এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ধারাবাহিক

  • মহাভারত তৃতীয় পর্ব

    শুদ্ধসত্ব ঘোষ লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | ১৫ মে ২০১১ | ১২৩৩ বার পঠিত


  • ।।৩।।

    হস্তিনাপুর আজ ঘুমোচ্ছে না। রাস্তায় রাস্তায় জ্বলছে মশাল। বিরাট বিরাট থামের মাথায় বাঁধা এই মশালগুলো। জ্বললে একটা বড় অঞ্চল আলো হয়ে থাকে। রাজপ্রাসাদের দিকে সারারাত জ্বলে এই মশালগুলো। কিন্তু বণিকদের অঞ্চলে বা অন্যান্য রাজকীয় কার্য্যের আগারগুলিতে অন্ধকার। সূর্য ডোবার সঙ্গে সঙ্গে শেষ হয়ে যায় এদের কাজ। একমাত্র কৃষকদের থেকে বা অধীন রাজ্যগুলোর থেকে কোনো উৎসব উপলক্ষ্যে বিশেষ কর এলে সে রাতে কাজ চলে কোষাগার সংলগ্ন মহাগাণনিকের অধিকরণে। সেই সেই রাতগুলোতে অধিকরণের চারপাশে ছায়া বলে কোনো বস্তুর অস্তিত্ব কল্পনাও করা যায়না। আজ যেমন সেখানে জ্বলছে বিশাল বিশাল মশাল সব। অথচ সেই অর্থে রাজ্যে আজ কোনো উৎসব নেই। কিন্তু যা আছে তা উৎসবের উর্ধ্বে। কুরু রাজ্যের ন্যায্য উত্তরাধিকারী রাজচক্রবর্তী রাজা পাণ্ডুর মৃত্যু হয়েছে। অবশ্য সম্প্রতি হয়েছে বলা ভুল, বলা ভাল যে সে খবর এই পেল হস্তিনাপুর। অনেককাল আগেই রাজা পাণ্ডু ইহলোক ত্যাগ করেছেন। সে খবর নিয়ে রাজ্যে এসেছিল এক অদ্ভূত আগন্তুকদের সারি। পর্বত ছেড়ে ঋষি আর মুনিদের দল নেমে এসেছিলেন এই সমতলের নগরে। সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন রাজা পাণ্ডুর বিধবা স্ত্রী কুন্তী আর পাঁচ বালককে, যারা কৈশোরে পা দিল বলে। রাজ্যে হৈ হৈ পড়ে গেছে। এতকাল পরে রাজার মৃত্যুর সংবাদ এসেছে বলেই শুধু না, পাঁচ রাজপুত্র নিয়ে প্রবল সংশয় দেখা দিয়েছে। মহারাজ পাণ্ডু তাঁর রাজ্যপাট তাঁরই জ্যেষ্ঠভ্রাতা ধৃতরাষ্ট্রের হাতে সমর্পণ করে চলে গিয়েছিলেন বনবাসে। কিন্তু ধৃতরাষ্ট্র রাজা হতে পারেননি। শাস্ত্র মতে তিনি শারীরিক খুঁতবিশিষ্ট ব্যক্তি। কাজেই তাঁর রাজা হওয়া সম্ভব না। তিনি পাণ্ডুর প্রতিনিধি হিসেবেই শাসন চালাচ্ছিলেন ভীষ্ম-বিদুরাদির সহায়তায়। সাধারণভাবে এক্ষেত্রে রাজার পুত্র বয়সকালে শাসনভার গ্রহণ করবে এটাই রীতি। কিন্তু এখানেই জটিলতা। অনেক অনেক প্রশ্ন এখন ভীড় করেছে হস্তিনাপুরবাসীর মনে। আগামী পরশু বসবে মহাপঞ্চকের সভা। অর্থাৎ রাজসভায় রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসবেন গ্রামসভাগুলোর প্রতিনিধিরা। তাঁদের সামনেই হবে রাজ অধিকারের প্রশ্নের মীমাংসা। তাই আজ হস্তিনাপুরের চোখে ঘুম নেই। অন্যদিকে রাজা পাণ্ডুর মৃত্যুর শোকপালনের জন্য অধিকৃত রাজ্যগুলো থেকে এসেছে বিশেষ কর, যা প্রণামী নামের আদায়। রাষ্ট্র শোক পালন করবে অর্ধমাস। তার খরচ বিস্তর। সেই খরচের একাংশ বহন করবে অধিকৃত রাজ্যগুলো। সেই কাজের জন্যই আজ অধিকরণের সামনে এত আলো এই রাতে। কিছুক্ষণ আগেই এখানে পৌঁছেছেন মহামন্ত্রী বিদুর স্বয়ং। একে একে রাজ্যের তালিকা এবং পাঠানো ধনের পরিমাণ তিনি নিজের উপস্থিতিতেই দেখে নেবেন। কোনো রাজ্য যদি তার আয়তনের আনুপাতিক বা আয়ের আনুপাতিক হারে এই আদায় না পাঠিয়ে থাকে তাহলে তার জন্য অপেক্ষা করে থাকবে দুর্ভোগ।

    বিদুর যখন সবটা দেখা শেষ করলেন তখন রাত প্রায় শেষ হতে চলেছে। জটিল কাজ সন্দেহ নেই। কিন্তু তার থেকেও জটিল কাজ তিনি একই সঙ্গে সেরে রাখছেন। তাঁর মাথা কাজ করে চলেছে অনেক দিকে। কুন্তী, মহিয়সী কুন্তী তাঁকে কিছুটা বিপদে ফেলেছেন। প্রাসাদে কুন্তীর থাকার ব্যবস্থা তাঁর পছন্দ হচ্ছে না। তিনি মাতা সত্যবতীকে সোজা জানিয়ে দিয়েছেন তিনি তাঁর এবং তাঁর সন্তানদের নিরাপত্তার জন্য হস্তিনাপুরের প্রাসাদের বাইরে থাকতে পছন্দ করবেন। আর সে ক্ষেত্রে তাঁর প্রথম পছন্দ মহামতি বিদুরের ঘর। অবশ্য বিদুরের যদি আপত্তি থাকে তাহলে অন্য কথা। আপত্তি? কুন্তী থাকবেন তাঁর কাছে এতে তাঁর আপত্তি? কুন্তী জানেন না, এ তাঁর কত কাঙ্খিত? জানেন! কিন্তু অসম্ভব কৌশলী মহিলা এই কুন্তীভোজ কন্যা। সকলেই সব কিছু বোঝে হয়ত, কিন্তু তাঁর সামনে বলে কার সাধ্য। তাঁর ব্যক্তিত্ব বড়ই প্রখর। মাতা সত্যবতীও জানেন দেবরকে কতটা পছন্দ করেন কুন্তী, আর সেই পছন্দ শুধুমাত্র পছন্দের মাত্রাতেই হয়ত নেই। কিন্তু জানলেও কিছু করার নেই। কোনো প্রমাণ নেই এর। শুধু অনুমান। তার ভিত্তিতে কিছু বলা বা করা যায়না। কাজেই সত্যবতীকে অপেক্ষা করতে হবে বিদুরের সিদ্ধান্তের। কিন্তু এখানে সমস্যা নয় বিদুরের। তাঁর সমস্যা হল তাঁর গার্হস্থে এর প্রভাব ঠিক কেমন পরবে তা বুঝতে না পারা! আর তার চেয়েও বড় সমস্যা হল হস্তিনাপুরের লোক কী ভাববে? কী ভাবে নেবে এই অবস্থান? জ্যেষ্ঠভ্রাতার ভ্রূকুটি নিয়ে তিনি চিন্তিত না। ধৃতরাষ্ট্র, যতদিন ভীষ্ম আছেন এবং সর্বোপরি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন, ততদিন চাইলেও তাঁর ক্ষতি করতে পারবেন না। সেক্ষেত্রে নিজের বিপদ ডেকে আনবেন।

    অধিকরণ থেকে বেরিয়ে নিজের রথে চড়লেন। রথ পথের ধুলো আর রাতের নৈ:শব্দ্যকে খণ্ড খণ্ড করে চিরে চলল হস্তিনাপুরের প্রান্তের দিকে। চোরাদুয়ারের কাছে এসে রথ ছেড়ে দিলেন বিদুর। এখান থেকে যে রাস্তাটি যাচ্ছে সেই রাস্তাটি একটি জঙ্গলের মধ্যে ঢুকবে। রথ এখান থেকে ফিরে যাবে নগরীর পশ্চিম প্রান্তে। এই পূর্বপ্রান্তের জঙ্গলটি ধরে কিছুটা গেলে একটি মন্দির আছে। সেই মন্দিরের সামনে এসে দাঁড়ালেন বিদুর। ভোর হতে আর বাকী সামান্যই। মন্দিরের ভিতরে খুব সামান্য একটি আলো জ্বলছে। কিন্তু এত নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে সেই আলোই মনে হচ্ছে অনেক। আলোক লক্ষ্য করে এগোলেন তিনি। বুকের ভিতরে একটা চাপা উত্তেজনা। কেমন একটা লাগছে নিজেকে! কিছুটা অচেনা। হঠাৎ করে যেন ফিরে গেছেন তাঁর নবযৌবনের দিনগুলোতে। যখন ধর্মাত্মা বিদুর গভীর রাতে একটি কালো অশ্বের পিঠে সওয়ার হতেন এবং এই জঙ্গলের মধ্যে এসে তাকে বেঁধে রেখে প্রায় ছুটতে ছুটতে পৌঁছে যেতেন এই মন্দিরে। এক রমণী সেখানে তাঁর জন্য অপেক্ষায় থাকতেন। না, তিনি তাঁর স্ত্রী না, হবেনও না কোনো দিন, কিন্তু তিনি তাঁর পরমাকাঙ্খার পাত্রী, তিনি তাঁর অলক্ষ্য নিয়তি। আজও সেই মহিলা বসে আছেন মন্দিরে তাঁর জন্য। বিদুরের মনে হচ্ছে তাঁদের মধ্য দিয়ে যেন কালস্রোত সত্যি প্রবাহিত হয়নি, সকলই স্থির হয়ে আছে তাঁকে তাঁর ঈপ্সিত লক্ষ্যে পৌঁছে দেওয়ার জন্য। কিন্তু এখন মন্দিরে প্রবেশ করে সেই নারীর পিঠের দিকে দাঁড়িয়ে যেন তাঁর গলা শুকিয়ে আসছে। রমণী চিত্রার্পিতার ন্যায় দাঁড়িয়ে আছেন। অনেক কষ্টে গলা দিয়ে শব্দ বার করলেন বিদুর।

    -মহারাণী!

    রমণী কোনো সাড়া দিলেন না। বিদুর একটু অবাক হলেন। আবার ডাকতে গেলেন। হঠাৎ তাঁর মনে পড়লো এ নামে জনান্তিকে সাড়া দেবার শর্ত নেই। অনেক কাল, অনেক কাল চলে গেছে যে! অভ্যাস বড্ড বলশালী। সেই অভ্যাসও তাঁকে দিয়ে ভুল করিয়ে ফেলেছে। আবার গলা পরিষ্কার করে নিলেন। ডাকলেন,

    -পৃথা!

    রমণী খুব ধীরে ধীরে তাঁর দিকে ঘুরতে শুরু করলেন অবশেষে।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ধারাবাহিক | ১৫ মে ২০১১ | ১২৩৩ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। দ্বিধা না করে মতামত দিন