
যুযুধান দু-পক্ষই এই নতুন দাম্পত্যে পরস্পর পরস্পরকে মেপেই চলেছে।কে কাকে আগে আক্রমণ করবে? দুজনেরই শরীরে উৎকন্ঠার ছাপ।বৃত্তাকারে একে অপরকে প্রদক্ষিণ করে চলেছে।পায়ের উরুতে চাপড় মেরে শব্দ করে চলেছে,আর কাঁধ ঝাঁকাচ্ছে।পরস্পরকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে চলেছে।একই সময় দুজনেই ভাবছে অপরে বুঝি আক্রমণ করলো,আবার নিজেদের ভুলে নিজেরা আরো সতর্ক হয়ে চলছে।কিছুক্ষণ এমন চলার পরে দুর্যোধনের বিরক্ত লাগতে শুরু করলো।পিতামহ ভীষ্ম মন দিয়ে দেখে চলেছেন।কুস্তির আখড়াটিতে নতুন করে মাটি খোঁড়া হয়েছে।চারপাশে এখনো তলার মাটি উপরে উঠে এলে তাতে যে সোঁদা গন্ধ থাকে সেই গন্ধ আছে।দুর্যোধন মন দিয়ে দেখছিল,ভীমের শরীরের ভার দুঃশাসনের চেয়ে বেশী হলেও তার চলাফেরায় মাটিতে ছাপ কম পড়ছে।অথচ দুঃশাসন পা-টা কে মাঝে মাঝেই মাটিতে গেঁড়ে নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ছে।হালকা পায়ে চলার কৌশল তার মাথায় ঢুকছে না।দুর্যোধন বুঝতে পারছে বেশ।এমন খানিকক্ষণ চললেই দুঃশাসন হাঁফিয়ে যাবে।তখন ভীমের আক্রমণের সময়।কিন্তু সে তো অনেকক্ষণ এখনো!
সে নিজে হলে এতক্ষণে আক্রমণ করে বসতো অবশ্যই।প্রতিপক্ষকে এতটা গুরুত্ব দিতে সে রাজি না।তার ভাবনা অনুযায়ী এত বেশী গুরুত্ব দিলে প্রতিপক্ষ মাথায় চড়ে বসে।বরং,তাকে যত দ্রুত সম্ভব আক্রমণ করে বুঝিয়ে দিতে হয় যে কে বেশী শক্তিশালী।তাছাড়া তার সমবয়সী তো বটেই,তার থেকে বেশী বয়স্কদের অনেকেই তার শারীরিক শক্তির কাছে নতিস্বীকার করতে বাধ্য হয়।দুর্যোধনের সঙ্গে লড়তে হবে জানলে সকলেরই কিছু উৎকন্ঠা তৈরী হয়।সে এতক্ষণ সময় কারোর জন্য ব্যয় করবে না।ভাবতে ভাবতেই সে দেখলো আক্রমণ শুরু করেছে ভীম।কিন্তু তার মতন আক্রমণ না,এর ধরণ আলাদা।শারীরিকভাবে কাছাকাছি এসেও ভীম শক্তিপ্রয়োগ করছে না তেমন,বরং,প্রলোভন দেখাচ্ছে দুঃশাসনকে তাকে আক্রমণ করার জন্য।এখনো সেই হালকা পা।যেই দুঃশাসন লাফাচ্ছে তাকে ধরার জন্য তখনই সে সরে যাচ্ছে এবং যাবার সময় অবশ্যই কিছুটা দূর থেকে দুঃশাসনকে ধরে নীচু করে দিচ্ছে বারবার।আবার ছেড়েও দিচ্ছে।বেশ লাগছে দুর্যোধনের। এর শক্তিও বেশ ভাল।নইলে অতটা দূরত্ব থেকেও দুঃশাসনকে নীচু করিয়ে দেওয়ার কাজটা সহজ না।
ভীষ্ম জানতে চান।অনেক অনেক কিছু তাঁকে জানতে হবে এখন। গত কয়েকদিন যাবত তিনি কিশোর এবং বালক রাজকুমারদের ক্রীড়ার আয়োজন করছেন তাঁর গৃহাঙ্গনে।সকালের দিকে হালকা শরীর চর্চা সেরেই এদেরকে নিয়েই পড়ছেন।প্রাসাদের রথ পান্ডবদের নিয়ে আসছে,আবার দিনের শেষ হলে দিয়েও আসছে।দুপুরে তাঁরই আগারে খাওয়া-দাওয়া এবং বিশ্রাম সারছে পান্ডবেরা।কৌরবদের তিনি নিমন্ত্রণ করেছিলেন,কিন্তু ধৃতরাষ্ট্র বিনয়ের সঙ্গেই প্রত্যাখ্যান করেছেন সে নিমন্ত্রণ।অজুহাত দিয়েছেন।হ্যাঁ,অজুহাতই!কৌরবদের সঙ্গে নিয়ে আহারে তিনি এতই অভ্যস্ত যে তারা না থাকলে তাঁর আহার ঠিক হয় না।ভীষ্ম শুনেছেন।বুঝেওছেন।ভাগ হয়ে গিয়েছে।দাগ বাড়ছে মাত্র।ধৃতরাষ্ট্রের পক্ষে তাঁকেও আর বিশ্বস্ত ভাবা সম্ভব না।সেই ধৃতরাষ্ট্র,যে বাল্যকালে তাঁরই আগারে বেশীরভাগ সময় কাটাতো।অন্ধ বালকের হাত ধরে তিনি লক্ষভেদ থেকে গদাযুদ্ধ শিক্ষা সবই দিয়েছেন।তাঁর আহারকাল উপস্থিত হলে তাঁরই পাত থেকে খাবার না তুলে খেলে যার দিন যেতনা,সেই ধৃতরাষ্ট্র?সেও ভাবতে পারলো যে তিনি,গাঙ্গেয়,সন্তানসম পুত্রের পুত্রাদির ক্ষতি করতে পারেন?তাহলে?নাকি এ কর্ণিকের মন্ত্রণা?তাই হবে।কিন্তু তা হলেও,নিজেকেই জিজ্ঞেস করেন তিনি,ধৃতরাষ্ট্র কি দোষী না?সে তো রাজা এখন।তার নিজের ভাবনা কি বলে?বলে যে গাঙ্গেয় ভীষ্ম,এ কাজ করার কথা ভাবতেও পারেন?হায় রে!পক্ষ,পক্ষ আর পক্ষ।সকলেই তাঁকে বাধ্য করতে চাইছে,চেয়েছে পক্ষ নেওয়ায়!কিন্তু তিনি আজ-ও এখনো হস্তিনাপুরের মহারাজ শান্তনুর বংশ ছাড়া কারোর পক্ষ নেননি।পান্ডবদের এ রাজ্যে যথাযোগ্য ঠাঁই পেতে সাহায্য করেছেন এ কথা সত্যি!কিন্তু সে যুধিষ্ঠিরই এর ন্যায্য উত্তরাধিকারী বলে,অন্য কারণে নয়।এ শাস্ত্র সঙ্গত বলে,হস্তিনাপুরের জন্য প্রয়োজনীয় বলে তিনি পক্ষ নিয়েছিলেন তৎকালে।কিন্তু তা বলে তিনি যাচিয়ে নিতে ছাড়ছেন না।এই লড়াই এতক্ষণ মন দিয়ে দেখছেন তার কারণ তিনি জানতে চান কতটা উপযুক্ত হাতে পড়তে পারে শাসন।এতসব ধৃতরাষ্ট্র বুঝতে চায়নি,নইলে...!
এই তো।দুঃশাসনকে চকিত আক্রমণ করেছে ভীম।এর আগে আক্রমণ করে করে ফিরে যাচ্ছিল বলে দুঃশাসন ধরেই নিয়েছে সে এবারো তাই করবে।ক্লান্তি এবং অসতর্কতার ফসল নিল ভীম। হাঁটুর পিছনের দিকে একটা হাত,আরেকটা হাত বুক আর পেটের সীমান্তে দিয়ে দুঃশাসনকে মাটি থেকে তুলে ফেলেছে।নিজের পা গেঁথে নিয়েছে মাটিতে।যুধিষ্ঠির সমেত বাকী পান্ডবরা উল্লাসে চিৎকার করছে।দুর্যোধনের মুখ গম্ভীর।বাকী কৌরবরাও উৎসাহ দিচ্ছে দুঃশাসনকে হাত দিয়ে ভীমের মাথাটাকে সাপটে ধরার জন্য।বারবার হাত বাড়াচ্ছে দুঃশাসন।কিন্তু ভীম মাথা সরিয়ে নিচ্ছে ওই অবস্থাতেই।দুটো পক্ষ এখানেও স্পষ্ট।ক্রমশ নিজের উপরের হাতের জোর বাড়িয়ে দুঃশাসনকে নিজের হাঁটু থেকে মাটিতে আছড়ে ফেললো ভীম।একই সঙ্গে বাঁ-পাটা বাড়িয়ে প্রথমে কোমরে,তারপরে চেপে বসলো তার বুকের উপরে।প্রশংসনীয় দক্ষতা বটে এই মধ্যম পান্ডবের।শক্তি এবং বুদ্ধির মিশেল আছে এর কৌশলে।তবে এই কৌশল উত্তরাখন্ডের কৌশল না।দুঃশাসনরা কুস্তির এই ধারার সঙ্গে এখনো পরিচিত হয়নি।এ হল পূর্ব দেশের ধারা।নিষাদ,শবর,নাগেরা এই ধারায় লড়ে।জঙ্গলে বাঁচার মতন নিয়ম এই ধারায়।শত্রু নিজের থেকে অনেক দুর্বল হলেই একমাত্র সরাসরি আক্রমণ।না হলে তাকে প্রথমে শক্তিক্ষয় করাতে হবে।তারপরে হানতে হবে অতর্কিতে আক্রমণ।জঙ্গলের যুদ্ধের নিয়ম এ সব।কোথায় ভীম শিখলো জানতে হবে!
উঠে দাঁড়ালেন ভীষ্ম।স্নানাহারের সময় হয়েছে এখন।প্রহরী ঘোষণা করল সময়।ছেলেরা ঘোষণা শুনে নিজেদের মধ্যে জটলা বন্ধ করলো।সেই দু-পক্ষ আলাদা আলাদা।পান্ডবরা গা থেকে ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে চললো তাঁর রক্ষীদের সঙ্গে স্নানাগারের দিকে।কৌরবরা আজ নদীতে স্নানে যাবে।কিন্তু দুর্যোধন কই?এদিক ওদিক দেখলেন।নেই।তার মানে তার আঁতে ঘা লেগেছে।দুঃশাসন তার প্রিয়তম ভ্রাতা।তার পরাজয় মানে দুর্যোধনের পরাজয়।হাসলেন ভীষ্ম।এই কিশোরটি শক্তিশালী।দুঃশাসনের জায়গায় ভীম এর সঙ্গে লড়লে ফলাফল অন্য হতেই পারতো।অভিমানে তাই সকলের আগে নিশ্চই রথের দিকে চলে গিয়েছে খেলা শেষ হওয়া মাত্র।কিন্তু এর মানে পরাজয়কে নিতে শেখেনি এই কিশোর।নিয়ম হল বিজয়ীকে সহৃদয় অভিনন্দন জানাতে হয়।সেটাই বীরধর্ম।অন্য যোদ্ধার কৌশলকে সন্মান করতে না শিখলে যুদ্ধ শিক্ষার একটা বড় অংশ ফাঁকি হয়ে যায়।মাথা নাড়লেন ভীষ্ম নিজের স্নানাগারের দিকে যেতে যেতে।তিনি নানান কাজে ব্যস্ত।তাঁর পক্ষে কতটা সম্ভব এদের সকল শিক্ষার দিকে নজর দেওয়া?প্রকৃত শিক্ষক চাই।সন্ধান পেতেই হবে তার।তিনি অবহেলা করে ফেলছেন অজান্তে।এখনই এই সকল শিক্ষা না হলে বড্ড ক্ষতি হয়ে যাবে।ভাবতে ভাবতেই তিনি ক্রীড়াঙ্গন পেরোলেন।সংলগ্ন উদ্যানটি পার হয়েই তাঁর স্নানাগার। আরে,ওই তো!ভীমের সঙ্গে কথা বলছে দুর্যোধন।আবার হাসলেন তিনি।সত্যি,হস্তিনাপুর তাঁকেও সন্দেহাকুল করে তুলেছে।শিশুরা শিশুই হয়,কিশোরেরা কিশোর।তাঁর নিজের মতন পরিণত মস্তিষ্ক হলে তাদের শিশু বা কিশোর বলবে কেন?হাঁটার গতি বাড়ালেন। হয়তো কিশোরটির ক্ষণিকের ক্রোধ হয়েছিল।তাই বাইরে চলে গিয়েছিল ক্রীড়াঙ্গনের সে ক্রোধ সংযত করতে।আবার ফিরে এসেছে তার পরে।ভালই তো,অন্তত নিজে নিজে সংবৃত হতে পারলে ধৃতরাষ্ট্রের মতন হয়ে উঠবেনা এই সুকুমার কিশোর।স্নানাগারে পৌঁছতেই ভৃত্য তাঁর অঙ্গভূষণটির জন্য হাত বাড়ালো।গরম পড়ে গিয়েছে।স্নান করতে একটু সময় নেবেন আজ।তারপরেই আজ আবার বসতে হবে মন্ত্রণাসভায়।দূত এসেছে মথুরা থেকে।কংসের পতনের পর এই দূত এল।তার বার্তা শুনতে হবে।
দুর্যোধন রথে চড়ে দাঁড়ালো।মনটা এখন একটু ভাল লাগছে।কালকেই শোধ হয়ে যাবে আজকের।রথের ঘোড়া হাঁকাল সে।একমাত্র তার রথই সারথি বিহীন।সে নিজেই রথ চালাতে ভালবাসে।যুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছে।শত্রুর প্রতি ক্ষমাহীন থাকাই একমাত্র শর্ত যুদ্ধের।সেও ভীমকে ক্ষমা করবে না।ঠিক বলেছেন কর্ণিক।জয়ই একমাত্র উদ্দেশ্য যুদ্ধের,বাকী সব মিথ্যা।
PM | unkwn.***.*** | ০২ অক্টোবর ২০১২ ০৪:০৫89389
শুদ্ধ | unkwn.***.*** | ০৪ অক্টোবর ২০১২ ০৪:১৭89390