এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ধারাবাহিক

  • মহাভারত -- ষোড়শ পর্ব

    শুদ্ধসত্ত্ব ঘোষ লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | ০৬ আগস্ট ২০১২ | ১১৮৯ বার পঠিত
  • সামনের দুটি রথে রয়েছে পঞ্চ পুত্র। তাদের কলরব শোনা যাচ্ছে। বাহিকায় করে চলেছেন কুন্তী। বাহিকার সঙ্গে গতি মিলিয়ে রথের চলা খুব সমস্যার। কিন্তু ভাল সারথির কল্যাণে সকলই সম্ভব। পাশে পাশে চলেছেন বিদুর, একা ঘোড়ায়। সত্যবতীর যাত্রার দিন এগিয়ে আসছে। আজকে তাঁর সঙ্গে দেখা করেই বিদুরের গৃহে স্থান নিলেন কুন্তী। সত্যবতীর সঙ্গে কুন্তীর সম্পর্ক আলাদা করে খুব একটা ভাল বা খারাপ না। তিনি যখন এই বংশে বধূ হিসেবে আসেন তখন পাণ্ডু থাকলেও সত্যবতীই মূলত রাজ্যশাসন করেন। ভীষ্ম সকল কাজেই তাঁর পরামর্শ নিয়েই চলেন। পাণ্ডু ব্যাস্ত থাকেন যুদ্ধ অথবা মৃগয়া অথবা বিলাস আচার নিয়েই। তাঁদের জন্য আলাদা বাসস্থান প্রাসাদের মধ্যেই নির্মাণ করিয়েছিলেন ভীষ্ম। সেখানে কুন্তী ও মাদ্রীর সঙ্গে বিলাসব্যাসনে কিছুদিন কেটে গিয়েছিল পাণ্ডুর। তারপরে বার হলেন যুদ্ধজয়ে। তখন একদিকে নতুন বৌ আর অন্যদিকে দোর্দন্ডপ্রতাপ রাণী সত্যবতীর মধ্যে কোনো যোগসূত্র ছিল না। পাণ্ডু যখন ফিরলেন তখন সঙ্গে এল রোগ-ও। সেই নিয়েই ব্যাস্ততা ছিল কুন্তীর। তারপরেই তো বনবাসী হবার দিন এল।

    তার মধ্যে তাঁর ঘনিষ্ঠতা যত বেড়েছে বিদুরের সঙ্গে ততই অন্যদিকে দূরত্বও বেড়েছে সত্যবতীর সঙ্গে। আগে যাও বা যোগাযোগ হত বিভিন্ন পূজা-পার্বণে সেটাও কমে এল। হলেও অনেকের মধ্যেই হত, তাই আলাদা করে কিছুই বিনিময় সম্ভব ছিল না। রাজপ্রাসাদের মধ্যে তাঁর দাসী শুক্তিমতীর গতায়াত বেড়েছে এর মধ্যেই। সেই খবর এনেছিল বিদুরের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কে খবর শুধু সত্যবতী নয়,  ভীষ্মও জানেন এবং সমর্থন করেন না। কুন্তী আড়ষ্ট হয়েছিলেন এমন না,  কিন্তু তাঁর মস্তিষ্ক বলেছিল যতটা সম্ভব দূরত্ব রাখাই বাঞ্ছনীয়। অসুরগুরু বৃহস্পতির শিক্ষা কুন্তী পেয়েছিলেন ঋষি দুর্বাসার কাছ থেকে। দুর্বাসা তাঁর প্রথম যৌবনেই বলেছিলেন তাঁর স্বাধীনচিত্ততা বজায় রাখতে গেলে তাঁকে জানতে হবে রাজনীতি। যে কদিন ছিলেন সঙ্গমের পরবর্তী কাজ ছিল তাঁকে অসুরনীতির শিক্ষা দেওয়া। যে শিক্ষা শুধুমাত্র রাজপুত্রদের জন্য সাধারণভাবে নির্দিষ্ট, তাই দুর্বাসার কল্যাণে তিনিও অধ্যয়ন করেছেন। মনুর সংহিতা বলে বিদ্যা তিনপ্রকার। ত্রয়ী বা তিন বেদ-জ্ঞান, বার্ত্তা বা কৃষি, পশুপালন এবং বাণিজ্য বিষয়ক নানান শিক্ষা এবং দন্ডনীতি। দানবগুরু শুক্রাচার্য্য বা অসুরগুরু বৃহষ্পতি দন্ডকেই মূল ধরেন। ভেদ থেকে বেদ সকলই এই বিদ্যার অন্তর্গত বলে মনে করেন। দুর্বাসা তাঁকেও দিয়েছিলেন এই দন্ডের শিক্ষা। ত্রয়ী বা বার্ত্তা সম্পর্কে অল্প জ্ঞানই তাঁর যথেষ্ট বলেই মনে করেছিলেন ঋষি। কুন্তী একবার জানতেও চেয়েছিলেন এমন কেন! খুব সোজা কথায় ঋষি তাঁকে বলেছিলেন তিনি জীবনের কোনো পর্যায়েই স্বনির্ভর হবেন না। সেই গঠন তাঁর নেই। কোনো না কোনো অবলম্বনের মধ্যেই নিজেকে বিকশিত করবেন যতটা সম্ভব। তাই কূটজ্ঞান আবশ্যক তাঁর। শাসনের পৃথক নীতিতে কি লাভ?

    অবাক হয়েছিলেন কুন্তী! জুড়েছিলেন প্রণয় কলহও। দুর্বাসা হেসে বলেছিলেন তিনি দুর্বাসা। স্পষ্টতাই তাঁর বৈশিষ্ট্য। যাদব সমাজে নারীর গুরুত্ব বিপুল এমন না। আর কুন্তী যদি নিজে চলতে সক্ষম হত তাহলে কি রাজা কুন্তীভোজ তাঁকে নিজ স্বার্থে ব্যবহার করতে পারতেন? যতই তাঁর জন্মদাতা যদুবংশীয় পিতা শৌরসেন কংসের রাজত্বে সমস্যায় থাকুন না কেন, কি ভ্রাতা বাসুদেব বন্দী, তাতেও কুন্তীভোজ ঋষি দুর্বাসার সেবায় কুন্তীকে পাঠানোর আগে ভাবতো, যদি তার পুত্র না হত! কিন্তু সেই সন্তানের জন্ম কুন্তীভজোকে এতটাই নিশ্চিত করেছে যে সে কুন্তীকে ব্যবহার করতে পিছপা হয়নি। এই অবজ্ঞা কি কুন্তীর মনের কোণে কোনো ক্রোধের জন্ম দেয়নি? এই জন্যেই তো কুন্তীও কুমারীদশাতেই তাঁর পালক পিতার প্রতি প্রতিশোধ নেবার আশায় তাঁর সঙ্গে শয্যায় গমন করছেন! তিনি তো জানেন  যে কন্যাকে ঋষি দুর্বাসা শয্যায় গ্রহণ করবে সেই কন্যাকে অন্য ব্রাহ্মণে ভবিষ্যৎ-এ কামনা করা থেকে বিরত থাকবে?  অর্থাৎ ভবিষ্যতে আর কোনো প্রৌঢ় বা বৃদ্ধ ব্রাহ্মণের ভোগে তাঁকে উৎসর্গীকৃত হতে হবে না। নত মস্তকে বসেছিলেন কুন্তী। সত্য এ! রূঢ়, কিন্তু সত্য। প্রৌঢ় কিন্তু তেজস্বী ঋষি দুর্বাসা সত্য বলেছেন। কুন্তী প্রকাশ্য বিদ্রোহ করতে সক্ষম না, তিনি গোপনে গোপনে যুদ্ধে সক্ষম। দুর্বাসা দত্ত অসুর বা দানব নীতি মনে করে সমাজ শাসনের সকল শিক্ষাই লুকিয়ে থাকে একমাত্র দন্ডনীতির মধ্যেই। তার কারণ হল সমাজে শাসনের কাজ। সুকর্মকে পুরস্কার না দিলেও অপকর্মকে দন্ড দিতেই হবে। নতুবা সমাজ ধ্বংস। সেই জন্যই কুন্তীর বিচারধারার মধ্যে বেশী প্রাধান্য অসুরনীতির। বিদুর তবুও এর পরেও সংখ্যা, যোগ এবং লোকায়ত শাস্ত্র শিক্ষাও কিছু দিয়েছিলেন। একে বলে আণ্বীক্ষিকী। এই শিক্ষা কাজে লাগে মনন তৈরী করতে। কিন্তু সে শিক্ষা কাজে লাগার মতন অবকাশ আসেনি কুন্তীর জীবনে।

    আজ-ও সত্যবতীর সঙ্গে তাঁর যে সাক্ষাৎ হল তাতে শুধুই প্রাধান্য অসুরনীতির। সত্যবতী জানেন তিনি সরে যাচ্ছেন কৌরবজীবন থেকে চিরকালের মতন। এই নারীর পুত্ররাই সম্ভবত ভবিষ্যৎ-এ শাসন করবে কুরুবংশ। পুত্র ব্যাস বা ভীষ্মের কার্যক্রমে তেমনই মনে হচ্ছে তাঁর। এই নারীকেই তাই তিনি তাঁর শেষ উপদেশ দেবার জন্য মনস্থ করেছেন। তাছাড়া আরেকটি জটিল ভাবনায় তাঁর মন সম্পৃক্ত ছিল। যে কুরুবংশ তিনি রেখে যাচ্ছেন সেই বংশের উপরে ছায়া পড়েছে যেন কালের। তিনি অনুভব করছেন গণের সভায় যে শান্তি স্থাপিত হল সে আসলেই যুদ্ধের উপরে একটি আবরণ মাত্র। দু-পক্ষই পরস্পরের শক্তিকে পরিমাপ করছে। নিজের শক্তি বৃদ্ধি করছে। সময় এবং সুযোগ মতন ঝাঁপিয়ে পড়বে। একে সন্ধি বলে বটে, কিন্তু এমন সন্ধির সময়েই সবচেয়ে বেশী সতর্কতার প্রয়োজন। তিনি যাবার পথেও বাধ্য আজ পক্ষ নিতে। পাণ্ডুর আমলে আলাদা করে যে কিছু বলার মতন মহান কিছু ঘটেছে তা নয়, কিন্তু তাও তাঁর মনে হয় ধৃতরাষ্ট্রের চেয়ে সে আমল কোথাও যেন ভিন্ন ছিল। পাণ্ডু বয়োজ্যেষ্ঠদের অধিকারকে ধৃতরাষ্ট্রের মতন করে সন্দেহের চোখে দেখেনি।

    সত্যবতী, নারীর মন দিয়ে যা বোঝেন তা তাৎপর্য্যপূর্ণ। একজনের দৃষ্টি ছিল, তার ছিল বহির্বিশ্ব। অন্যজনের দৃষ্টিহীনতা তাকে নিজের মনের অন্দরমহলই ব্যাতিব্যাস্ত রেখেছে। দৃষ্টির বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে কোথাও চেতনার বিস্তার বাধা পেয়েছে যেন। একজন তার বিলাসে-বৈভবে মশগুল থেকেছে, জ্যেষ্ঠভ্রাতা কিম্বা পিতৃপ্রতিম ভীষ্ম বা পিতামহীর প্রতি তার অনাস্থা ছিল না। নিজের ব্যাধিকে নিজেরই কর্মফল মেনেছে। অন্যজন শুধুমাত্র হাসি বজায় রেখে মনের দ্বন্দ্ব-দ্বেষ-সন্দেহকে নিয়ে ঘর করেছে। দ্বিতীয়জনের শাসন ক্রুর, সংশয়াকূল হতে বাধ্য। সেই ধারায় যদি শাসন চলে তাহলে সমূহ বিপদ। অভ্যুত্থানও সম্ভব। তাতে বিনষ্ট হবে কুরুকূল। কাজেই তিনিও পক্ষ নিয়েই যাচ্ছেন। বাণপ্রস্থ প্রাসাদ থেকে দূরে, কিন্তু এত দূরেও না যে কোনো আঁচ সেখানে যাবেনা। নিজের এবং কুরুকূলের ভাবনাই তাঁকে কুন্তীর মুখোমুখী করেছিল। যে আলোচনা হয়েছিল তাকে অসুরনীতির অনুশীলনও বলা চলে।

    হস্তিনাপুর কোন পথে চলবে তার উপরেই দুই নারীর ভবিষ্যৎ নির্ভর করে আছে। একজন যাবেন বাণপ্রস্থে, অন্যজন নগরের মধ্যেই থাকবেন, কিন্তু প্রাসাদে নয়। প্রাসাদের মতিগতি তাহলে নিয়ন্ত্রণের রাস্তা কিছুই থাকলো না কি? আছে। সত্যবতীর নিজস্ব চরেরা থাকবে। তারা থাকবে অলকার অধীনে। তার জন্য নির্দিষ্ট মাসোহারার বাইরেও সে অর্থ পাবে। সেই অর্থ আসবে সত্যবতীর নিজস্ব সম্পদ থেকে। মহারাজ শান্তনু জীবৎকালে তাঁকে যে গহনা ও ভূসম্পদ দান করেছিলেন সেই সম্পদ তিনি গচ্ছিত রাখছেন গাঙ্গেয়র কাছে। সেই সম্পদের থেকে আহরিত অর্থে এই বিশেষ বাহিনীর ব্যয় নির্বাহ হবে। এই বাহিনীতে বয়স্কা স্ত্রী লোক, সেই ঋষিপত্নীরা যাঁদের যাতায়াত থাকে অন্দরমহলে বিভিন্ন কারণে, নাপিতানি, ধাই-এরাই মূলত নিযূক্ত হত। এদের কাজ ছিল রাজপ্রাসাদের অন্দরমহল ও রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে কি ঘটছে তাও জানানো রাণীকে!

    এতকাল সে খবর পেয়ে এসেছেন সত্যবতী। অলকা তাঁর বিশিষ্ট দাসী। সাধারণ দাসীদের মত সে নয়। প্রাসাদের বাইরে তার বাড়ি রয়েছে নিজস্ব। সেখানে রয়েছে সংসার। যদিও তার জীবনের বেশীরভাগটাই কেটে গ্যাছে প্রাসাদে তবুও তাতে তার সংসারের বাড়-বৃদ্ধি কমেনি। তার সন্তানেরা সকলেই দুধে-ভাতে রয়েছে। দুটি ছেলে আছে বাহিনীতে খাদ্যভান্ডারে, মেয়েটির বিবাহ হয়েছে কোশলে। এমনকি সেখানকার রীতি অনুযায়ী মেয়ের বিয়েতে ভাল পণ নিয়েছে অলকা। তার জীবনে আর বাকী কিছুই নেই। সেও চেয়েছিল যেতে সত্যবতীর সঙ্গে। কিন্তু সত্যবতী রাজী হতে পারেননি। কুন্তী প্রাসাদে না থাকলেও সেখানে থাকবে গান্ধারি। তার দখলে সম্পূর্ণ ব্যবস্থা চলে যাক একথা তিনি ভাবতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না। বিশেষ করে এই অবস্থায়।

    এতদিন প্রাসাদের মধ্যে তাঁর প্রধান শত্রু ছিলেন ধৃতরাষ্ট্র। অন্ধ রাজা তার মুকুটহীনতার জন্য পিতা বেদব্যাসের মতন অনেকাংশে সত্যবতীকেও দায়ী করেন। তিনি তাঁর ঘনিষ্ঠদের বলেন যে সত্যবতী চাইলে বেদব্যাসকে দিয়ে নতুন ব্যবস্থা করতে পারতেন। শাস্ত্রের সকল কিছুই যখন সময়কাল অনুযায়ী পাল্টায় তাহলে শাসক নির্বাচন ব্যবস্থা পাল্টানো যাবে না এ হতে পারে না। কিন্তু মহারাণী সত্যবতী কখনোই তাঁর জ্যেষ্টপুত্রের জ্যেষ্ঠসন্তানটিকে ভরসা করেননি। তিনি নিজের হাতেই ক্ষমতা দেখতে চেয়েছিলেন। তাই পাণ্ডুর মৃত্যুর পরেও ধৃতরাষ্ট্রকে রাজা করার ইচ্ছে তাঁর হয়নি। একা গাঙ্গেয় ওই দুজনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কখনোই দাঁড়াতেন না। প্রমাণও আছে এর। মহারাজ বিচিত্রবীর্য্য কি পাণ্ডুর অসুস্থতার ক্ষেত্রেও কখনো গাঙ্গেয় তাঁদের রাজ্যশাসনে বাঁধা হয়ে দাঁড়াননি। ধৃতরাষ্ট্র মনে করেন আদতে সত্যবতীর ক্ষমতাস্পৃহাই দায়ী পাণ্ডুকে বনবাসে পাঠানোর জন্যও। পাণ্ডুর চিকিৎসা মহারাজ বিচিত্রবীর্য্যের মতনই রাজপ্রাসাদে থেকেও তো হতে পারতো!  কিন্তু মহারাণী সত্যবতীই প্রাসাদের মধ্যে এমন এক পরিবেশ গড়ে তুলেছিলেন যেখানে পাণ্ডু সঙ্কুচিত বোধ করেছে। মহারাজ বিচিত্রবীর্য্যের যে যৌনরোগ কুরুকূলকে বিপদে ফেলেছে সেই রকম রোগই আবার ধরেছে তাঁকে এবং তিনিও আদতে কুরুকূলের স্বার্থের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন নিজের লোভের জন্য, এ ভাবনা অস্থির করেছে পাণ্ডুকে। তার উপরে ছিল সুক্ষ ভাবে রাজআমাত্য এবং গণের সভার মধ্যে পাণ্ডুর প্রতি ধিক্কারব্যাঞ্জক মনোভাব জাগিয়ে তোলা। মহারাণী সত্যবতী তাঁর নিজস্ব চরব্যবস্থার মাধ্যমে সুনিপূণভাবে পাণ্ডুকে প্রাসাদ ছাড়তে বাধ্য করেছেন চাপ সৃষ্টি করে।

    আরেকটি সন্দেহ ধৃতরাষ্ট্রের মধ্যে প্রবল। তিনি তাঁর কনিষ্ঠ ভ্রাতাটিকে চিনতেন খুব ভাল করে। অসংযম তাকে বেপথু করে তুলতে পারলেও বুদ্ধিবৃত্তি কিছু কম ছিল না তার। কেউ নিশ্চিতভাবে সত্যবতীরই দ্বারা আদিষ্ট হয়ে সম্ভবত পাণ্ডুকে এক সম্ভাবনার কথা ভাবিয়েছে। এই হস্তিনাপুর প্রাসাদে থাকলে পাণ্ডুর পক্ষে সবচেয়ে বড় বিপদ হবে বংশধারা বজায় রাখা। পাণ্ডুকে ক্ষেত্রজ পুত্র নিতে দিতে মহারাণী সত্যবতী অবশ্যই আপত্তি জানাবেন, বেদব্যাস-ও অমত করতে পারেন এবং গাঙ্গেয় কোনো অবস্থাতেই চাইবেন না। এর প্রধান যুক্তি হল ধৃতরাষ্ট্রের পক্ষে সম্ভব যখন পুত্র উৎপাদন করা তখন কেন ক্ষেত্রজ পুত্র চাই? যদি বা চাই-ই তাহলে সে পুত্রর উৎপাদন করতে সকলের আগে ডাক পড়বে ধৃতরাষ্ট্রেরই। জন্মান্ধ ধৃতরাষ্ট্রের সন্তানরাও জন্মান্ধ হবে এমন কোনো কথাই নেই। যে জ্যেষ্ঠভ্রাতা তাঁর অন্ধত্বর জন্য সিংহাসন পেলেন না তিনিই যদি পরবর্তী প্রজন্মের উৎপাদক হন তাহলে মহারাজ পাণ্ডুর অবস্থা কি বিচিত্রবীর্য্য মহারাজের থেকেও খারাপ হবে না?

    সত্যবতী জানেন এ সব সন্দেহের কথা। অমূলক সন্দেহ বলেও তিনি বলতে পারেন না একে!  হ্যাঁ, তিনি চাননি যে পাণ্ডুর বংশধারা লুপ্ত হয়ে যাক। তিনি চাননি ধৃতরাষ্ট্র রাজার মুকুট পরুক। ধৃতরাষ্ট্র রাজা হলে হস্তিনাপুর কিছুতেই তার নির্ধারিত রাস্তায় চলবে না। গাঙ্গেয় বা তিনি বা ব্যাস কেউই তাকে চালাতে সক্ষম হবেন না। তার পাশে গড়ে ওঠা স্বার্থান্ধ ব্রাহ্মণ মন্ত্রী, আমাত্য, বণিকের দল তাকে দিয়ে রাজ্য চালাবে। আজ, এখনো যে মর্যাদা হস্তিনাপুরের আছে তা থাকবে না। এমন নয় যে পাণ্ডু তার থেকে ভাল রাজা ছিল!  কিন্তু পাণ্ডু কখনো রাজ্যশাসনে পৃথক হস্তক্ষেপ করেনি। হ্যাঁ, কিছু বহির্যুদ্ধে সে লিপ্ত হয়েছে যা না হলেও চলতো। সে তার নিজের বিলাসের আয়োজনে ব্যাপৃত থেকেছে, যুদ্ধ তার ফলশ্রুতি। তাই সেই যুদ্ধগুলোও আকারে খুব বড় হয়ে ওঠেনি। কেন না বড় যুদ্ধ করতে হলে সময় লাগবে, সে সময় পাণ্ডু ব্যায় করতে রাজী ছিল না। কিন্তু ধৃতরাষ্ট্র পাণ্ডু না। সে তার ব্যাক্তিস্বার্থকে সব কিছুর আগে রাখবে এবং সন্দেহ করবে সর্বদা তাঁদের। কাজেই হস্তিনাপুরকে তিনি বা গাঙ্গেয় যে রাস্তায় চালাতে চাইবেন সে রাস্তা সে সবসময়েই পরিহার করে চলবে। এই জন্যেই ধৃতরাষ্ট্রের শাসন তিনি অন্তত চাননি। অন্যদিকে পাণ্ডুর ক্ষেত্রে তাঁর কাছে সেই বিচিত্রবীর্য্যের সমস্যাই আবার ঘুরে হাজির হয়েছে।

    হস্তিনাপুর প্রাসাদের কাহিনী হল এক ঋষিকে হরিণ ভেবে তাঁর স্ত্রী-র সঙ্গে সঙ্গমকালে পাণ্ডু হত্যা করেন। জনশ্রুতি হল ঋষিকে হত্যা করে অমিতাচারী পাণ্ডু চেয়েছিলেন ঋষিপত্নীর দখল। ঋষিপত্নী তার শোধ নিয়েছিলেন পাণ্ডুকে যৌনব্যাধিগ্রস্ত করে। সত্যবতী জানেন যে ঋষিপত্নী যদি নিজে রোগগ্রস্ত আগে থেকেই না হয়ে থাকেন তাহলে একাজ সম্ভব না। আগে থেকে রোগ থাকলে তিনি ঋষির আশ্রয়ে পালিত হতেন না। যা হতে পারে, অমিতচারের ফলে কোনো না কোনো রমণীর দ্বারা পাণ্ডুর মধ্যেও রোগসংক্রমণ ঘটে। দীর্ঘ্যকাল ধরেই নিশ্চই রোগগ্রস্ত থাকায় তিনি ঋষিপত্নীতেও সঙ্গত হতে পারেননি। অন্যদিকে কুন্তীর সঙ্গে বিদুরের সম্পর্ক যেভাবে বেড়েছে তাতে পাণ্ডুর সঙ্গে কুন্তীর যৌন সম্পর্ক অবশ্যই অনেকদিন ধরেই নেই এও ধরে নেওয়া যায়। থাকলে একটি নখক্ষতও কি পাণ্ডুর চোখে পড়তো না কখনো?  না, এ হওয়ার নয়। অন্য নারী বা পুরুষ সংসর্গ করলে শরীরে এবং আচরণে কিছু না কিছু পরিবর্তন ঘটবেই, যা নারী ও পুরুষ চিরকাল পরস্পরের থেকে গোপন রাখতে পারে না। তার উপরে কুন্তীর শরীর অবশ্যই সম্পৃক্ত হয়েছিল বিদুরের বীজে। সেই চিহ্নকেও পাণ্ডু অনুধাবন করেননি তাই বা কি করে হয়! 

    একমাত্র সম্ভব যদি কুন্তী পাণ্ডুকে বনবাসের শুরুতেই বোঝাতে সক্ষম হয় যে এছাড়া মহারাজ পাণ্ডুর বংশধারা রক্ষার সম্ভাবনা নেই। এ কাজে কুন্তী অবশ্যই মুনি-ঋষিদের সাহায্য পেতে সক্ষম-ও। ঋষি দুর্বাসার অঙ্কশায়িনী খুব মূর্খ হবার কথা না। তিনি নিজের অভিজ্ঞতা থেকে জানেন যে উচ্চ বুদ্ধির সংস্পর্শে এলে কিছু না কিছু বিকাশ অবশ্যই হয় মানব মস্তিষ্কের। কুন্তীরও হয়েছে। হয়েছে যে তার জ্বলজ্যান্ত পাঁচ পাঁচটি প্রমাণ নিয়েই তো সে ফিরেছে হস্তিনাপুরে। বিদুরের সঙ্গে কুন্তীর ঘনিষ্ঠতা যখন বেড়েছে তখন সত্যবতী দেখতে চেয়েছিলেন এই কন্যা কতদূর অব্দি যেতে পারে!  দেখে নিয়েছেন। গোপনে গোপনে কিছু নিয়ম ভাঙার মতন সামর্থ্য বা ইচ্ছে এর আছে, কিন্তু প্রবল প্রকাশ্য বিপ্লব করা এর উদ্দেশ্য নয়। ধীরে, কিন্তু নিশ্চিত পদক্ষেপে এই নারী তার লক্ষের দিকে এগোবে। ক্ষমতা অনুযায়ী কৌশল তৈরী করাটাও অসুরনীতি। এই কন্যা সে নীতিতে দক্ষ।

    এখন যু্যুধান দুই পক্ষের কোনো একটিতে তাঁকে থাকতে হবে। তিনি বাণপ্রস্থে থাকলেও সংসার তাঁকে ছেড়ে দেবেনা তিনি জানেন। সবচেয়ে বড় কথা ধৃতরাষ্ট্র কখনো ভুলবে না তাঁর অনীহার কথা। গান্ধারীও রাজকন্যা। যতই ধর্ম ধর্ম করুন না কেন, সেও স্বামীর উচ্চাকাঙ্খায় প্রবল বাধা হয়ে দাঁড়াবেন এমনও হবে না। গান্ধারীও পতিত হতে পারে তা গর্ভপাতের সময়েই বোঝা গিয়েছে। গান্ধারী তো আর গাঙ্গেয় নয়!  এই যে অশান্তি দখল নিয়ে, এ তাঁর পিছু ততক্ষণ ছাড়বেনা যতক্ষণ না কোনো এক পক্ষের দখল নিশ্চিত হচ্ছে। সে হতে হতে এখনো বহুকাল। কাজেই সাবধানের মার নেই। অলকার নেতৃত্বেই চলবে ব্যবস্থা। গাঙ্গেয়র কাছে সকল সংবাদ যাবে। আর তাঁর জন্য থাকবে বিশেষ দূত। রাজপ্রাসাদের পোষা পায়রারা যাবে তাঁর কাছে সাংকেতিক লিপি নিয়ে। এ বিষয়েও বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করা হচ্ছে। একই সঙ্গে অন্তত তিনটি পায়রা আকাশে উড়বে। একটি যদি শ্যেনজাতীয় পাখির আক্রমণের মুখেও পড়ে, তাহলে বাকীগুলো অন্তত পৌঁছবে। অন্যটিও যদি কোনো অনিয়ন্ত্রিত কারণে পথভ্রষ্ট হয়, বা না পৌঁছয় তাহলে তৃতীয়টির সম্ভাবনা থাকেই। কাজেই সত্যবতী এই ব্যবস্থায় নিশ্চিন্ত। এর পরে ঘটনা কোনদিকে গড়াবে তা তাঁর-ও জানা নেই।


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ধারাবাহিক | ০৬ আগস্ট ২০১২ | ১১৮৯ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভালবেসে প্রতিক্রিয়া দিন