সংসারে উচ্চতম আদর্শ কি ব্রহ্মচর্য্য?পরাশরকে এ প্রশ্ন করেছিলেন সত্যবতী।তাঁর কৌতূহল ছিল খুব স্বাভাবিক।সাধারণভাবে এই ব্রহ্মচর্য্য নিয়ে এত কথা বলা হয়।তাহলে যাঁরা সংসারত্যাগী তাঁদের মধ্যে একাংশ কেন স্ত্রী-পুত্রাদির অভিলাষ রাখেন?অন্য অংশটা,যাঁরা দুরূহ পাহাড় বা জঙ্গলে চলে যান সাধনা করতে সেই অংশটা অতি ক্ষুদ্র।পরাশরের কাছে নানান কাহিনী শুনতে শুনতে তাঁর কৌতূহল জেগেছিল যে এত এত মহা ঋষি বা মুনি কেন সংসার করলেন? তারই সঙ্গে ধীমতি আরেকটি প্রশ্নও করেছিলেন!এই যে যাঁরা সংসার ত্যাগ সত্যি করেন,নারী সংসর্গকেও অনাচার বলে গণ্য করে এক দীর্ঘ্ সময় সাধনা করতে থাকেন বারেবারে দেখা যায় দেবরাজ তাঁদের ভয়ে ভীত,অথবা দেবকূল চূড়ামণি ব্রহ্মা বা বিষ্ণু বা মহাদেব স্বয়ং তাঁকেই বর দিয়ে সন্তুষ্ট করছেন।এই আখ্যানের মধ্যখানে থাকে দেবরাজ ইন্দ্র বা অন্যান্য দেব অপ্সরা পাঠিয়ে নারীর প্রলোভনে ভাঙতে চাইছেন তপস্যা।কেন?নারী কি শুধুই পাপ?তাহলে আবার বশিষ্ঠ থেকে পরাশর স্ত্রী রূপে বা অন্য ভাবে নারী সংসর্গ করেন কেন?
কিছু প্রশ্ন থাকে যার উত্তর কখনোই খুব সহজ নয়।পরাশরের সবচেয়ে বড় সুবিধা হল তিনি খুব ঘোরালো মানুষ না।বশিষ্ঠ-র মত হিসেবী এবং আপাত নিরুত্তাপও তিনি নন।বশিষ্ঠ পত্নী অরুন্ধতীর বশিষ্ঠর বহুগামিতা নিয়ে সন্দেহ ছিল এবং তিনি তা ব্যক্তও করতেন।একাধিক পত্নী এবং শিষ্যদের দ্বারা নিয়োগ ধরলে বশিষ্ঠ বহুগামী বটেই।বশিষ্ঠ নিজে এ নিয়ে সোচ্চার হন নি।অরুন্ধতির ধারায় এমনকি পরাশরের পিতা শক্তির জন্ম না।কিন্তু বারেবারে এই অভিযোগ করায় অরুন্ধতি অভিশাপগ্রস্ত হয়েছিলেন বলে কথন।তাই সপ্ত নক্ষত্রের পাশে তাঁর যে স্থান সেখানে তিনি ক্ষণিক উজ্জ্বল,ক্ষণিক নিষ্প্রভ।যদি ধরেও নেওয়া হয় যে সপ্তঋষির স্থান আকাশে আবিষ্কার করার পরে তার পাশে থাকা নক্ষত্রের সারিতে ওই নক্ষত্রটি ছিল এবং অরুন্ধতিকে স্থান দেওয়া,তারই সঙ্গে পতিব্রাত্য অর্থে প্রশ্নহীন আনুগত্যকে প্রতিষ্ঠা করা উদ্দেশ্য ছিল তাহলে এই অভিশাপের আখ্যানটি সুপ্রযুক্ত বলতে পারেন পরাশর।আবার একই ভাবে একটু অন্য কাহিনী জড়িয়ে আছে মরচীর সঙ্গে তাঁর পিতা ব্রহ্মার দ্বন্দ্বে।মরিচীর সেবা আগে না করে তাঁর স্ত্রী ধর্মব্রতা শ্বশুর ব্রহ্মার সেবা করেছিলেন বলে তিনি অভিশপ্ত হন।এখানে বহুগামিতার অভিযোগ সরাসরি না থাকলেও স্ত্রী-ধন দখলের প্রশ্ন অবশ্যই আছে।তাছাড়া খুব সুক্ষভাবে হলেও যদি যৌন অধিকার এবং সন্দেহ জড়িয়ে না থাকে এর সঙ্গে তাহলে এর কঠোর অভিশাপ কেন?ধর্মব্রতার শরীরকে পাথর হয়ে যেতে হবে?তাহলে শরীর-ই কি দায়ী না পরোক্ষে?এই শরীরের জন্যই কি ব্রহ্মাও এই পুত্রবধূর সেবার জন্য উদ্গ্রীব?জটিল অবস্থান!
পরবর্তীতে সংহিতার রচয়িতা পরাশর তাই সত্যবতীর প্রশ্নের উত্তরে ভেবেছিলেন গভীরভাবেই।এর আগে অবধি এ ছিল তাঁর কাছে প্রথা।তাই সে সহজ এবং স্বাভাবিক।কিন্তু সত্যবতীর প্রশ্ন একে অন্য আলোকে প্রতিভাত করলো তাঁর কাছে!শাস্ত্র বলছে চতুরাশ্রমের কথা।এই শ্রেষ্ঠ।ঋষিগণ শুধু পুরোহিত ছিলেন না,তাঁরা যোদ্ধাও।তাছাড়া এককালে বংশ উৎপাদন একটি আজকের চেয়েও বড় কাজ ছিল।জনসংখ্যার আধিক্যই একমাত্র শত্রুর আক্রমণ থেকে খাদ্যের সঞ্চয়ে সাহায্য করতে পারে।যত বড় গোষ্ঠী তত তার শক্তি।তাই সংসারত্যাগীর ভূমিকা প্রত্যক্ষে নিন্দিত না হলেও বহুল প্রশংসিত ছিল না।তাছাড়া শুধু ব্রাহ্মণার্থে মুনি বা ঋষির সঙ্গে অনেক পার্থক্য আছে সংসারত্যাগীর।মুনি বা ঋষি প্রচলিত ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ ত্যাগ করছেন না।তিনি তার অংশ হিসেবেই অবস্থান করছেন।কিন্তু সন্ন্যাসীন্ তা নয়।বহু কৃচ্ছ সাধনে তিনি পন্থা খুঁজছেন মুক্তির।এই কষ্ট সাধনকে বাকী সমাজ সমীহ করেছে যুগে যুগে।বুঝতে চেয়েছে একে।সেই চাওয়া কখনো ঈর্ষার জন্ম দিয়েছে তো কখনো ভীতির।দেব কাহিনীগুলি এরই রূপক।এটা কাহিনীর একাংশ।অন্য অংশ হল পুরুষ নারীর বিভেদ।নারী ভোগ্যা।এই ধারণা তাঁদের ব্যবস্থায় বহুকাল প্রচলিত।তাই সমাজ ত্যাগিনী নারীর নিরাপত্তার প্রশ্ন আছে।পুরুষ যত সহজে সমাজ ত্যাগ করতে পারেন নারীকে তত সহজে করতে দেওয়া যায় না।দুটি মুখ্য কারণ।প্রথম কারণ পুরুষেরই দুর্বৃত্তি।যেখানে গ্রামে বা শহরে অবাধ যৌননিপীড়ন চলে সেখানে নির্জন অরণ্যে বলাৎকার কে প্রতিরোধ করবে?তার থেকে যে সন্তানের জন্ম হবে তাকে কোন স্থান দেবে সমাজ।মুনি বা ঋষির স্ত্রী-গণ বহুবার ক্ষমতাবানের দ্বারা ধর্ষিত হয়েছেন কাহিনী এবং বাস্তবে।তাহলে?অন্যদিকে আছে আরেকটি সামাজিক সমস্যা।নারীর অস্তিত্ত্ব খর্ব হতে হতে এমন এক জায়গায় ঠেকেছে যে এমন হতেই পারে নারীর সমাজত্যাগ সহজে সম্ভব হলে সমাজে নারী-পুরুষ ভারসাম্য চূড়ান্ত বিঘ্নিত হবে।তা সমাজ বা ব্যবস্থা মানতে অক্ষম।পরাশর বহু দেশ ভ্রমণ করেছেন।তিনি জানেন সর্বত্র নারীর এই করুণ অবস্থান নয়।এই যে রমণী যিনি এ প্রশ্ন করেছেন তাঁকে তিনি আশ্রমকন্যা শকুন্তলা না।কাজেই তাঁর সঙ্গে বিবাহপূর্ব সহবাসের জন্য বাধ্যত তাঁকেই পতিত্বে বরণ করতে হবে এমনও না।অনেকানেক বিরোধ আছে সমাজে সমাজে।এ উত্তর সহজ না।
অন্যদিকে রয়েছে আরেকটি প্রশ্ন।নারীর কেন সকল পাপের দায়!এ প্রশ্নের উত্তর পরাশর সম্যক জানেন খুব কঠিন। একথা বলা ঠিক হবে না।নারীর দায়ের উত্তরে তিনি বলেছিলেন সমাজধর্মের কথা।সে ধর্ম খুবই জটিল।নারী ও পুরুষ এই দুটি শ্রেণীর মধ্যে দুর্বল হল নারী।তার চরিত্র নিয়েই সঙ্কট।বা এভাবেও বলা যায় পুরুষ জানে তার কোনো দিশা নেই।ফলতঃ সততই তার সন্দেহ থাকে নারীর প্রতি।কেন?তার ব্যাখ্যায় আর যান নি পরাশর।স্থানীয় আসব পান করে ততক্ষণে তাঁর রক্তচক্ষু।তিনি সত্যবতীকে নিজের বুকে টেনে নিয়েছিলেন আচমকা।সবলে পিষে দিয়েছিলেন তাঁর সুউন্নত স্তন।ঠোঁটে কেটে বসেছিল তাঁর দংশন।সত্যবতী প্রস্তুত ছিলেন না।দ্বৈপায়ণের জন্মের এক বছর অতিক্রান্ত হয়ে গ্যাছে।এই এক বছর তাঁদের মধ্যে দেহজ সম্পর্ক ক্বচ্চিৎ ঘটেছে।প্রাথমিক বিহ্বলতা কাটিয়ে সত্যবতীর রক্তেও বেজেছিল রণদামামা।বাঘ ও বাঘিনীর সঙ্গমের শব্দে জেগে উঠেছিল দিগ্বিদিক।কুটিরের অন্য প্রান্তে শুয়ে থাকা দ্বৈপায়ন সেই শব্দে জেগে ওঠার আগেই তাকে নিয়ে চলে গিয়েছিল সত্যবতীর দাসী।সে দিকে তাকানোর ফুরসতও ছিল না তাঁদের তখন।পরাশর যখন নিজেকে স্থাপন করলেন সত্যবতীর মধ্যে ততক্ষণে নারীর পাপের প্রশ্ন হারিয়ে গ্যাছে মহাশূন্যে।
কিন্তু সেই প্রশ্নই যখন দেবব্রত-র সামনে এনেছিলেন তখন এক অন্য যুগ,অন্য সময়।নিয়োগ প্রথার পক্ষে বলছিলেন দেবব্রত।ঋষি দীর্ঘ্যতমার উপাখ্যান বয়ান করছিলেন।সেই উপাখ্যানই আবার একই প্রশ্ন নিয়ে এসেছিল তাঁর সামনে।উতথ্য দেবগুরু বৃহষ্পতির ভ্রাতা।তাঁর স্ত্রী মমতা।একদিন বৃহস্পতি কামতাড়িত দশায় গর্ভিণী মমতাকে আশ্রমে প্রবেশ করে দেখেন এবং সঙ্গম প্রার্থনা করেন।স্ত্রীজাতি সেই আমলে কারোর অধীন ছিল না।তবুও মমতা গর্ভাবস্থায় সঙ্গমে অসম্মত হলেন।বৃহষ্পতি ধর্ষণ করেন তাঁকে।গর্ভস্থ পুত্র অন্ধ অবস্থায় জন্মগ্রহণ করেন।সেই পুত্র বেদবিদ্ দীর্ঘ্যতমা।কালে তিনি ব্রাহ্মণকন্যা প্রদ্বেষীকে বিয়ে করেন।গৌতমাদি ঋষির জন্ম দেন।এর পরে একদিন জানতে পারেন তাঁর অন্ধ হবার আনুপূর্বিক বৃত্তান্ত।দেবগুরুর এই আচরণের জন্য ক্রুদ্ধ দীর্ঘ্যতমা বিচার চাইলেন।কিন্তু সে বিচার তিনি পেলেন না।দেব সমাজ গুরুর বিরোধে সাহস করেননি।তাছাড়া এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট নিয়মাদি না থাকায় কোন পথে বিরোধ হবে তাও জানা ছিল না।
দীর্ঘ্যতমা সেই ক্রোধে গো ধর্ম গ্রহণ করেন।গো ধর্মাচারীরা সে যুগের এক মরমীয়া সাধক সম্প্রদায়।তাঁরা সংসার এবং সম্পদের বন্ধন স্বীকার করতেন না।মানুষের প্রতিপালিত গো আচরণ থেকেই এই ধর্মের উৎপত্তি।ক্ষুধার কালে যে কোনো ক্ষেত্রের তৃণাদি শ্রেয় এবং রমন কালে গো জাতীয়দের কোনো বাছবিচার নেই।অন্যদিকে অন্যান্য ব্রাহ্মণেরা তখন তাঁদের নিজস্ব সম্পদ রক্ষার বিষয়ে সতর্ক হয়ে উঠছেন।কাজেই দু পক্ষের বিরোধ লেগেই থাকত।গো ধার্মিকরা বলতেন বেদ তাঁদের কার্য্য সমর্থন করে।কারণ বেদাদির অধিষ্ঠাত্রী দেব এবং দেবী ব্রহ্মা এবং সরস্বতী বা পদ্মা আসলে পিতা ও কন্যা।কাজেই এ বিষয়ে কোনো বিধি নিষেধ চলতে পারেনা। এসব আরোপ করা মানেই হল বেদকে অস্বীকার করা।বেদ এক মুক্ত সমাজের আদর্শ।অন্যদিকে উপনিষদে এ প্রশ্নের মীমাংসা ব্রাহ্মণরা করতে শুরু করেছেন সবে।তাঁদের মতে ত্রিদেব-এর অন্যতম ব্রহ্মার ক্ষেত্রে কর্মের ফলভোগের কোনো দায় নেই।সে দায় আছে অন্যান্য দেব সহ মানুষের।এমনকি ইন্দ্রের মত দেবতাও তখন আর প্রধান নন।তাঁকেও নির্ধারণ করা হয়েছে কর্মফল দিয়েই।ইন্দ্র কোনো এক দেব নন।যিনি ইহলোকে তেমন কর্ম করবেন তিনিই দেবলোকে সেই পূণ্যের ফলে ইন্দ্রত্ব প্রাপ্ত হতে পারেন।এতে করে ব্রাহ্মণদের পক্ষে রাজন্যবর্গকে আরো দান এবং আরো যজ্ঞাদিতে উৎসাহিত করাও সম্ভব হয়েছিল।কিন্তু ব্রহ্মাদি দেব এ সকল বিধিনিষেধের উর্দ্ধে।এ যুক্তি মানেননি গোধার্মিকরা।
বেদবিদ্ দীর্ঘ্যতমা বৃহস্পতির অত্যাচারের সুরাহা না করতে পেরেই যোগ দিয়েছিলেন এই গো ধার্মিকদের পক্ষে।সেই অনুযায়ী তিনি আচরণও করতেন।অন্যান্য ঋষির স্ত্রী বা কন্যাগমন তাঁর কাছে স্বাভাবিক মাত্র।ক্ষুব্ধ এবং ক্রুদ্ধ হলেন স্ত্রী প্রদ্বেষী।দীর্ঘ্যতমা অন্ধ এবং গো ধার্মিক হবার ফলে সংসারে সম্পদ সৃষ্টিতে উৎসাহ ত্যাগ করেন।প্রদ্বেষীকেই ভার নিতে হয়েছিল সংসার এবং পুত্রদের।তিনি দীর্ঘ্যতমাকে অমান্য করতে থাকেন।তখন দীর্ঘ্যতমাই বেদজ্ঞদের মধ্যে এই নিয়ম আনতে চাইলেন যে স্ত্রী এক পুরুষের অধীন থাকবে।সেই পুরুষের জীবিত অবস্থায় বা মৃত্যুর পরেও অন্য পুরুষ সহবাস করতে পারবেন না।কোনো সম্পদের অধিকার স্ত্রী-র নয়।বেদবিদ্ দীর্ঘ্যতমা ঋক্বেদের নারীর অধিকারকেই বাতিল করে দিলেন ক্রোধে।অপস্তম সুক্তকে নস্যাৎ করে দিলেন।কিন্তু দীর্ঘ্যতমা তত ক্ষমতাবানও ছিলেন না।তাঁর বিধান গুরুত্ব পেলো না তখন।বরং প্রদ্বেষী তাঁর পুত্রদের সহায়তায় এই ঋষিকে হত্যার উদ্দেশ্যে ভাসিয়ে দিলেন নদীর জলে।রাজা বলি তাঁকে উদ্ধার করলেন।নিঃসন্তান রাজা নিজ রাণী সুদেষ্ণার গর্ভে সন্তান উৎপাদনের জন্য নিয়োগ করলেন দীর্ঘ্যতমাকে।সুদেষ্ণা প্রথমে পাঠিয়েছিলেন নিজের দাই-কে।তাঁর গর্ভে পুত্র উৎপাদনের পর বলিকে ঋষি জানালেন এ পুত্র তাঁর।বলির নয়।কারণ সুদেষ্ণা ছলনা করেছেন তাঁর সঙ্গে।তখন আবার বলি সুদেষ্ণাকে পাঠালেন ঋষির কাছে।সুদেষ্ণার গর্ভে ঋষি অঙ্গ,বঙ্গ,কলিঙ্গ,পুন্ড্র,সুহ্ম নামের সন্তান উৎপাদন করলেন।সেই সন্তানরাই পরবর্তীকালে এতদ অঞ্চলের অধিপতি হলেন এবং এই নামের দেশ স্থাপন করলেন।এ সকল দেশের বেদবিরোধ এভাবেও প্রতিষ্ঠা পেয়েছে বলে কথিত।এক কালের বেদবিদ্ এবং পরবর্তীতে গোধার্মিকের সন্তানের রাজ্যে বেদ চলে কী করে?
সত্যবতীর মনে পড়ে গিয়েছিল আরেকটি আখ্যান।উদ্দালকপুত্র শ্বেতকেতুর আখ্যান।বালক শ্বেতকেতুর সামনে দিয়েই মা-কে নিয়ে চলে গিয়েছিল আরেক ব্রাহ্মণ সঙ্গমের জন্য।উদাসীন পিতা বলেছিলেন এই গো ধর্মই আচরণীয়,তাই দোষের কিছু নেই।শ্বেতকেতু মানেন নি।সারাজীবন গো সম্পদের অধিকারী ব্রাহ্মণ এবং রাজাদের একত্রিত করেছিলেন এর বিরুদ্ধে।স্ত্রী এবং সম্পদের উপর পুরুষের বংশানুক্রমিক অধিকার তিনি সুনিশ্চিত করেছিলেন।কাজেই নিয়োগের কাজে সত্যবতীর ব্যাসকে আমন্ত্রণ জানাতে বাঁধা ছিল না।কিন্তু প্রশ্ন আবার এসেছিল ভীড় করে।এই কারণেই সংহিতাকার পরাশর তাঁর প্রশ্নের উত্তর দেননি সরাসরি?এত পরস্পরবিরোধকে সমাধান করবেন কি করে?তাছাড়া যে রমণী ব্রাহ্মণ বা ক্ষত্রিয় কূলধর্মের ধার ধারেনা,যে রমণী তার কন্যকাবস্থা বিসর্জন দিয়েছেন তাঁর জন্য স্বচ্ছন্দে,তাঁকে এই প্রতারণা তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না।এই কারণেই ওই শক্তিমান পন্ডিত পুরুষটিকে এত ভালবেসেছেন সত্যবতী।হঠাৎ তাঁর মনে পড়লো তিনি কখনো পরাশরের সংহিতা পাঠ শ্রবণ করেননি।করতে হবে একদিন, এ বাসনা জেগেছিল তাঁর!
গাঙ্গেয়,যাঁর মাতা এবং মাতৃকূল নারীর অধিকারকে অদ্যপি অস্বীকার করেননা তিনি নিজে কেমন করে এই স্ববিরোধ সহ্য করেন?এ প্রশ্নও জেগেছিল তাঁর!কেমন করে শাল্বের পরাজয় এবং অম্বা প্রত্যাখ্যান করে ফিরে যাওয়ার পর রথের উপরে অপ্রকৃতিস্থা অম্বার স্তনভারে পিষ্ট হতে হতেও প্রতিজ্ঞা স্মরণ রেখেছিলেন ভীষ্ম?জানতে ইচ্ছে করেছে তাঁর!কিন্তু ওই তাঁর বিবাহকালের যুবকটি আজ বৃদ্ধ হয়ে গ্যাছেন বটে,তবুও নিশ্চুপ এসকল প্রশ্নের উত্তরে।মহাসমুদ্রের মতই যাবতীয় তরঙ্গ লুকিয়ে রেখেছেন গূঢ় অভ্যন্তরে,যার নাগাল কারোর পক্ষেই পাওয়া কোনোদিন সম্ভব না।আজ যখন তাঁর বিদায়কাল সমাগত তখন এই সকালের সদ্য কুয়াশা ছেঁড়া রোদে,প্রাসাদ অলিন্দে দাঁড়িয়ে সত্যবতী দেখছিলেন ঋজু সৌম্য এক প্রবীণ প্রবেশ করছেন ধীর গতিতে।গজগমনে আসছেন সিংহকটি পুরুষটি।আচ্ছা যদি ওই বৃদ্ধ শান্তনুর বদলে এই প্রবীণ তাঁর স্বামী হতেন?সত্যবতীর চেয়ে বয়স ভীষ্মের বেশী অবশ্যই।তাহলে?তাহলে আজ কি এত কিছু ঘটতো?তাঁকেও কি আজ যেতে হত এই হস্তিনাপুর প্রাসাদ ছেড়ে?কাশীরাজদুহিতা অম্বা প্রকৃতিস্থ হলেও এঁকেই তো কামনা করা উচিত ছিল!সুপুরুষ,ধীর বাচন,ভয়ঙ্কর যোদ্ধা এই পুরুষটিকে কামনা না করে থাকা কঠিন।সেই কঠিন কাজ সত্যবতী করেছেন এতকাল।অবশ্য এই পুরুষ বলেই একাজ সহজ ছিল।আসক্তির লেশমাত্র দেখেননি কখনো এর চোখে সত্যবতী।সামনে এলে সর্বদা মাটির দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে মাতৃসম্বোধনে কথা বলেছেন ভীষ্ম।চোখই দেখেননি দূর থেকে ছাড়া।আর যে চোখ দেখেছেন তাতে আছে এক সুদূর দৃষ্টি,এক অমোঘ শূন্যতা।তার উৎস কি?ব্যাকুল হবার মতন মানুষ সত্যবতী না।তা তিনি হনও নি।কিন্তু বুকের কাছে কখনো কখনো একটা তীব্র মোচড় অনুভব করেছেন। ওই উন্নত শিরকে নিজের বুকের মধ্যে এনে কিঞ্চিত স্থান দিতে ইচ্ছে করেছে।কিছুক্ষণ বা বহুক্ষণ!নিঃসঙ্গ,ভীষণ বঞ্চিত এক একাকি সদ্যকৈশোরউত্তীর্ণ-কে আজও দেখতে পান সত্যবতী।যে বন্য ঘোড়াকে বশ মানাতে মানাতেও তাঁর সন্নিধানেই এলেই অতি শান্ত হয়ে দাঁড়াতো,সেই মাটির দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে।আচ্ছা,সত্যবতীর রূপ জানেন গাঙ্গেয়?দেখেছেন কখনো,দূর থেকে হলেও?জানা নেই তাঁর।জানার কোনো পথও নেই আর।একবার,শুধু একবার অত্যন্ত কৌতূহলে তাঁকে পরীক্ষা করেছিলেন সত্যবতী।ভ্রাতার পত্নীদ্বয়ের গর্ভ উৎপাদনের প্রস্তাব নিয়ে।ভেঙে দেখতে চেয়েছিলেন এই নির্বাক পুরুষকে।সেই প্রথম স্বর উচ্চগ্রামে গিয়েছিল কিঞ্চিত।যখন ভীষ্ম তাঁকেই স্মরণ করিয়েছিলেন তাঁর কাছে করা প্রতিজ্ঞার কথা।বলিষ্ঠ এক পুরুষ কম্বুকন্ঠে বলেছিলেন,
-ইন্দ্র যদিচ স্বর্গচ্যুত হয়,ধর্ম যদিচ স্বর্গচ্যুত হয়...ভীষ্ম তবুও তাঁর প্রতিজ্ঞাচ্যুত হবেন না।
সত্যবতী প্রতিটি কথাকে পরম আস্বাদে গ্রহণ করেছিলেন।কোথাও যেন শান্তিও হচ্ছিল তাঁর।তাঁর পুত্রবধুদের ক্ষেত্রোৎপাদনে আগ্রহ যদি দেখাতেন গাঙ্গেয় তাহলে,তাহলে হয় তো অন্তরে ক্ষুণ্ণই হতেন সত্যবতী।খুব মনে হত তাঁর এ সকল এদের প্রাপ্য নয়।এরা এর যোগ্য নয়।একাকী জানতেন তিনি এক দুর্মর কষ্ট গ্রাস করে থাকতো তাঁকে।প্রাসাদের বা রাজশাসনের কাজও তাঁর থাকতো না সেদিন ভীষ্ম যদি প্রতিজ্ঞাভঙ্গ করে দায় নিতেন।তিনি এই প্রাসাদের অজস্র কক্ষের একটি কক্ষে প্রাক্তন রাজরাণী,রাজমাতা এবং বর্ষিয়সী হয়েই অনেকদিন আগেই চলে যেতেন বিস্মৃতিতে।কেন হলেন না ভীষ্ম রাজি?শুধু কি তাঁরই প্রতিজ্ঞার জন্য?শাস্ত্রবিৎ জানতেনই তিনি রাজী হলে কী কী হবে,আর না হলেই বা কী!ব্যাসের কথা সম্মুখে বলেননি এর আগে ঠিকই,কিন্তু জানতেন তো দেবব্রত সবই।তবে?কেন হলেন না একথার প্রকৃত উত্তর শুধু ভীষ্ম দিতে পারতেন।তিনি দেবেন না।তাই এর উত্তর স্বয়ং বিধাতাপুরুষও দিতে পারবেন না।
আজ সব মনে পড়ছে একে একে তাঁর।এত দিন তিনিও বন্দী ছিলেন এই প্রাসাদের মায়াবী বন্ধনে।কর্তব্যের কারাগারে মূর্খ বন্দী এই প্রবীণের মতই।আজ সব একে একে ফিরে আসছে স্মৃতিতে।থাক্!আজ আর না।সামনের দিনগুলোতে সঙ্গে শুধুই সকল স্মৃতি।একে তিনি একটু একটু করে উলটে পালটে দেখবেন সঙ্গোপনে।লোক সমাজ জানবেনা,তাই বলতেও পারবেনা কিছু।দূরের থেকে হলেও এই একটি সঙ্গ ছিল তাঁর,যাঁর সন্নিধানে তাঁরও ইচ্ছা হত কিশোরীর মত রাঙা হয়ে উঠতে লাজে।
-নিলাজ!
লোকসমাজ ধুলো দেবে তাঁর গায়ে একথা শুনলে।হোক স্বপত্নী পুত্র,মাতাতো তিনি বটেই।বিমাতা হলেও এ কর্ম অতিব নিন্দিত কর্ম।মাতা-পুত্রে সম্পর্কের চিন্তাও বিষাক্ত।
লোকসমাজ?ঠোঁট বেঁকে গেল সত্যবতীর ঝলসানো ব্যাঙ্গে।এই বৃহস্পতি,দীর্ঘ্যতমা,ইন্দ্রের অন্য মুনিপত্নীতে প্রভূত আসক্তি,রাজন্য কূলের দূর্বৃত্তি এসবের পরেও তারা কথা বলবে?বলার সাহস করবে?শান্তনুর কামতাড়নায় বঞ্চিত পুত্রের সেবা দীর্ঘ্য দীর্ঘ্যকাল ভোগ করার পরেও কথা বলবে পাপ-পুণ্য নিয়ে?নারীর পাপ নিয়ে কথা বলবে?রাজা রামের মত,পত্নী কারাগারে ধর্ষিতা কিনা তার পরীক্ষায় বসবে?চোদ্দ বছরের বনবাসান্তে অপরিসীম লোকক্ষয়ের যুদ্ধ সমাপন করে,স্বর্ণলঙ্কা ধ্বংস করে জানতে চাইবে সীতা কি পবিত্র?কারণ সে নারী!সেই দোষভাগিনী তাই।পুরুষোত্তমের আদর্শে নির্মিত লোকসমাজ কথা বলবে পাপ-পুণ্য নিয়ে!কি তামাশা এবে!
-মাতা।
ছিন্ন হল ভাবনার জাল।কখন এরই মধ্যে তাঁর কক্ষে প্রবেশ করেছেন দেবব্রত।কখন এসছিল প্রতিহারিণী?কখন তিনি আদেশ দিলেন প্রবেশের?সকলই স্বপ্নে বুঝিবা!
-দেবব্রত আপনার সন্নিধানে। কী আদেশ?