একটি অভ্যুত্থানের পিছনে কত বিস্তৃত পরিকল্পনা থাকতে পারে তা মহর্ষি গর্গের এই কান্ড সম্পর্কে না জানলে সত্যি বোঝা সম্ভব না। মহর্ষি গর্গ কণাদপন্থী। পরমাণুবাদী দার্শনিক। বিশ্ব পরমাণু দ্বারা গঠিত এবং বিশ্বের স্রষ্টা কোনো চেতন অস্তিত্ত্ব নয়, এই ছিল তাঁদের মতবাদ। তর্কের শাখার মধ্যে এটিও একটি জোরালো শাখা ছিল। কণাদ, এই শাখার উদ্গাতা, এককালে অন্নব্রহ্মবাদী ছিলেন বলেই শ্রুতি ছিল। তিনি একদিন অন্নগ্রহণের সময় দেখলেন যে অন্ন থেকে ক্ষুদ্রাংশ তিনি ফেলে দিচ্ছেন এবং সেই ক্ষুদ্রাংশকে আর ভাগ করা যাচ্ছেনা মনে মনে। তখন তাঁর মনে হয় তাহলে ব্রহ্মান্ডও এমন কণা-সমূহ দ্বারা গঠিত যাতে এমন অবিভাজ্য কণা রয়েছে। আর সেই কণা প্রতিটি পদার্থে রয়েছে সীমিত পরিমাণেই। একটি তর্কের থেকেই এই ভাবনার উৎপত্তি হয়েছে। ধরা যাক, একটি পাথরের মধ্যেও রয়েছে অনন্ত সংখ্যক পরমাণু এবং হিমালয় পর্বতেও রয়েছে তাই। তাহলে কি হবে? কারণ পাথরের মধ্যেকার পরমাণু দিয়ে তাহলে হিমালয় তৈরী করে ফেলা যাবে, যা অসম্ভব। সুতরাং কণাদবাদীরা মনে করতেন এই পরিমাণ অবশ্যই সীমিত।
এর সঙ্গেই ছিল আরেকটি প্রশ্ন। সেই প্রশ্নের অভিমূখ ছিল স্রষ্টার দিকেই। এর স্রষ্টা কে? কণাদের বৈশেষিক দর্শনের ভাবনা ছিল পরমাণু অবিভাজ্য এবং সে অক্ষয়ও। এ চিরকাল আছে। এবং যাকে আর ভাগ করা আয়ত্ত্বের বাইরে তাকে সৃষ্টি কে করবে? কাজেই এর স্রষ্টার প্রশ্ন থাকতে পারেনা। মহর্ষি গর্গের সময়ে এই ধারণার পরিবর্তন ঘটতে শুরু করেছিল। প্রাথমিক বৈশেষিকরা যেমন নিজেদের প্রত্যক্ষ এবং অনুমানের উপরেই শুধু নির্ভর ছিলেন তেমন আর থাকা গেল না। বিশ্ব পঞ্চভূতের অবদান। এই পঞ্চভূত হল পৃত্থ্বী, ব্যোম, তেজ, অপ, আকাশ। এই ছিল কণাদের ভাবনা। সঙ্গে কালে কালে যুক্ত হয়েছিল স্থান, কাল। কিন্তু এই ভাবনাকে রক্ষা করা অসম্ভব হয়ে পড়ছিল, যাজ্ঞ্যবল্কবাদীদের এবং অন্যান্য বেদবাদীদের আক্রমণের মুখে। পরমাণু অচেতন। সে নিজের ইচ্ছায় বস্তু সৃষ্টি করতে পারে না। তাহলে বস্তু সৃষ্টির চেতন সৃষ্টি করে কে? তাহলে বিশ্বে চেতনের স্রষ্টা কে? এই প্রশ্নের উত্তরে ব্রহ্মবাদীদের ছিল পরমব্রহ্ম। পরমাণুবাদী বৈশেষিকদের হাতে ছিল না এর উত্তর। তাঁরা পদার্থের দ্রব্য, গুণ, কর্ম, সমন্বয় (সাধারণ অবস্থা), বিশেষ (বিশেষ অবস্থা), সমবায় (কণাদ একে কার্য-কারণ সম্পর্ক হিসেবেই ধরেছিলেন) নিয়ে কাজ করতেন। কিন্তু পদার্থর স্রষ্টা কে, এই প্রশ্ন তাঁদের একাংশকে ক্রমশ দুর্বল করে দিল। আসলে কণাদবাদকে রক্ষা করতে গিয়ে মহর্ষি গর্গও দেখেছেন যে সমস্যা হচ্ছে এই ভাবনাটির প্রত্যক্ষ প্রমাণ অনুপস্থিত। এটি শুধুমাত্র তর্কের ক্ষেত্রেই প্রমাণিত হচ্ছে, অন্যান্য ক্ষেত্রে না। সেখানেই বিরোধ এল। গর্গের সময়েই একদল ন্যায়ের সঙ্গে এর মৈত্রী গড়ে তুললেন। তাঁরা বললেন এর সৃষ্টিতে আছে সর্বময়ের ইচ্ছা। তাঁরা পদার্থের সকল গুণের সঙ্গে যুক্ত করলেন অভাব (অনস্তিত্ত্ব)-কে। তার ফলে পদার্থ গঠনের উপাদান হিসেবে এল আত্মা এবং মন।
গর্গ চোখের সামনে দেখলেন ক্রমশ ক্রমশ তাঁর অধীত কণাদবাদ যা বৈশেষিক নামে পরিচিত তা চলে যাচ্ছে ন্যায়বাদীদের কব্জায়। আত্মা,মন ইত্যাকার বুদ্ধিজাত অ-পদার্থ এসে বেদের মতই একেও ক্রমশ ঈশ্বর মুখাপেক্ষী করে তুলছে। যাঁরা একে মেনে নিচ্ছেন তাঁরা সকলেই ধনাঢ্য হয়ে উঠছেন কংসের কল্যাণে। আর যাঁরা বিরোধ করছেন তাঁরা কংসের রাজত্বে চিহ্নিত হচ্ছেন উপদ্রবকারী হিসেবে। আশ্রম ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে রাতের অন্ধকারে। মথুরা এবং সংলগ্ন অঞ্চলের লোকেরাই প্রধানত দ্বারকাবাসী কণাদকে পিছে ফেলে দিচ্ছেন তাঁরই মতবাদে। গর্গ তখন শিক্ষান্তে আশ্রম করেছেন একটি। সেই আশ্রমে তিনি একটি পাঠ পড়াতেন কণাদের রাবণভাষ্যের। কথিত, লঙ্কারাজ রাবণ, এই ভাষ্য রচনা করেছিলেন কণাদের বৈশেষিকের। একরাত্রে তাঁর আশ্রমও আক্রান্ত হল। কংসের লোকেরা জানিয়ে গেল এই পাঠ পড়ানো যাবেনা। এর আগে তিনি কংসের অত্যাচার সম্বন্ধে অবহিত ছিলেন, কিন্তু প্রত্যক্ষভাবে তার ফল ভোগ করেননি। এবারে করলেন! সেই রাত্রেই আশ্রম ছাড়েন গর্গ। কণাদ তাঁর সর্বার্থে গুরু। তাঁর মতবাদ যেখানে আক্রান্ত সেখানে কোনো কিছুই নিরাপদ না। কংস এবং বেদপন্থীরা জোট বেঁধেছে। ন্যায়, সাংখ্যের লোকেরাও আছে সেখানে।
কংস নিজে বেদাচারী না। তার শ্বশুর জরাসন্ধ তার বেদাচারী হওয়াকে সমর্থন করবে না। কিন্তু বেদবাদীদের বিরোধের অজুহাতে একে একে বিরোধী মতবাদ দমনের কাজে সে অত্যন্ত সক্রিয়। অভিযোগ ছিল বেদাচারীদের আক্রমণের উদ্দেশ্যে আশ্রমে অস্ত্র-শস্ত্রাদি জমিয়ে রাখছে বৈশেষিক পন্থীরা। এবং গর্গ তাঁদের অন্যতম। আসলে মহর্ষি গর্গকে তর্কযুদ্ধে পরাস্ত করার মত কেউই ছিল না অঞ্চলে। তিনি বেদবাদীদের জন্য কঠিন প্রশ্ন রেখেছিলেন, যার উত্তর তাদের কাছে ছিল না। তিনি জানতে চেয়েছিলেন যদি ঈশ্বর সর্বগুণনিরপেক্ষ হন তাহলে তাঁর সৃষ্টিতে বিবিধ গুণ এবং দোষ আসে কেন? যদি ঈশ্বর শুধুমাত্র সৎ হয়ে থাকেন তাহলে অসৎ আসে কোথা থেকে? যদি ঈশ্বর ভাল ছাড়া অন্য কোনো গুণের অধিকারী না হয়ে থাকেন বা সৃষ্টির ভাল করাই তাঁর কাজ হয়ে থাকে তাহলে সৃষ্টিতে কেন মন্দ জোটে কারোর? জন্মান্তরের কর্মও তো শুরু হয়েছে কোথাও! সেই শুরুতেই বা তাহলে মন্দ এসেছিল কেন? স্রষ্টা যদি নাই চাইতেন মন্দকে তাহলে সৃষ্টি মন্দ করে কি করে? যদি করে তাহলে কি স্রষ্টার সৃষ্টির উপরে অধিকার নেই? নানান এমন প্রশ্নে জেরবার হয়ে যেত বেদবাদী ব্রহ্মবাদীরা তর্কসভায়।
ন্যায়ের লোকেরাও ছাড় পেত না। শব্দকে প্রমাণ হিসেবে ধরে নেওয়াটাকেই প্রশ্ন করতেন গর্গ। কেন মানা হবে একে প্রমাণ হিসেবে? প্রাচীন যে সঠিক তা কিভাবে মানা যাবে, যখন পৃথিবীর সকল পরিবর্তনের অধীন? এত গায়ের জোরে মানানো হচ্ছে। যেমন নাকি যাজ্ঞ্যবল্ক গার্গীকে থামিয়ে দিয়েছিলেন অতিপ্রশ্নের কথা বলে তেমন তাঁকে থামানো যায় নি। গর্গ ছিলেন যথেষ্ট শক্তিশালী পুরুষ। খ্যাতি ছিল তাঁর শস্ত্র চালনাতেও। তিনি নিজেই হেসে বলতেন যাজ্ঞ্যবল্ক তাঁকে এভাবে ভয় দেখালে তিনি বুঝে নিতেন তার ক্ষমতা। সাংখ্যবাদীরাও কপিলের যে বিকৃতি ঘটিয়েছিল তাকেও ছাড়েননি তিনি। প্রকৃতিই যদি ক্রিয়াশীল হয় তাহলে পুরুষের কি প্রয়োজন? আর পুরুষ সেখানে প্রধান হবে কেন? তাছাড়াও কেনই বা নিরীশ্বরবাদীর ঈশ্বর লাগবে? এভাবে ক্রমশ তাঁর শত্রু বেড়েছে। তর্কসভায় পরাস্ত হতে হতে শিষ্য কমেছে অন্যান্য শাখার লোকদের। তিনি আরো অপ্রিয় হয়েছেন। সেই সব শোধ উঠিয়েছে তারা কংসকে দিয়েই। আর কংসও তার শাসনের পাশে অনুগত মুনি, ঋষি, বিদ্বান জড় করার অভিলাষে আক্রমণ করেছে গর্গকে এবং কণাদপন্থীদের। অনেকেই সন্ধি করে নিয়েছে। গর্গ করলেন না।
সেই শুরু। তারপরে দীর্ঘ্য সময় গর্গ ভ্রমণ করেছেন মথুরা রাজ্যের প্রতিটি অংশ। যাদবদের রাজনীতি কেন্দ্রীভূত ছিল গণসভার অস্তিত্বের মধ্যে। সেই অস্তিত্বকে যখন কংস উপড়ে ফেলে দিল, রাজা উগ্রসেনকে বন্দী করলো, বন্দী করলো নিজ ভগিনী দেবকী এবং বান্ধব বসুদেবকে তখন মথুরা নগরে কোনো বিরোধী কেন্দ্র রইলো না। কংস ভেবেছিল বসুদেব তাকে সমর্থন করবে। কিন্তু তা না হওয়ায় সে ক্ষিপ্ত হয়। এই সূত্রটা ধরলেন গর্গ। বসুদেবের মিত্রতা ছিল গোপেদের সঙ্গেও। সে বৈষ্ণবদের ‘বাসুদেব’ হতে চলেছে তখন এবং গোপেরা মূলত বৈষ্ণব। তাছাড়া সে স্বভাব বশতই মিষ্টভাষী। শ্বশুর উগ্রসেন রাজা থাকাকালীন গোপেদের রাজনৈতিক এবং অন্যান্য সুযোগ সুবিধার প্রতিনিধিত্ব সেই করতো মথুরাপুরে। প্রথমে গর্গ গোপেদের মধ্যে নিজের অবস্থান শক্ত করলেন। কণাদের পরমাণুবাদ ছাড়লেন। নিজেকে রূপান্তরিত করলেন বৈষ্ণবে। একমাত্র ধর্মই সমাজকে চালনাকারী রাজশক্তির সমকক্ষ হতে পারে। আর সেই ধর্ম বেদ, ন্যায়, সাংখ্য এ সব দিয়ে চললে হবে না। ধর্মের জনপ্রিয়তা ও শক্তির মূল ভিত্তি যে মানুষ তার কাছে সহজ হতে হবে ধর্মকে। বৈষ্ণব ধর্মের মধ্যে আছে সে বীজ। তাই পরিবর্তিত গর্গ বৈষ্ণব হলেন। তারপরে মথুরাপুরে খুঁজে বের করলেন কংস বিরোধী গণসভ্যদের। দ্বিতীয় কাজে তাঁর সাহায্য করেছেন কদম। যেহেতু কংসের নজর বেশী থাকবে গর্গের উপরে, তাই তিনি রাজধানীতে আসতেন না। আসতো কদম। অক্রুর, পৌল সাত্যকীরা ধীরে ধীরে মেনে নিয়েছেন একমাত্র উপায় অভ্যুত্থান। কিন্তু সামরিক অভ্যুত্থান হওয়া অসম্ভব। কংস নিজের হাতে রেখেছে সৈন্যবাহিনীকে। তাদের প্রতিপালনে সে যথেষ্ট মনোযোগীও। সাধারণ মানুষ সেই বাহিনীর সঙ্গে সমরবিদ্যায় পেরে উঠবে না। তাহলে? রাস্তা ছিল একটাই। কংসের দম্ভকে কাজে লাগানো। ঠিক সেই কাজটাই হয়েছে।
শুনছিলেন ব্যাস। আর মনে মনে প্রণাম জানাচ্ছিলেন মহর্ষি গর্গ-কে। সবচেয়ে আশ্চর্য্যের বিষয়, এর আগে কোনো বিশ্বামিত্র ছাড়া আর কোনো ঋষি এভাবে সমাজবিপ্লবে অংশ নিয়েছেন এমন তাঁর জানা নেই। রাজনীতিতে তাঁদের অংশগ্রহণ আছে অবশ্যই। কিন্তু এভাবে নিজের সাধনা, নিজের পঠন-পাঠন সব শিকেয় তুলে রেখে এভাবে এত দীর্ঘ্যকাল একটি মাত্র রাজাকে কোনো রাজাকে দিয়ে ছাড়া ক্ষমতাচ্যুত করার উদ্দেশ্যে এত দীর্ঘ্য লড়াই কেউ করেননি। এ এক নতুন ব্যাপার তাঁর যুগে। তিনি এত মন দিয়ে বহুকাল পরে কিছু শুনছেন। তাঁকে জানতে হবে এর সংগঠন হয়েছে কেমন করে। এই সংগঠন যদি অমিত শক্তিশালী জরাসন্ধকে, যাকে এই দেবখন্ড বা উত্তরাখন্ডের রাজ-রাজেন্দ্ররাও সমীহ করে চলে, গাঙ্গেয় যাকে উপেক্ষা করেন না, তাকে উপেক্ষা করে তার জামাতাকে ক্ষমতাচ্যুত করাই না শুধু হত্যাও করতে পারে,এমন শক্তির সংগঠন না জানাটা একটা অপরাধই। দুপুর পেরিয়ে গিয়েছে বিকেলে। কদম বলে চলেছেন, তিনি শুনছেন। তিনি শুনবেন। দরকার হলে আজ সারাদিন - সারারাত।