এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • রাতের অতিথি 

    Debmalya Mukherjee লেখকের গ্রাহক হোন
    ১৭ মে ২০২৫ | ৪৩ বার পঠিত
  • গল্পের নাম: রাতের অতিথি
    দেবমাল্য মুখোপাধ্যায়

    রাতে ঝড় উঠেছে। গ্রামের শেষ প্রান্তের বিশু কাকার পুরোনো বাঁশবাগানটা তখন ভয়ানক শব্দ করছে। এমন রাতেই নাকি শাকচুন্নী বের হয়—এ কথা সবাই জানে।

    রনি আর তার বন্ধু তন্ময়, শহর থেকে গ্রামে এসেছে দাদুর কাছে বেড়াতে। ভয়কে পাত্তা না দিয়ে দু'জন মিলে সন্ধ্যায় বের হয়েছিল বটতলার দিকে। কিন্তু বাড়ি ফেরার পথেই বাঁশবাগানের পাশ দিয়ে আসতে গিয়ে শুনল, কে যেন খিলখিল করে হাসছে!

    রনি কাঁপা গলায় বলল, "কে ওখানে?"

    কোনো জবাব এল না। তবে বাগানের গভীর থেকে সাদা কাপড়ে মোড়া এক মেয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে এল। তার চুল বুক ছুঁয়ে গেছে, চোখদুটো লালচে, আর ঠোঁটের কোণে অদ্ভুত এক হাসি!

    তন্ময় আর রনি দৌড় দিল। পেছন থেকে সেই হাসির শব্দ আবার শোনা গেল—এবার আরও ভয়ংকর! দাদুর ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করতেই বাহির থেকে ঠকঠক শব্দ এল। কেউ যেন দরজা খটখটাচ্ছে।

    দাদু ধীরেসুস্থে একটা কালো সুতো বের করে দরজায় বেঁধে দিলেন। কাঁপা গলায় বললেন, "এটা রাতের অতিথি, ওকে ডাকতে নেই!"

    বাইরে তখনো সেই হাসির শব্দ, তবে ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল বাতাসের মধ্যে। তন্ময় আর রনি নিঃশ্বাস নিল—এবার তারা বুঝেছে, শাকচুন্নী শুধু গল্পেই নয়, বাস্তবেও আছে!

    রাত কেটে গেল, কিন্তু তন্ময় আর রনি এক মুহূর্তের জন্যও ঘুমাতে পারেনি। দরজার ওপাশে আর কোনো শব্দ নেই, তবু ভয় যেন জমাট বেঁধে আছে ঘরের ভেতর।

    ভোর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই দু'জন দাদুর কাছে সব খুলে বলল। দাদু গম্ভীর হয়ে শুনলেন, তারপর ধীর গলায় বললেন,

    "তোমরা যেটা দেখেছো, সেটা এই গ্রামের পুরনো অভিশাপ। বিশু কাকার বাঁশবাগানে অনেক বছর আগে এক মেয়ের লাশ পাওয়া গিয়েছিল। ওর নাম ছিল নন্দিনী। বিয়ের আগের রাতে পাত্রপক্ষের লোভে পড়ে তার বাবা তাকে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলে। সেই থেকে ওর আত্মা এখানেই ঘুরে বেড়ায়, প্রতিশোধ নেওয়ার অপেক্ষায়!"

    রনি আর তন্ময় শিউরে উঠল।

    তন্ময় ফিসফিস করে বলল, "কিন্তু দাদু, কাল রাতে যদি আমরা দৌড় দিতাম না?"

    দাদুর চোখ কুঁচকে গেল। তিনি নিচু গলায় বললেন, "তাহলে তোমরা আর এই কথাগুলো বলতে পারতে না।"

    এই কথা শুনেই রনি আর তন্ময়ের মুখ শুকিয়ে গেল। তখনই দরজার বাইরে কে যেন পায়ের নুপুরের মতো শব্দ করে হাঁটল।

    তন্ময় আর রনি আতঙ্কে একে অপরের দিকে তাকাল।

    দাদু তখন একমুঠো সরষে আর কিছু মন্ত্র পড়া ধুলো দরজার ফাঁক দিয়ে ছুঁড়ে দিলেন। দরজার ওপাশ থেকে এক করুণ আর্তনাদ ভেসে এল, যেন কেউ কেঁদে উঠল! তারপর সবকিছু আবার নিস্তব্ধ হয়ে গেল।

    দাদু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, "ও চলে গেছে, তবে আবার আসবে। কারণ ওর প্রতিশোধ এখনো অসম্পূর্ণ।"

    রনি আর তন্ময় থরথর করে কাঁপছিল। ওরা জানত, এই গ্রামে আর এক রাতও থাকা যাবে না… কিন্তু যেতেই বা পারে কোথায়? কারণ শাকচুন্নী কাউকে সহজে ছাড়ে না

    তন্ময় আর রনি আর এক মুহূর্তও থাকতে চাইল না এই গ্রামে। ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গেই ওরা শহরে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। কিন্তু দাদু বললেন, "এমন হুট করে পালিয়ে গেলে বিপদ আরও বাড়বে। আগে কিছু নিয়ম মানতে হবে, তারপর যাও।"

    রনি কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞেস করল, "কী নিয়ম, দাদু?"

    দাদু গভীর শ্বাস নিয়ে বললেন, "এই আত্মা খুবই প্রবল, কিন্তু কিছু বিধিনিষেধের বাইরে যেতে পারে না। সূর্য ওঠার আগে ঘর থেকে বের হওয়া যাবে না, বাঁশবাগানের দিকে তাকানো যাবে না, আর যাওয়ার সময় পেছনে ফিরে দেখা যাবে না, একদম না!"

    তন্ময় একটু ইতস্তত করল, "এতকিছু দরকার কি, দাদু? আমরা তো চলে যাব, ও তো শহরে আসতে পারবে না!"

    দাদু কঠিন কণ্ঠে বললেন, "ও কোথায় আসতে পারে আর কোথায় পারে না, সেটা তুমি জানো না। ও যে কাউকে ছাড়ে না, বিশেষ করে যাদের সামনে একবার এসেছে।"

    এই কথা শুনে রনি আর তন্ময়ের গলা শুকিয়ে গেল।

    অভিশপ্ত পথ

    সকাল আটটার মধ্যে ওরা দাদুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রওনা দিল। দাদু ওদের গায়ে সরষের তেল মাখিয়ে দিলেন, ছোট একটা লাল সুতো হাতে বেঁধে দিলেন, আর একটা নিমপাতা মুখে রাখতে বললেন।

    গ্রামের পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে ওরা বাঁশবাগানের কাছাকাছি চলে এল। চারপাশ নীরব, কেমন যেন এক অদ্ভুত গুমোট ভাব। রনি আর তন্ময় একে অপরের হাত শক্ত করে ধরল, যেন একটু সাহস পাওয়া যায়।

    ঠিক তখনই ঠান্ডা বাতাস বইতে লাগল, যেন কেউ ফিসফিস করে ডাকছে!

    "তন্ময়… রনি… থামো…"

    ওরা ভয় পেয়ে আরও দ্রুত হাঁটতে লাগল।

    হঠাৎ রনির মনে হল, কেউ যেন ওদের পেছনে হাঁটছে! ধীর, ভারী পায়ের শব্দ, ঠিক সেই রাতের মতো।

    রনি প্রায় চিৎকার করে বলল, "তন্ময়, পেছনে তাকাস না! দৌড়া!"

    কিন্তু তন্ময় আর সহ্য করতে পারল না। বুক ধড়ফড় করতে করতে একঝলক পেছনে তাকিয়ে দেখল—

    সাদা শাড়িতে মোড়া সেই মেয়েটি, নন্দিনী! চোখজোড়া আগুনের মতো লাল, ঠোঁটে একটা বিকৃত হাসি। হাত বাড়িয়ে যেন ওদের ডাকছে।

    "তুমি ফিরে গেলে কেন?"

    তারপরই হঠাৎ এক বিকট ঝড় শুরু হল, যেন পুরো পথটাই ধুলোয় ঢেকে গেল। তন্ময় কাঁপতে কাঁপতে পেছনের দিকে হাত বাড়াল রনির দিকে, কিন্তু রনি ততক্ষণে আরও সামনে এগিয়ে গেছে।

    তন্ময় চিৎকার করল, "রনি, আমাকে ধরে রাখ!"

    কিন্তু ওর গলা যেন আটকে আসছিল। সামনে ঝাপসা দেখছিল, পুরো শরীর শীতল হয়ে যাচ্ছিল।

    রনি পাগলের মতো তন্ময়ের হাত ধরার চেষ্টা করল, কিন্তু হঠাৎ করেই ও দেখল, তন্ময়ের মুখটা বদলে গেছে!

    সেই আগুনের মতো লাল চোখ, ঠোঁটে বিকৃত হাসি, আর ফিসফিসে কণ্ঠ—

    "তুমি কি সত্যিই শহরে ফিরে যেতে পারবে, রনি?"

    রনির শরীর বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে গেল। তন্ময় কি আসলেই ওর পাশে দাঁড়িয়ে আছে? নাকি…?

    পথের ধারে কেউ একজন গলা ফাটিয়ে চিৎকার করল,

    "নিমপাতা মুখে রাখ! পেছনে তাকাস না!"

    রনি আর কিছু না ভেবে নিমপাতাটা চিবিয়ে ফেলল। সাথে সাথে একটা বিকট আর্তনাদ শোনা গেল, যেন কেউ ব্যথায় ছটফট করছে। তারপর সবকিছু নিস্তব্ধ হয়ে গেল।

    রনি চোখ খুলে দেখল, তন্ময় মাটিতে পড়ে আছে, অচেতন!

    ও আতঙ্কে তন্ময়কে টেনে তুলল, কিন্তু ওর শরীর বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে গেছে। দাদুর কথা মনে পড়তেই ওর চোখে পানি এসে গেল।

    "তন্ময়! ওঠ! প্লিজ!"

    একটা মুহূর্তের জন্য মনে হল, সব শেষ…

    শেষ প্রতিশোধ

    কিন্তু হঠাৎ তন্ময় চোখ খুলল। প্রথমে ফাঁকা ফাঁকা দৃষ্টিতে তাকাল, তারপর স্বাভাবিক হয়ে গেল। ওদের পাশে দাদু এসে দাঁড়িয়েছেন, হাতে একটা প্রদীপ আর কিছু হলুদ গুঁড়া।

    দাদু গম্ভীর স্বরে বললেন, "ও এখনো ওকে ছাড়েনি। সময় খুব কম আছে। চলো!"

    রনি আর তন্ময় দাদুর সাথে দৌড়ে গ্রামের বাইরে বেরিয়ে এল। সূর্যের আলোতে পৌঁছাতেই তন্ময় স্বাভাবিক হতে শুরু করল।

    দাদু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, "ও এবার তোমাদের ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু মনে রেখো, বিশু কাকার বাঁশবাগানে কেউ ঢুকলে ওর হাত থেকে বাঁচতে পারবে না!"

    তন্ময় আর রনি কিছু বলার মতো অবস্থায় ছিল না।

    শহরে ফিরে গেলেও ওরা জানত, এই স্মৃতি কখনো ভুলতে পারবে না।

    আর একটাই প্রশ্ন থেকে গেল—তন্ময় কি আসলেই বেঁচে ফিরেছে, নাকি… সেই রাতের অতিথি এখনো ওদের সঙ্গে আছে। 

    শহরে ফিরে আসার পর তন্ময় ও রনি স্বাভাবিক জীবনে ফেরার চেষ্টা করছিল। কিন্তু কিছুই আর স্বাভাবিক মনে হচ্ছিল না।

    বিশেষ করে তন্ময়ের জন্য।

    ও মাঝেমধ্যেই গভীর রাতে ঘুম থেকে উঠে বসে থাকত, কোনো কথা বলত না, শুধু জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকত। রনি প্রথমে ভাবত, হয়তো দুঃস্বপ্নের কারণে, কিন্তু ধীরে ধীরে বুঝতে পারল, ব্যাপারটা স্বাভাবিক নয়।

    এক রাতে ওর সন্দেহ আরও গাঢ় হয়ে উঠল।

    রনি ঘুমানোর আগে দেখে, তন্ময় পাশেই ঘুমিয়ে আছে। কিন্তু মাঝরাতে হঠাৎ শব্দ শুনে জেগে উঠে দেখল, তন্ময় জানালার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। চাঁদের আলোয় ওর মুখ দেখা যাচ্ছিল না, তবে এক অদ্ভুত ফিসফিসানি শুনতে পেল।

    "তুমি আমাকে ডাকছিলে, তাই না?"

    রনির গা শিউরে উঠল। তন্ময়ের কণ্ঠ স্বাভাবিক ছিল না—শীতল, নিঃসংগ, যেন অন্য কেউ কথা বলছে।

    রনি ধীরে ধীরে উঠে এসে ওর কাঁধে হাত রাখতেই তন্ময় ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াল।

    ওর চোখদুটো লালচে, ঠোঁটে সেই বিকৃত হাসি।

    "তুমি কি ভেবেছো, আমি চলে গেছি?"

    রনি আতঙ্কে চিৎকার করে পিছিয়ে গেল!

    হঠাৎ একটা জোরালো ঝাপটা লাগল, ঘরের সবকিছু উল্টে গেল, জানালা প্রচণ্ড শব্দে খুলে গেল! ঠান্ডা বাতাস ঘরে ঢুকল, আর সেই চেনা হাসির শব্দ—ঠিক সেই রাতের মতো!

    শাকচুন্নী ফিরে এসেছে!

    রনি প্রাণপণে দাদুকে ফোন করল। কিন্তু ফোন বাজল, কেউ ধরল না।

    এদিকে তন্ময় ধীরে ধীরে ওর দিকে এগিয়ে আসছে, ওর হাঁটার ভঙ্গি বদলে গেছে—ঠিক যেন নন্দিনীর মতো!

    রনি কিছু না ভেবে এক দৌড়ে ঘরের পুজোর আলমারি খুলল, সেখানে দাদু দিয়েছিলেন কিছু নিমপাতা আর হলুদ গুঁড়া। কাঁপতে কাঁপতে সেটা তন্ময়ের গায়ে ছুড়ে দিল!

    সঙ্গে সঙ্গে বিকট এক চিৎকারে কেঁপে উঠল পুরো ঘর! তন্ময় মাটিতে লুটিয়ে পড়ল, আর ঘর অন্ধকার হয়ে গেল।

    সবকিছু স্তব্ধ।

    কিছুক্ষণ পর রনি ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে দেখল, তন্ময় নিস্তেজ হয়ে মাটিতে পড়ে আছে। ওর শরীর আবার স্বাভাবিক, চোখ বন্ধ।

    ঠিক তখনই দাদুর ফোন এল।

    রনি কাঁপা কণ্ঠে বলল, "দাদু, ও ফিরে এসেছে! ও এখনো তন্ময়কে ছাড়েনি!"

    দাদু কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, "আমি জানতাম। ওরা যাকে একবার  পেয়ে যায় তাকে সহজে ছাড়ে না। তন্ময় এখন দুই জগতের মাঝে আটকে আছে, ওকে এই দুই জগৎ থেকে বার করার জন্য আমাদের কিছু করতে হবে। দাদু এসে পৌঁছালেন, সঙ্গে কিছু ভয়াল দর্শন তান্ত্রিক। দাদু এসে দেখে যে তন্ময় তখনো অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে।

    রাতের অতিথি (শেষ অধ্যায়)

    শহরে ফিরে আসার পর তন্ময় ও রনি স্বাভাবিক জীবনে ফেরার চেষ্টা করছিল। কিন্তু কিছুই আর স্বাভাবিক মনে হচ্ছিল না।

    বিশেষ করে তন্ময়ের জন্য।

    ও মাঝেমধ্যেই গভীর রাতে ঘুম থেকে উঠে বসে থাকত, কোনো কথা বলত না, শুধু জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকত। রনি প্রথমে ভাবত, হয়তো দুঃস্বপ্নের কারণে, কিন্তু ধীরে ধীরে বুঝতে পারল, ব্যাপারটা স্বাভাবিক নয়।

    এক রাতে ওর সন্দেহ আরও গাঢ় হয়ে উঠল।

    রনি ঘুমানোর আগে দেখে, তন্ময় পাশেই ঘুমিয়ে আছে। কিন্তু মাঝরাতে হঠাৎ শব্দ শুনে জেগে উঠে দেখল, তন্ময় জানালার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। চাঁদের আলোয় ওর মুখ দেখা যাচ্ছিল না, তবে এক অদ্ভুত ফিসফিসানি শুনতে পেল।

    "তুমি আমাকে ডাকছিলে, তাই না?"

    রনির গা শিউরে উঠল। তন্ময়ের কণ্ঠ স্বাভাবিক ছিল না—শীতল, নিঃসংগ, যেন অন্য কেউ কথা বলছে।

    রনি ধীরে ধীরে উঠে এসে ওর কাঁধে হাত রাখতেই তন্ময় ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াল।

    ওর চোখদুটো লালচে, ঠোঁটে সেই বিকৃত হাসি।

    "তুমি কি ভেবেছো, আমি চলে গেছি?"

    রনি আতঙ্কে চিৎকার করে পিছিয়ে গেল!

    হঠাৎ একটা জোরালো ঝাপটা লাগল, ঘরের সবকিছু উল্টে গেল, জানালা প্রচণ্ড শব্দে খুলে গেল! ঠান্ডা বাতাস ঘরে ঢুকল, আর সেই চেনা হাসির শব্দ—ঠিক সেই রাতের মতো!

    শাকচুন্নী ফিরে এসেছে!

    রনি প্রাণপণে দাদুকে ফোন করল। কিন্তু ফোন বাজল, কেউ ধরল না।

    এদিকে তন্ময় ধীরে ধীরে ওর দিকে এগিয়ে আসছে, ওর হাঁটার ভঙ্গি বদলে গেছে—ঠিক যেন নন্দিনীর মতো!

    রনি কিছু না ভেবে এক দৌড়ে ঘরের পুজোর আলমারি খুলল, সেখানে দাদু দিয়েছিলেন কিছু নিমপাতা আর হলুদ গুঁড়া। কাঁপতে কাঁপতে সেটা তন্ময়ের গায়ে ছুড়ে দিল!

    সঙ্গে সঙ্গে বিকট এক চিৎকারে কেঁপে উঠল পুরো ঘর! তন্ময় মাটিতে লুটিয়ে পড়ল, আর ঘর অন্ধকার হয়ে গেল।

    সবকিছু স্তব্ধ।

    কিছুক্ষণ পর রনি ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে দেখল, তন্ময় নিস্তেজ হয়ে মাটিতে পড়ে আছে। ওর শরীর আবার স্বাভাবিক, চোখ বন্ধ।

    ঠিক তখনই দাদুর ফোন এল।

    রনি কাঁপা কণ্ঠে বলল, "দাদু, ও ফিরে এসেছে! ও এখনো তন্ময়কে ছাড়েনি!"

    দাদু কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, "আমি জানতাম। ওরা যাকে একবার পেয়ে যায়, তাকে সহজে ছাড়ে না। তন্ময় এখন দুই জগতে আটকে আছে। আমাদের দ্রুত কিছু করতে হবে।"

    চূড়ান্ত লড়াই

    দাদু এসে পৌঁছালেন, সঙ্গে কয়েকজন তান্ত্রিকও নিয়ে এলেন। তন্ময় তখনো সংজ্ঞাহীন।

    তান্ত্রিকরা ঘরজুড়ে কিছু মন্ত্র পড়তে লাগলেন, ধুনোর ধোঁয়া ঘরে ছড়িয়ে পড়ল। তারপর তন্ময়ের কপালে এক ফোঁটা সরষের তেল ছোঁয়াতেই ওর শরীর কেঁপে উঠল!

    তন্ময়ের মুখ দিয়ে একটা বিকট আর্তনাদ বেরিয়ে এল, যেন কোনো ভিন্ন কণ্ঠস্বর চিৎকার করছে!

    "ও আমার! আমি ওকে ছাড়ব না!"

    দাদু কঠোর স্বরে বললেন, "ও এখন মুক্ত হবে! তুই চলে যা!"

    একটা চিৎকারের সঙ্গে জানালার কাঁচ চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল! বাতাসের ঝাপটা পুরো ঘর কাঁপিয়ে দিল, তন্ময়ের শরীর ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে এল।

    এক মুহূর্তের জন্য মনে হল, সব শেষ হয়ে গেছে।

    তন্ময় ধীরে ধীরে চোখ খুলল। ওর চোখ স্বাভাবিক, নিস্তেজ।

    দাদু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, "শেষ পর্যন্ত আমরা ওকে ফিরিয়ে আনতে পেরেছি। কিন্তু…"

    রনি ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, "কিন্তু কী, দাদু?"

    দাদু ঘরের ভাঙা জানালার দিকে তাকিয়ে বললেন,

    "ও চলে গেছে, কিন্তু পুরোপুরি নয়। ও অপেক্ষা করবে… কারণ ওর প্রতিশোধ এখনো অসম্পূর্ণ।"

    বাইরে তখনো বাতাস বইছে, দূরে বাঁশবাগানের দিক থেকে একটা মৃদু হাসির শব্দ ভেসে আসছে।

    রাতের অতিথি (চূড়ান্ত অধ্যায়)

    তন্ময় এখন ঠিক আছে। কিন্তু সত্যিই কি সব ঠিক হয়ে গেছে?

    দাদু আর তান্ত্রিকরা চলে যাওয়ার পর, রনি ও তন্ময় একেবারে নিস্তেজ হয়ে পড়ল। সারাদিন তারা ঘর থেকে বের হয়নি। রনি মাঝে মাঝে তন্ময়ের দিকে তাকাচ্ছিল, যেন নিশ্চিত হতে চায়—ওর ভেতরে এখন আর কেউ আছে কি না।

    তন্ময়ও কেমন চুপচাপ হয়ে গেছে, কথা কম বলছে। ওর চোখে একটা অদ্ভুত শূন্যতা।

    রনি একসময় বলল, "তোর ঠিকঠাক লাগছে তো?"

    তন্ময় একটু হেসে বলল, "হ্যাঁ রে, সব ঠিক আছে। ওই দুঃস্বপ্নের রাত শেষ হয়ে গেছে।"

    কিন্তু রনি জানত, এটা পুরোপুরি সত্যি নয়।

    অদ্ভুত পরিবর্তন

    পরের কয়েক সপ্তাহে রনি লক্ষ্য করল, তন্ময়ের মধ্যে কিছু পরিবর্তন এসেছে।

    ও এখন খুব বেশি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে, নিজের প্রতিবিম্বের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। মাঝে মাঝে মুখের মধ্যে অদ্ভুত এক হাসি খেলে যায়—ঠিক সেই হাসির মতো!

    একদিন রনি জিজ্ঞেস করল, "তন্ময়, তুই আয়নার সামনে এতক্ষণ ধরে কী দেখিস?"

    তন্ময় ধীরেসুস্থে বলল, "আমার মাঝেমধ্যে মনে হয়, আয়নার ভেতরে কেউ আছে।"

    রনির গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল।

    রাতে ও ঠিকমতো ঘুমাতে পারছিল না। বারবার মনে হচ্ছিল, ঘরের কোথাও যেন কারও উপস্থিতি আছে। কখনো মনে হয়, জানালার পর্দা একটু নড়ে উঠল, কখনো মনে হয়, দরজার নিচ দিয়ে কেউ যেন ছায়া ফেলে যাচ্ছে।

    এক রাতে, তন্ময় হঠাৎ ঘুম থেকে উঠে পড়ল। রনি দেখল, ও আবার আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।

    রনি ধীর পায়ে গিয়ে তন্ময়ের পাশে দাঁড়াল।

    আয়নার ভেতরে তন্ময়ের প্রতিবিম্ব একটু আলাদা লাগছিল। মুখটা একটু লম্বা, চোখগুলো একটু বেশি গাঢ়।

    তন্ময় ধীরে ধীরে ফিসফিস করে বলল, "রনি, তুই কি জানিস, আয়নার ওপাশে একটা জগৎ আছে?"

    রনি আতঙ্কে পেছিয়ে গেল। "তন্ময়, এসব কী বলছিস?"

    তন্ময় এবার রনির দিকে তাকাল। ওর চোখদুটো অস্বাভাবিক ভাবে লাল হয়ে গেছে!

    "ও এখনো আমাকে ছাড়েনি, রনি। ও এখন আমার মধ্যে আছে।"

    রনি মুহূর্তের মধ্যে তন্ময়ের হাত ধরে ঝাঁকুনি দিল, "তন্ময়, তুই স্বাভাবিক হ!"

    কিন্তু তন্ময় এবার বিকটভাবে হেসে উঠল, সেই চেনা শাকচুন্নীর হাসির মতো!

    শেষ লড়াই

    রনি দ্রুত দাদুকে ফোন দিল। দাদু ফোন ধরতেই চিৎকার করে বলল, "দাদু, তন্ময় আবার বদলে গেছে! ও এখন…"

    দাদুর গলা ওর কথা কেটে দিল, "আমি জানতাম! তুমি ওকে একা রেখো না! তাড়াতাড়ি একটা আয়না ভেঙে দাও!"

    রনি চারপাশে তাকিয়ে একটা ভারী মোমদানি তুলে নিয়ে আয়নার দিকে ছুড়ে মারল!

    চড়চড় করে আয়না ভেঙে গেল!

    আর সঙ্গে সঙ্গে বিকট একটা আর্তনাদ শোনা গেল—তন্ময় ছটফট করতে লাগল, যেন ওর শরীরের ভেতর থেকে কেউ বেরিয়ে আসতে চাইছে!

    তন্ময় মাটিতে পড়ে গেল, ওর পুরো শরীর কাঁপছে।

    আর তখনই, আয়নার ভাঙা কাচের টুকরোর মধ্যে রনি দেখল—একটা বিকৃত ছায়া আয়নার টুকরোর ভেতরে ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে।

    শাকচুন্নী!

    প্রেতাত্মার মুক্তি

    দাদু এসে পৌঁছালেন। সঙ্গে তান্ত্রিকরা আবার কিছু মন্ত্র পড়তে লাগলেন। পুরো বাড়িতে ধুনোর গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল, বাতাস ভারী হয়ে উঠল।

    তন্ময় তখনও মাটিতে পড়ে আছে।

    একসময়, ধুনোর ধোঁয়ার ভেতর দিয়ে এক করুণ কণ্ঠ ভেসে এল, "আমাকে আমার পরিবারই মেরেছিল… আমার প্রতিশোধ সম্পূর্ণ হয়নি…"

    তান্ত্রিক কঠোর কণ্ঠে বললেন, "তোর সময় শেষ, চলে যা!"

    একটা বিকট চিৎকার, তারপর সব শান্ত হয়ে গেল।

    তন্ময় ধীরে ধীরে চোখ খুলল। ওর মুখে এবার সেই অস্বাভাবিক হাসিটা নেই, চোখে আবার পুরনো উজ্জ্বলতা ফিরে এসেছে।

    রনি কাঁপা কণ্ঠে বলল, "তুই ঠিক আছিস?"

    তন্ময় কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, "হ্যাঁ… কিন্তু আমি কিছু মনে করতে পারছি না। আমি… আমি কোথায়?"

    দাদু ধীরে ধীরে বললেন, "তুই ফিরে এসেছিস, বাবা। এবার সব শেষ হয়ে গেছে।"

    নতুন শুরু… নাকি?

    সবকিছু স্বাভাবিক হতে শুরু করল। তন্ময় আবার আগের মতো হয়ে গেল, শাকচুন্নীর কোনো ছায়া আর ওর মধ্যে দেখা গেল না।

    কিন্তু রনি জানত, সে যেটা দেখেছিল, সেটা কল্পনা ছিল না।

    ও জানত, বিশু কাকার বাঁশবাগান এখনো অভিশপ্ত, এখনো সেখানে কেউ গেলে সেই রাতের অতিথি ফিরে আসবে…

    আর ঠিক তখনই, হালকা বাতাসে একটা হাসির শব্দ ভেসে এল—খুব দূর থেকে, কিন্তু খুব চেনা।

    রনি আর তন্ময় একে অপরের দিকে তাকাল।

    "তুমি কি সত্যিই ভেবেছো, আমি চলে গেছি।

     
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। মন শক্ত করে প্রতিক্রিয়া দিন