অনেক কাল আগে একবার এক বাঙালি বৌদ্ধ তান্ত্রিকের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। তিনি তখন বেশ বৃদ্ধ। মণিভূষণ বড়ুয়া। কলকাতায় এক পালি ভাষার সেমিনারে তাঁর সঙ্গে পরিচয়। আমরা দুজনেই ছিলাম শ্রোতার সারিতে। ঘটনাচক্রে পরিচয় এবং আলাপের সূত্রপাত। মধ্য কলকাতার একটি হোটেলে এক রাত্রি থেকে গেছিলাম তাঁর সঙ্গে। নানা কথায় তিনি কতগুলো বিষয় নিয়ে কিছু মন্তব্য করেছিলেন। মানুষটির অতীত আমি খুব একটা যে জেনেছিলাম তা নয়। কথায় কথায় বাংলাদেশ উঠে এসেছিল। এবং চট্টগ্রাম-ও। তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক থাকতে পারে বাংলাদেশ ও চট্টগ্রামের আমার এমনই অনুমান। পরের দিন তাঁর রওনা হওয়ার কথা ছিল ধর্মশালায় পথে। সেমিনারের কেউ একজন প্রশ্ন তুলেছিলেন যে বজ্রযান মতের টেক্সট যখন পালি ভাষায় অন্যান্য টেক্সট-এর মতন পাওয়া যায়নি তখন কেন বজ্রযান পদ্ধতিকে ধরা হবে বৌদ্ধ পদ্ধতি হিসেবে! যিনি প্রশ্ন করেছিলেন তিনি তরুণ এবং অবশ্য বজ্রযানপন্থী না। আমারও বয়স কম-ই ছিল। সুতরাং একটু বিরোধ করে ফেলেছিলাম আমার সামান্য সম্বল নিয়ে। বলেছিলাম যে ঠিক এই ভাবেই চার্বাকদের যেহেতু কোনো টেক্সট পাওয়া যায় না তাই তাঁদেরকে উড়িয়ে দেবার চেষ্টা একটা উত্তরভারতীয় দর্শনচর্চার মধ্যে আমি দেখেছি। হাজার বছর আগের পুঁথি নানা কারণে নষ্ট হতে পারে, নষ্ট করাও হতে পারে। তার চেয়েও বড় কথা কোনো দর্শন এমনও হতে পারে যাতে কোনো পুঁথিই থাকবে না। বস্তুত এ দেশের বহু প্রাচীন দর্শনই শুরু হয়েছে লেখনীর জ্ঞান না থাকা অবস্থায়। পরে লিখিত হয়েছে। সম্পাদিত হয়েছে। নানা মত প্রবেশ করেছে। নানা সুবিধে অনুযায়ী সাজানো হয়েছে। তাহলে তো একই যুক্তিতে সকলকেই বাতিল করতে হয়। হতে পারে সেই টেক্সট-এ থাকা কিছু বিষয় আমার মতে অপ্রাসঙ্গিক বা আরোপিত। এমনকি এও হতে পারে যে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বিকৃতি আছে সেখানে। কিন্তু তার জন্তয সবটাই বাতিল করার মানে হয় না।
বুদ্ধের তন্ত্রশিক্ষার যেহেতু উল্লেখ পালি ক্যাননে নেই তাই পরে যাঁরা বুদ্ধ থেকেই এর শুরু বলে দাবী করছেন তাঁরা মিথ্যাবাদী, এও আমার কাছে সরল বিশ্বাস মাত্র। বুদ্ধ তান্ত্রিক সাধনা করতেন এমন বিশ্বাসও আমার নেই, করতেন না এমনও না। আমি বস্তুত বিশ্বাসের ধারকাছ দিয়েই হাঁটি না, যুক্তি দিয়ে হাঁটি। এই তর্ক-বিতর্কের আসরেই ওনার সঙ্গে পরিচয় জমে ওঠে। সুতরাং সারা রাত এক অদ্ভুত আড্ডার সূত্রপাত হয়। আমার মতন বালখিল্যর সঙ্গে তিনি এক অমল আড্ডায় মেতে ওঠেন।
সে আড্ডায় আমার কাজ ছিল ওনাকে হালকা করে প্রসঙ্গ জুগিয়ে যাওয়া। উনি কথা বলে যাবেন। তো একসময়ে বলেছিলাম যে আমার বহু সময়েই মনে হয়েছে বুদ্ধের ধর্মের এ দেশে পতনের কারণ তার মধ্যেকার আর্থিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতার বিরোধ। এত বড় ভূখণ্ডের সমস্ত রাজত্বকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য যে জ্ঞান এবং পাণ্ডিত্যের প্রয়োজন, যে কাজটা প্রাথমিকভাবে চার্চ করেছিল ইউরোপে সেটা করার মতন বুদ্ধের পরে কেউ তৈরী হননি। যে ভাবে সমস্ত শ্রেণীকে একটি মূল সুতোয় বেঁধে চলার মতন নীতিসমূহ প্রবর্তন তিনি করেছিলেন তাতে কিছু সময় চলার জোর অবশ্যই ছিল, আবার উল্টোদিকে দীর্ঘ সময় চলার জোর ছিল না। কেন না চুরি কোরো না বললে সকল শ্রেষ্ঠী মুনাফা করবে না এটা ভাবাই যায় না! অথবা রাজারা অন্যের জিনিস ছিনিয়ে নেবে না, তাও ভাবা যায় না। তাহলে সেই মুনাফা/ছিনিয়ে নেওয়া যে ব্যাক্তিজীবন বনাম পেশাজীবন বনাম রাষ্ট্রজীবনের সমস্যা তৈরী করবে তার সমাধান করার মতন কাউকে লাগতো! সেইটা ছিল না বা পাওয়া যায়নি বলে এত টুকরো হয়ে গেল। এই প্রসঙ্গেই এসেছিল বজ্রযানের বিস্তৃত আলোচনা। সে আলোচনার সব এখানে লেখার অবকাশ নেই, কিন্তু বজ্রযান ও অন্তজ শ্রেণীর সম্পর্ক লেখার প্রয়োজন আছে।
বজ্রযানের উৎপত্তি বাংলায়, ওড়িষায় না বর্তমান পাকিস্তানের সোয়াত ভ্যালীতে এ নিয়ে বিস্তর চর্চা আছে। জল্পনা-কল্পনা আছে। কিন্তু নালন্দা মহাবিহার যে এই চর্চার অন্যতম শরিক ছিল এ নিশ্চিত। তার আগে অবধি বৌদ্ধ ধর্মের প্রধান শাখায় একধরণের ঈশ্বর প্রকল্প এসে গিয়েছে। নিরীশ্বর ধর্মকে প্রায়-ঈশ্বরকল্প করার মধ্যে দিয়েই তার ধ্বংসের বীজ বপন করা হয়েছে এ আমি বলেছিলাম। তিনি আমাকে বলেছিলেন ভেতর থেকে বুদ্ধের ধর্মকে ধ্বংস করা হয়েছে ঠিকই। কিন্তু সবটাই যে অসৎ উদ্দেশ্যে হয়েছে এমন না। জানতে চাইলাম যখন তখন বললেন, নিরীশ্বরদর্শন/ধর্মকে মানা এ দেশের তখনকার অধিবাসীদের পক্ষে খুব সম্ভব ছিল না। তাই সামাজিক একটি ধর্মকে ঈশ্বরমুখী করার জন্যই বুদ্ধকে ঈশ্বর করে তুলতে হয়। তার বিপরীতে আসে শয়তান। মার।
আমি বললাম যে কারণে এক সময়ে গীতা তৈরী করে নানান দার্শনিক স্কুল যাঁরা আদতেই নিরীশ্বরবাদী তাঁদেরকেও ঈশ্বরবাদী করে নিতে হয় সেই একই কারণে তাহলে? তিনি সম্মতি দিলেন। আমি শুনছিলাম। তর্কের থেকে শোনার আগ্রহই আমার বেশী ছিল। কথা প্রসঙ্গে এলো সেই সময়কালের পরের রীতিনীতির কথা। তিনি তাঁর ভাবধারায় বলছিলেন ডাকিনীতন্ত্রের কথা। যা বাংলাতে এক সময়ে সাঙ্ঘাতিক প্রভাব ফেলেছিল। ডাকিনীতন্ত্রে এসেছিল ঘুড়ির ব্যবহার। এক অপদেবতা হিসেবে। এর পরের ব্যাখ্যা তিনি করেননি। অন্য কথায় চলে গেছিলেন। আমিও পরে সেই সূত্র ধরে খোঁজ করে দেখছিলাম ও তাঁর অন্য কথার সূত্রে দেখছিলাম যে এটা সম্ভব। আমি তাঁর কথাগুলোকে পরে আমার মতন করে সাজিয়েছি। সঙ্গে জুড়ে নিয়েছি ইতিহাস। কিছু আমার ব্যাখ্যা।
মূল তিনটি প্রকল্প। ঈশ্বর প্রকল্প নির্মাণ (যদিও বুদ্ধ সেই অর্থে ঈশ্বর নন), মূর্তি নির্মাণ এবং প্রথা নির্মাণ- এই তিনটেই মহা গুরুত্বপূর্ণ। এবং সে নির্মাণ চলেছে আসলে গোটা মধ্যযুগ ধরেই। একে একে লিখি।
১- বুদ্ধের অবতারত্ব। তার বিপরীতে শয়তানের কাহিনী। 'মার' প্রথমদিকে ছিল চাররকমের বিরক্তিকর ব্যাপার মাত্র।
ক) ক্লেশ-মার
খ) মৃত্যু-মার
গ) স্কন্ধ-মার
ঘ) দেবপুত্ত-মার
এঁরা ক্লেশ, মৃত্যু, শর্তাধীন জীবন ও বিগড়ে যাওয়া দেবপুত্রের বজ্জাতির মাধ্যমে যে নির্বাণ চায় তাকে বিরক্ত করতো। কিন্তু কালে কালে যত বেশি ব্রাহ্মণ্যবাদী চ্যালেঞ্জ বাড়লো তত বেশি করে বুদ্ধকে অবতার গড়তে হল। 'মার'-কে শয়তানের আদল দিতে হল।
২- এখানেই এল মূর্তি নির্মাণের প্রাসঙ্গিকতা। এল আসলে বিদেশাগতদের সংস্কৃতির সৌজন্যে। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চলে বারেবারে আক্রমণ হচ্ছে। ভারতের নানা প্রান্তে ব্যবসার জন্য বিদেশীরা আসছে। আসছে আক্রমণও। গ্রীকদের আক্রমণ বুদ্ধধর্মের ক্ষেত্রে একটা কোয়ালিটেটিভ চেঞ্জ আনলো। গান্ধার শিল্পের কথা সকলেই জানেন। সঙ্গে জুড়ে নিন গ্রীকো-বুদ্ধিজম এর ধারণা। মূর্তি নির্মাণ সূত্রে এঁরাই হেলেনিস্টিক ট্র্যাডিশনকে আনলেন। সেই ট্র্যাডিশন বয়েই তারপরে কুষাণযুগ।শুরু মোটামুটি ৩০ সি ই। কুষাণযুগের মূর্তির পরিচয় আলাদা করে দিচ্ছি না। কিন্তু এই সেই যুগ যেখানে বুদ্ধমূর্তি ছাড়াও কিছু রীতিনীতির এবং দেবতা-দানবের প্রবেশ ঘটলো।
৩- প্রথা নির্মিত হয় সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের হাত ধরে। কুষাণদের হাতে হেলেনিস্টিক ট্র্যাডিশন ছাড়াও ছিল চীনের সংস্কৃতির ফসল। এবং শেষ পর্যায়ে যুক্ত হয়েছে বৈষ্ণবভাবধারা। একে একে লিখি। গ্রীকদের থেকে ভাস্কর্য্য ও কিছু দেবতা তাঁরা নিলেন। চীনের এক পুরোনো দেবতা তিয়াঙ্গো হল কুকুরের মতন যে সূর্যকে গ্রাস করে। অনেকটা রাহুর মতন কাজ-কারবার তার। এখানেই মনে রাখুন যে সেই রাহুর গলা কেটেছিলেন বিষ্ণু, সমুদ্র-মন্থন কালে যিনি মোহিনী রূপিণী। আবার চীনের তিয়াঙ্গো জাপানে গিয়ে হয়েছে টেঙ্গু। লম্বা নাকের এক অপদেবতা, যে পাখির মতন ওড়ে। এর মধ্যিখানে আপনি যদি মনে রাখেন যে কুষাণরা যেহেতু চীনের একটা অঞ্চল দখল করেছিল এক সময় ও হ্যান চীনের সঙ্গে তার বেশ সম্পর্ক ছিল তাহলে এই রূপান্তরটার কিছু কথা বোঝা যায়।
কী বোঝা যায়? কুষাণরা ছিল প্রথমে এ অঞ্চলে বুদ্ধানুরাগী। পরে তারা এ দেশাগত গ্রীকদের মতনই বৈষ্ণবে পরিণত হয়। অর্থাৎ আগের গ্রীকদের বৈষ্ণব ধর্মগ্রহণের সঙ্গে এদের প্রাথমিক বিরোধ ছিল। তক্ষশীলার গ্রীক রাজা অ্যান্টিয়ালসিডাস-এর দূত হেলিওডোরাস প্রাচীন বিদিশার কাছে (এখন বেসনগরের) গরুড় স্তম্ভ স্থাপন করেছিল।সুঙ্গ রাজাদের সময়। মানে সময়কাল খ্রীষ্টজন্মের ১১০ বছর আগে, রাজা ভগভদ্রর সময়। সে স্তম্ভ ছিল বাসুদেবের উদ্দেশ্যে নির্মাণ করা। কাজেই গ্রীকদের থেকে রাজ্য কাড়া কুষাণরা বৌদ্ধ হওয়ায় গরুড় সহজেই শত্রু হয়। লম্বা নাকের পাখির মতন উড়তে পারা নাগপুত্র। এখান থেকে যাত্রাটা শুরু হয়েছে। শেষের একটা চিহ্ন আমরা পাচ্ছি 'কোনজাকু মোনোগাতারিশু' নামের ৭৯৪ খ্রীষ্টাব্দে শুরু হওয়া জাপানি লোককথায়। সেখানে গরুড়/টেঙ্গু একজন ঘুড়ির মতন চেহারা নিতে পারা অপদেব। যার কাজ হল মারের দোসরের মতন বৌদ্ধ শ্রমণদের এক জায়গা থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে জনহীন শ্বাপদসঙ্কুল অরণ্যে ফেলা। কিম্বা মারের মেয়ে যেমন করে বুদ্ধকে লোভ দেখিয়েছিল, তেমন করে এঁদের লোভ দেখানো। কুষাণ থেকে জাপানি অবধি রাস্তাটা কিছুটা পরে আলোচনা করছি।
এখান থেকে কিছুটা বোঝা যায় যাত্রাটা। চীনে ঘুড়ি অনেককালের বিষয়। শাংডং-এ প্রথম জানা যাচ্ছে ২৩০০ বছর আগে। শুধু তাই না, চীনে মাস্টার মু জি আর পরে লু বান মানুষ উড়তে পারে ঘুড়িতে বাঁধা অবস্থায় এমন কালো কাঠের কানওয়ালা ঘুড়ি বানাতে সক্ষম ছিলেন। সে ঘুড়ি গুপ্তচরবৃত্তির কাজেও লেগেছিল। কিছু পরে হয়েছে ঈগলের মতন দেখতে ঘুড়ি যাতে মানুষ চড়ে উড়বে, শুধু তাই না, সেই ঈগল ডানাও ঝাপটাবে। নামার সময়ে কাঠের পায়ের উপরে ভর দিয়ে আসল ঈগলের মতন নামবে।
ভারত ও চীন থেকে বৌদ্ধ ধর্ম গিয়েছে জাপানে। চীনে গেল কিভাবে ও কখন এটা নিয়ে দু কথা এখানে বলে ফেলি। চীনে বৌদ্ধ ধর্ম গিয়েছে বিখ্যাত 'রেশম পথ' ধরে। ঝাং কুইয়াং-কে হ্যান সম্রাট চীনের বাইরের অঞ্চল সম্পর্কে তথ্য জোগাড়ের জন্য পরের পর যাত্রায় নিযুক্ত করেন। এই উপমহাদেশের দুটি অঞ্চল থেকে রেশম পথ ধরা হত। তার একটি উত্তর-পশ্চিমে, অন্যটি নেপাল হয়ে। সে পথ ধরেই নেপাল থেকে চীনে গিয়েছে বৌদ্ধ ধর্ম। মোটামুটি ৬৭ এডিতে চীনের ইতিহাসে আনুষ্ঠানিক ভাবে বৌদ্ধধর্মের প্রবেশ। এ ছাড়া হ্যানদের সঙ্গে ইউয়েঝি বা কুষাণদের বাণিজ্যিক সম্পর্ক সেও ঝাং কুইয়াং-এর মাধ্যমেই স্থাপিত হয়েছিল এ কথা মনে রাখার দরকার। কুষাণরা যখন পরে ব্যাক্ট্রিয়া দখল করলো তখনও সে সম্পর্ক ছিল। সুতরাং আবার সেই উত্তর-পশ্চিম থেকে, বা গান্ধার থেকে বা কুষাণদের সেই এককালের রাজত্ব থেকে (৪৫০ খ্রীঃ অব্দিও এরা ছিলেন সাসানিডিদের সামন্তরাজা) বৌদ্ধ শ্রমণদের একটি দল গিয়েছিল জাপানে। উত্তর-পশ্চিম থেকে তাঁরা যে 'রেশম পথ' ভূমধ্যসাগর থেকে পারস্যের উত্তর এবং আজকের ভারতের বেশ কিছুটা উত্তরে, নেপালের পশ্চিমের দিক দিয়ে যাচ্ছিল তা দিয়ে যাননি। তাঁরা গিয়েছিলেন জলপথে, জাহাজে। আরব সাগর দিয়ে ভারতের স্থলভাগ ঘেঁষে ভারত মহাসাগর ছুঁয়ে বঙ্গোপসাগর দিয়ে আবার চট্টগ্রামের পথ দিয়ে জাভার মধ্যে দিয়ে চীনের ফুজাও বা নানজিং ছুঁয়ে হয়তো। সেটা ছিল ৪৬৭ খ্রীঃ। চীনা ঐতিহাসিক লিয়াং সু-এর লেখায় পাওয়া যাচ্ছে এটা। তো বৌদ্ধ ধর্ম নেপাল ধরে চীনে গেলে ঘুড়িও সেখান থেকে নেপাল হয়ে এই বাংলা অবধি পৌঁছতে পারার সম্ভাবনা। এমনকি যদিও এই লেখার সঙ্গে সম্পর্কিত না, তবুও চীনে রেশমের সঙ্গে বাংলার রেশম শিল্পীদের যোগ হয়তো একদিন আরো পরিস্কার হবে এটা এখানে বলার ইচ্ছে হল। আবার চীনের থেকেই ঘুড়ি গিয়েছে জাপানেও। ঘুড়ির আকারের অপদেবতা তৈরী হয়েছে লোককথায় সেখানে। অথবা কোনো অপদেবতাকে ঘুড়ির আকার দেওয়া হয়েছে। কেন না চীনেই কিন্তু মানুষ তোলা ঘুড়ির ব্যবহার হয়েছে। অতএব শ্রমণ তুলে নিয়ে যাচ্ছে অপদেবতা এই কল্পনার একটা বস্তুসম্মত ভিত্তিও আছে।
নালন্দা মহাবিহার ছিল বজ্রযান চর্চার স্থল তা আগেই বলেছি। সেখানে চীন ও জাপান থেকেও শিক্ষার্থী এসেছে। চীনাদের সূত্রের মধ্যেই যদিও সবচেয়ে বেশী নালন্দার তথ্য ধরা আছে, তবুও এটা ছিল একটা চমৎকার জ্ঞান চর্চা ও দেওয়া-নেওয়ার কেন্দ্র তা বোঝাই যায়। শুধু তাই না, পাল রাজাদের আমলে বিক্রমশীলা, নালন্দা, সোমপুর, ওদন্তপুর এবং জগদ্দল ছিল পাঁচ বৃহৎ কেন্দ্র। এ ছাড়া আরো নানা কেন্দ্র তৈরী হয়েছিল নানান সময়ে। তার মধ্যে বিহারালি, রক্তমৃত্তিকা, মহাস্থানগড়, নন্দদীর্ঘিকা-উদরঙ্গ এমন বহু বিহার রয়েছে। সেখানে গম্ভীর বিষয়ের সঙ্গে ঘুড়িও যে এসে পড়েনি বলার কোনো উপায় নেই আর। হাজারে হাজারে, লক্ষ লক্ষ-এ পুঁথি ধ্বংস হয়েছে তুর্কী আক্রমণের বর্বরতায়। যা বা যে টুকু বেঁচেছে তা তিব্বতের মহিমায়।
বাংলায় তন্ত্রের অঙ্গ হল ডাকিনীবিদ্যা। তন্ত্র ঋগ্বেদ-এও আছে। এবং সে যে আছে তা নিয়ে মহা বিতর্ক আছে। প্রখর বৈদিকদের মতে এই সূক্তটি একদম তন্ত্রর বিষয় না ইত্যাদি। দেবী সূক্তর সবটাই তন্ত্রসার হিসেবে চর্চিত হয়েছে। দশম মণ্ডলের ১২৫ তম সূক্ত এটা। ঋষি অম্ভৃণার কন্যা রচনা করেছেন এটা। এবং ডাকিনী বস্তুটাও এসেছে ভগবৎপুরাণ, ব্রহ্মপুরাণ, মার্কণ্ডেয় পুরাণ, কথাসরিতসাগরের চর্চার মধ্যে দিয়ে। কাজেই বৌদ্ধ মতাদর্শের মধ্যে এর অনুপ্রবেশের আগেই এর এক চেহারা ছিল। ডাকিনী হল সে যে আকাশে উড়তে পারে। ঘুড়িও আকাশে ওড়ে। এ দুটোর মধ্যে সম্পর্ক গড়ে তোলার মতন টেক্সট না পাওয়া যেতে পারে, কিন্তু অনুমান করা চলে। বাংলাতেও সে সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। তার একটা কারণ হল বজ্রযানের খোলা হাওয়া। বুদ্ধের অনাত্মের যে প্রাথমিক ধারণা তার সঙ্গে এর বেশ সংযোগ আছে। সমস্ত কিছুই নশ্বর, সমস্তই পরিবর্তনীয়। বস্তুত মহাযানের মধ্যে যখন নানান সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় রীতিনীতির বৈচিত্র্য সূত্রের মধ্যে থেকে উপাদান আগমন শুরু হয় তখনই বজ্রযান, কালচক্রযান, সহজযানের মতন পন্থার উদ্ভব হয়। বজ্রযান ব্যক্তিগত ঈশ্বরের ধারণাতে সরে এসেছিল কিছুটা। অর্থাৎ প্রাতিষ্ঠানিক বৌদ্ধ ধর্মের সঙ্ঘায়ণের পরিবর্তে সে স্থান দিয়েছিল ব্যক্তিকেও। আদিম বিশ্বাস ও রীতিনীতিকে সে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করলো। নারীকে সম্মান দিল ও সামাজিক ক্ষেত্রে বর্ণবৈষম্যের অভ্যাসকে সে বাদ দিল। সুতরাং সমাজের অন্তত নীচের মহলে তার অনুগামী গড়ে উঠতে সময় লাগেনি। এখানেই যৌনতার ব্যবহারের সঙ্গে সঙ্গে ক্রীড়ার ব্যবহারও হতে শুরু হল রীতি হিসেবে। মণিভূষণ বড়ুয়া ভিক্ষু জীবন যাপন করতেন না। তিনি ব্যাক্তিগত স্তরে তন্ত্র সাধনা করতেন বলেই জানিয়েছিলেন। আশ্রমভেদ ইত্যাদি তাঁর কাছে অপ্রাসঙ্গিক ও গৌণ। তিনি এইখানে বলেছিলেন ঘুড়ি ওড়ানোর খেলার কথা। ঘুড়ির চল এলো এই বাংলাতে। যে ঘুড়ি আসলে এক অপদেবতা। সেই অপদেবতাকে সুতোয় বেঁধে ওড়ানোর উৎসব হল বৌদ্ধদের। প্রথমে প্রকাশ্যে, তারপরে গোপনে। ব্রাহ্মণ্যবাদ এবং বৈষ্ণবভাবধারার সঙ্গে তখন তুমুল বিবাদ। যে কারণে চর্যার উদ্ভব সান্ধ্য ভাষায়, সেই একই কারণে বৌদ্ধদের ঘুড়ি ওড়ানো বন্ধ। কিন্তু এ ঘুড়ি ওড়ানোর যে মজা তা তো ছাড়া যাবে না! অতএব ঘুড়ির কারিগরী মাথায় রেখে বিশ্বকর্ম্মার সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হল তাকে। মাটিতে তুমি অনেক কিছুই করতে পার। কিন্তু আকাশে না পারলে আর পারলে কি? ওটাই তো আসল কেদ্দানি! সে কেদ্দানির জন্যই বাছা হল স্থপতিগুরুর পূজোর দিনকে। বৌদ্ধদের ঘুড়ি ওড়া এদেশে থেমে গেলেও, বিশ্বকর্ম্মার শ্রমশীল ভক্তদের ঘুড়ি উড়তেই থাকলো।।
এর সমর্থনে আমি কোনো পুঁথি জোগাড় করতে পারিনি। উত্তর-ভারতে মকর-সংক্রান্তিতে ঘুড়ি ওড়ানোর চল আছে। মকরের সঙ্গে বাংলার যোগসূত্র হল ভগীরথের গঙ্গা আনার কাহিনী দিয়ে। কপিলের আশ্রমের কাছে সমুদ্রে গঙ্গা মিশে যাবার পরে ভগীরথ এই দিনে পিতৃপুরুষদের উদ্দেশ্যে তর্পণ করেছিলেন বলে পুরাণ জানায়। সেই রীতির অনুসারে এখানে মকর-সংক্রান্তিতে ঘুড়ি ওড়ানো উত্তরের মতন প্রচলিত না। বাংলাদেশে আছে পৌষ সংক্রান্তিতে সাকরাইন উৎসবে ঘুড়ি ওড়ানোর ও ঘুড়ির লড়াই-এর প্রতিযোগিতা। কিন্তু পরে মনে হয়েছে বিশ্বকর্ম্মার সঙ্গে জোড়ার একটা কারণ যদি কারিগরী হয় তাহলে অন্য কারণ বিশ্বকর্ম্মা নিজে। নানা মত ও ব্যাখ্যার মধ্যে দিয়ে বিশ্বকর্ম্মার বিবর্তন হয়েছে বেদ থেকে পুরাণে। ব্রহ্মা থেকে পঞ্চমুনির পিতা থেকে অষ্টম বসু ও যোগসিদ্ধার সন্তান- বিশ্বকর্ম্মার অনেক পরিচয়। এর মধ্যে যোগ সিদ্ধার সন্তান পরিচয় এবং কন্যা সংক্রান্তিতে ঘটা বিশ্বকর্ম্মার পূজো আমাকে আকর্ষণ করেছে। কন্যা সংক্রান্তিতে বলা হয় বর্তমান বিশ্বকর্ম্মাদের পূর্বপুরুষ আদি বিশ্বকর্ম্মা লাঙল সৃষ্টি করেন জমি চাষ করার জন্য। অর্থাৎ ফার্টিলিটি কাল্টের সঙ্গে প্রকৌশলগত যোগসূত্র তৈরী হচ্ছে এখানে। আবার অষ্টম বসু প্রভাসের ও যোগ সিদ্ধার সন্তান মানে বৈষ্ণবদের বান্ধব। এবং যদি যোগ সিদ্ধাকে সামান্য উল্টে নেওয়া যায় তাহলে সিদ্ধ যোগ হয়ে দাঁড়ায়। সিদ্ধ যোগাচার এসেছে তন্ত্র থেকে। আবার বিশ্বকর্ম্মার স্ত্রী-র নাম গায়ত্রী। ঋষি বিশ্বামিত্র এর স্রষ্টা ঋগ্ বেদ-এ। সেই গায়ত্রী মন্ত্র প্রসঙ্গে মন্ত্র নিয়েও দু কথা ভাবা যায়। ভারতীয় তন্ত্র শাস্ত্রগুলো শব্দকে মনে করে পরমের প্রকাশ। কিন্তু লেখা নিয়ে তাঁদের খুব চর্চা ছিল যে এমন না। সে চর্চার সিরিয়াস সূত্রপাত কিন্তু আবার সেই চীনে। চীনে লিপি চীনের ভাষাগুলোর মধ্যে চমৎকার যোগসূত্র ছিল। সেই লিপি প্রস্তুত করাই ধীরে ধীরে একটা বিশেষ বিষয় হয়ে উঠেছিল। সেখান থেকে জাপানে গিয়ে তার আরো অনেক উন্নতি হয়েছে। সিদ্ধ লিপি একটা দেখার মতন বিষয়, যাতে তান্ত্রিক টেক্সটগুলো সযত্নে রক্ষিত। এবং জাপানেই শুধু আছে এখনো, আমি যদ্দুর জানি। আবার সংস্কৃততেও মন্ত্রের সঙ্গে যন্ত্রের সম্পর্ক রয়েছে। এও এক বিশেষ প্রকৌশল। প্রকৌশল শিল্পের দেব বিশ্বকর্ম্মা। অন্যদিকে যদি খেয়াল করেন তাহলে দেখবেন যে বৌদ্ধ শ্রমণদের ক্ষেত্রে ব্রাহ্মণদের মতন মন্ত্র ব্যবহার সম্পর্কে প্রাথমিক নিষেধ সত্ত্বেও মন্ত্র প্রবেশ করেছে মহাযান বৌদ্ধ পথে। সেখান থেকে বজ্রযানে। প্রজ্ঞাপারমিতা মন্ত্র কিম্বা ওম মণিপদ্মে হুম-এর কথা ভাবুন। এমন মন্ত্র কিন্তু তিব্বতে আরো তৈরী হয়েছে। তার মধ্যেই রয়েছে বজ্রগুরুর মন্ত্র যিনি পদ্মসম্ভব। আবার খেয়াল করে দেখুন যে ব্রহ্মার নাভি থেকে বেরোনো পদ্মে আসীন বিষ্ণু। গুরু পদ্মসম্ভব যিনি আজকের পাকিস্তানে সোয়াত ভ্যালীতে জন্মেছেন বলে কথিত তিনি মহাযান পন্থার সূচক। এই সোয়াত ভ্যালিতে গুরু পদ্মসম্ভব যিনি তিব্বতে রিমপোচে তাঁর পিতা ইন্দ্রভূতি ছিলেন প্রথম সিদ্ধদের একজন। অর্থাৎ সেই সিদ্ধ সম্পর্ক। এমন সব ছেঁড়া ছেঁড়া সূত্র আমাকে ভাবতে বাধ্য করেছে যে শ্রমশীল মানুষদের দেবতায় পরিণত হওয়া বিশ্বকর্ম্মাকেই বৌদ্ধ পরবর্তী ঘুড়ি ওড়ানোর রীতির আশ্রয় ভাবা যায় বোধহয়। যদি কোনোদিন যাঁরা প্রকৃত গবেষণা করতে সক্ষম তেমন মানুষরা এ বিষয়ে আরো আলোকপাত করতে পারেন তাহলে আনন্দ পাব। ততদিন মণিভূষণ বড়ুয়ার তত্ত্বটি প্রত্যেক বিশ্বকর্ম্মায় ঘুড়ি ওড়ানোর মুহূর্তে ভাবাবে।