১।
গলির শেষ প্রান্তে একসময় বাজত সুরের রজনীগন্ধা
গ্রীষ্মের ক্লান্ত দুপুরে, শীতের মিঠে রোদে ছাদে উঠে
মেলে দিত ছাপা কাপড়, ছড়িয়ে যেত রেক্সোনা সাবানের চেনা গন্ধ
কৈশোর চাইত আরো একটু গায়ের কাছে যেতে
ঘেঁষে যেত ঝুঁকে আসা গাব গাছের পাতা
কাটা কাটা ছায়ায় বসে ফিসফিস করে কানের কাছে কেউ বলত
নিষিদ্ধ গল্প – একের পর এক
শীতের চাদরের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে আসা দুধ সাদা হাতে
আলতা চুঁয়ে পড়া দেখতে বলত মিঠে ফিনফিনে গলা
বলত চাদরে জড়িয়ে রাখা আছে সিন্দবাদের গল্পের ঝুলি
আলাদিন হবার প্রলোভন দেখাত দুপুরের ছাদ –
একদিন অন্য সাবানের গন্ধ এল বাতাসের সাথে
সদ্য কৈশোর শেষ না হওয়া সিঁড়ি দিয়ে ছুটে উঠে দেখল
সেদিনের আকাশ হালকা কমলা রঙে
রাঙিয়ে নিয়েছে নিজেকে
একরাশ সিন্দবাদের গল্প ছড়ানো ছাদের মাঝে
আলাদিনের প্রদীপের কাছে এসেছে গোলাপী ঠোঁট
প্রায় বুজে আসা চোখ এদিকে ফেরে না
ছাপা কাপড় বাতাসে ছড়িয়ে দেয় নিজেকে
প্রতি ভাঁজে মাখিয়ে নেয় সুরের রজনীগন্ধা
কৈশোর ঢলে বিকেলের রোদের সাথে
২।
মাঝে মাঝেই সূর্যগ্রহণ দেখা যেত আমাদের ছাদ থেকে
গাব গাছটা প্রথম দিকে ছিল পশ্চিমে
তারপর একদিন প্রখর দুপুরে পুড়ে যাওয়া
সাদা কংক্রীটে পায়ের ছাপ ফেলে দেখলাম
উত্তর দিক থেকে একরাশ সবুজ মাখিয়ে
জানালায় মুখ ঢেকেছে কেউ
আমার চোখে তখন গাঢ় রঙের কাঁচ, ওপাশের সব কেমন ধূসর দেখায়
তার চোখের মণি পূর্নবার জানায় সবুজের গল্প
রঙীন কাঁচ ভাবে কত গভীরে দেখা যায়!
পাতার আড়াল গ্রহণ করছে সূর্যকে
জানি এরপর মিষ্টি আলো নেমে আসবে
ওবাড়ির ছাদে উঠবে মিশে যাওয়া কাপড়ের কেউ
কৈ তার চোখে তো চশমা নেই!
এক আঙুলে পাতায় হাত বুলায় আর
অন্য আঙুল নিভতে থাকা সূর্য দেখিয়ে
ক্ষণিকের গল্প শোনায়
এভাবেই প্রায়শঃ আমাদের ছাদে গ্রহণ নেমে আসে
দেখা যায় মিশে যাওয়া লম্বা ছায়ায়
সূর্য লুকায়, নরম উত্তাপ মাখিয়ে
দেয় গাব গাছের পাতায়
গাছ সরে আসে উত্তর দিকে আরো
আরো প্রশ্নের উত্তর দেয় ঠোঁটে আঙুলে দিয়ে
৩।
ক্লাশ নাইনে এক নিষিদ্ধ গল্প বলেছিল ছাদ
দমকা হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়েছিল ব্লাউজ
ধার করা লাল পাড় শাড়ি, আর বুকে এতদিনের লেগে থাকা তিল
সেখানেও জুঁই ফুল, সেখানেও ভোর রাতে কেউ দরজা খুলে
বেরিয়ে যেত না ফেরার গান শুনিয়ে
কানের লতির কাছে আরো আগে বেহাগের সাথে মিশে যাওয়া
ধনেখালি শাড়ি মিশে যেত, মিশে যায় অবুঝের সিল্ক
মসৃণ আরো মসৃণতর হল সে বছর জুড়ে
বাতাসে ছড়িয়ে মৃগগন্ধ
সিন্দবাদের গল্প শুনতে ছাদ ডাকে
নিষিদ্ধ সুবাসের বুকের তিল প্রথমবার বৃষ্টির ছোঁয়া পায়।
৪।
প্রতিবার অসময়ে বর্ষা আসে
ডুবিয়ে দেয় ক্ষেতের মাঝে উঁকি দেওয়া সবুজ
ভিজিয়ে দেয় জমি, স্বপ্ন আর ভোর রাতে ঝরা শিউলি
সকালে আলস্যে চা খাওয়ার সময়টুকুতে
গল্প করার তেমন কিছু থাকে না, শুধু
উঠোনের কোণে ছেড়ে রাখা জুতোয় লালচে রঙ দেখে
সবাই শিউলির ঘরে ফেরার কথা ভাবে
ভোর রাতে শিশির মেখে দরজার কড়া নাড়া
এলোমেলো চুলে ছড়িয়ে থাকা টুকরো টুকরো সাদা
ঝরে যাবে, ঝরে যাবে জানি
গত সন্ধ্যে পেরিয়ে নামা আঁধার
ও বাড়ির দুয়ার থেকে কেউ বলেছিল
যেতেই কি হবে আজ? থেকেই যদি যায় বৈঠকখানার ঘরে?
আজ রাতে চাঁদ উঠবেনা, চিনতেও চাইবে না কেউ সেই
অস্ফুট আলোয় এলোমেলো চুলের ফাঁকে লাল রঙ
অসময়ের বর্ষা বাতি নিভিয়ে দিয়েছে অনেকক্ষণ
অসময়ে বর্ষা এলেই শিউলি বের হয়
বর্ষা দ্যাখে নিত্য নতুন জানালা দিয়ে
বৈঠকখানার ঘরে অনেক পায়ের শব্দ মিলিয়ে যেতে যেতে
রাত ভোর হয়, সময় হয় শিশির মাখার