতার Justice for the Peace পরিকল্পনা তৈরি করার জন্য একটি কমিটি তৈরি করলেন। কমিটি, গ্রামের থেকে আসা পণ্য বিভিন্ন গুদামে পৌঁছে দেওয়ার উপযোগী করে একটি রুট ঠিক করল। পরিকল্পনা মঞ্জুর হল। দেড় লক্ষ টাকা খরচ করে শেয়ালদা থেকে বৈঠকখানা রোড, বৌবাজার স্ট্রিট, ডালহৌসি স্কোয়ার হয়ে আর্মেনিয়ান ঘাট পর্যন্ত লাইন পাতা হল। আর্মেনিয়ান ঘাট পর্যন্ত লাইন পাতা হয়েছিল কারণ, ওইখানে ছিল তখনকার ইষ্ট ইন্ডিয়ান রেলওয়ের হাওড়ার টিকিটঘর। শিয়ালদহ এবং হাওড়ার মধ্যে পণ্য পরিবহণের সুবিধার কথা চিন্তা করেই ওই স্থান নির্বাচন করা হয়। ১৮৭৩ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি কোলকাতায় চলল প্রথম ট্রাম।

    সেদিন শিয়ালদহ স্টেশন থেকে দুটি ‘ট্রাম ট্রেন’ রওনা হয়। প্রথম ট্রেনে ছিল একটি প্রথম শ্রেণীর এবং দুটি দ্বিতীয় শ্রেণীর গাড়ি। দ্বিতীয়টিতে ছিল একটি প্রথম এবং একটি দ্বিতীয় শ্রেণীর গাড়ি। ট্রেন বলা হলেও গাড়িগুলি কিন্তু একটি অপরটির সাথে জোড়া ছিল না। একটি গাড়ির পিছনে আর একটি গাড়ি দাঁড়িয়েছিল। প্রতিটি গাড়ি টানার জন্য সামনে ছিল দুটি করে বলিষ্ঠ ঘোড়া। ৯.১৫তে শিয়ালদহে ইস্টবেঙ্গল রেলওয়ের ট্রেনটি ঢোকা মাত্র যাত্রীরা ছুট লাগাল প্রথম ট্রামে সওয়ারি হওয়ার জন্য। পণ্য পরিবহনের উদ্দেশ্যে ট্রামের পত্তন হলেও মানুষের ভিড়ে পণ্য ওঠার আর কোন জায়গা রইল না। প্রথম শ্রেণী অবশ্য ফাঁকা ছিল, কিন্তু সেখানে দামী মানুষদের মাঝে পণ্য রাখার প্রশ্নই ওঠে না। ট্রামের বড় কর্তা মিঃ সি এফ অ্যাব্রো এবং ইঞ্জিনিয়ার মিঃ ক্লার্ক ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে তদারকি করছেন। ৯.৩০ মিনিটে গাড়ি ছাড়ার সংকেত দেওয়া হল। প্রথম শ্রেণী সংকেতের সাথে সাথেই স্টেশন থেকে রওনা হল। যাত্রী মাত্র পাঁচ জন, তিনজন সাহেব আর দুজন স্থানীয়। গোল বাঁধল দ্বিতীয় শ্রেণী দুটি ছাড়ার সময়। ট্রামে বসার আসন ছিল ৪৫টি। ভিড়ের ঠেলায় মুহূর্তে বসার আসন ভরে গিয়ে ছাতে পর্যন্ত লোক উঠে গেছে। তাগড়া ওয়েলার ঘোড়াগুলো সাধ্যমত চেষ্টা করেও গাড়ি এগিয়ে নিয়ে যেতে পারছে না। তারপর বিস্তর ঠেলাঠেলি এবং বেশ কয়েক ঘা চাবুক মারার পর গাড়ি ধীরে ধীরে রওনা হল। শয়ে শয়ে মানুষ সেদিন কোলকাতার রাস্তায় ভিড় করে এই নতুন গাড়ি চলা দেখেছিল।

    প্রথম পর্যায়ের এই ট্রাম পরিষেবার পরমায়ু খুব কম ছিল। লোকসানের ধাক্কা সামলাতে না পেরে ৯মাস পরে ১৮৭৩ এর ২০ নভেম্বর ঝাঁপ বন্ধ হয়ে যায়। কোলকাতায় ট্রাম চালাবার মূল উদ্দেশ্য ছিল পণ্য পরিবহণ। কিন্তু লোকের ভিড়ে তা বাস্তবায়িত হল না। সামান্য যাত্রী ভাড়ায় বিপুল খরচ সামলান সম্ভব ছিল না। কিছুদিন চলল দোষারোপের পালা। কেউ দুষলেন জাস্টিস অফ পীসদের, জাস্টিসরা দুষলেন সরকারকে। মিউনিসিপ্যালিটির মাথা হগ সাহেব জাস্টিসদের পাশে দাঁড়ালেন। সরকারের কাছে ক্ষতিপূরণের জন্য আবেদন করলেন। সরকার সে আবেদনে কর্ণপাত করেনি। অগত্যা ট্রামের লাইন, গাড়ি এবং যাবতীয় কিছু বিক্রি করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। ম্যাকলিস্টার নামে এক সাহেব কেনা দামে সব কিছু কিনতে সম্মত হলেন। বাংলা সরকারের আপত্তিতে তাঁকে বিক্রি করা গেল না। অবশেষে বিক্রি করা হল Dillwyn এবং Alfred Parish ও Robinson Souttar নামে তিনজন ইংরাজের কাছে।

    ১৮৭৮ সালে কিছু ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে কোলকাতা শহরে নিয়মিতভাবে ট্রাম চালাবার প্রস্তাব সরকারের কাছে আসে। তার মধ্য থেকে মেসার্স প্যারিস অ্যান্ড সাউদারের প্রস্তাব গৃহীত হয়। অনুমতি পাওয়ার পর তাঁরা প্রস্তাব রূপায়ণের জন্য ‘ক্যালকাটা ট্রামওয়েজ কোম্পানি’ গঠন করেন। ১৮৭৯ সালের ২ অক্টোবর কোলকাতা কর্পোরেশনের সাথে ট্রাম কোম্পানির একটি চুক্তি হয়। কোলকাতা কর্পোরেশন এই চুক্তি অনুসারে ট্রাম কোম্পানিকে শহরের বেশ কিছু রাস্তায় ট্রামলাইন পাতার অধিকার দেয়। ঠিক হল, কোম্পানি কর্পোরেশনকে একটি লাইনের জন্য বছরে ২ হাজার টাকা এবং জোড়া লাইনের জন্য ৩ হাজার টাকা দেবে। ১৯০১ সালে এই ভাড়া বেড়ে হবে যথাক্রমে ৩ ও ৪ হাজার টাকা। এ ছাড়া ট্রামের ভাড়া ঠিক করার অধিকার সম্পূর্ণভাবে কোম্পানির হাতে থাকবে।

    শিয়ালদহ-বৌবাজার লাইনে পরীক্ষামূলকভাবে প্রথম ট্রাম চলে ১৮৮০ সালের ২৯ অক্টোবর। শিয়ালদহ-বৌবাজার—ডালহৌসি-হেয়ার স্ট্রিট লাইনে ট্রাম চলাচল শুরু হয় ১৮৮০ সালের ১৯ নভেম্বর। চিৎপুর রোডে ট্রাম চলে ১৮৮১ সালের মার্চে, চৌরঙ্গি রোডে ওই বছরের নভেম্বরে, ধর্মতলা স্ট্রিটে ১৮৮২ সালের মার্চে, স্ট্র্যান্ড রোডে ১৮৮২ সালের জুনে, শ্যামবাজারে ১৮৮২ সালের নভেম্বরে, খিদিরপুরে ১৮৮৩ সালের ডিসেম্বরে এবং ওয়েলেসলি স্ট্রিটে ১৮৮৪ সালের এপ্রিল মাসে। ১৯০৪ সাল থেকে কয়েক বছরের মধ্যে টালিগঞ্জ, বেলগাছিয়া, হ্যারিসন রোড এবং সার্কুলার রোডে ট্রাম লাইন পাতা হল। চিৎপুর রোডে প্রথমে সক স্ট্রিট(বর্তমানে দুর্গা চরণ ব্যানার্জী স্ট্রিট) পর্যন্ত লাইন পাতা হয়েছিল, পরে তা বাগবাজার পর্যন্ত বাড়ান হয়।

    প্রথম দিকে ট্রাম লাইন ছিল ৩ ফুট ৩/৮ ইঞ্চি চওড়া। ১৯০২ সালে তা বেড়ে হয় ৪ ফুট ৮-১/২ ইঞ্চি। সেকালে ড্রাইভার আর কন্ডাক্টর মাথায় লাল পাগড়ি পরত। ট্রামগাড়ি ছিল ধূসর রঙের, ইংরাজিতে বলা হত CTC Grey। ১৮৯৬ সালে কোলকাতায় ট্রামের ৬টি ডিপো ছিল—শ্যামপুকুর, চিৎপুর, শিয়ালদহ, কলিঙ্গা (ওয়েলেসলি স্কোয়ার), ভবানীপুর এবং খিদিরপুর। ট্রাম গাড়িতে দুদিকে পাঁচটি করে মোট দশটি খোলা দরজা থাকত। লোকে দুদিক দিয়েই ওঠানামা করত। তখন ট্রামের কোন রুটে কত ভাড়া তা জানিয়ে বিজ্ঞাপন দেওয়া হত। ট্রাম রাস্তায় এক মাইল বাদে বাদে থাকত একটি করে স্টেশন। এখানে যেমন যাত্রীরা নামাওঠা করত তেমনই প্রয়োজনে ঘোড়া বদল করা হত। রাস্তার ধারে ঘোড়ার জল খাওয়ার জন্য বড় বড় জলাধার ছিল। ট্রামে ঘোড়ার প্রয়োজন ফুরিয়ে যাওয়ার পরেও অনেক কাল রাস্তার ধারের সেই জলাধারগুলি স্মরণ করাত ঊনবিংশ শতাব্দীর কোলকাতাকে।

    দ্বিতীয় দফায় ট্রাম চলাচল শুরু হওয়ার পর লাইন নিয়ে কিছু সমস্যা দেখা দেয়। শহরের বেশ কিছু জায়গায় ট্রাম লাইন রাস্তার থেকে কয়েক ইঞ্চি উপরে উঠে ছিল। পথচারী এবং যানবাহনের পক্ষে তা বেশ বিপজ্জনক হয়ে উঠেছিল। মাঝে মাঝে ছোটখাট দুর্ঘটনাও ঘটছিল। আলাপ আলোচনায় সমস্যা না মেটায় ১৮৮৫ সালে ব্যাপারটা আদালত অব্দি গড়াল। আদালতের দীর্ঘসূত্রতা তখনো ছিল। চার বছর পর আদালত কোম্পানিকে লাইনগুলি ঠিক করে দেওয়ার নির্দেশ দেয়। ১৮৯০ সালে, অর্থাৎ লাইন বসার ১০ বছর পরে ত্রুটি মেরামত করা হয়।

    ঘোড়ার লালন পালন ছিল সেই সময় ট্রাম পরিষেবার সব থেকে বড় সমস্যা। ঘোড়াগুলো সব আনা হত শীতের দেশ থেকে। একে আমাদের দেশের গরম তাদের কাছে কষ্টকর ছিল, তার ওপর টানতে হত মানুষ বোঝাই ভারি গাড়ি। পরিবেশ ও পরিস্থিতির কারণে ১৮৮১ সালের গরমকালে অনেকগুলো ঘোড়া মারা যায়। শুরু হল বিকল্পের সন্ধান। ১৮৭৯ সালের ২৪ জুলাই P.W. Fleury & Co. বিজলি বাতির প্রথম প্রদর্শন করে কোলকাতা শহরে সাড়া ফেলে দিয়েছে। ১৮৮১ সালে Mackinnon & Mackenzie Cotton Mill এর মত অল্প কিছু জায়গায় বিজলি বাতির আলো ঝলমল করছে। তবে সেই সময় তা একেবারেই বিরল দৃশ্য। কোলকাতার রাস্তায় কিন্তু তখনো গ্যাসের বাতি জ্বলছে। বিদ্যুতের ব্যাপকভাবে ব্যবহার শুরু হতে তখনো দুই দশক দেরী আছে। তাই ঘোড়ার বিকল্প হিসাবে, রেলের মত ট্রামের জন্য তৈরি হল বাষ্পীয় ইঞ্জিন। ১৮৮২ সালে ট্রাম কোম্পানিকে পরীক্ষামূলকভাবে একমাসের জন্য চৌরঙ্গির রাস্তায় বাষ্পীয় ইঞ্জিনের সাহায্যে ট্রাম চালাবার অনুমতি দেওয়া হল। একমাস শেষ হওয়ার পর জনগণের ইচ্ছায় আরো এগার মাস ঐ লাইনে বাষ্পীয় ইঞ্জিনের সাহায্যে ট্রাম চলে। বাষ্পীয় ইঞ্জিন আসায় ট্রামের গতি বেড়েছিল এবং হয়ত সেই কারণেই বেড়েছিল দুর্ঘটনা। কিছুটা দুর্ঘটনা এবং কিছুটা প্রশাসনিক সমস্যার কারণে স্টিম ইঞ্জিনের ব্যবহার বন্ধ করে দেওয়া হয়। বন্ধ হলেও, প্রতি বছর দুর্গা পুজোর সময় তীর্থ যাত্রীদের কালিঘাটে নিয়ে যাওয়ার জন্য বাষ্পীয় ইঞ্জিন চালাবার বিশেষ অনুমতি দেওয়া হত। খিদিরপুর লাইনেও কিছু সময় ট্রামে বাষ্পীয় ইঞ্জিন ব্যবহৃত হয়েছিল। বাষ্পীয় ইঞ্জিন বাতিল হওয়ার পর থেকে বিদ্যুতায়ন পর্যন্ত এক দশক, শত সমস্যা সত্ত্বেও, ঘোড়াই সচল রেখেছিল কোলকাতার ট্রাম। ১৮৯০-৯১ সালে ট্রাম কোম্পানিতে ২২৫০ জন কর্মচারী ছিল আর ঘোড়া ছিল ১০০০টি।

    সময়ের সাথে সাথে কোলকাতা শহরে বিদ্যুতের ব্যবহার বাড়তে থাকে। কিলবার্ন কোম্পানি ১৮৯৬ সালে বিদ্যুতের সাহায্যে ট্রাম চালাবার অভিপ্রায়ে সরকারের কাছে অনুমতি চেয়ে আবেদন করে। ট্রাম কোম্পানির সাথে কিলবার্নের এই মর্মে আলাপ আলোচনা এবং সমঝোতা হয়। ১৮৯৭ সালে কর্পোরেশন বিদ্যুতের সাহায্যে ট্রাম চালান সংক্রান্ত নতুন কিছু শর্তাবলী যুক্ত চুক্তিপত্র ট্রাম কোম্পানিকে দিলে কোম্পানি তা মানতে অস্বীকার করে। পরবর্তীকালে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে খসড়ায় কিছু পরিবর্তন করা হয় এবং ১৮৯৯ সালে চুক্তিটি কার্যকর হয়। চুক্তি অনুযায়ী, ট্রাম কোম্পানিকে ৯ ডিসেম্বর ১৯০২ এর মধ্যে বিদ্যুৎ চালিত ট্রাম পরিষেবা শুরু করতে হবে। এই সময়ের মধ্যে সেরে ফেলতে হবে পরিকাঠামোগত সমস্ত পরিবর্তন। লাইন পাতা, নতুন কামরা বানান, বিদেশ থেকে ইঞ্জিন আনা, বিদ্যুতের খুঁটি পোতা, বিদ্যুতের তার লাগান, ড্রাইভারদের প্রশিক্ষণ ইত্যাদি কাজে বিপুল শ্রম এবং অর্থ বিনিয়োগ করতে হয়েছিল। তবু নির্ধারিত সময়ের কয়েক মাস আগেই শহরে এসে গেল বিদ্যুৎ চালিত ট্রাম। ১৯০২ সালের ২৭ মার্চ প্রথম বিদ্যুতের ট্রাম চলল খিদিরপুর লাইনে। এরপর একে একে চালু হল চৌরঙ্গি কালীঘাট, ওয়েলিংটন স্ট্রিট- বৌবাজার- ডালহৌসি স্কোয়ার এবং ধর্মতলা লাইনে। ১৯০২ সালের মধ্যেই পুরনো সব কটি রুটেই বৈদুতিক ট্রাম এসে গেল। যাতায়াতের সময় কমে গেল, কোম্পানির আয় বেড়ে গেল। যাত্রীরাও খুশি, কোম্পানিও খুশি। মুনাফায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ট্রাম কোম্পানি কয়েক বছরের মধ্যে শহরে পেতে ফেলল আরো কটি নতুন লাইন। ১৯০৩ সালে খোলা হয় টালিগঞ্জ, বেলগাছিয়া, হ্যারিসন রোড, ১৯০৪ সালে বাগবাজার এবং ১৯০৮ সালে চালু হয় লোয়ার সার্কুলার রোড, আলিপুর এবং বেহালা লাইন। ১৯০৫ সালের জুলাই মাসে শিয়ালদহ থেকে হ্যারিসন রোড, স্ট্র্যান্ড রোড হয়ে হাইকোর্ট পর্যন্ত ট্রাম চলাচল শুরু হয়। ১৯১০ সালে শিয়ালদহ থেকে রাজাবাজার পর্যন্ত লাইন পাতা হয় এবং ১৯৪১ সালে তা শ্যামবাজার অব্দি সম্প্রসারিত করা হয়। ১৯২৫ সালে পার্ক সার্কাস এবং ১৯২৮ সালে রাসবিহারী অ্যাভিনিউ এ ট্রাম চলাচল শুরু হয়। পার্ক সার্কাস-বালিগঞ্জ লাইন চালু হয় ১৯৪৩ সালে। ১৯১৪ সালে কোলকাতা এবং শহরতলি মিলিয়ে ৩১ মাইল ট্রামলাইন ছিল। ২৪৫টি করে প্রথম এবং দ্বিতীয় শ্রেণীর কামরা ছিল। কেবল কোলকাতা শহরেই নয়, মিউনিসিপ্যালিটির অনুমতিক্রমে ১৯০৭ সালে হাওড়াতেও ট্রাম পরিষেবা শুরু হয়।

    গাড়ি রাখার জন্য কালীঘাট, শিয়ালদহ, শ্যামবাজার এবং খিদিরপুরে তৈরি হল ডিপো। মেরামত এবং রক্ষণাবেক্ষণের জন্য তৈরি হল কারখানা। ট্রামগাড়ির চেহারাও পালটে গেল। তখন গাড়ির সামনে এবং পিছনে দুদিকেই দরজা থাকত। মুনাফার সন্ধান পেয়ে ট্রাম কোম্পানি যাত্রীদের সুখ সুবিধার দিকে নজর দিতে শুরু করল। ফার্স্ট ক্লাসে পাখা লাগান হল, বসার জায়গায় লাগান হল গদি। ট্রামের ভাড়া সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যেই ছিল। তাকে আরো আকর্ষণীয় করে তুলতে নানা রকম সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা ছিল। দুপুর বেলা, ফাঁকা সময়ে ভাড়া কম লাগত। ছিল ‘ট্রান্সফার টিকিট’ এর ব্যবস্থা। এক জায়গা থেকে ট্রান্সফার টিকিট কিনলে অন্য রুটের ট্রামে চাপলেও আর নতুন করে টিকিট কিনতে হত না। ছিল ‘অল ডে টিকিট’ আর ‘মান্থলি টিকিট’। নামেতেই বোঝা যাচ্ছে, প্রথমটি ছিল সারাদিন ঘোরার জন্য আর দ্বিতীয়টি সারা মাসের জন্য। ট্রামের টিকিট এমনিতেই সস্তা ছিল, ওই টিকিটে আরো ছাড় দেওয়া হত। ‘অল ডে টিকিট’ এর দাম ছিল ৬ আনা। এই সুবিধেগুলি অনেকদিন পর্যন্ত বলবৎ ছিল। কিছু হয়ত এখনও আছে। কেবল আদিপর্বেই নয়, আজও ট্রামই কোলকাতা শহরের সব থেকে সস্তার পরিবহণ। অল্প খরচে সুখকর পরিষেবা দিয়ে ট্রাম হয়ে উঠেছিল শহরের মানুষের অত্যন্ত প্রিয় যান। দুঃখের কথা, গতির দৌড়ে পিছিয়ে পড়ে শতাব্দী প্রাচীন এই যানটি এখন অন্তিম প্রহর গুনছে।

    শহরের বিকাশের সাথে সাথে তাল মিলিয়ে বাড়ছিল জনসংখ্যা। শুধু জনসংখ্যাই নয়, কোলকাতা বন্দরে বিপুল পরিমাণ পণ্যের আসা যাওয়া আছে। শিয়ালদহ এবং হাওড়ার কথা পূর্বেই উল্লেখ করেছি। বন্দরের পণ্য অন্যত্র নিয়ে যাওয়ার জন্য গঙ্গার ধারে রেল লাইন পাতা হয়। মাল টানতে চিৎপুরেও বিছান হল রেল লাইন। ১৮৫৪ সালে রেল পরিষেবা শুরু হওয়ার পর যাত্রী এবং পণ্য পরিবহণের ক্ষেত্রে দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছিল। কিন্তু এতদসত্ত্বেও মোটর গাড়ি আসার আগে শহরের অভ্যন্তরে পণ্য পরিবহণে যন্ত্রের ছোঁয়া সেভাবে লাগেনি। ট্রামে বিদ্যুতের সংযোগ হওয়ার পর কোলকাতার পরিবহণ কিছুটা আধুনিক রূপ পেয়েছিল। কিন্তু ট্রাম কোলকাতার পণ্য পরিবহণের ক্ষেত্রে কোন দিশা দেখাতে পারেনি।

    মোটর গাড়ির কাহিনীতে যাওয়ার আগে শহরের আরো দুটি অতি পরিচিত যানের একটু তত্ত্বতালাশ করে নেওয়া যাক। একটি হল বাই-সাইকেল এবং অন্যটি রিকশ।

    বাই-সাইকেলের পূর্বসূরি হল ভেলোসিপিড নামে এক দুই চাকার গাড়ি। ১৮৬৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি অমৃতবাজার পত্রিকায় লেখা হয়— ‘এডুকেশন গেজেট বলেন, প্যারিস নগরে ভিলসিপিড নামক এক প্রকার যন্ত্র প্রস্তুত হইয়াছে। ইহা দ্বিবিধ, এক প্রকার দুই চাকা বিশিষ্ট, যাহাতে পুরুষেরা আরোহণ করেন, অপর তিন চাকার, ইহাতে সচরাচর স্ত্রীলোকেরা চড়িয়া থাকেন। দুই চাকারগুলিই অধিক দ্রুতগামী। আরোহী স্বয়ং পদদ্বয় দ্বারা চাকা ঘুরাইয়া অতি দ্রুতবেগে যাইতে পারেন। ভিলসিপিড ব্যবহারের নিমিত্ত সমতল পথের আবশ্যক। ভাল রাস্তায় দ্বিচক্র ভিলসিপিড আরোহণে ঘন্টায় বার-তের মাইল এবং তিন চাকারগুলিতে ঘন্টায় ১০ মাইল যাইতে পারা যায়। ভিলসিপিড সঞ্চালন এরূপ অল্পআয়াসসাধ্য যে ক্রমাগত পাঁচ ছয় ঘন্টা চলিলেও বিশেষ কষ্ট অনুভব হয় না।’

    এই যানটির উৎপত্তি স্থল হল ফ্রান্স, সময় আনুমানিক ১৮০০সাল। বাই-সাইকেলের পরিচিত রূপে আসার আগে এটি নানা বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে এগোয়। প্যারিস থেকে জার্মানি হয়ে এই যান ইংল্যান্ডে দেখা যায় ১৮৬৫ সালে। প্রথম অবস্থায় চাকাগুলি ছিল কাঠের। পরে এতে লোহার চাকা লাগান হত। তখন এতে আরোহণ মোটেই সুখের ছিল না। সর্বাঙ্গ ঝাঁকিয়ে দিত বলে তখন ইংল্যান্ডে একে বলা হত ‘Bone shaker’। এরপর চাকায় লাগান হত হাওয়া বিহীন সলিড টায়ার। নতুন গাড়ির নাম হল Penny-farthing. পেনি যেমন ফারদিং এর চার গুণ তেমনই এর একটি চাকা অপরটির চারগুণ হত। এরপর ধীরে ধীরে দুটি চাকা সমান করে সাইকেলের বর্তমান রূপটি বাজারে আসে।

    কোলকাতায় সাইকেল আসার সঠিক দিনক্ষণ জানা যায় না। রাধারমণ মিত্র তাঁর ‘কলিকাতা-দর্পণ’এ জানিয়েছেন যে কোলকাতায় প্রথম বাইসাইকেল আসে ১৮৮৯ সালে। তাঁর মতে কোলকাতায় বাইসাইকেলের প্রবর্তক হলেন হেমেন্দ্র মোহন বোস। এইচ বোসের হ্যারিসন রোডে সাইকেলের দোকান ছিল। তিনি বাইসাইকেলকে শহরে জনপ্রিয় করে তোলার জন্য চেষ্টা করতেন। শোনা যায় তিন দিকপাল মানুষ, স্যার জগদীশচন্দ্র বসু, স্যার প্রফুল্লচন্দ্র রায় এবং স্যার নীলরতন সরকার, তাঁরই উদ্যোগে বাইসাইকেল ব্যবহার করতে শেখেন। শ্রী হরিপদ ভৌমিক তাঁর ‘কলির শহর কোলকাতা’ বইয়ে এই তথ্যের সাথে ভিন্নমত পোষণ করেছেন। তাঁর মতে কোলকাতায় সাইকেল এসছে ১৮৮৯ সালের প্রায় কুড়ি বছর আগে এবং আদি প্রবর্তকের সম্মান এইচ বোসের প্রাপ্য নয়। সেটি বর্ধমানের মহারাজার প্রাপ্য। শ্রী ভৌমিক তাঁর বক্তব্যের সমর্থনে সেই সময়ের কিছু সংবাদকে মেলে ধরেছেন।

    ১৮৭১ সালের জুলাই মাসের ‘সুলভ সমাচার’ পত্রিকায় এই সংক্রান্ত একটি খবর ছাপা হয় — “বছর দুই হইল, কলকাতায় দুই চাকার এবং তিন চাকার এক রকম গাড়ি আসিয়াছে, যাহার উপর চড়িয়া পা নাড়াইলেই গাড়ির মত দৌড়ায়।”

    ১৮৬৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি অমৃত বাজার পত্রিকায় এই সংক্রান্ত একটি খবর প্রকাশিত হয় – “এই যন্ত্রটি নিতান্ত নূতন নহে, এক বৎসরের অধিক হইল বর্ধমানের মহারাজ ঐরূপ তিন চাকার ভিলিসিপিড একটি আনাইয়াছেন, এখনও সেটি আছে কিনা বলিতে পারি না।”

    উপরিউক্ত খবরে জানতে পারছি যে বর্ধমান মহারাজার যানটি ছিল ভেলোসিপিড। শ্রী ভৌমিক লিখেছেন যে ভেলোসিপিড থেকে রূপান্তরিত হয়ে আধুনিক বাইসাইকেল আসতে অনেকটা সময় লেগেছিল। আমার অনুমান শ্রী রাধারমণ মিত্র সাইকেলের রূপান্তরিত আধুনিক রূপটির কোলকাতায় আগমনের সময়ের কথা জানিয়েছেন।

    প্রথমদিকে অধিকাংশ সাইকেলের দোকান ছিল ধর্মতলা স্ট্রিটে। পরবর্তী কালে সাইকেল এবং তার যন্ত্রাংশের প্রধান আড়ৎ হয়ে ওঠে বেন্টিংক স্ট্রিট। ধর্মতলা স্ট্রিটে হরিদাস নন্দী ছিলেন প্রথম বাঙালি সাইকেল বিক্রেতা। সাইকেলকে কেন্দ্র করে সেই সময় কোলকাতায় অনেক সাইকেল ক্লাব গড়ে উঠেছিল। সাইকেল হয়ে উঠল বহু মানুষের নিত্যদিনের যাতায়াতের সঙ্গী।

    এবার আসা যাক কোলকাতার হাতে টানা রিকশর কাহিনীতে। দোমিনিক লাপিয়েরের ‘সিটি অফ জয়’এর দৌলতে কোলকাতার হাসারি পালদের হাতে টানা এই যানটির কথা বিশ্বের সর্বত্র ছড়িয়ে গেছে। কোলকাতা শহরে হাজার হাজার মানুষের জীবিকা এই টানা রিকশ। আগের থেকে সংখ্যা কিছুটা কমলেও, ভারতের প্রথম পাতাল রেলের শহরে এখনও এটা সারা শহরে ছেয়ে আছে। কোলকাতা এই যানটির ধারক ও বাহক হলেও এটি উদ্ভাবিত হয়েছিল জাপানে। সালটা ছিল ১৮৬৯। জাপানে একে বলা হত ‘জিন-রিকি-শ’। জিন এর অর্থ মানুষ, রিকি অর্থ শক্তি এবং শ অর্থ যান। এককথায়, ‘মানুষ টানা গাড়ি’। ১৮৭৪ সালে চীনে এর ব্যবহার শুরু হয়। আগের মানুষবাহিত যানে(পালকি) একাধিক লোকের প্রয়োজন হত, রিকশ একজনেই টানতে পারে। ধীরে ধীরে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়াতেও এর প্রচলন হয়। ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে কোলকাতায় চীনা অভিবাসীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। এদের হাত ধরেই আনুমানিক ১৯০০ সাল নাগাদ কোলকাতায় রিকশর যাত্রা শুরু হয়। ভারতের সিমলায় অবশ্য রিকশ এসেছে ১৮৮০ সালে। বহু মানুষকে রুজিরুটি যোগাতে সক্ষম এই সস্তার যানটি অচিরেই চীনা গণ্ডী পেরিয়ে সমগ্র কোলকাতায় ছড়িয়ে যায়। ১৯১৯ সালে Hackney Carriage Act পাশ হওয়ার পর রিকশ সরকারি স্বীকৃতি পেয়ে যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে এশিয়ায় উপনিবেশবাদ হ্রাস পাওয়ার সাথে সাথে ব্রিটিশ উপনিবেশগুলিতে হাতে টানা রিকশর প্রচলন ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যায়। চীনের কমিউনিস্ট সরকার ১৯৪৯ সালে এই যানকে নিষিদ্ধ করে। অন্যত্র বন্ধ হয়ে গেলেও আর্থসামাজিক কিছু কারণে কোলকাতায় রিকশ রয়ে গেছে। রিকশ ইউনিয়ানের ২০১৯ এর তথ্য অনুযায়ী শহরে অনুমতিপ্রাপ্ত আনুমানিক ৫০০০ এবং অনুমতিহীন আনুমানিক ১৪০০০ রিকশ চলে। রিকশ চালকেরা প্রায় সকলেই অত্যন্ত গরিব। অধিকাংশ চালকই রিকশর মালিক নয়। সর্দারদের থেকে নিয়ে চালায়, বিনিময়ে দৈনিক ভাড়া দিতে হয়। ভাড়া দেওয়ার পর যা অবশিষ্ট থাকে তাতে কোনমতে সংসার চলে, সঞ্চয় কিছুই থাকে না। চালকেরা মূলত বিহার থেকে আগত। ২০০৬ সালে শহরে রিকশ চলাচল বন্ধ করার উদ্দেশ্যে রাজ্য সরকার Calcutta Hackney-Carriage (Amendment) Bill পাশ করে। কিন্তু নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে তা বাস্তবায়িত হয়নি। তাই আজও শহরের রাস্তায় কাঁধে গামছা নিয়ে টুং টুং করে ঘন্টা বাজাতে বাজাতে শয়ে শয়ে ঘর্মাক্ত হাসারি পালদের রুজি রুটির সন্ধানে ঘুরতে দেখা যায়।

    মোটর গাড়ি আসার পর শহরে যান চলাচলের চিত্রটাই সম্পূর্ণ পালটে গেল। কোলকাতায় প্রথম মোটর গাড়ি আসার সময় নিয়ে ভিন্নমত আছে। রাধারমণ মিত্রের ‘কলিকাতা দর্পণ’ এ সময়টি লেখা আছে ১৮৯৬ সাল। যদিও সমর্থনে কোন সূত্রের উল্লেখ নেই। সমসাময়িক পত্র পত্রিকায় ১৮৯৯ সালের আগে মোটর গাড়ির কোন উল্লেখ নেই। ১৮৯৯ সালের ‘ইন্ডিয়ান অ্যান্ড ইস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ার’ পত্রিকার ফেব্রুয়ারি সংখ্যায় প্রথম মোটর গাড়ির সম্বন্ধে নিম্নলিখিত বিবৃতিটি প্রকাশিত হয়—Automotor is now gradually making their appearance felt in some of the cities in India. Not that the machines in use here have proved themselves entirely superior of their types at home and their failing: for the spectacle of a motely crowd of cyces, chaprasis etc, pushing behind a car along Clive Street, Calcutta was evidence of the fact that they are only--we had almost written human, but should say-motor.

    ওই সময় ফটোগ্রাফিক সোসাইটি অফ ইন্ডিয়ার জার্নালেও মোটর গাড়ি সংক্রান্ত খবর প্রকাশিত হয়। ১৯৫৯ সালে ডানলপ কোম্পানি তাদের হীরক জয়ন্তী উপলক্ষে ‘সিক্সটি ইয়ারস অফ মোটর ট্রান্সপোর্ট ইন ইন্ডিয়া’ নামে একটি তথ্যবহুল বই প্রকাশ করে। বইটিতে ১৮৯৮ সালে কোলকাতায় প্রথম মোটর গাড়ি আসে বলে অনুমান করা হয়েছে। বইটির তথ্য অনুসারে ওই সালে বম্বেতে চারটি মোটর গাড়ি এসেছিল। তিনটি ছিল ওল্ড সমোবিল। যেগুলির মালিক ছিলেন জামসেদজি টাটা, রুস্তম কামা এবং কাওয়াসজি ওয়াদিয়া। একটি কিনেছিলেন মিঃ প্যাক, যার মডেলের কোন উল্লেখ নেই। প্রায় একই সময়ে কোলকাতায় অবার্ট নামে এক ব্যক্তি একটি ‘সার্পলেট স্টিম কার’ এবং এইচ এইচ রেনল্ডস একটি ফরাসি প্যুজো (Peugeot) কিনেছিলেন। ‘দা এম্প্রেস’ পত্রিকার ১৯০৪ সালের সেপ্টেম্বর সংখ্যাতেও রেনল্ডসকেই কোলকাতার প্রথম মোটর কার মালিক হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বাঙালিদের মধ্যে প্রথম মোটর গাড়ি কেনেন সি বসাক।

    মোটর গাড়ি বলতে আমরা সাধারণভাবে পেট্রোল চালিত গাড়িকেই বুঝি। উপরোক্ত সকল তথ্যই পেট্রোল চালিত গাড়ির। একটু বিস্তৃত দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে যে কোন যন্ত্রচালিত গাড়িই মোটর গাড়ি, একটু অন্যভাবে বললে, কলের গাড়ি। এই কলের গাড়ি কিন্তু কোলকাতার রাস্তায় ১৮৬৫ সালেই দেখা গিয়েছে। ওই বছরের ডিসেম্বরের ‘বেঙ্গলি’ দৈনিক পত্রে টি ই টমসন অ্যান্ড কোম্পানির নিম্নলিখিত বিজ্ঞাপনটি প্রকাশিত হয়—
    ROAD STEAM-CARRIAGE
    Capable of running upon ordinary roads at a speed from 10-12 maile per hour; carrying five persons, with its own Engineer, coals and water….

    বাস্প চালিত গাড়িই কোলকাতার আদি মোটর গাড়ি। কোলকাতায় পেট্রোল গাড়ির প্রথম বিক্রেতা ছিল, জাম্বোন অ্যান্ড কোম্পানি। তারা অবশ্য পেট্রোল ছাড়া অন্য গাড়িও বিক্রি করত। এরপর আসে ‘দা মোটর ট্রান্সপোর্ট অ্যান্ড সাপ্লাই কোম্পানি’। এই কোম্পানিটি এই অঞ্চলে ‘লোকোমোবাইল’এর একমাত্র এজেন্ট ছিল। তাদের বিক্রীত গাড়ির মডেল এবং তার মুল্য ছিল নিম্নরূপ—
    ছ’জন যাত্রীবাহী ওয়াগনেট (১২ হর্স পাওয়ার) ৯০০০ টাকা
    একই গাড়ি - চারজন যাত্রীবাহী ৫৭৫০ টাকা
    ওই গাড়ি - সেকেন্ড হ্যান্ড ৪৫০০ টাকা
    লোকো-সারে — সেকেন্ড হ্যান্ড ২৮০০ টাকা

    গাড়ি চালাতে শেখান এবং পেট্রোল গাড়ি হলে তার জ্বলানি সরবরাহ করা ছিল বিক্রয় পরবর্তী পরিষেবার অবশ্যিক শর্ত। ১৯০৪ সালে গ্যালন প্রতি পেট্রোলের দাম ছিল ১ টাকা। মোটর গাড়ি ব্যবসায় প্রথম নামী বাঙালি প্রতিষ্ঠান হল হেমেন্দ্রমোহন বসুর ‘গ্রেট ইস্টার্ন মোটর কোম্পানি’। ৪৪ নং পার্ক স্ট্রিটে ছিল তাদের শোরুম। তারা গাড়ি মেরামতির কাজও করত। সেই সময় কোলকাতায় পেট্রোল জোগাড় করা বেশ কষ্টকর ব্যাপার ছিল। সেই কারণে অনেক স্টিম কার আমদানি করা হত। কোলকাতার ‘মোটর ট্রান্সপোর্ট কোম্পানি’ ডেমলার, উলসলি, নেপিয়ার, গ্লেডিয়েটর এর মত গাড়ি আমদানি করত। এ ছাড়াও তারা সস্তার পেট্রোল গাড়িও বিক্রি করত।

    ছয় হর্স পাওয়ারের দুজন যাত্রীবাহী ‘স্পিডওয়েল’ (দু টাকা চার আনার পেট্রোলে ১০০ মাইল চলবে) এবং দুজন যাত্রীবাহী পাঁচ হর্স পাওয়ারের ‘বিস্টন হাম্বারেট’, ১৯০৪ সালে উভয়েরই দাম ছিল তিন হাজার টাকা।
    ১৯০৪ সালে কোলকাতায় প্রথম পেট্রোলের ডিপো খোলা হয়—
    Petrol: Suitable for motor cars can be obtained ex. the Port Commissioners Depot at Moyapur at a cost of 12 As/gallon.
    Apply to MACNEILL & CO., Agents ASSAM OIL CO. LTD.

    ভারতে প্রথম মোটরগাড়ি নির্মাতা ছিলেন একজন বাঙালি, শ্রী বিপিন বিহারী দাস। বালিগঞ্জ ফাঁড়ির কাছে তাঁর একটা ছোট গ্যারেজ ছিল। তিনি তিন চারটি মোটর গাড়ি তৈরি করেন। তাঁর প্রথম গাড়ি তৈরি হয় ১৯৩১ সালে। গাড়িটি কিনেছিল বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটি। সেই গাড়ি ব্যবহার করতেন, মোতিলাল নেহেরু এবং মদন মোহন মালব্য। ১৯৩৩ সালে নির্মিত তাঁর দ্বিতীয় গাড়িটি কেনে কোলকাতা কর্পোরেশন। রেজিস্ট্রেশনের পর গাড়ির নম্বর হয় ৩৫৯৭৭। শোনা যায় গোয়ালিয়র রাজ্যের জন্যও তিনি একটি গাড়ি বানিয়েছিলেন। কর্পোরেশনের সেই সময়ের বাঙালি কাউন্সিলররা যথাসাধ্য সমালোচনা করে গেছেন বিপিন বিহারীর কাজের। কেবল মেয়র সন্তোষ কুমার বসু, ডি পি খৈতান এবং মোটর ভেহিকল সুপারিন্টেন্ডেন্ট জে সি গুপ্ত তাঁর সমর্থনে ছিলেন। ১৯৩৮ সালে মাত্র পঞ্চান্ন বছর বয়সে অবহেলা আর অনাদরকে সঙ্গী করে বিপিন বিহারী ইহলোক ত্যাগ করেন।

    গাড়িতে ইলেকট্রিক হর্ন সংযুক্ত হয় ১৯১১ সালে। হেমেন্দ্রমোহনের লেখায় জানা যায়, তখন ইলেকট্রিক হর্নের দাম ছিল ৪৫ টাকা। গাড়ির দামের অনুপাতে হর্নের দাম বেশি থাকায় সেই সময় এর ব্যবহার খুব কম ছিল।

    এ তো হল সেইসব গাড়ির কথা, যা ছিল বিত্তবান বাবুদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি। এবার আসি সাধারণ মানুষের যাতায়াতের জন্য যে সব মোটর গাড়ি রাস্তায় চলত, সেগুলির কথায়।

    কোলকাতায় প্রথম ট্যাক্সি পরিষেবা শুরু হয় ১৯০৬-১৯০৭ সালে। চৌরঙ্গি রোডে ফ্রেঞ্চ মোটরকার কোম্পনির অফিসের সামনে থেকে মিটার ট্যাক্সি ছাড়ত। ইন্ডিয়ান মোটর ট্যাক্সি ক্যাব অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি বা ‘A’ কোম্পানির ট্যাক্সির তখন খুব নাম ছিল। এই কোম্পানির ৮০-৯০ টা ট্যাক্সির সবকটিরই নম্বর শুরু হত A দিয়ে। কেবল কোলকাতাতেই নয়, এইসব ট্যাক্সি দমদম, ব্যারাকপুর, বজবজ, প্রভৃতি মফঃস্বল শহরেও যাতায়াত করত। এই কোম্পানির গ্যারেজ ছিল মালেন স্ট্রিটে। ফরাসি শেভিজাঁ কোম্পানিও প্রথমদিকে বেশ কিছু ট্যাক্সি রাস্তায় নামায়। দুই সিলিন্ডারের ছোট ‘Charron’ গাড়িতে দুজন আরোহী যেতে পারত। গাড়ির রং ছিল লাল। ওল্ডস মোবাইল, শেভ্রোলে,ওভারল্যান্ড ইত্যাদি নানা ধরণের গাড়ি ট্যাক্সি হিসাবে চলত। ট্যাক্সি ড্রাইভার প্রথম দিকে বাঙালি ছিল, পরে তা শিখদের একচেটিয়া অধিকার হয়ে যায়। ইদানীং অবশ্য সে চিত্রও পালটে গেছে। বিংশ শতাব্দীর চারের দশকে ট্যাক্সি ভাড়া ছিল, মাইল প্রতি আট আনা, আর প্রতি সিকি মাইলের জন্য দিতে হত দু’আনা। অপেক্ষা করালে, এক ঘন্টার জন্য দিতে হত এক টাকা চোদ্দ আনা, বা প্রতি চার মিনিটের জন্য দু আনা। ১৯৫৭ সালে হিন্দুস্তান মোটর কোম্পানি, British Morris Oxford III র আদলে তৈরি করল অ্যাম্বাসাডার গাড়ি। ১৯৬২ সালে ট্যাক্সির জন্য বেছে নেওয়া হল, অধিক যাত্রী এবং মাল বহনে সক্ষম এই নতুন গাড়িকে। মালিকও খুশি, যাত্রীরাও খুশি। সেই থেকে এই হলুদ ট্যাক্সি হয়ে গিয়েছে শহরের আইকন।

    ট্যাক্সির ভাড়া ট্রামের থেকে অনেকটাই বেশি পড়ে যেত। খুব প্রয়োজন ছাড়া সাধারণ মানুষ সচরাচর ট্যাক্সি ব্যবহার করত না। নিত্যযাত্রীদের সংখ্যা নিত্য বাড়তে থাকায় কেবলমাত্র ট্রামে সামাল দেওয়া যাচ্ছিল না। প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল নতুন কিছু পরিবহণ পরিষেবার, যা মধ্যবিত্তের নাগালের মধ্যে থাকবে। পৃথিবীর অন্যান্য বড় বড় শহরের মত আমাদের শহরের রাস্তায় এল মোটর বাস। বাস অবশ্য কোলকাতায় প্রথম চলে ১৮৩০ সালে। ঐ বাস টানত তিনটি ঘোড়ায়। এসপ্ল্যানেড থেকে ব্যারাকপুর পর্যন্ত যাত্রী নিয়ে যাতায়াত করত ওই বাস। নামে বাস বলা হলেও ওটি ছিল বড় ধরণের ঘোড়ার গাড়ি। ওই বাস বেশিদিন চলেনি। ওয়ালফোর্ড কোম্পানির উদ্যোগে কোলকাতায় মোটর বাস পরিষেবা শুরু হয় ১৯২২ সালে। কিছু সময়ের মধ্যে ট্রাম কোম্পানিও বেশ কিছু বাস রাস্তায় নামায়। ট্রাম কোম্পানির বাসের ছিল লেল্যান্ডের ইঞ্জিন। ১৯২৬ সালে ওয়ালফোর্ড কোম্পানিই দোতলা বাস শহরে আনে। সেই সময়ের দোতলা বাসের মাথায় ঢাকা থাকত না। প্রথম বাসটি ছিল একটি এ.ই.সি গাড়ি, নম্বর - এম বি ৪২। ছাপান্ন জন যাত্রী পরিবহণের ব্যবস্থা ছিল সেই বাসের। ওয়ালফোর্ড কোম্পানির বাস শ্যামবাজার থেকে কলেজ স্ট্রিট, বৌবাজার, ডালহৌসি হয়ে কালীঘাট পর্যন্ত চলত। ট্রাম কোম্পানির বাস শ্যামবাজার থেকে আলমবাজার, এবং বেলেঘাটা রাসমণি বাজার থেকে ডালহৌসি স্কোয়ার পর্যন্ত চলাচল করত। ১৯২৪ সালে মোট বাসের সংখ্যা ছিল পঞ্চাশের কিছু বেশি। এক বছরের মধ্যেই তা আড়াইশ ছাড়িয়ে গেল। আবদুস সোভান নামে এক ব্যক্তির উদ্যোগে কোলকাতা থেকে শহরতলিতে বাস চলাচল শুরু হয়। ১৯৪৮ সালে গঠিত হল State Transport Services। তারপরেই কোলকাতায় প্রথম সরকারি বাস চলাচল শুরু হয়। বাসের গায়ে প্রতিষ্ঠানের প্রতীক, বাঘের মাথার ছবি থাকত। ১৫ জুন ১৯৬০এ State Transport Services এর নাম পরিবর্তন করে রাখা হল, Calcutta State Transport Corporation (CSTC)। সর্বশেষ নাম হয়েছে, West Bengal Transport Corporation। ৬টি রুটে ২৫টি বাস নিয়ে এর যাত্রা শুরু হয়। এরপর বিভিন্ন সময়ে নানা রকম বাস রাস্তায় দেখা গেল। ১৯৪৯-৫০ সালে রাস্তায় নামল দুটি দোতলা বাস। পরবর্তীকালে অনেকগুলি রুটেই দোতলা বাস চলত। অনেকদিন চলেছে কিন্তু এখন তা অতীত। এরপর এল, কম স্টপেজের ডিলাক্স যা পরবর্তীকালে হল স্পেশাল বাস। এল, ‘ই’ বাস ও বাতানুকুল বাস। বাস অনুযায়ী ভাড়া কিছুটা করে বেশি। ১৯৬৮ সালে চালু হয় দূরপাল্লার কোলকাতা-দিঘা বাস পরিষেবা। এখন সরকারি এবং বেসরকারি বাস বাংলা তো বটেই, বাংলার বাইরেও দূর দূরান্তে নিত্য যাতায়াত করে।

    কোলকাতার এই বিপুল যাত্রীর চাপ কেবলমাত্র সরকারি বাসের দ্বারা সামলান সম্ভব নয়। তাই একসময় বন্ধ করে দেওয়া বেশ কিছু রুটের বেসরকারি বাসকে পুনরায় চালানর অনুমতি দেওয়া হয়। সময়ের সাথে সাথে বেসরকারি বাসের অবয়বে এসেছে নানা পরিবর্তন। এসেছে মিনি, মিডির মত নতুন আঙ্গিকের অনেক বাস। সংখ্যাও বেড়েছে উল্লেখযোগ্য ভাবে।

    কোলকাতার রাস্তায় মোটর চালিত গাড়ি কেবল যে যাত্রী পরিবহণে অন্য মাত্রা যোগ করেছিল তাই নয়, পণ্য পরিবহণের ক্ষেত্রেও নূতন দিগন্ত উন্মচিত করেছিল। লরি, ট্রাক, স্টেশন ওয়াগন, টেম্পো ইত্যাদি নানা আকৃতি এবং আয়তনের পণ্যবাহী যানের আবির্ভাবের ফলে পালটে গিয়েছিল শহরের পণ্য পরিবহণের সামগ্রিক চেহারা।

    যানবাহনের বিবর্তনের প্রতিটি স্তরেই এসেছে কিছু পরিবর্তন, যার অনেকটাই গতি কেন্দ্রিক। পেশি শক্তির স্থলে যান্ত্রিক শক্তির আগমন, সেই গতিকেই আরো ত্বরান্বিত করেছিল। যত দিন গেছে শহরে নতুন নতুন গতিশীল যানবাহন এসেছে, তবু যাতায়াতের দুর্গতি মেটেনি। কারণ, যানবাহনের সাথে টেক্কা দিয়ে বেড়েছে শহরে যাতায়াত করা মানুষ। এছাড়া রাস্তার অনুপাতে গাড়ি বেশি হয়ে যাওয়ায় বেড়েছে যানজট। পাতাল রেল এবং সার্কুলার রেল, প্রথম দিকে কিছুটা স্বস্তি দিয়েছিল। আজ সেখানেও রীতিমত যুদ্ধ করে উঠতে হয়। যানবাহনে ব্যাপক পরিবর্তন এবং পরিবর্ধনের পরেও শহরে নিত্যযাত্রীদের দুর্ভোগ আজও রয়ে গেছে। আগামী দিনে আরো উন্নত কিছু প্রকল্প এই ক্লেশ থেকে মুক্তি দিতে পারবে কিনা তা ভবিষ্যতই বলবে।

    তথ্যসূত্রঃ
    কলিকাতা দর্পণ - রাধারমণ মিত্র,
    কলির শহর কলকাতা - হরিপদ ভৌমিক,
    কলের শহর কলকাতা - সিদ্ধার্থ ঘোষ,
    The Last Ride - A tribute to good old Ambassador - Premankur Biswas — The Indian Express,
    পালকি থেকে পাতাল রেল - সন্তোষ চট্টোপাধ্যায়
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • প্রবন্ধ | ০৩ আগস্ট ২০২৪ | ২৫৪ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভেবেচিন্তে মতামত দিন