এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ধারাবাহিক

  • মহাভারত -- পঞ্চদশ পর্ব

    শুদ্ধসত্ত্ব ঘোষ লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | ২৪ জুলাই ২০১২ | ১২৬৫ বার পঠিত
  • সকাল থেকে সাজ সাজ রব ছিল। হস্তিনাপুরকে দেখলে মনে হত যেন মেলা বসেছে কোনো। মোড়ে মোড়ে চওকে চওকে ভীড়।বেশী ভীড় প্রাসাদের জন্য যে অধিদুর্গ সেখানে। সেখানে একটা হট্টমেলার আসর যেন। এক এক করে সকাল থেকে গণপতিরা প্রবেশ করেছেন,আর জয়ধ্বনি উঠেছে।বামন,ভাঁড়,অভিনেতা,নর্তকেরা তখন তাদের খেলা থামিয়ে অপেক্ষা করে থেকেছে কতক্ষণে সেই গণপতি প্রাসাদের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেন। নতুবা তাদের খেলা কেউ দেখছেনা। নগরের বিবিধ রাস্তায় গ্রাম-গ্রামান্ত থেকে আগত বিত্তশালীদের গো-শকট,ছাগ-শকট,একঘোড়ার রথ আটকে বসে আছে। হস্তিনাপুর প্রাচীন নগরী। তাই তার সর্বত্র সমান মাপ নয় রাস্তার। কোথাও কোথাও নগরনীতি ভেঙেই রাস্তার ধারের সাময়িক পণ্যগৃহ রাস্তাকে জুড়ে ফেলেছে। কোথাও বা কারোর বাসগৃহই নিয়ম ভেঙে চলে এসেছে পথের একাংশে।দন্ড বিধান করেও একে পরিশোধন করা যায় নি। রথের রাস্তা আটকে গেলে যে ১০ পণ দন্ড। সেই দন্ড আদায় করার এবং দেবার লোকেরা সকলেই আজ সারাদিন যেন মত্ত ছিল। নাগরিক এমনই আশঙ্কা করেছিলেন বলে তাঁর নগররক্ষী বাহিনীকে বলেই রেখেছিলেন আজ এই দন্ড আদায় নিয়ে যেন কোনো হাঙ্গামা না হয়। খুব বড় কিছু যাতে না ঘটে তার দিকে নজর রাখতে হবে। কিন্তু ছোট-খাট কিছুকে বড় করে দেওয়া চলবেনা। তেমন হলে সংশ্লিষ্ট আধিকারিকের শাস্তি হবেই। আজ গণের সভা এবং সেখানেই হয়েছে পঞ্চপুত্র নিয়ে আগত কুন্তীর আবেদনের বিচার। শুধুমাত্র হস্তিনাপুর না,সমগ্র উত্তরখন্ডের নজর ছিল আজকের এই সভায়। তৎসঙ্গে হস্তিনাপুরে। আধুনিক নগরগুলোও তাকিয়ে ছিল আজকে তার নাগরিক কেমন আচরণ করেন তার দিকে। সে সব পেরিয়ে এখন সন্ধ্যা।

    এখন হস্তিনাপুরে অন্য উৎসব চলছে। সারাদিনে কি হল,আর কি হল না,কেন হল আর কেন হল না তার খুঁটিনাটি আলোচনা চলছে সর্বত্র। কে কোনদিকে গেল,কেন গেল,কাকেই বা কে কিনেছে,কে বিশ্বাসঘাতকতা করলো,তা নিয়ে বিভিন্ন পানশালা আন্দোলিত। বিদুর চলেছেন এখন সত্যবতীর প্রাসাদের দিকে। পথ অতিক্রম করে এসে রাজপ্রাসাদের মধ্যে এখন পায়ে হেঁটে চলেছেন। পথে একবার দেখা করে যাবেন গাঙ্গেয়র সঙ্গে। তাঁর ডানদিকে এখন যে পথ সে পথ নিথর। ওই পথ চলে যাচ্ছে ধৃতরাষ্ট্রের কক্ষের দিকে। বাগানের মধ্য দিয়ে চলে যাওয়া এই পথে আজ প্রায় লোক নেই। অন্যদিন এই সময় গমগম করে এই দিক। কেউ না কেউ চলেছেই!আজ লোকের লক্ষ গাঙ্গেয়র কক্ষের দিকে। সেদিকে আলো জ্বলছে অনেক। প্রাসাদরক্ষীরা সে দিকে বেশী ব্যস্ত। এইদিকের সরণীতে শুধু গাছেরা ঘুমোচ্ছে এখন।

    কিন্তু গাছ নির্ধারিত সময়ে ঘুমোলেও মানুষ ঘুমোয় না। বিদুর জানেন ধৃতরাষ্ট্র আজ ঘুমোবেন না। আরেকবার তাঁর যাবতীয় আশা নির্মূল হয়ে গেছে। আরেকবার তাঁর হাত থেকে অবসাদে খসে পড়েছে রাজমুকুট। কাল সকালেও এই মুকুট হাতে নিয়ে তিনি আসবেন সভাস্থলে,কিন্তু আজকের মতন কাল-ও সেই মুকুট তাঁর আসলেই অধরা থেকেই যাবে। সকলেই জানবে রাজার প্রতিনিধি হিসেবেই তিনি শাসন করছেন, নিজে রাজা হলেন না। তাছাড়া আজকের ক্ষতগুলো শুকোতে সময় লাগবে অনেক। নাও শুকোতে পারে!গণের সভার উপরে আলাদা করে এত ভরসা ধৃতরাষ্ট্রের ছিল না যে তিনি তাঁদের বিশ্বাসঘাতক মনে করবেন। কিন্তু সুধন্য,অশ্বসেন,দশরথাদি মিত্রকূলের উপরে ছিল। আজ সভা যখন শুরু হয় তখনও জানা ছিল না যে মন্ত্রী কর্ণিক ছাড়া অন্য কেউ-ই পান্ডুপুত্রদের যথার্থতা যাচাই করার প্রস্তাব আনবেন না। জানা ছিল না যে এই প্রস্তাব আনার জন্য কর্ণিককে এত নিন্দার মুখোমুখি হতে হবে। এই ভূখন্ডের অন্যান্য অঞ্চলে যখন গণ এবং রাজার বিরোধ সামান্য কারণেই এত প্রকাশ পাচ্ছে সেখানে এমন একটা কারণে বিরোধ না হয়ে যেতে পারে?

    কর্ণিক যখন সভায় গাঙ্গেয়র আনা প্রস্তাবের বিপক্ষে বলতে উঠলেন তখনও মনে হচ্ছিল আজ বুঝি গোটা সভায় ঝড় হবে। সকাল থেকে একে একে সদস্য এসেছেন এবং উত্তেজনা মাত্রা ছাড়িয়েছে। বাইরের অগণন মানুষ, যাঁদের কি হচ্ছে জানার উপায় নেই, তাঁরা এঁদের হাবভাব দেখে প্রস্তাবের পক্ষে বা বিপক্ষে কিনা তা বিবেচনা করে নিয়েছেন। শুধু তাঁরাই বা কেন,বিদুরেরও এক সময় মনে হয়েছিল বিশ্বকর্মাদি গণের সদস্যরাও বুঝি আজ বিপক্ষেই যাবেন। প্রতিটি সদস্যদের মুখ-চোখ ভয়ঙ্কর রকমের ভার। কাজেই কর্ণিক যখন বললেন পর্বত প্রদেশ থেকে আনা মুনিরা যে স্বাক্ষ্য দিয়েছেন সেই স্বাক্ষ্য যে ভবিষ্যতে বিশেষ সুবিধার বিনিময়ে পাওয়া নয়, বা নারীর কুহকজালের কারণে লাভ করা নয় তার প্রমাণ কি? তখন গোটা সভার মেজাজ দেখার মতন। সভায় উপস্থিত সকলের চোখ তখন রাজাসনের পিছনে দ্বিতলে পট্টমহিষীর অবরোধের দিকে। তীক্ষ্ণ,তীব্র সে দৃষ্টি। মহাদেবী গান্ধারীকে ডান পাশে নিয়ে পিতামহী সত্যবতী বসে আছেন। তাঁরই বাম পাশে বসে কুন্তী।

    সচরাচর অমাত্য বা গণের সদস্যরা এমন বিশেষ অনুষ্ঠানেও ওই দিকে সরাসরি দৃষ্টিক্ষেপ করেন না। সভায় উপস্থিত গূঢ়পুরুষদের কাজই হল কে কোথায় তাকিয়ে ছিল, কার কি ভঙ্গিমা ছিল তা স্মরণ করে রাখা!সেই ভঙ্গিমা এবং দৃষ্টি যথাসময়ে বিবেচিত হবে। বিশেষ করে গাঙ্গেয় নিজে দন্ডনীতির বিষয়ে আচার্য্য বৃহষ্পতির অনুগামী বলে পরিচিত। কাজেই যে কোনো সময় যে কোনো অমাত্যের পরীক্ষা চলে। বহু সময় এমনও হয়েছে রাজঅন্তঃপুরে প্রায়শই যাতায়াত করা কোনো বয়স্কা মহিলা শ্রমণকে দিয়ে বিশেষ অমাত্যকে জানানো হয় যে মহিষী বা অন্য কোনো অন্তঃপুরস্থ রমণী তাঁকে কামনা করছেন। সেই অমাত্য যদি এই বার্তায় বিচলিত হয়ে নির্ধারিত স্থানে দেখা করতে যায় তাহলেই জানতে পারে আসলে এই কাজ গাঙ্গেয়র। তারপরে তার জন্য রাখা শাস্তির বাহুবন্ধনে তাকে ধরা পড়তে হয়। কাজেই রাজরমণীদের প্রতি দৃষ্টিপাতের অর্থ কেউ জানেনা এমন না। তবুও আজ সবকটা চোখ চলে যাচ্ছিল বারেবারে ওই দিকে। আর এই অভিযোগের সময় তো সকলেই একইদিকে তাকিয়ে। কর্ণিক বলেই নিয়েছিলেন ব্যাক্তিগতভাবে শালীনতা,সৌজন্য,নম্রতার প্রতিমূর্ত্তি দেবী কুন্তীর প্রতি তাঁর কোনো বিদ্বেষ নেই। কিন্তু তিনি বাধ্য, গণের এবং রাজ্যের স্বার্থে এই প্রসঙ্গ তুলে আনতে। সাধারণ জনতার মনে যে ভাবনা থাকে তার হদিশ থাকা খুব জরুরী। না হলে প্রকৃতিপুঞ্জ ক্ষুব্ধ হয়,দেশে বিপ্লবের সম্ভাবনা দেখা দেয়। এখন,এই ক্ষেত্রেও সে সম্ভাবনা আছে। কাজেই সেই বিচার আজ জরুরী। নইলে ভবিষ্যতে দেখা যাবে এইভাবে প্রাপ্ত রাজত্ব ক্ষমতা, এই বালকেরা একদিন আবারও বিক্রয় করে দেবে অন্যদের হাতেই।

    সমগ্র সভাতে অদ্ভূত নিস্তব্ধতা।অথচ যাকে নিয়ে প্রশ্ন সে তখন মৃদু স্বরে পাশে উপবিষ্টা নারীর সঙ্গে আলাপনে মগ্ন। সেই নারী সকলেই জানেন,ধৃতরাষ্ট্রের সন্তানের জননী বৈশ্যকন্যা। মহাদেবী গান্ধারী, মাতামহী সত্যবতীর মুখ চোখ পাথরের মতন। উত্তর দিলেন বিরাট। বিরাট উত্তর কুরুর মানুষ। তিনি প্রথম বললেন রীতি অঞ্চল ভেদে ভিন্ন একথা কর্ণিক ভুলে যাচ্ছেন। তাঁর অঞ্চলে এখনো রীতি হল স্বামীর বর্তমানে স্ত্রী-র গর্ভের সন্তানের পরিচয় হবে স্বামীর নামে। সেই স্ত্রী যদি ব্যভিচারিনীও হয় তাহলেও তার দন্ডবিধান করার আগে শুনতে হবে তার কথা। যদি এমন দেখা যায় সেই স্ত্রী যথাযথ কারণ ছাড়াই দীর্ঘ্যকাল স্বামী পুরুষ সংসর্গে বঞ্চিত অথবা তার স্বামী যৌনরোগগ্রস্ত বা যৌনক্ষমতাহীন বা সন্তানউৎপাদনে সক্ষম নয়,তাহলে সেই পুরুষ দন্ডার্হ,স্ত্রী নয়। তাহলে কর্ণিক কি বলছেন উত্তর কুরুর এই প্রথাকে তিনি সন্মান করেন না? বা কুরুরাজ্যে এই প্রথাকে স্থান দেওয়া যাবে না আর?বিদুর বুঝলেন এই কাজ একমাত্র সম্ভব পিতার পক্ষেই। তিনিই এই প্রথা সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ বিরাটকে আনিয়েছেন এই সভায়। গত বহুকাল বয়স এবং অসুস্থতা বশতঃ বিরাট আসেননি গণের কোনো সভাতেই। কর্ণিকের প্রশ্নটি যতটাই জোরালো ছিল ততটাই কৌশলী এই উত্তর। কর্ণিক কেন কারোর পক্ষেই বলা সম্ভব নয় যে উত্তর কুরুর এই প্রথা মানা চলেনা। এমনিতেই উত্তর কুরুর সঙ্গে দক্ষিণ কুরুর বিবাদ রয়েছে সামাজিক প্রথা থেকে রাজাধিকার সব নিয়েই। কুরু বংশ এই দক্ষিণের মানুষ। কাজেই উত্তর নিজেকে বঞ্চিত বোধ করে। সেখান থেকেই এই নীতি সম্পর্কিত প্রশ্নের উত্তর দান বেশ কঠিন।

    পর্বত প্রদেশ শুধুমাত্র একাংশের মুনি-ঋষিদের বসতি। সেই অঞ্চল গুরুত্ব রাখে দেবখন্ডের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে। হিমালয়গামী সকল পথের মধ্যে এই পথটিই সবচাইতে নিরাপদ এবং প্রাকৃতিক শোভায় সৌন্দর্য্যমন্ডিত। সেখানকার মুনি বা ঋষিদের রাজনৈতিক গুরুত্ব তেমন না হলেও এই কারণেই তাঁদের কেউ সাধারণভাবে ক্ষুণ্ণ করতে সাহস করেনা। আজ পরিস্থিতি এমন বিচিত্র না হলে সম্ভবত কর্ণিক বা ধৃতরাষ্ট্রও এই অভিযোগ আনতেন না।বিরাটের এই প্রথা সম্পর্কে প্রশ্নকে যদি পার্বত্য প্রদেশের আধ্যাত্মিক গুরুত্বের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা হয় তাহলে কর্ণিকের পক্ষে উত্তর দেওয়া বেশ সমস্যার। তাই-ই হল। কর্ণিক বললেন তিনি জানেন প্রথার বৈচিত্র্য,কিন্তু সামাজিক প্রথাকে অতিক্রম করতে হয় রাজনীতির স্বার্থে। সেই কাজটাই তিনি করছেন এখানে,শুধুমাত্র কৌরবদের স্বার্থকে মাথায় রেখেই। এবারে উঠলেন বিকচ। তিনি কৃষিসঙ্ঘের প্রতিনিধি। তিনি তাঁদের ক্রিয়াকর্মের নির্ধারকও বটে। খুব চাঁচাছোলা ভাষায় কথা বলেন বিকচ। বললেন এই প্রশ্ন কতটা সঙ্গত। কুন্তীর সন্তানেরা যদি রাজপ্রাসাদে বয়োঃবৃদ্ধদের অনুমতিক্রমে জন্মাতেন অন্য ক্ষেত্রে তাহলেই একমাত্র তারা বৈধ? না হলে নয়? মহারাজ পান্ডু জীবিত অবস্থায় একে যখন অনুমোদন করেছেন তখন ভর্তার আদেশ তো ছিলই। তাহলে এই প্রশ্ন তোলার দরকার কি?

    এইবারে এল সবচেয়ে কঠিন প্রশ্ন। কর্ণিকের পরে উঠে দাঁড়ালেন ধৃতরাষ্ট্র পক্ষীয় বলসেন। বলসেন বণিক। সুধন্যর সঙ্গে তাঁর বাণিজ্য সম্পর্কের সূত্র ধরেই এককালে সুধন্য এই দেশে এসেছিলেন। আজও সেই সখ্য তাঁদের বজায় আছে। বলা হয় সুধন্যর বহু ব্যবসাই আসলে চলে তাঁর নামে। তিনি সামনে থেকে রাজকরের সুবিধা করে দেন সুধন্যকে। কারণ সুধন্য এই দেশে জন্মানো নাগরিকের প্রাপ্য করছাড় থেকে বঞ্চিত। সে সুযোগ সুধন্য হয় তো পেয়েও যেতেন গাঙ্গেয়র বিরোধ না থাকলে। ধৃতরাষ্ট্র অনেক কিছুই করেছেন,কিন্তু সরাসরি এই সংঘাতে যেতে পারেননি। বলসেন বললেন জনমনে সবচেয় বড় প্রশ্ন হল মহারাজ পান্ডুর মৃত্যু নিয়ে। তিনি মহারাজের একান্ত সুহৃদ হিসেবে জানতে চাইছেন আজ সভার কাছে, যে মাদ্রীর সহমৃতা হওয়া এবং পান্ডুর প্রকৃত মৃত্যুর কারণ হিসেবে কুন্তীর স্বাক্ষ্য কেন বিশ্বাস করা হবে? কুন্তী রাজবংশজ। তিনি কি জানতেন না যে এই কার্য বিপুল সন্দেহর উদ্রেক করবে জনসমাজে?  জানতেন না যে এই সন্দেহও হবে যে মহারাজ পান্ডু কুন্তীর এই স্বেচ্ছাগমনের বিরোধ করেছেন বলেই তাঁকে মরতে হয়েছে। মাদ্রী সেই কার্যের বিরোধ করেছেন বলে তাঁকেও আসলেই বলপূর্বক হত্যা করা হয়েছে এমনও হতেই পারে। তাই দুর্গম পার্বত্য প্রদেশেই দুজনকেই দাহ করে এসেছে এই নারী ও তার সহচররা। এই নারী চরিত্রহীনা এবং এর সন্তানেরা কৌরবদের পক্ষে বিপজ্জনক নয় এ কি করে প্রমাণিত হয়? তা আজ যদি না বোঝা যায় তাহলে কৌরবদের ধ্বংসের সম্ভাবনা সমূহ।

    বিদুর দেখছিলেন কুন্তীকে। দ্বিতল কক্ষ থেকে অলস এই মধ্যাহ্নে সভাকক্ষের এই উত্তপ্ত পরিস্থিতিতেও কি অবিচল ভঙ্গিমায় সোজা চেয়ে আছেন বলসেনের দিকে! বলসেন তাঁর বক্তব্য শেষ করে লহমা তাকিয়েছিলেন, দ্রুত চোখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। বিদুর উঠে দাঁড়ালেন। ক্রোধ তাঁর সর্বাঙ্গে। অতিরিক্ত ক্রোধ তাঁর শরীরে ভর করলে শরীর কাঁপতে থাকে। এখনো তেমন বোধ করছেন। ধীরে গভীর নিশ্বাস নিলেন। এই সময় ক্রোধ তাঁর দৃষ্টি আচ্ছন্ন করলে চলবেনা। তিনি বললেন,

    - বলসেন বণিক। ন্যায়শাস্ত্র তাঁর অধীত।তাই তিনি জানেন যে সর্পকে রজ্জুজ্ঞান করা শরীর স্বাস্থ্যের পক্ষে ভাল না। তবু প্রশ্ন যখন উঠেছে তখন আমার মনে হয় এই প্রশ্ন বা সংশয়ের নাশের জন্য সভাস্থ পার্বত্য প্রদেশের প্রতিনিধির সাহায্য আমাদের নেওয়া উচিত। আমি অনুরোধ করবো ঔর্ব্ব্যকে এই বিষয়ে আলোকপাত করতে।

    উঠে দাঁড়ালেন ঔর্ব্ব্য।ইনি ব্রহ্মবাদী। কিন্তু এঁর ব্রহ্মবাদ হল অন্নবাদ। এঁরা মনে করেন অন্নই ব্রহ্ম। সকলে তাকিয়ে ছিল তাঁর দিকে। শীর্ণকায় ঋষি ঔর্ব্ব্য তাঁর ক্ষীণ কন্ঠস্বরকে তীক্ষ্ণ করে বললেন,

    -এ সভার আলোচনার উদ্দেশ্য কি?

    সকলে সকলের মুখের দিকে চাওয়া-চাওয়ি করতে থাকল।

    -না মানে,অনেকক্ষণ শুনছি আপনারা সকলে একটি নারীর চরিত্র নিয়ে বিষম চিন্তিত। দেশশাসন না নারী চরিত্র আলোচনার বিষয় তা বুঝে নেওয়াটাই প্রথমে সঙ্গত নয় কি? আমরা পার্বত্যবাসীরা দীর্ঘদিন এই হস্তিনাপুরে আমাদের আশ্রম,সাধনা,পঠন-পাঠন ছেড়ে দিয়ে বসে আছি কি নারী চরিত্র নিয়ে আলোচনা করতে বা মনুষ্যচরিত্র নিয়ে আলোচনা করতে, তাও এমন একদলের সঙ্গে যাদের বিভিন্ন পেশায় চরিত্রগুণের শ্রাদ্ধ হয় মাত্র?

    বলসেন উঠে দাঁড়ালেন। খুব উত্তেজিত।

    -আপনি আমাদের অপমান করতে পারেন না মুনি!

    -অপমান? আপনি বলসেন ওই মিথিলায় যে স্বর্ণ বাণিজ্যের জন্য গিয়েছিলেন সেখানে স্বর্ণ ছিল উৎকৃষ্টমানের। আপনি আপনার বিক্রেতাকে বঞ্চিত করার জন্য গো-মূত্রের মধ্যে থাকা হিঙ্গুর-হাত দিয়ে তা ধরেছিলেন। রাজপ্রতিনিধিকে সামনে রেখে এ কাজ করেছিলেন। তার স্বর্ণ নিকৃষ্টমানের বলে তখন প্রমাণ হয়। কারণ স্বর্ণ ধাতুর ওই হিঙ্গুরের সঙ্গে সংশ্লেষ তাকে রক্তবর্ণের করে তোলে। আপনি তাকে বাধ্য করেছিলেন মূল্যের চেয়ে কম অর্থে সেই স্বর্ণ আপনাকে বিক্রয় করতে। বেঁচে যেতেন যদি সেদিনই মহামাত্য সত্রক সেই অঞ্চলে গূঢ়পুরুষের ছদ্মবেশে না যেতেন! তিনি আপনাকে অনুসরণ করে আপনার পান্থশালায় যান এবং সেখানে ক্রেতা সেজেই আপনার কাছে ওই স্বর্ণ ক্রয় করতে চান। তখন, আপনি অনেক বেশী অর্থে তাঁকে বিক্রয় করতে চান সেই স্বর্ণ। আপনি ধরা পড়েছিলেন। দন্ড দিয়ে মিথিলা রাজ্য থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়েছিলেন সেই রাত্রে। আপনি বলছেন চরিত্রের কথা,এ আশ্চর্য্য না?

    -আপনি মিথ্যাচারী। একথা সত্য নয়।

    -আদ্যন্ত সত্য বলসেন। আমি ঔর্ব্ব্য মিথিলারাজ্যের রাজকুমারদের শিক্ষাদান কার্য্যে নিযুক্ত ছিলাম। আপনি আমাকে এ বিষয়ে এর বেশী কোনো কথা বলবেন না। সেক্ষেত্রে আমি এই রাজ্যের শাসনের কাছে আপনার মিথ্যাচারের দন্ড চাইতে বাধ্য হব। প্রয়োজনে দ্বিমাসিক কালের মধ্যে আমি সেই মহামাত্যকে এখানে আনয়ণ করতে পারি। আর তাঁকে অনুরোধ করতে পারি মিথিলারাজ,আমার ছাত্র সত্রসেনের কাছ থেকে আপনার দোষস্বীকার সংক্রান্ত পত্রটি নিয়ে আসতে।

    বিদুর এত নাটকীয়তা আশা করেননি। উঠে দাঁড়ালেন পিতা স্বয়ং। তিনি বললেন,

    -ক্রোধ সংবরণ করুন মহামান্য ঔর্ব্ব্য। বলসেন, ব্রাহ্মণ পূজ্য। তাঁকে কোনোভাবে অপমানের দন্ড আপনি জানেন। অযথা এ নিয়ে বাক্যব্যয় করবেন না। কিন্তু যে অভিযোগ আপনি এনেছেন তার বিচার আবশ্যক। আমি এই সভার পক্ষ থেকে ঔর্ব্ব্যকে অনুরোধ করবো এই অভিযোগ বিষয়ে আমাদের আলোকিত করতে। রাজ্য জনগণের। কাজেই তাঁদের জন্যই এই অভিযোগ নিষ্পত্তি আমাদের অবশ্য কর্ম।

    সভাস্থলে এখন প্রশান্ত বাতাস আসছে পার্শ্ববর্তী যমুনার থেকে। কিন্তু সেই শীতল বাতাস সভার উত্তাপ কমাতে সক্ষম নয়। আজ সভায় এখনও কোনো কথা বলেননি ধৃতরাষ্ট্র। তিনি শুধুই শ্রোতা। বাম দিকে ঈষত হেলানো তার মাথা।কর্ণ বক্তার দিকে নিবদ্ধ। বিদুরের মনে পড়লো ‘নৃপ কর্ণেন পশ্যন্তি’। রাজা কানে

    -আচার এবং বিচার নিয়ে কিছু বলার আগে আমার মনে হয় জ্ঞানতত্ত্ব নিয়ে দু-কথা বলা প্রাসঙ্গিক। এই যে বিষয়কে আমরা জানতে চাই তাকে জানব কি ভাবে? ব্যাস মহাত্মন সম্যকভাবে অবগত আছেন এই তত্ত্বের দুটি রূপ এই দেশে প্রচলিত। একটি রূপ প্রত্যক্ষকেই সম্যক জ্ঞান করেন। এই ধারানুগামী ঋষি অশ্বল-ও এখানে আজ উপস্থিত। অন্য রূপটির মত হল প্রত্যক্ষ আসলেই ইন্দ্রিয়সংবেদী বলে তা অভ্রান্ত নয়। আমি দুই ধারাতেই এর বিচার দেখবো।

    কুন্তী,প্রত্যক্ষত যে সন্তান সকলের জন্ম দিয়েছেন তা আমরা সকলেই জানি। দেশ-কালে যে আচারই হোক না কেন মহাত্মন এবং সভাস্থ সন্মানীয়রা,আমরা জানি মাতাই একমাত্র বলতে সক্ষম সন্তানের জনক কে! সেক্ষেত্রে কুন্তী যা বলছেন তাকে আমরা মেনে নিচ্ছি না কেন?

    উত্তেজিতভাবে উঠে দাঁড়ালেন বলসেন।

    -তার কারণ এই স্বাক্ষ্য দুষ্ট হতেই পারে। কিছুক্ষণ আগেই আমি এ কথা বলেছি।

    -বেশ। প্রত্যক্ষ যদি অভ্রান্ত না হয় তাহলে পরোক্ষের সাহায্য নিতে হয়।  বলসেন আবারও সেই অভিযোগ পুনরাবৃত্তি করলেন। কিন্তু বলসেন কিভাবে বলতে পারেন এই নিয়োগের আদেশ মহারাজ পান্ডু তাঁর জ্যেষ্ঠা মহিষীকে নিজে দেননি? তিনি নিজে কি এর স্বাক্ষী? সভা কি বলেন?

    এবারে কথা বললেন উপমন্যু। তিনি ক্ষত্রিয় এবং হস্তিনাপুরের সামরিক বাহিনীতে তাঁর স্থান। গণের সভায় তিনি তাঁর প্রাচীন এবং গৌরবময় বংশের প্রতিনিধিত্ব করেন।

    - একথা বলসেন বলতে পারবেন না। আচার্য্য ঔর্ব্ব্য যা ইঙ্গিত করছেন তাকে স্পষ্ট করলে বলা যায় যে দোষের অভিযোগ এসেছে প্রাক্তন মহারাণী কুন্তীর স্বাক্ষীর বিরুদ্ধে একই অভিযোগ আনা যায় বলসেন-এর বিরুদ্ধে। কাজেই তাঁর অভিযোগ, তাঁর প্রাক্তন দুষ্টতার জন্যই পক্ষপাতী ও সম্যক জ্ঞান বঞ্চিত, এমন কথা বলাই যায়।

    -কিন্তু এ আমার অভিযোগ নয় মিত্র উপমন্যু! এ অভিযোগ হস্তিনাপুরের চওকে চওকে ছড়িয়ে আছে।

    -তাহলে সে অভিযোগও এই বিচারে পক্ষপাতী এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মিত্র বলসেন।

    কথা বললেন গাঙ্গেয়।

    -বণিকশ্রেষ্ঠ সুধন্য কি বলছেন?

    সুধন্য ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন। এতক্ষণ তাঁর একটি কথাও শোনা যায় নি এই সভায়। এ বড়ই আশ্চর্য্যের বিষয়। সকলের কৌতুহলের কেন্দ্রে তিনি ছিলেন বহুক্ষণ। এবারে উঠে দাঁড়াতেই সকলের দৃষ্টি তাঁকেই অনুসরণ করল স্বভাবতই।

    খুব নীচু কন্ঠে,কষ্টে জোর ফুটিয়ে তিনি বললেন,

    -আমি গতকাল থেকেই কিঞ্চিত অসুস্থ। কিন্তু এ রাজ্যের সঙ্গে আমার সুখ-দুঃখ জড়িয়ে গিয়েছে বলে এমন একটি মহতী কার্য্যের আহ্বানে আমাকে আসতেই হয়েছে। যদি সভা অনুমতি করেন তাহলে আমি আমার কথা বলে সভা থেকে বিদায় নিতে চাই। বহুক্ষণ উপবেশনের ফলে আমার শরীর খুবই ক্লান্ত। রাজবৈদ্য স্বয়ং আমাকে আদেশ দিয়েছিলেন পূর্ণ বিশ্রামের। তবুও...! সভার অনুমতি প্রার্থনা করি।

    সকলে মুখ চাওয়া-চাওয়ি শুরু করে দিল। জানেন সকলেই যে এই যে মহানাটক তার অন্যতম কুশীলব সুধন্য। তিনি ঠিক কি চাল চালবেন তাই নিয়ে কৌতুহল চরমে উঠলো। আবার কথা বললেন গাঙ্গেয়।

    -সভা আপনাকে অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গেই সেই অনুমতি দিচ্ছে সুধন্য। এই সভায় আপনার উপস্থিতি কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা কাউকে বলে দিতে হবেনা। কিন্তু এমত শারীরিক অবস্থায় আপনাকে এভাবে কষ্ট দেওয়ার অর্থ আপনার আয়ুক্ষয়। এ দায় হস্তিনাপুর তার পরম মিত্রের জন্য নিতে সক্ষম নয়। সভাস্থ সকলে অনুমতি করুন!

    সকলেই দ্রুত তাঁদের অনুমতি জানালেন।

    -আমার সৌভাগ্য যে আমি মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রর সুহৃদ মর্যাদা পেয়েছি এবং বস্তুত তাঁরই করুণায় এই দেশে আমি মান্য মিত্রসকলে লব্ধ হয়েছি। ধন-সম্পদ আজ আছে কাল নেই,কিন্তু মিত্রাদি অচল। তাঁদের মঙ্গল হস্ত আমার উপরে থাকলে আমার সে ঈশ্বরভাগ্য। সেই সকল মিত্রদের বলি আজকের সভা এক অর্থে অর্থহীন!

    সভায় মুখগুলো তখন দেখার মতন হয়েছিল বটে। সুধন্য কি সম্পূর্ণ উন্মাদ হয়ে গিয়েছে? এত মান্যগণ্য গণের সদস্যদের উপস্থিতিতে সে এ সব কি বলছে?

    -মিত্রগণ,কেউ ক্রোধিত হবেন না। আপনাদের সকলের সম্যক গুরুত্বে আমি অবহিত আছি। কিন্তু যে কার্যে আমরা সকলে অবতীর্ণ সেই কার্য বিলক্ষণ কঠিন। আপনারা সকলেই সহমত হবেন আমার সঙ্গে যে ক্ষেত্রজ পুত্র অশাস্ত্রীয় নয়। আমরা সে ব্যবস্থার বিচার করতে বসিনি। তাহলে কি করছি? ঋষি ঔর্ব্ব্য তাঁর অননুকণীয় ভঙ্গিমায় আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছেন রাণী কুন্তীকে নিয়ে আমাদের মনে যদি কোনো প্রশ্ন থেকেও থাকে তাহলেও তার সদুত্তর সত্যি আমাদের কারোর কাছে নেই। আমরা কেউই তার স্বাক্ষী নই। এমনকি স্বয়ং ঔর্ব্ব্যও এর স্বাক্ষ্য দিতে পারছেন না।

    -আমি মাদ্রীর সহগমন যে স্বেচ্ছায় তার স্বাক্ষ্য দিতেই পারি। সে ঘটনার সময় আমি এবং শতশৃঙ্গপর্বতবাসী অনেকেই উপস্থিত ছিলাম দুঃখিত চিত্তে।

    -তার পূর্বে ছিলেন না ঋষি,সে কথাও বলাই বাহুল্য।

    গতকালই পিতা তাঁকে জানিয়েছিলেন সুধন্যকে নিয়ন্ত্রণ করবেন গাঙ্গেয়।কিন্তু বিদুর ভাবছিলেন গাঙ্গেয় কতটা সক্ষম হয়েছেন এই চতুর বণিককে নিয়ন্ত্রণ করতে?এর উদ্দেশ্য এখনও পরিস্কার নয়। ধৃতরাষ্ট্র সোজা হয়ে বসেছেন। তাঁর হাত সরে গিয়েছে সিংহাসনের হাতল থেকে। কোলের উপরে যুক্তহস্ত। গ্রীবা উন্নত। ডান কর্ণ,যে দিকে সুধন্য উপবেশন করছেন সেই দিকে উদ্যত। তাহলে কি গাঙ্গেয় অক্ষম হলেন?

    -বণিক সুধন্য কি ধাঁধা সৃষ্টি করতে ইচ্ছুক?

    -না হে ভরতশ্রেষ্ঠ গাঙ্গেয়। আমি বলতে চাই যেখানে সত্য যে কোনো ভাবেই পক্ষপাতী সেখানে এই বিচার অসম্ভব। তাই সে বিচারের বাসনা আমাদের ত্যাগ করাই উচিত।

    -তাহলে আপনি কি উপদেশ করেন বণিক?

    -আমি বলি হস্তিনাপুরের রাজবংশের পরম অনুগ্রহের কথা। রাজ্যাধিকার এই বংশে দীর্ঘ্যকালই আর গণের বিবেচ্য নয়। এর আগেও যখন সংকট দেখা দিয়েছে তখন সেই সংকট মেটাবার দায়িত্ব নিয়েছেন গাঙ্গেয় স্বয়ং এবং মুনিশ্রেষ্ঠ ব্যাস। তাহলে আজ-ই বা কেন আমাদের প্রয়োজন?

    -এই সন্তানসকলের জন্ম হয়েছে এই রাজপ্রাসাদের বাইরে এবং আমাদের কারোর উপস্থিতিতে হয়নি সে কাজ। তাই এই বিচার এবং রাজ্যাধিকার নিয়ে হস্তিনাপুরবাসীর যেন কোনো সন্দেহ না থাকে তাই!

    -গাঙ্গেয়,এই না হলে আপনি ক্ষত্রিয়শ্রেষ্ঠ!এই বিবেচনা আমরা আর কার থেকে আশা করতে পারি! আমি ব্যাক্তিগতভাবে সভাকে অনুরোধ করব,সভা যেন এই বিচারকে গাঙ্গেয় এবং মহর্ষি ব্যাসের হাতেই ছেড়ে দেন। তাছাড়া স্বয়ং মহারাজা ধৃতরাষ্ট্র রয়েছেন। তিনি নিজেই কি তাঁর ভ্রাতৃবংশ রক্ষার জন্য উদ্গ্রীব না? আমার মনে হয় তিনিও অবশ্যই মেনে নেবেন কূলাগ্রজদের বিচার। তাহলে এ নিয়ে অযথা বিতর্কে লাভ কি?

    বলসেন উঠে দাঁড়ায়। কিছু বলার উদ্যোগ করে।সুধন্য বলে,

    -এর চেয়ে অধিক বাক্যব্যয় আমার পক্ষে সমীচিন হবেনা বলসেন। আপনি আমার সুহৃদকূলের অগ্রগণ্য। আমার এ অনুরোধ আশাকরি আপনি রাখবেন!

    বলসেন বাক্যনিরুদ্ধ হলেন। বিদুর ভাবছিলেন কত ধূর্ত্ত এই বণিক। গাঙ্গেয় একে আজকের জন্য সংবরণ করলেন বটে,ভবিষ্যৎ-এর জন্য একটি কাঁটা কিন্তু সুচারুরূপে থেকে গেল। কুন্তী-পুত্রদের স্বীকৃতি দিতে দুজনের কেউ-ই আজ যেমন পিছ-পা নন,তেমনই কিন্তু তাদের ভবিষ্যৎ কার্যের সকল দায়ও নিতে হবে দুজনকেই। গণ,সুধন্য,এমনকি ধৃতরাষ্ট্রও এই দায় মুক্ত। জনগণের মধ্যে বলসেন এবং সুধন্য দুজনেই সুচতুর ভাবে বুনে রাখলেন সন্দেহর বীজ। কুন্তীর প্রতিটি আচরণ এই হস্তিনাপুর খুঁটিয়ে দেখবে এবার থেকে। নকুল ও সহদেবের প্রতি বিমাতা সুলভ সামান্য আচরণও পক্ষান্তরে প্রমাণ করে দেবে তিনি-ই মাদ্রীকে বাধ্য না করে থাকলেও উস্কানি দিয়েছিলেন সহমৃতা হতে। এ প্রথা বাধ্যতামূলক নয়,এমনকি এই প্রথার বিপরীতেই মহর্ষি পরাশর তাঁর সংহিতাতে বিধবা বিবাহেরও নিদান রেখেছেন। বিধবা যদি জীবিতই না থাকে তাহলে বিবাহের কথা আসে কি করে?

    হায় রে সন্দেহ! এমন এক রোগ যে বোধহয় কোনো দেহকেই ছাড়ে না। গতি কমালেন বিদুর। গাঙ্গেয়র কক্ষে এখনও লোক। পিতা ব্যাসদেব কাল কুতুহলশালা ছেড়ে আসবেন তাঁর গৃহে, রাত্রিকালে। আজ রাতটি কাটাবেন মাতা সত্যবতীর কক্ষে বলেই অনুমান। যাত্রাপ্রস্তুতির রাত এখন। পান্ডুর সৎকারাদি ক্রিয়া সমাপন হলেই তিনি রওনা দেবেন। আজ রাত্রেই তাঁর গৃহের পার্শ্বস্থ্য নতুন নির্মিত গৃহে গমন করবেন কুন্তী। তাঁর স্ত্রী রাজা দেবকের কন্যা আরেক পারসবী। সে দায়িত্বে আছে এই গৃহসজ্জার। তাঁর পুত্ররাও যথোচিত সাহায্য করেছে তাদের মা-কে। দেবক-কন্যাকে তাঁর হস্তে গাঙ্গেয় সমর্পণ করেছিলেন একদিন। মহারাজ পান্ডু এবং জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা ধৃতরাষ্ট্রের বিবাহকালেই তাঁর বিবাহ সম্পূর্ণ হয়েছিল। এই রমণী তাঁর অনুরক্তা এতে সন্দেহ নেই। কিন্তু অনুরাগ পরস্পরগামী না হলে তাকে প্রেম বলা যায় না। প্রেম তাঁর একনিষ্ঠ। কিন্তু সেই প্রেমের দায় সারাজীবন বহন করাও কঠিন কাজ নিঃসন্দেহে। বিশেষতঃ, চারপাশে যত সন্দেহের বীজ রয়েছে তাতে কাজটা ক্রমশ কঠিন থেকে কঠিনতর হচ্ছে।

    আচ্ছা,তিনি নিজেও কি সন্দেহাক্রান্ত?

    থামলেন বিদুর! খুব সমস্যাজনক প্রশ্ন। কিছু প্রভাব নিশ্চই পড়েছে তাঁর মনেও। তিনি বিলক্ষণ জানেন কুন্তীকে। প্রয়োজন সিদ্ধ করার জন্য তাঁর নীতিজ্ঞান অসুরনীতির স্বরূপ। জটিল এবং তর্কাতীত নয়। হাসি পেল বিদুরের। নীতিজ্ঞান? তিনি কেনই বা বিচার করবেন এত? পত্নীকে দায়িত্ব দিয়ে এসেছেন প্রিয়তমার গৃহসজ্জার। ধৃতরাষ্ট্র প্রকৃত রাজা না জেনেও তাকে সেবা করে চলেছেন। কৌরবকূলের কোনো রাজাই সেই মহারাজ ভরতের পর থেকে আর বংশধারা সূত্রের দাবী করতে পারে না জেনেও রাজত্বর সমর্থন করছেন। কেন করছেন? না ভূখন্ডের শাসক চাই। শাসক জনসমাজের উন্নতি ঘটাতে পারে বলে তিনি মনে করেন। আজকেও কে শাসক হবে নিয়ে যখন সমস্যা তখনও তিনি বলেননি কেউই শাসনের কোন ঈশ্বরপ্রদত্ত অধিকার নিয়ে আসেনি। তাহলে? তিনি করবেন নীতির বিচার? ধর্মাচারী তিনি বটেই। কিন্তু লোক যেমন ভাবে জানে তেমন না। তাঁর ধর্ম তাঁর নিজস্ব নির্মাণ। সে ধর্মে অপরের বিচারের কাজটাই অচল।


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ধারাবাহিক | ২৪ জুলাই ২০১২ | ১২৬৫ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভালবেসে মতামত দিন