এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ধারাবাহিক

  • মহাভারত সপ্তম পর্ব

    শুদ্ধসত্ব ঘোষ লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | ১৬ জুলাই ২০১১ | ১২৫৯ বার পঠিত
  • -আপনি এবারে বিশ্রাম নিন মাতা!

    সত্যবতী প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারেননি ব্যাস, পুত্র দ্বৈপায়ন একথা তাঁকে বলতে পারে। কী বলছে?

    -অনেককাল এই হস্তিনাপুরকে আপনি সেবা করেছেন। এবারে আপনারও উচিত বিশ্রাম নেওয়া।

    বিভ্রান্তের মত তাকালেন অলকার দিকে। অলকা তাঁর পুরোনো সেবাদাসী। তিনি এই প্রাসাদে বধূ হয়ে আসার পরেই তাঁকে এই দাসী উপহার দিয়েছিলেন মহারাজ শান্তনু। এখান থেকে অনেক অনেক পথ পশ্চিমে গেলে এর দেশ। সে নাকি অনেক মরুভূমি, পাহাড়, সমুদ্র পেরিয়ে যেতে হয়। গান্ধার দেশ থেকে হস্তিনাপুরের ব্যবসায়ী সুধন্য কিনে এনেছিল একে। গান্ধার দেশে এই ধরণের যবন-যবনীর কেনা-বেচা চলে। দেশের অভ্যন্তরে এদের পাওয়া যায় না। পাওয়া গেলেও অনেক দাম দিতে হয়। দাসের বাজারে এদের মূল্য সর্বোচ্চ। সবচেয়ে বড় কারণ এদের গায়ের রং। গমের মত হয়, চোখ নীল, চুল হলুদ। এদেশীয় রাজা-রাজরারা অনেকেই আজ প্রাচীনদের মত গৌরবর্ণ নয়। মেয়েটি এসেই মন জয় করে নিয়েছিল তাঁর। ভাষা শিখেছিল গান্ধারেই। সেখানে তাকে আলাদা করে এমন কোনো পরিবারের সঙ্গে থাকার জন্য সংস্কৃত-র শিক্ষা দেওয়া হয়েছিল। তবুও এই যবনী বেশী স্বচ্ছন্দ পালিতে। মহারাণী সত্যবতী এর সংস্রবেই পালি শিখেছেন। অলকা তাঁর দিকে তাকিয়েই আছে। কিন্তু আশ্চর্য তার দৃষ্টিতে কোনো বিস্ময় নেই। তাহলে কি সেও জেনে গেছে মহারাণী সত্যবতীর দিন ফুরোচ্ছে? কবে জানলো? কীভাবে জানলো? আরো বিভ্রান্ত হলেন সত্যবতী। মুহুর্তের জন্য তিনি বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন।

    -মাতা, পৃথিবীতে সকল কর্মেরই একটি অবসান রয়েছে। মৃত্যু সে অবসানকে আনবেই। তাতে সমস্যা হতে পারে এই যে আরব্ধ কার্য্য অসম্পাদিত থাকলে ব্যাক্তির চেতনা সঙ্কুচিত হয়। অন্যদিকে সে কার্য্য কে বইতে সক্ষম তারও নির্ধারণ হয় না। তার আগেই বাধ্যত কারোর না কারোর হাতে দায়িত্ব এসে পড়ে। তখন তার ভবিষ্যৎ নিয়ে ঘোর সংশয় তৈরি হয়।

    কথার ফাঁকে সম্বিত ফিরে পেয়েছেন সত্যবতী। তিনি পুত্রকে বলেছিলেন গান্ধারীর কথা। বলেছিলেন হস্তিনাপুর আজ বিভক্ত হয়ে গেছে দু-পক্ষে। একদল কুন্তীকেই মেনে নিতে চায়, অন্যদল চায় তাঁকে অবিলম্বে দূর করে দেওয়া হোক রাজ্যসীমা থেকে। ধৃতরাষ্ট্র জানিয়েছে সভা যে মত দেবেন তাই তিনি মেনে নেবেন। এর বেশী তাঁর পক্ষেও বলা সম্ভব নয়। তাঁর শাসন চলে ভীষ্মের জোরের উপরে। তাঁর মন্ত্রীপ্রধান কণিকের সঙ্গে পরামর্শক্রমেই তিনি এ পন্থা নিয়েছেন। কিন্তু গান্ধারী মানেননি। তিনি সরাসরি এসেছিলেন সত্যবতীর কাছে। কুন্তীর দাবি সম্পর্কে প্রশ্ন তুলেছেন। গান্ধারী এবং কুন্তীর প্রতিদ্বন্দ্বিতা ব্যাসের অগোচর নয়। কুন্তী বা গান্ধারী কার জন্য এর শুরু তা বলা খুব মুশকিল! অন্ত:পুরের গলিঘুঁজির আলো-অন্ধকারের মধ্যেই এর জন্ম হয়। এর জন্য আলাদা কোনো কারণ লাগে না বোধহয়। তবে এক্ষেত্রে পাণ্ডুর রাজ্যলাভ এবং ধৃতরাষ্ট্রের তজ্জনিত ক্ষোভ ইন্ধনের কাজ করেছে। গান্ধারী হিতাকাঙ্খির মত জানাতে এসেছিলেন কুরুকুলের এই দুর্দিনে সকলেই তাকিয়ে আছে মাতা সত্যবতীর দিকে। তিনিই ন্যায় করতে সক্ষম। প্রজাপুঞ্জের মধ্যে সংশয় বাসা বেঁধেছে কুন্তীর দাবীর যাথার্থ্য নিয়ে। তাঁর চরিত্র নিয়েও হাজারো প্রশ্ন জন্ম নিয়েছে। সেকাল হলে সীতার মত অগ্নিপরীক্ষা দেওয়ার দাবি প্রবল হত হয়তো। কিন্তু আর সেকাল নেই। কাজেই এখন প্রমাণ চাই এসবের।

    সত্যবতী সব শুনেছেন প্রথমে। তারপরে শীলিত শীতল কন্ঠস্বরে একে একে খণ্ডন করেছেন সব অভিযোগ। কুন্তীর প্রথম গর্ভাধানের খবর তাঁর মতই গান্ধারীর কাছেও পৌঁছেছিল সময়েই। তাই সে নিজের গর্ভ থেকে সময়ের আগে সন্তান চেয়েছিল সে কথা মনে করিয়ে দিয়েছিলেন। ধৃতরাষ্ট্রের প্ররোচনা ছিল এর পিছনে। কিন্তু কাজটা গান্ধারীই করেছিল। কুন্তীর সেই সন্তান জন্মের খবর যখন এল তখন নিজের গর্ভ নষ্ট করার চেষ্টার মত গর্হিত কার্যেও পিছপা হয় নি সে। ব্যাসকে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছিল। এ নিয়েও প্রজাপুঞ্জের মধ্যে ক্ষোভ থাকা অস্বাভাবিক নয়। এমনকি তাঁর কানে এ নিয়ে কিছু কথা এসেওছে। তবে তিনি সে সব অগ্রাহ্য করেছেন। প্রজার ধর্ম হল রাজার সমালোচনা করা। রাজকীয় সকল কিছুর সমালোচনা করা। আর রাজার সামনে নতমস্তকে থাকা। এ সব কথা শুনলেও গুরুত্ব দিতে নেই। তিনিও দেন নি। জোঁকের মুখে কিছুটা নুন পড়েছিল। এর পরে আর কথা বাড়ানো সঙ্গত মনে করেননি গান্ধার তনয়া। ধীরে ধীরে আরো কিছু অপ্রাসঙ্গিক কথা বলেই বিদায় নিয়েছেন। ষড়যন্ত্র প্রাসাদে তা বলে থেমে নেই। এমন অবস্থা এর আগে সত্যবতী দেখেননি। এই প্রাসাদের প্রতিটি চরিত্রই এখন কেমন যেন রহস্যময় হয়ে উঠেছে। কে কার উপরে নজরদারি করছে একথা বলা বেশ কঠিন। এখনই তো, তাঁর মনে হচ্ছে এতকালের দাসী এই অলকা, সেও বুঝি অন্য কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে আছে এখানে। তারই মধ্যে নিজ গর্ভজাত এ সব কী বলছে তাঁকে?

    -আমি চলে গেলেই কি এ সঙ্কটের অবসান ঘটবে পুত্র?

    -মাতা, আমি আপনার সন্তান। অন্য সকল সন্তানের মতই আপনার ভাল-মন্দ বিবেচনার কিছু দায় আমারও আছে।

    সত্যবতী উত্তর দিতে যাচ্ছিলেন, থামালেন ব্যাস। অলকাকে বললেন ঘরের বাইরে যেতে। ব্যাস জানেন এই অবধি যা অলকা শুনেছে তা এবারে পৌঁছে যাবে গান্ধার-নন্দন শকুনির কাছে। সেখান থেকে ধৃতরাষ্ট্র জানবে। তাঁর প্রথম কাজ সার্থক হবে। এতদিন তিনি এই রাজবংশের নানান বিষয়ে দূর থেকেই থেকেছেন। একমাত্র ক্ষেত্রজ পুত্রের জন্ম দেওয়া ছাড়া আর কোনোভাবেই ঘনিষ্ঠ হন নি। কিন্তু এবারে অন্য সময়। দেবব্রতর উপরে ছেড়ে দেওয়া যায় না এই রাজবংশের গতি। গাঙ্গেয় বীর, কিন্তু রাজনীতিজ্ঞ সেই অর্থে নন। শাস্ত্র তাঁর সকলই অধিগত, কিন্তু কূট নীতির কার্যে তিনি বেশ দুর্বল। তাছাড়া তাঁর নিজের রক্তও কেউ নয় আজ। অপক্ষপাতী আচরণ তাঁর পক্ষে সুবিধার। কিন্তু ব্যাসের দায় অনেক। তাঁরই পুত্রদের মধ্যে জন্মেছে বিভেদের বিষ। সেই বিষ এখন শাখা-প্রশাখায় বাড়ছে। তাঁকেই বিবেচনা করতে হবে কোন শাখা ভবিষ্যৎ-এর বৃক্ষটির পক্ষে অধিক ফলপ্রসূ। অলকা ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই সত্যবতী বললেন,

    -আমি কি নিজ দায়িত্বে অক্ষম বলে তুমি মনে কর?

    নি:শ্বাস ছাড়লেন ব্যাস। এই নারী তাঁর মাতা, কিন্তু স্বমর্যাদা বোধ এঁকে স্বতন্ত্র করেছে অন্যান্য নারীদের থেকে। এমন রমণী ব্যাতিক্রম। এঁকে ব্যাখ্যা করার দরকার তাঁর ভাবনা। নইলে এভাবে সম্ভব নয় এঁর এই দৃশ্যপট থেকে অপসারণ। রাত্রের শেষ প্রহরের ঘন্টা পরেছে প্রাসাদ দেউড়িতে। ক্রমশ: জাগরণ হবে এক ব্যাস্ত প্রাসাদের। ভিস্তিরা জল নিয়ে বেরোবে শহরের রাজপথে। রাজপ্রাসাদে একই সময় নালার থেকে জল তুলে ধোয়া শুরু হবে সমস্ত প্রাঙ্গণ। তারপরে একে একে কক্ষে কক্ষে আসবে জল। অন্যদিকে পাচনাগারে পাচকের সহকারী জ্বালাবে একে একে পঞ্চান্নটি মাটির উনুন। শুরু হবে দিনের খাদ্য প্রস্তুতের কাজ। প্রাসাদ সংলগ্ন দেব মন্দিরের পুরোহিত এতক্ষণে প্রস্তুত হচ্ছেন কিছুক্ষণ পরেই ঊষাগমে শুরু করবেন বেদ পাঠ। এখনই সময় হল। নতুন দিনের আগমনে নতুন সময়ের ভূমিকা সাঙ্গ করার। তাঁর বার্তাবাহীরা সকলেই বিদুরের পরামর্শক্রমে একে একে চলে গিয়েছে কালই গণের সভার বৃদ্ধদের কাছে। আজ যাবে যুবকদের মধ্যে। গাঙ্গেয় জানেন কারা যাচ্ছে কোথায়, কিন্তু তিনি নিশ্চুপ থাকবেন। দ্বৈপায়ন যা করছেন তার বিরোধ তিনি করবেন না। তিনি শুরু করলেন।

    -এক নতুন সময় আসছে মাত:। বহু রক্তক্ষয়, বহু লোভ, পাপের মধ্যে দিয়ে এর উদ্বোধন হবে। জ্ঞাতিহত্যা, ভ্রাতৃহত্যা, নারীর সন্মানহানি নিত্যকর্ম হয়ে দাঁড়াবে। পরিবারের বন্ধনও আর কোনো রক্ষাকর্তা নয়। এককালে এই দেশের মানুষ যখন তামার লাঙলে চাষ করত তখন তাদের উৎপাদন ছিল সীমাবদ্ধ। আজ তা আর নেই। লোহার লাঙল সব বদলে দিয়েছে। এক বিপুল উৎপাদন আজ এই দোয়াবের দুই তীর ধরে পুঞ্জীভূত হচ্ছে। এই সম্পদের অধিকার কার হাতে থাকবে?

    আমাদের পূর্বজরা অধিকাংশ ছিলেন পশুপালক, মৎস্যজীবি। চাষ তাঁরা শুরু করলেন অনেক অনেক পরে। গোধন ছিল সবচেয়ে বড় ধন। মাতা প্রপিতামহ বশিষ্ঠ্য এবং ঋষি বিশ্বামিত্রে কীসের বিরোধ? ওই গোধনের দখল নিয়েই তো? সে কালে এই ছিল সবচেয়ে বড় সমস্যা। মনে করে দেখুন মাতা কার্তবীর্য্য রাজার সকল দান এককালে ভার্গবদের হাতে গিয়েছিল। সেই রাজার বংশধরেরা যখন দুর্দশায় পরে তখন তারা সেই ধনের কিছু অংশ চায় ওই ভার্গবদের থেকে। তারা অস্বীকার করে দিতে। সেই থেকে তাদের সঙ্গে বিরোধ বাধে। ভার্গবদের পরাজয় এবং রক্তস্রোতে প্রথমবার এই দ্বন্দ্বের সমাধান হয়। সেই সমাধানকে অস্বীকার করে আসেন ভার্গব ঔর্ব্য পরশুরাম। ক্ষত্রিয় ধ্বংসই হয়ে দাঁড়ায় তাঁর ব্রত। ব্রাহ্মণের অধিকার তিনিই পুন:প্রতিষ্ঠা করেন এই ভূমন্ডলে। বিশ্বামিত্র সেই অধিকার আর ধনের দখলকেই পুনরায় প্রতিস্পর্ধায় ভেঙে দিতে চেয়েছেন। পিতামহ শক্তি এবং তাঁর বাকি নিরানব্বই ভ্রাতার মৃত্যুও তাঁরই পরিকল্পিত। অযোধ্যার রাজা কল্মষপাদকে দিয়ে এই হত্যা এবং সেই মৃতদেহ ভক্ষণ করিয়ে তিনি শোধ নিয়েছেন প্রপিতামহের উপরে। পিতা পরাশর রাক্ষসবধের আয়োজন করেছিলেন এককালে এর শোধ হিসেবে। সেই আয়োজন নিবারিত হয় অত্রি আদি কুলগুরুদের সঙ্ঘের আদেশে। কিন্তু শোধ নেওয়া সম্পূর্ণ হয় নি। সেই শোধ হল প্রপিতামহের দ্বারাই। যে অযোধ্যার রাজবংশের তিনি কুলগুরু সেই রাজবংশের ওই কল্মষপাদের সঙ্গে তাঁর পুনর্মিত্রতা হল। অযোধ্যার প্রজাকুলের মধ্যে যে রক্ষণশীল অংশ বেদধর্মের জয়গান গেয়েছে চিরকাল সেই অংশই রাজাকে রাজ্য ছাড়তে বাধ্য করেছে। রাজা বশিষ্ঠ্যের আনুগত্য স্বীকার করে নিয়ে রাজ্য ফিরে পেলেন। সঙ্গে রাজমহিষীর গর্ভে বশিষ্ঠ্যের সন্তানকেই নিতে হল তাঁকে। সেই পুত্রই রাজা হল অযোধ্যার। একেই বলে আসল প্রতিশোধ। যে প্রতিশোধ আপনিও নিয়েছেন মহারাজ শান্তনুর প্রতি।

    চমকে ওঠেন সত্যবতী। পুত্র তাঁর মহা-পণ্ডিত। কিন্তু তিনি মাতা। এ কী কথা পুত্রের মুখে?

    -পুত্র, এ আলোচনা আমার-

    -মাতা!

    থামিয়ে দিলেন ব্যাস। দৃঢ় কন্ঠে বললেন,

    -আমি আপনার পুত্র। মাতার নিন্দা করার মত গর্হিত কাজে আমি ব্যাপৃত নই এ আপনি নিশ্চই বুঝবেন। এ কথা বলার মত যথেষ্ট কারণ আছে বলেই আমাকে বলতে হচ্ছে একথা। এমনকি আমার পরিকল্পনাও এই ভাবনাকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে।

    -যে কারণই থাক আমি এই আলোচনায় প্রীত হতে পারছিনা পুত্র!

    -পিতা পরাশরকে আপনি ভোলেননি মাতা কখনোই।

    সত্যবতী তাকালেন পুত্রের দিকে। সত্য বটে লোকের কথা। যৌবনকালে এমনই ছিলেন পরাশর। আজ ব্যাসও তাঁর যৌবনের উপান্তে দাঁড়িয়েছেন। কিন্তু যে দীপ্ত চক্ষু নিয়ে চেয়ে আছেন তাঁর দিকে ওই দৃষ্টি সেই যুবক পরাশরের, যিনি তাকে বলেছিলেন শান্ত স্বরে, তাঁকে কামনা করেন। না ভোলেন নি তিনি। ভুলতে পারেননি। শান্তনু না এলে হয়তো আরো অনেককাল পরস্পরের সঙ্গ পেতেন তাঁরা। একথা সত্যি তিনি পারেননি পরাশরের সঙ্গে দেশে দেশে, দিকে দিকে ভ্রমণ করে বেড়াতে, কিন্তু তিনি জানতেন তাঁর টানে ফিরে ফিরে আসেন পরাশর। অপেক্ষা করে থাকতেন তিনিও। পরাশর এসে বলতেন নতুন নতুন স্থানের কথা, মানুষের কথা, বৃক্ষাদি এমনকি নতুন নতুন জন্তুর কথাও! বলতেন নতুন সকল জায়গার রীতিনীতির কথা। তিনি শুনতেন। কিছু বুঝতেন, অনেক কথাই বুঝতেন না। তবু ওই কন্ঠস্বর তাঁর অবচেতনে তলিয়ে যেত। আবেশে, আমেজে পড়ে থাকতেন পরাশরের কোলে মাথা রেখে। ওই সেই দ্বীপের কুটিরে ছিল তাঁদের একান্ত বাস। মহারাজ শান্তনুর রথ যেদিন এসে দাঁড়াল সেদিনই তিনি জেনে গিয়েছিলেন এই বার শেষ সব। লোকমুখে বিবাহ সংবাদ শুনেছিলেন পরাশর। অভিমানী ঋষি আর আসেননি। পুত্রের মুখে সংবাদ শোনার প্রথম অবকাশ হল যখন তখন...!

    কষ্টের সেই ভার আজও অনুভব করেন তিনি। যখন প্রথম ওই অলকা তাঁকে জানায় পরাশরের মৃত্যুর কথা, তিনি সেই থেকে তিনদিন জলগ্রহও করেননি। অলকাই তাঁকে জোরাজুরি করে শেষে জলস্পর্শ করায়। বারুণি ব্রতের নামে নিজেকে ছিন্নভিন্ন করছিলেন তিনি। একবার, একবার অন্তত যদি বলে আসতে পারতেন তাঁকে, তিনি এ চাননি। কিন্তু শান্তনুর রথ তাঁর ইচ্ছের সঙ্গে যেন এক জন্মের দূরত্ব গড়ে দিয়েছিল। পরাশরও জানতেন এমনই হবে। তবু এত অভিমান? একবার আসাও গেলনা এই হস্তিনাপুরে? এই রাজ্য তো বহু বহু ঋষির পাদস্পর্শে ধন্য। শুধু পরাশর একবারেও এলেন না। একবার চোখের দেখাও হয় নি তাঁর। পুত্র যখন গাঙ্গেয়র আমন্ত্রণে এসে দাঁড়ালো, তখন তাঁর শোক যেন আবার ফেনিল আবর্ত নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে চাইছিল চোখের দুকূল জুড়ে। কিন্তু তিনি অতিকষ্টে তাকে রুদ্ধ করেছিলেন সেই দিন। পুত্রের মুখে একে একে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সকল সংবাদ নিয়েছিলেন পরাশরের। সারাটা দিন তাঁর কাছেই কেটে যেত ব্যাসের। আর রাত্রে রাজকন্যারা আসতেন। সত্যবতী পুত্রের কাছে নি:শঙ্কোচে নিজেকে উজাড় করে দিতে পারেননি। কিন্তু প্রেমিকার তীব্র প্রেমে, মাতার মমতায় এই চিহ্নটিকে ধারণ করেছিলেন। তিনি নিজেও কম অভিমানিনী না! আর কখনো পদার্পণ করেননি পিতৃগৃহে। আমন্ত্রণকারীকে অতি রূঢ়তায় জানিয়ে দিয়েছেন যে পিতা কন্যাকে বৃদ্ধের হাতে সমর্পণ করে নিজের রাজ্যের সুখ আর সম্ভোগ দেখে তাঁকে যেন জানিয়ে দেওয়া হয় কন্যা নিজেকে মনে করে অনাথা। সেই যে এই প্রাসাদে এসেছিলেন তিনি সেই থেকে এই অবরোধই তাঁর পৃথিবী। এখান থেকে কোথাও কখনো আর যান নি তিনি। আজ পুত্র তাঁকে বলছে এই বন্দীশালা ত্যাগ করতে। আশ্চর্য, এতক্ষণ এতদিন তাঁর মনেও হয়নি তিনি বন্দীশালায় আছেন? কি রহস্য মনের? এই নিগড় তাঁর আপন মনে হয়েছে এতদিন? এত আপন? শান্তনুর মৃত্যুর পরেও তিনি আঁকড়ে থেকেছেন এই বন্দীত্ব! কেন? কেন সত্যবতী? আহ্‌, কী যন্ত্রণা তাঁর ভিতরে, কী অসহ যন্ত্রণা! তিনি ধীর গতিতে দোলনা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। জানালার দিকে হেঁটে যেতে যেতে বললেন,

    -আমি তাঁকেই শুধু মনে রাখতে চেয়েছি পুত্র। যতদিন কাছে ছিলেন সেদিন যতটা, তার চেয়ে ঢের ঢের বেশী যেদিন আমি তাঁর থেকে দূরে চলে এলাম সেদিন থেকে শুধু তাঁকেই মনে রাখতে চেয়েছিলেম।

    বাইরে এখন নরম লাল আলো একটু একটু করে ভেসে উঠছে। রাত্রির অন্ধকার কেমন পা পা হেঁটে চলে যাচ্ছে পর্দার আড়ালে। ওই, স্তবগান শুরু হচ্ছে মন্দিরে! পুত্র ব্যাস যা ব্যাখ্যা করতে চাইছে তা তিনি জানেন। বশিষ্ঠ্য-বিশ্বামিত্র বা ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয় বিরোধ আজ আর বিষয় নয়! আজ নতুন যুগের সঙ্গে নতুন সংকট এসেছে। দেবধর্ম বা বেদধর্ম নয়, ধনের ধর্মই প্রবল এখন। দোয়াবের দুই তীর ধরে যে অসংখ্য নগর গড়ে উঠেছে তাদের কেউ কেউ রাজশাসিত, কেউ কেউ গণের অধীন। সর্বত্রই এখন সামাজিক আইনের বিরোধ চলছে। যেখানে যে আইন আছে, সেখানে সেই আইনই মানুষের অসহ ঠেকছে! কী একটা বিষয় যেন তাকে সর্বত্র খোঁচা দিয়েই চলেছে। কিছুতে তার শান্তি নেই। কিছুতে স্বস্তি পেতে পারছেনা সে। বিলাসের চূড়ান্ত থেকে কৃচ্ছসাধনের শেষ সীমা অবধি গিয়েও যেন কিছুতেই হচ্ছেনা সমাধান। এ বিরোধের প্রকৃতি সত্যি পরিষ্কার নয় সত্যবতীর কাছে। তিনি আর কত বুঝবেন? কেনই বা বুঝবেন? সত্যিই তো, যার সন্তান সে এসে গেছে এবারে। সেই ঠিক করে দিক কে কী করবে? তিনি কেন আর টানবেন এই সব? এই প্রাসাদের বাইরের যে জীবন তাঁকে অমৃতের আস্বাদ একবার দিয়েছিল তারই কাছে ফেরাই উচিত। দূর থেকে ভেসে আসছে স্তব, কান পেতে শোনার চেষ্টা করলেন তিনি। গায়ত্রী, না কি অন্য কিছু? ছাই আজকাল কানেও সমস্যা। হেসে ফেললেন নিজেই। বুড়ি হয়েছ সত্যবতী, বুড়ি। চলো, এবারে তবে বাণপ্রস্থেই চল!
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ধারাবাহিক | ১৬ জুলাই ২০১১ | ১২৫৯ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভালবেসে প্রতিক্রিয়া দিন