ফেরার পথে ফল্গু জিজ্ঞেস করল, কী কী আবিষ্কার করলি আজ?
অনেক কিছুই নতুন দেখলুম, উল্কি বলে, তাই বলে সেগুলোকে কি আবিষ্কার বলা যায়?
যেমন?
এত বিচিত্র রকমের প্রজাপতি একই জায়গায়, জঙ্গলের অংশ হলেও ঠিক জঙ্গল নয়, গাছপালাগুলোর উপর মানুষের হাত স্পষ্ট, প্রজাপতিদের থাকবার আর ডিম পাড়ার সুবিধে হবে এমন বাছাই করা সব গাছ-গুল্ম, কেয়ারি-করা বাগানের মতোই খানিকটা। মানুষের কাটা ছোট ছোট জলাশয়, তার উপর ছোট ছোট সাঁকো – ভালো হলেও খুব স্বাভাবিক ভাবে বেড়ে ওঠা বলে মনে হয় না, এগুলোই আমার আবিষ্কার। আর তা ছাড়া মাউন্ট হাউজের ওই অগুনতি প্রজাপতির প্রদর্শন তো ভোলা যাবে না কোনদিনই। পিন দিয়ে লাগানো না থাকলে মনে হতো এখনই বুঝি বা উড়ে যাবে!
আর তুই, মুড়কি?
উল্কিদি যা যা বললো সেগুলোর সঙ্গে আমিও একমত, মুড়কি বলল, কিন্তু আমার সবচেয়ে বড় আবিষ্কার চিত্রগুপ্ত্ বর্মা। শুধু ইন্টারেস্টিং বললে কম বলা হবে, একেবারে জলজ্যান্ত একজন বিজ্ঞানী, যাঁর নামে একটা প্রজাপতির নাম! কিন্তু কী ভালো লোক! যেভাবে কথা বললেন আমাদের সঙ্গে, মনে হল যেন কতদিনের চেনা!
সেটা ঠিকই বলেছিস, বলে ফল্গুদি, কিন্তু আর একজন মানুষকে কেমন লাগল?
আর একজন? কে? – মুড়কি আর উল্কি একসঙ্গে বলে ওঠে।
কেন, ওই স্ন্যাক-বারের ছেলেটা?
স্ন্যাক-বারের ছেলেটা? – বলে মুড়কি, কিন্তু ওর সম্বন্ধে কী ধারণা হবে? ও তো নীরবে খাবার-দাবার দিচ্ছিল শুধু।
নীরবে?
কেন, কথা বলেছিল নাকি? কই, আমি তো মনে করতে পারছি না, বিস্ময় প্রকাশ করে মুড়কি।
না না, বলেছিল এক-আধবার, আমি মনে করতে পারছি, উল্কি বলে, আমরা যখন স্ন্যাক-বারে, তখন মিস্টার বর্মার খাদ্য সংক্রান্ত দুয়েকটা প্রশ্নের উত্তর ও দিচ্ছিল যে ভাষায় সেটা বোধ হয় পর্তুগিজ।
মনে করতে পেরেছিস তাহলে, বলে ফল্গু। আচ্ছা পেরেইছিস যখন, তখন বল তো ও পর্তুগিজ ভাষায় যখন উত্তর দিচ্ছিল, বর্মা তখন ওর সঙ্গে কথা বলছিলেন কোন ভাষায়?
পর্তুগিজেই হবে।
পর্তুগিজেই হবে? হবে নয়, ফল্গু বলে, পর্তুগিজেই। পর্তুগিজে প্রশ্ন করছিলেন বর্মা, আর ও উত্তর দিচ্ছিল পর্তুগিজেই, ঠিক যেমন স্ন্যাক-বারের মালিক উত্তর দিচ্ছিল স্প্যানিশে, কারণ তাকে প্রশ্ন করা হচ্ছিল স্প্যানিশে। দুজনকে দুটো আলাদা ভাষায় প্রশ্ন করার কারণ হয়তো এই যে, ওদের দুজনের মাতৃভাষাও আলাদা আলাদা। আর বর্মা যে দুটো ভাষাতেই স্বচ্ছন্দ সে তো আমরা বুঝতেই পারছিলাম। কিন্তু, তোদের কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে, আবার বলে ফল্গু, ওই স্ন্যাক-বারের বাইরে ছেলেটাকে কোন কথা বলতে শুনিসনি তোরা, তাই তো?
স্ন্যাক-বারের বাইরে? – একটু সময় নেয় মুড়কি, স্ন্যাক-বারের বাইরে ওকে আর একবারই মাত্র দেখলুম তো আমরা, সে ওই হোলি ব্লু প্রজাপতির মাউন্টের সামনে। কিন্তু তখন কি ও কথা বলেছিল?
কথা বলেছিল কি? ভেবে দেখ্, বলে ফল্গু।
মুড়কির মুখটা কেমন যেন অসহায় হয়ে যায়, ছেলেটা এসে দাঁড়িয়েছিল মাউন্টটার সামনে ঠিকই, কিন্তু ও ভেবে পায় না ছেলেটা তখন কথা বলেছিল কিনা। এমন সময় উল্কি বলে ওঠে, হ্যাঁ, কথা বলেছিল ছেলেটা, ওই যে প্রজাপতির ডিম সবুজ ঘাসে ক্ল্যামোফাজ হয়ে থাকার কথা যখন বলছিলেন মিস্টার বর্মা, তখন ও সেটা নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছিল, ঠিক ঠিক মানতে চাইছিল না প্রথমে।
বিস্ময় প্রকাশ করছিল কোন ভাষায়?
কোন ভাষায়? – এবার যেন একটু ফাঁপরে পড়ে যায় উল্কি, তারপর একটু ভেবে বলে, পর্তুগিজেই হবে।
তুই শিওর? – প্রথমে উল্কি, তারপর মুড়কির দিকে ফেরে ফল্গু, তুই?
মুড়কি বলে, আমি তো ছেলেটা আদৌ কথা বলেছিল কিনা তা-ই মনে করতে পারছি না, তবে কথা যদি বলেই থাকে, তাহলে পর্তুগিজেই বলেছিল নিশ্চয়ই, কারণ পর্তুগিজ ওর মাতৃভাষা।
পর্তুগিজ ওর মাতৃভাষা জানলি কী করে?
তুমিই তো বললে ফল্গুদি, ওর মাতৃভাষা পর্তুগিজ আর স্ন্যাক-বারের মালিকের স্প্যানিশ।
এবার কথা বলে উল্কি, না না সে কথা বলেনি ফল্গুদি। মিস্টার বর্মা যেহেতু মালিকের সঙ্গে স্প্যানিশ আর ছেলেটার সঙ্গে পর্তুগিজ ভাষায় কথা বলছিলেন, তাই ফল্গুদি আন্দাজ করছিল যে ওদের আলাদা আলাদা মাতৃভাষা।
ফল্গুদি এবার বেশ গম্ভীর হয়ে যায়, বলে, ছেলেটা যখন কথা বলেছে তখন আমরা তিন জনেই সেখানে উপস্থিত ছিলাম, তিন জনেই নিজের নিজের কানে শুনেছি ওর কথা, সেই স্মৃতির ভিত্তিতে তোদের আমি জিজ্ঞেস করছি কী ভাষায় কথা বলেছিল ছেলেটা।
ওরা দুজন কথা না বলে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে মাথা নীচু করে বসে থাকে। বেশ নাটকীয় ভঙ্গিতে ফল্গু বলে এবার, আমি যদি বলি ও কথা বলেছিল বাংলায়!
বাংলায়! বাংলায় কীভাবে হবে? বাংলায় শুনলে আমাদের মনে থাকতো না? – দুজনেই বলে ওঠে একসঙ্গে।
ঠিক ঠিক শুনলে মনে থাকারই কথা, কিন্তু তোরা ঠিক ঠিক শুনিসনি, শুনেছিস শুধু কান দিয়ে, মন দিয়ে শুনিসনি। আসলে ও ছাড়া বাকি আমরা যে চারজন ওখানে ছিলাম, তারা সবাই বাংলায় কথাবার্তা বলছিলাম। শুধু তা-ই নয়, বর্মা ছাড়া আমাদের তিনজনেরই মাতৃভাষাও বাংলা, অসতর্ক মুহূর্তে বাংলা কথা শুনলে আমরা খেয়ালই করব না, বিশেষ করে যে বিষয়ে আমরা কথা বলছিলাম সেটা যদি খুব ইন্টারেস্টিং আর অ্যাবজর্বিং হয়। ছেলেটা কিন্তু বাংলা বলেই খেয়াল করেছে যে ও বাংলা বলে ফেলেছে, কাজেই পুরো কথোপকথনটার সময় আর একবারও কথা বলেনি ও। ছেলেটা যে বাংলায় কথা বলছিল, আমি ছাড়া সেটা খেয়াল করেছিল আর একজন। তিনি চিত্রগুপ্ত্ বর্মা, যিনি বাংলা খুব স্বচ্ছন্দ বললেও যাঁর মাতৃভাষা বাংলা নয়। খুব বুদ্ধিমান মানুষ, কাজেই বিশেষ কিছু প্রতিক্রিয়া বর্মা দেখাননি ঠিকই, কিন্তু আমি স্পষ্ট দেখেছি, ওর কথাটা শুনে এক মুহূর্তের জন্যে থমকে দাঁড়িয়েছিলেন উনি।
কিন্তু ছেলেটা অসতর্ক মুহূর্তে ওর নিজের মাতৃভাষা না বলে বাংলা বলে ফেলল কীভাবে? – প্রশ্ন করে উল্কি।
এই প্রশ্নটার সমাধান করা দরকার, বলে ফল্গু, প্রশ্নটা আমি করলুম, এবার চিন্তাটা শুরু কর তোরা।
এই সব কথা হচ্ছিল গাড়িতে বসে বসেই, ফেরার পথে। ড্রাইভারের পাশেই বসেছিল ফল্গু, হঠাৎ দূর থেকে দেখতে পেল ট্যুরিস্ট ইনফর্মেশন সেন্টারের পাঁচিলের বাইরেই দাঁড়িয়ে আছেন সকালের সেই ট্যুরিস্ট অফিসার মহিলা, তাঁর সঙ্গে রীতিমত স্যুট-বুট পরা এক ভদ্রলোক। মহিলা বোধ হয় আশা করছিলেন ওরা আরও তাড়াতাড়ি ফিরবে, ফিরতে দেরি হওয়ায় বোধ হয় উদ্বিগ্ন হয়েই দাঁড়িয়ে আছেন।
গাড়ি থেকে নামতে-না-নামতেই এগিয়ে এলেন মহিলা, সঙ্গে ভদ্রলোকটিও। ভদ্রলোকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে মহিলা বললেন, মিস্টার অ্যালেহান্ড্রো শ্যাভেজ হলেন পেরু অ্যামাজন রেনফরেস্ট প্রোজেক্টের ডিরেক্টর, ওঁর সঙ্গে তোমাদের পরিচয় করিয়ে দেব বলেই বাটারফ্লাই ফার্মে হিসেব করে তোমাদের পাঠিয়েছিলাম যাতে ঠিক সময়ে তোমরা ফিরতে পার। যাই হোক, ঠিকই ফিরেছ তোমরা, এখন তোমাদের খিদেও পেয়েছে নিশ্চয়ই, অফিসের ভিতর তোমাদের জন্যে একটা করে লাঞ্চবক্স রাখা আছে – ভেজিটারিয়ান – চট করে খেয়ে নিয়ে আগে তাড়াতাড়ি চলে যাও তোমাদের ট্র্যাভ্লার্স ইন-এ। চেক-আউট করে তাড়াতাড়ি চলে এসো, তাহলে এক দিনের চার্জেই হয়ে যাবে। তাড়াতাড়ি কর। অ্যালেক্স, মানে মিস্টার শ্যাভেজ তোমাদের জন্যে এখানেই অপেক্ষা করবেন, দেখা যাক কী ব্যবস্থা করা যায় তোমাদের জন্যে।
ভদ্রমহিলার কথা বলার ভঙ্গিতে এমন একটা কিছু যে ওরা ভদ্রতা করেও খাবারের ব্যাপারে লজ্জা দেখাতে পারল না। একটা করে বাক্স ওদের জন্যে ছিল, অফিসের সিকিউরিটির লোকটা ওদের তিনজনের সামনে একটা করে কোক-এর বোতল বসিয়ে চলে গেল, তাড়াতাড়ি করে খেয়ে ওরা বেরিয়ে গেল তাম্বোপাতা ট্র্যাভ্লার্স-ইন এর উদ্দেশে।
ট্র্যাভ্লার্স-ইন এর ম্যানেজারের হাবভাবে মনে হলো উনি আগে থেকেই জানতেন ওরা এরকম হঠাৎ ফিরে এসেই চলে যেতে চাইবে। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ওদের চেক-আউট হয়ে গেল, ভদ্রলোক একটা মোটোট্যাক্সি ডাকিয়ে ওদের তুলে দিয়ে বললেন, যেদিন ফিরবে ম্যালডোনাডোয়, একটা টেলিফোন করে চলে এস আবার।