এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ভ্রমণ  দেখেছি পথে যেতে

  • মারকুটে মাস্টারের সাথে বিশাল সাগরে

    সমরেশ মুখার্জী লেখকের গ্রাহক হোন
    ভ্রমণ | দেখেছি পথে যেতে | ২৫ অক্টোবর ২০২৩ | ১২৬৫ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • -  ১  -

    সাড়ে দশটায় ভীড়ে ঠাসা লোকাল বাসে চাপলুম। ৫০ কিমি দুরে বেলা একটায় পৌঁছলাম মধ‍্যপ্রদেশের অন্দরে এক ছোট্ট প্রাচীন জনপদ - কুশগড়। বাসস্ট্যান্ড থেকে আগে পিছে স‍্যাক নিয়ে এক কিমি হেঁটে জৈন ধর্মশালায় পৌছলাম। চিমসে ম‍্যানেজার বিরস বদনে জানালেন জৈনসমাজের না হলে থাকা যাবে না। এযাবৎ গোটা দশেক জৈন ধর্মশালায় সমাদরে থেকেছি, সব রসিদ‌ও আছে সাথে। কিন্তু তার চিরতা খাওয়া মুখভাব দেখে কথা না বাড়িয়ে আরো এক কিমি হেঁটে পৌঁছ‌ই খুশবু ম‍্যারেজ গার্ডেন। নামেই গার্ডেন, আসলে বিয়ের অনুষ্ঠানে‌র জন‍্য সিমেন্ট বাঁধানো চবুতরা। 

    বছর পঁয়ত্রিশের মালিক দারা সিং বাইরে রোদ পোয়াচ্ছিলেন। নামের সাথে মানানসই স্বাস্থ্য। আমার লো বাজেট একাকী ভ্রমণের মনোবাঞ্ছা শুনে একটা ছোট দ্বিশয‍্যার ঘর দেখিয়ে বলেন - দুশো টাকা। বলি, একা মানুষ, দুদিন থাকবো, কিছু কমসম হবে না? আরো কম?  - কয়েক সেকেন্ড সটান তাকিয়ে দারা হয়তো বুঝতে চাইলে‌ন মজা করছি কিনা। দু দিনের না কাটা দাড়িতে মুখটা যথাসম্ভব গোবেচারা করে রেখে‌ছি। দারা সহৃদয়। বলেন, আমার আসল কামাই বিয়ের বুকিংয়ে। তখন লজ ফুল হয়ে যায়। এখন কদিন বিয়ের তারিখ নেই‌। লজের অনেক ঘর খালি‌‌। ঠিক আছে, না হয় দেড়শো‌‌ই দেবেন।

    ডিসেম্বরে‌র শেষ। মেঘলা ভর দুপুরে‌ও বেশ ঠাণ্ডা। বাদামভাজা, কড়াইশুঁটি দিয়ে মুড়ি চিকি চিবিয়ে লাঞ্চ সারলাম। ক্লান্ত‌ লাগছে‌। ঘন্টা দেড়েক ঘুমিয়ে নি‌ই। বিকেলে নীচে নেমে চা খেয়ে  বাইপাস ধরে হাঁটতে থাকি। বাঁদিকে শহরের সীমানা‌য় উঁচু পাহাড়ের মাথায় সমীহ জাগানো বিশাল কেল্লা। গড়ের  অতীত গৌরব লুপ্ত। অনেকাংশে ভগ্নপ্রায়, জঙ্গলাকীর্ণ। তবু সেই কেল্লা‌র আকর্ষণে‌ই আসা। 

    তেমাথায় দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক দেখছি। কী খুঁজছেন? কমল মিত্রর মতো রাশভারী গলা শুনে ঘুরে তাকা‌ই। বছর পঞ্চাশের প্রশ্নকর্তা‌র লম্বা চ‌ওড়া সুঠাম চেহারা, ব‍্যক্তিত্বময় মুখ, মর্মভেদী দৃষ্টি। বলি, হনুমান মন্দির। কোত্থেকে আসছেন? নিক্ষিপ্ত হয় দ্বিতীয় প্রশ্নবাণ। কলকাতা। ধেয়ে আসে তৃতীয় মিসাইল, ওখানে কী দরকার? অচেনা কারুর এহেন অবাঞ্ছিত প্রশ্নমালা শুনে ভ্রু কুঁচকে যায়। ভাবি ইনি কেন এতো স‌ওয়াল করছেন? মন্দিরে কেন যায় লোকে? বাজার করতে নিশ্চয়ই নয়। কিন্তু তখনই একটু খটকা লাগে। অজনবী‌র ভাবিত মুখে পড়েছে অন‍্য ছায়া - স্বগতোক্তি‌র ঢঙে বিড়বিড় করেন, কলকাতা! পরক্ষণেই আবার দারোগার মতো স‌ওয়াল, আপনি কী বাঙ্গালী? ভাবি কলকাতা কী কিরিবাতি আইল‍্যান্ডের মতো দূরবর্তী না বাঙ্গালী নর্থ সেন্টিনেলীসদের মতো দুর্লভ? কলকাতা শুনে, বাঙ্গালী ভেবে অবাক হ‌ওয়ায় কী আছে? সাহারা থেকে সাইবেরিয়া - খুঁজলে দু এক পিস বাঙালি কোথায় নেই। সম্মতি‌সূচক মাথা নাড়ি। প্রশ্নকর্তা‌র দৃষ্টি নরম হয়। এগিয়ে আসে একটা বলিষ্ঠ হাত।

    আমি অলক শর্মা। সরকারী স্কুলের টিচার। এখানে আছি বিশ বছর। আপনাকে দেখে‌ মনে হলো পরদেশী। কিছু খুঁজছেন। আপনার নাম? একটু আগের দারোগাসূলভ ভঙ্গি‌ উধাও। চ‌ওড়া মুখে মৃদু হাসি‌তে উষ্ণতার ছোঁয়া। বলি, সমরেশ মুখার্জী। বেড়াতে এসেছি। কোথায় উঠেছে‌ন? বলি, এখানে ওঠবার তো একটা‌ই লজ, খুশবু গার্ডেন। অলক বলেন, এখন হাঁটতে বেরিয়ে‌ছি, তাই আর দাঁড়াতে পারছি না। আপনি ব্রাহ্মণ। আমি‌ও তাই। আপত্তি না থাকলে রাতে গরীবের ঘরে ডিনারে আসবেন? তাহলে একটু আলাপ করা যেতো।
     
    ঝোলাপিঠে বেরোলে আমি‌‌‌ও গরীব -  ডিনারে‌র আমন্ত্রণে একপায়ে খাড়া - তবে সেসব উহ‍্য রেখে‌ বলি, বেশ তো, কখন আসবো বলুন? অলক বলেন, আপনি লজেই থাকবেন। আমি আটটা নাগাদ বাইক নিয়ে যাবো। ফোন নম্বর আদানপ্রদান করে হাঁটতে চলে যান মাস্টার। অবাক লাগে।  এত স্বল্প আলাপে‌ কেউ কোনো পরদেশী‌কে বাড়িতে ডিনারে ডাকে! 

    অবশ‍্য এমন ব‍্যাপার সুরসিক, সুলেখক ঐতিহাসিক তপন রায়চৌধুরীর স্মৃতি‌কথা "বাঙালনামা" ব‌ইতেও পড়েছি। সেটা ১৯৫৭ সাল। অক্সফোর্ডে গবেষণা করতে গিয়ে থিসিস জমা দিয়ে সরাসরি জাহাজে না এসে ভ্রমণের নেশায় অনেক ঘুরেফিরে, স্থলপথে ইংল্যান্ড থেকে ভারতে আসছেন তিনি। বাকি‌টা তাঁর জবানিতে শোনা যাক - - -   "ইস্তাম্বুলে এসে রাস্তায় ঢিলেঢালা ধরনধারণ দেখে বড্ড আরাম পেলাম। আঃ! এ তো কলকাতা এসে গেছি মনে হচ্ছে। ইউথ হস্টেলে বোঁচকাটি রেখে বাজারের ভিতর এক চায়ের দোকানে গিয়ে জমিয়ে বসলাম। সে কী সুখ। কারও কোনও তাড়া নেই। গায়ের উপর দিয়ে লোক ধাক্কা মেরে চলে যাচ্ছে। কারও কোনও তাপোত্তাপ নেই। আর সবাই গলা খুলে কথা বলছে। মানে মানুষের যেমন ভাবে বাঁচা উচিত, সেই ভাবে সবাই চলে-বলে বেড়াচ্ছে। উহ, সাড়ে তিন বছর ইংরাজি সভ্যতার চাপে কণ্ঠরোধ হয়ে আসছিল। ওই চাপাচাপা কথা, মৃদুমৃদু হাসি, কাঁহাতক সহ্য হয় মশাই! অনেকদিন পর হাত পা ছেড়ে বেশ গলা খাঁকারি দিয়ে চেয়ারে পা তুলে বাবু হয়ে বসলাম। কেউ ফিরেও তাকাল না। তামার থালায় করে ঘটির মতো চেহারার কাচের গ্লাসে দোকানির ছোকরা সাকরেদ চা নিয়ে আসছে। ভারতের বাইরে এত সুখের ব্যবস্থা কোথাও আছে তা কে জানত?

    ইউথ হস্টেলে ফিরে এক জোড়া খ্রিস্টীয় ধ্রুব-প্রহ্লাদের সঙ্গে পরিচয় হল। এই দুই সন্ত পুরুষ কেরালার সিরিয় খ্রিস্টান। পৃথিবী পরিভ্রমণ করছে, কোনও জাগতিক বাসনা এঁদের নেই। ওরা আমার বেশ ন‍্যাওটা হয়ে পড়লো। প্রাচ্য দেশে যে পৌঁছেছি তার নানা প্রমাণ পেলাম। একদিন ধ্রুব-প্রহ্লাদসহ বাসস্টপে দাঁড়িয়ে আছি। এক ভদ্রলোকের হাতে ইংরিজি বই দেখে তাঁকে সুলতানদের প্রাচীন প্রাসাদ তোপকাপির পথ জিজ্ঞেস করলাম। ভদ্রলোক একটুও দ্বিধা না করে বললেন, “সে হবে এখন। এখন চল, আমার সঙ্গে খাবে। আমার মা খুব ভাল রাঁধেন।” 

    এ রকম ঘটনা ইংল্যান্ডে তো নয়ই, ইউরোপে কোথাও হওয়া সম্ভব বলে মনে হয় না। আমাদের প্রাচ্য সভ্যতা জিন্দাবাদ। ভদ্রলোকের বাড়ি পৌঁছে দেখি যা আশঙ্কা করেছিলাম তাই। মানে ওঁর মা গজর গজর করতে লাগলেন। বুঝলাম অকৃতদার মানুষটির এ সব ব্যাপারে কাণ্ডজ্ঞান কম। কিন্তু উনি বললেন, “তোমরা যা ভাবছ তা নয়। মা চটেছেন, তোমরা এসেছ সে জন্য না। যথেষ্ট খাওয়ার ব্যবস্থা করিনি দেখে।” 

    এরপর মা সোজাসুজি আমাদের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করলেন। পুত্রর ভূমিকা শুধু অনুবাদকের। বক্তব্যটা খুবই সহজ। “আমার ছেলে একটি গর্দভ। লেখাপড়া শিখে ওর কোনওই উপকার হয়নি। অথচ আমার স্বামী একজন বুদ্ধিমান লোক ছিলেন। লোককে খেতে বললে যে ভালমন্দ বাজার করতে হয় এ-কথা কোনও দিনই বুঝল না। মানুষ ডেকে যা তা খাইয়ে বিদেয় করে। আসলে কিপটের জাশু। এমন বাপের এমন ছেলে কোত্থেকে যে হল।” খাওয়ার সময় ছেলের কার্পণ্যের প্রমাণ পেয়ে আমরা চমৎকৃত। অন্তত ছ’পদ খেলাম। সত্যিই অনবদ্য রান্না। আর ভদ্রমহিলা আগাগোড়া ছেলের নির্বুদ্ধিতা নিয়ে ভাগ্যকে দোষারোপ করে গেলেন।"

    হনুমান মন্দিরটি জনপদের একান্তে। সেখানে কিছুক্ষণ কাটিয়ে লজে ফিরে মোবাইলে কিছু লিখছি‌লাম। হঠাৎ দেখি আটটা কুড়ি বাজে। অলক তো এলেন না!  ছোট জায়গা। দোকান‌পাট বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। নটার পর হয়তো কোথাও খেতেও পাবো না। তাহলে রাতেও মুড়ি বাদাম চিবোতে হবে। ফোন করি অলককে। একটি যুবতিকণ্ঠ বলে, আপনি কে বলছেন? তার মানে অলক আমার নম্বর সেভ করেন নি। বলি, আমি কলকাতা থেকে কুশগড় বেড়াতে এসেছি, সমরেশ মুখার্জী। অলকজী নেই? সে বলে, আমি শিবানী, ওনার মেয়ে। বাবুজী বলেছেন আপনার কথা। চলে আসুন, রান্না রেডি। ও বাবা! মেয়েও দেখি বাপের মতো অচেনা লোকের সাথে বেবাক সাবলীল! বলি, কিন্তু  আমি তো আপনাদের বাড়ি চিনি না। উনি বলেছিলেন আমায় লজ থেকে নিয়ে যাবেন। শিবানী বিব্রত হয়ে বলে, বাবুজী‌র বড্ডো ভুলো মন। আপনাকে আনার কথা ভুলে গিয়ে ধ‍্যানে বসে গেছেন। দাঁড়ান, ওনাকে দিচ্ছি। 

    আমার জন‍্য কারুর ধ‍্যানভঙ্গ হবে ভেবে খারাপ লাগে। ভাবি, এসব খাওয়া দাওয়ার মধ‍্যে না গেলেই হোতো। পরক্ষণেই অপরপ্রান্তে অলকের গমগমে স্বরে পলকে অস্বস্তি উধাও। হা হা করে হেসে বলেন, দেখেছেন কান্ড, একদম ভুলে গেছি। প্লিজ কিছু মনে করবেন না। আপনি কোথায়? ভাবি, লোকটা ভুলোমনা‌র সাথে ছিটগ্ৰস্ত‌ও  নাকি রে বাবা! এমন মানুষ মাস্টারি করে কী করে? বলি, আমি তো লজেই আছি। অলক বলেন, তাহলে চলে আসুন তেমাথায়। আমি‌ও আসছি ওখানে। ফোন কেটে যায়। ভাবি আচ্ছা ছিটিয়াল লোকের পাল্লায় পড়া গেছে‌! তখন বললেন লজ থেকে নিয়ে যাবেন, এখন বলছেন, চলে আসুন তেমাথায়। আগ্ৰহ‌ দানা বাঁধে। স্বাভাবিক মানুষ‌তো অনেক দেখেছি। দেখি‌ই না ছিটিয়াল মাস্টার কেমন হয়।

    লজ থেকে তেমাথা এক কিমি। বাইপাসে ল‍্যাম্পপোস্টগুলো দুরে দুরে - পোস্টে‌র তলায় কিছুটা জায়গা আলোকিত, বাকি‌টা আলোছায়া।  আকাশে ক্ষয়াটে চাঁদ‌। বাইরে বেশ ঠান্ডা। ছোট্ট জনপদ। সাড়ে আটটাতেই চারপাশ নিঝুম হয়ে গেছে। তেমাথায় দাঁড়িয়ে অলক। বলেন, ভেতরে সরু রাস্তায় পাইপলাইনে‌র জন‍্য মাটি খুঁড়েছে, তাই বাইক বার করতে পারলাম না। প্রায়ান্ধকার পথে যেতে যেতে বলেন, ডাইনে খালের মতো যা দেখছেন, ওটা ছিল অতীতে কেল্লা‌র পরিখা। মোটা দেওয়ালের ভগ্নাবশেষগুলো কেল্লা‌র প্রাচীর, দ্বিতীয় সুরক্ষা বলয়। এসব বারোশো  বছরের প্রাচীন। এই এলাকা তখন ছিল 'তলহাট্টি' মানে পাহাড়ের পাদদেশে সুরক্ষিত প্রাচীরের অভ‍্যন্তরে জনপদ। ক্রমশ এই সব‌ হারিয়ে যাবে। 

    তেমাথা থেকে প্রায় আধা কিমি হেঁটে পৌঁছলাম অলকের একতলা, সাদামাটা নিজস্ব বাড়িতে। ঘরে ঢুকতে বছর বাইশের একটি সুশ্রী, সপ্রতিভ মেয়ে নমস্কার করে বলে, আঙ্কল, আমি‌ই শিবাণী। মধ‍্য চল্লিশের এক মহিলা‌ও নমস্কার করেন। অলকের স্ত্রী। কোলে একটি ক্ষুদে কন‍্যাশিশু। শিবাণীর মেয়ে সুনীতা। ডাক নাম সুনী। শিশু‌টি বেশ মিষ্টি, হাসিখুশি। সদ‍্য দুটো নীচের দাঁত উঠেছে। দুহাত বাড়িয়ে দিদিমার কোল থেকে আমার কাছে আসতে চায়। বলি, একটু নেবো ওকে? শিবাণী বলে, নিন না, ও খুব লোকজন পছন্দ করে। কোলে নিতে সে আমার দিকে তাকিয়ে এক গাল হাসে। যেন কতদিনের চেনা। চারপাশে নানা কলুষতা‌র মধ‍্যে‌‌ও অবোধ পশুর আচরণ, নিস্পাপ শিশুর হাসি, নির্মল প্রকৃতির সান্নিধ্যে মন ভালো হয়ে যায়। 

    সুনীকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে‌ কথা বলার মাঝে সে হিসি করে দেয়। ঘরের মধ‍্যে ডায়াপার পরানো ছিল না। আমার ওয়াটারপ্রুফ উইন্ডচিটার বেয়ে মেঝেতে পড়ে সুনীর শিবাম্বু। শিবানী অপ্রস্তুত হয়ে বলে, এমা, সুনী, এ কী করলে? আর সুনী। তার কী কোনো লজ্জাবোধ হয়েছে? কুলকুলিয়ে হিসি করেও সে তাই খিলখিলিয়ে হাসে। শিশুর হিসি তার হাসির মতোই নির্মল। বলি, তাতে কী হয়েছে, আমাদের ছেলেও ছোটবেলায় বহুবার এমন কাপড় ভিজিয়ে‌ছে। অলকের স্ত্রী সুনীকে নিয়ে নেন। শিবানী একটা ভিজে তোয়ালে এনে উইন্ডচিটার মুছে দেয়। ঘরে ঢুকে‌ অলক চৌকিতে বৈঠকী মেজাজে বাবু হয়ে বসেছে। মনে হয় সে কোনো ফর্মালিটির ধার ধারে না। এসব কাণ্ড দেখে মিটিমিটি হাসে। বৌকে বলে, খানা লাগাও।

    শিবাণী সেন্টার টেবিলটা টেনে আনে। অলকের স্ত্রী সদ‍্য সেঁকা ফুলকো রুটি দিয়ে যান পাতে। আটার সাথে ছোলা, জোয়ার মেশানো 'মিশল' রুটিতে দেশী ঘিয়ের ম'ম' গন্ধ‌। সাথে অড়হড় ডাল, ভেন্ডি মশালা ও আলু মটরের তরকারি। আয়োজন সীমিত। রান্না সুস্বাদু। আপ‍্যায়ন আন্তরিক। ভাবি ঠান্ডায় দেড় কিমি হাঁটা সার্থক। গত দু রাত এক ছোট্ট আশ্রমে ছিলাম। আজ সকালে আসার আগে মহারাজ আশীর্বাদ করেছিলেন, আপনার যাত্রা মঙ্গল‌ময় হোক। এমন অপ্রত্যাশিত প্রাপ্তি হয়তো তাঁর‌ই কৃপায়! 
     
    অলক বলেন, আমরা নিরামিশাষী। আপনার অসুবিধা হচ্ছে না তো? বলি, বিন্দুমাত্র না। শিবাণী বলে, আলু মটরের সবজি‌টা আমি রেঁধে‌ছি। বাকি সব মামি। রান্না কেমন লাগছে? বলি, দারুণ। শিবানী বলে, ভালো করে খাবেন, লজ্জা করবেন না। বলি, সুনীর হিসি করে ফেলা‌র মতো‌ খেতে বসে লজ্জা টজ্জা‌‌ও আমার আসে না। আমার কথায় সবাই প্রাণখুলে হাসে। জিরিজিরি দুটি দন্তবিকশিত করে কিছু না বুঝে‌ই হাসে সুনী‌ও।

    অলক বলে, বাঙ্গালী ব্রাহ্মণ‌রা তো আমিষ খান। স্বামী বিবেকানন্দ‌‌ও মাছ, মাংস খেতেন। আপনি? বলি, আমি‌‌ও খাই। তবে বেড়াতে বেরিয়ে আমি ভেজ‌ই পছন্দ করি।  অলক বলেন, নিরামিষ ভোজন নিরাপদ। স্টেরয়েড, এ্যান্টিবায়োটিক, হরমোন দিয়ে খামারে চাষ করা পশুমাংস থেকে নানা উপসর্গ হতে পারে। আপনি কী বলেন? বলি, তা ঠিক। তাই তো নিরামিষ ভোজনের সপক্ষে প্রচার চলছে। তবে বিপুল জনসংখ্যার ক্ষিদে মেটাতে ফিশিং, এ্যানিম‍্যাল ফার্মিং‌ও অপরিহার্য। ফলন বাড়াতে রাসায়নিক সার, কীটনাশকের ব‍্যাপক ব‍্যবহারে ভেজ‌ও খুব নিরাপদ নয় আর। অর্গানিক ফুড তো সাধারণের নাগালের বাইরে। 

    অলক বলেন, আচ্ছা মানুষ পৃথিবীর তাবৎ জীবজগৎ থেকে এমন আলাদা হয়ে গেল কী করে বলুন তো? আপনার কী ধারণা? বলি, সে তো বটেই। লক্ষ লক্ষ বছর ধরে কুকুর ঘে‌উ ঘেউ, কাক কা কা করে চলে চলেছে কিন্তু মানুষ দ্রুত সবার থেকে উন্নত, আলাদা হয়ে গেছে। বিবর্তন বিশেষজ্ঞ‌রা বহু মাথা ঘামিয়ে‌ও সর্বজনগ্রাহ্য কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারেন নি। তাই এই হেঁয়ালি‌কে বিবর্তন‌বাদে মিসিং লিংক বলে আখ‍্যা দিয়েছেন। তবে একটা থিয়োরী কিছুদিন আগে একটা পত্রিকায় পড়লাম। অলক মাস্টার মনযোগী ছাত্রের আগ্ৰহে বলেন, কীরকম? 

    বলি, সবটা মনে নেই। সারাংশটা এরকম। বিবর্তনের ধারায় স্থলবাসী প্রাণী, পাহাড়, সমতল, ঠান্ডা, গরম এহেন নানা পরিমন্ডলে‌ জীবনধারণের উপযুক্ত হয়ে গেল। শিম্পাঞ্জি, ওরাংওটাং গোত্রের আদিমানবের একটা গোত্র অরণ্য‌ নির্ভর হয়ে থাকলেও অন‍্যদল, যারা উদ‍্যমী, দু পায়ে দাঁড়াতে শিখলো। দুটি হাত মুক্ত হয়ে রূপান্তরিত হোলো পৃথিবীর প্রাচীনতম সৃজনশীল যন্ত্রে। তারা অস্ত্র ও আগুনের ব‍্যবহার শিখে পশু শিকার করে উদরপূর্তী ক‍রতে শিখলো। মগজের বিকাশের জন‍্য প্রয়োজনীয় উপাদান পশু মাংস থেকে সরাসরি পেয়ে গেল। খাদ্যের জন‍্য অরণ‍্য নির্ভরতা কাটিয়ে তারা চাষবাস, পশুপালন শিখে যে কোনো ভৌগোলিক পরিস্থিতি‌তে জীবনধারণের উপযুক্ত হয়ে উঠলো। অধিকাংশ সময় অরণ‍্যে ফলমূল সংগ্ৰহে ব‍্যাপৃত না থাকায়  উদবৃত্ত সময়ে তারা অনেক কিছু পর্যবেক্ষণ করতে, তা নিয়ে ভাবতে শিখলো। এই দলটাই বর্তমান মানবপ্রজাতির পূর্বসূরি। 

    অলক বলেন, অর্থাৎ মানুষের উন্নতি‌র মূলে আমিষ ভোজন। যারা নিরামিষাশী তাদের বুদ্ধি‌বৃত্তি নিম্নমানের, তাই তো? বলি, এটা অতিসরলীকরণ হয়ে গেল না? মানুষ‌ও তো শুরুতে ছিল নিরামিষাশী। পরে হোলো উভ-ভোজী। পশু-আমিষ ত‍্যাগ করে সম্পূর্ণ নিরামিষ আহারের চল তো হাজার তিনেক বছর আগে। মানুষের এক দেড় লক্ষ বছরের বিবর্তনের ধারায় এটুকু সময়ে কেবল খাদ‍্যাভ‍্যাসের তফাতে বুদ্ধি‌বৃত্তির তফাৎ হ‌ওয়া সম্ভব নয়। তাছাড়া পশু-আমিষ ভোজনের ফলে মগজের বিকাশ তো ছিল প্রাথমিক পর্যায়। এরপর ভাষার উদ্ভব, বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসু‌তা, সামাজিক চর্চা এহেন নানান ক্রমবিকাশে উন্নত হয়েছে মানুষ। 

    অলক বলেন, পশুদের মধ‍্যে‌ও তো আমিষ, নিরামিষ‌ভোজী আছে। কুকুর, বাঘ আমিষ ভোজী। ঘোড়া, হাতি নিরামিষ‌ভোজী। এই থিয়োরী অনুযায়ী তাহলে হাতি‌র বুদ্ধি বাঘের থেকে কম। কুকুরের উন্নত বুদ্ধিমত্তা আমি‌ষ ভোজনের ফলে - তাইতো? বলি, এও অতিসরলীকরণ। কুকুরের উন্নত বুদ্ধি কেবল আমি‌ষ ভোজনের জন‍্য নয়, বহু‌দিন ধরে মানুষের সাহচর্যে থাকা‌ও একটা বড় কারণ। ঘোড়া‌ও তাই। হাতি‌র স্মৃতিশক্তি প্রখর, বুদ্ধি‌ও উন্নতমানের। আহারের সাথে বুদ্ধি‌র যোগসূত্র নিয়ে মতামত দেওয়ার মতো জ্ঞান আমার নেই। আমি যা পড়েছি তাই বললাম। এর বাইরে‌ অনেক কিছু থাকতে পারে যা আমার অজানা।

    আমাদের কথাবার্তা শিবাণী‌ও মন দিয়ে শুনছি‌ল। এবার সে বলে, বাবুজী, তোমার তো আজ উপোস, কিন্তু আঙ্কলকে‌ তো ঠিক মতো খেতে দা‌ও। খেতে ডেকে খাওয়া নিয়ে এসব কী আলোচনা‌ শুরু করলে বলো তো? মেয়ের বকুনি খেয়ে লাজুক হেসে অলক বলেন, ঠিক ঠিক, আমার‌ই ভুল, না না মুখার্জীসাহেব আপনি ভালো করে খান। এই আমি চুপ করলাম। হাসলে রাশভারী অলককে অমায়িক লাগে।

    ডিনার সেরে তেমাথায় এলাম দশটায়। ছোট্ট জনপদের পক্ষে গভীর রাত। কুয়াশা‌য় মোড়া বাইপাসে ছমছমে নির্জনতা। দিনকাল ভালো নয়। নির্জন রাস্তায় কয়েকজন ছুরি দেখিয়ে ছিনতাই করতে চাইলে কিছুই করার নেই। অলক হয়তো আমার ভাবনা আন্দাজ করে বলেন,  চিন্তা করবেন না, ছোট জায়গা, এখানে সবাই প্রায় সবাই‌কে চেনে, তাই চুরি, ছিনতাই নেই। তবু কেউ বেয়াদবি করলে বলবেন আপনি অলক মাস্টারের বন্ধু। কেবল মাস্টার হিসেবে নয়, অন‍্য কারণে‌ও এখানে আমায় সবাই চেনে। কেউ আপনাকে ছুঁতে সাহস পাবে না। পরক্ষণেই বলেন, আচ্ছা চলুন আপনাকে লজ অবধি ছেড়ে‌ দিয়ে আসি। বলি, ঠিক আছে, আপনার আশ্বাস‌ই যথেষ্ট। করমর্দন করে হাঁটতে থাকি বাইপাস ধরে। খানিকটা গিয়ে ফিরে তাকাই। দীর্ঘকায় শরীর আবছা অন্ধকারে দাঁড়িয়ে। ডাব্বা ফোনের টর্চ নাড়িয়ে ভরসা দেয় বলিষ্ঠ একটি হাত। 

    -  ২  -

    সকাল সাতটায় অলকের ফোন আসে - আজ কী প্রোগ্রাম আপনার? বলি, কেল্লা‌ দেখতে যাবো। অলক বলে, অনেক কিছু দেখা‌র আছে, ভালো লাগবে। তবে পাঁচটার মধ‍্যে লজে ফিরতে পারলে একজনের সাথে আলাপ করাতে নিয়ে যাবো। অপ্রত্যাশিত বেড়ানোর সম্ভাবনা‌য় পুলকিত হ‌ই। অলকের ঝাঁঝালো প্রাণশক্তি সম্মোহক। বলি, কোথায়? কে? অলক বলেন, এখান থেকে পনেরো কিমি দুরে বিশাল সাগর ড‍্যাম। 'কে'-টা সারপ্রাইজ‌ থাক। বলি, ঠিক আছে, যাবো। 

    কেল্লা ঘুরে এসে পাঁচটার আগেই লজে ফিরে ডবল পাতলুন, জ‍্যাকেট, উইন্ডচিটার, মাফলার, দস্তানা‌য় মুড়ে লজের নীচে এসে বসেছি।  বৃষ্টি থেমে গেছে। তবে আকাশ মেঘলা, ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে। এমন ওয়েদারে বাইকে যেতে হবে পনেরো কিমি। ফেরার পথে রাতে ঠান্ডা আরো বাড়বে। হেলমেট, রেনস‍্যূট পরে অলক আসে। চলন্ত বাইকে অলকের চ‌ওড়া শরীরের আড়াল থাকায় শনশনে হাওয়া আমায় কনকনে দাঁত ফোটাতে পারে না।
     
    সাড়ে পাঁচটায় পৌঁছে যাই বিশালসাগর ড‍্যামে। বিস্তৃত জলাধার। সাড়ে তিনহাজার ফুট লম্বা দুশো ফুট উঁচু ড‍্যামে দশটা স্লুইসগেট। ড‍্যাম নির্মাণে লেগেছিল তিরিশ বছর। উদ্বোধন হয় একযুগ আগে। অলক বলে বর্ষায় হাওয়া চললে ছশো ফুট দুরে স্পিল‌ওয়ে থেকে আছড়ে পড়া জলের ছাট এ‌ই ভিউপয়েন্ট অবধি চলে আসে। সে দৃশ‍্য দেখা‌র মতো। শীতে জল ছাড়ে না। আসন্ন সন্ধ্যায় অনেক নীচে পাথুরে নদীখাতে কালচে জলের শীর্ণ‌ ধারা।

    অলক বলেন, এবার বলি কার সাথে আলাপ করাতে নিয়ে যাচ্ছি। আমার গুরু শিবহরি দাস। ওনার গুরুপ্রদত্ত নাম। এখানে আছেন বছর দশেক। তার আগে বছর দশেক ছিলেন গুপ্তেশ্বর মহাদেব গুহা‌য়। তার‌ও আগে অনেকদিন ছিলেন হিমালয়ে‌। সংসারত‍্যাগী প্রচার‌বিমূখ সন্ন্যাসী। একা থাকেন। গেরুয়াধারী, জটাধারী‌ নন। সাধারণ পোষাকে থাকেন। সাধারণ কথা বলেন। দেখে সন্ন্যাসী বলে‌ মনে হয়না। বছর পাঁচেক আগে একজন আমায় এনার সাথে আলাপ করান। প্রথমদর্শনেই ভালো লাগে। পরে বহু‌বার এসেছি। এখন সপ্তাহে একদিন এসে কিছুক্ষণ বসি ওনার কাছে। আরো দু একজন আসে। বেশী ভীড়ভাট্টা পছন্দ করেন না। ওনাকে আমি সদগুরু মানি। উনি আমায় শিষ‍্য বলে স্বীকার করেন কিনা জানি না। দীক্ষা‌‌ নিতে চাইলে এড়িয়ে যান।

    বলি, আপনি কাল বলেছিলেন মাস্টার হিসেবে ছাড়াও আপনাকে কুশগড়ের লোক অন‍্য কারণে চেনে কিন্তু এখন যা বললেন মেলাতে পারছি না। অলক বলেন, আগে আমি খুব বদরাগী ছিলাম। বছর সাতেক  আগে, শিবাণী তখন কিশোরী, ভোপালে দেশের বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করতো। সেবার গরমের ছুটিতে এসেছিল এখানে। বাজারে কটা বকাটে ছেলে অশ্লীল মন্তব‍্য করে। ও কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি আসে। মাথায় আগুন জ্বলে গেল। ওকে বাজারে নিয়ে গিয়ে বলি, দেখা কোন ছেলে। ওরা তখন‌ও চায়ের দোকানে বসে গজালি করছি‌ল। হাতে ছিল লাঠি। বিনা বাক‍্যব‍্যয়ে বেধড়ক ঠ‍্যাঙাতে শুরু করি। আমার উগ্ৰমূর্তি দেখে ওরা শিবাণীর পায়ে ধরে ক্ষমা চায়। পরে পঞ্চায়েত বসেছিল। আমি পঞ্চদের বলেছিলাম, যৌবনধর্মে ছেলে মেয়েরা স্বেচ্ছায় মেলামেশা করলে কিছু বলার নেই কিন্তু এমন বেয়াদবি না রুখলে গাঁয়ে মেয়ে, ব‌উদের চলাফেরা দায় হয়ে উঠবে। সবাই আমায় সমর্থন করেছিল। সেই থেকে লোকে আমায় মারকুটে মাস্টার বলে‌। জ‌ওয়ানিতে ভোপালে এমন বেয়াদবি‌তে অনেককে ঠেঙিয়েছি কিন্তু এখানে বিশ বছরে একবার‌ই মেজাজ হারিয়েছিলাম। আমি কারুর সাতেপাঁচে থাকি না। কিন্তু বেয়াদবি সহ‍্য হয় না। 

    অলকের কথা শুনে বুঝি কেন ওকে প্রথম দর্শনে‌ই ডাকাবুকো দারোগা‌র মতো লেগেছিল। অভিজ্ঞতা‌য় দেখেছি এমন আপাতরুক্ষ মানুষ‌ সচরাচর খাঁটি মনের হয়। বলি, আপনার সদগুরু‌র সাথে আমার আলাপ করাতে নিয়ে এলেন কেন? আমার দেখে কী মনে হয়েছে আমার ভক্তি‌মার্গে, সাধুসঙ্গে আগ্ৰহ আছে? অলক বলেন, না, বরং উল্টো‌টাই মনে হয়েছে। বলি, তাহলে? অলক বলেন, উনি বাঙালী বলে। এবার বুঝি, গতকাল কলকাতা, বাঙালী শুনে অলক কেন অবাক হ‌য়েছিলেন। 
     
    এবার আমি‌ও অবাক হ‌য়ে বলি, এই প্রত‍্যন্ত অঞ্চলে এক বাঙ্গালী বাবা বিশ বছর ধরে রয়েছেন? অলক বলে, বাকিটা ওনার কাছেই শুনবেন। বাবা খুব গল্পবাজ। আড্ডায় তো আপনাদের জুড়ি নেই। সপ্তাহে একবার এখানে আসার সেটা‌ও একটা কারণ।  অনেক কিছু জানা যায় ওনার কাছে বসলে।

    ভিউ পয়েন্টের কিছুটা আগে রাস্তার ধারে ছোট একতলা বাড়ি। লোহার গেট খুলে অঙ্গনে ঢুকে বসার ঘরের ভেজানো দরজা অভ‍্যস্থ ভঙ্গিতে খুলে অলক ডাকে, আসুন। দশ বাই বারো ঘরে কিচেন প্ল‍্যাটফর্ম, ডাইনিং টেবিল, ওয়াল ক‍্যাবিনেটে কিছু বাসন, ডাব্বা‌ ও একটা চৌকি পাতা। বুঝি ওটা কিচেন, ডাইনিং কাম লিভিং রুম। ভেতরের ভেজানো দরজায় নক করে অলক ভেতরে আসার অনুমতি চায়। আরামকেদারায় বসে এলসিডি টিভি‌তে জি-বাংলায় 'রাণী রাসমণি' সিরিয়াল দেখছেন শিবহরি দাস। বয়স সত্তর। মুখে অযত্নলালিত সাদা দাড়ি গোঁফ। মাথায় উলের টুপি। একটু ভারী শরীর। মাঝারি উচ্চতা। চোখে চশমা নেই। পরনে ট্র‍্যাক স‍্যূটের ওপর সোয়েটার। ঠিকই বলেছিলেন অলক, দেখে সংসারত‍্যাগী সাধক বলে বোঝা মুশকিল। 

    আয়ো, আয়ো, বলে বাবা সাদরে আহ্বান করেন অলককে। পিছনে আমায় দেখে বলেন, এনাকে তো চিনলাম না। অলক বলে, ইনি সমরেশ মুখার্জী, কলকাতা থেকে এখানে বেড়াতে এসেছেন। কালকে‌ই আলাপ হয়েছে। আপনার দেশের মানুষ, তাই আলাপ করাতে নিয়ে এলাম। বাবা বলেন, আসুন, বসুন। জোড়হস্তে নমস্কার করে উল্টোদিকে বেতের সোফায় বসি। অলক সাষ্টাঙ্গে শুয়ে বাবার পায়ে মিনিট দুয়েক কপাল ঠেকিয়ে প্রণাম করে। বাবার চোখ টিভিতে। বাঁহাত ছুঁয়ে আছে অলকের মাথায়। উঠে দাঁড়িয়ে অলক বুককেসের ওপরে রাখা পেতলের রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ, সারদা মায়ের মূর্তিকে প্রণাম করে মেঝেতে বাবু হয়ে বসে।

    অলকের সমর্পিত ভাবভঙ্গিতে উশখুশ করি। আমার‌ও কী মেঝেতে বসা উচিত? বাবা অভয়মূদ্রায় আশ্বস্ত করে টিভি বন্ধ করেন। কোথায় থাকি, কী করি গোছের মামূলী কিছু কথা‌র পর আমার একাকী ভ্রমণের উদ্দেশ্য ছুঁয়ে আলোচনা এগোয় স্পর্শকাতর এলাকায়। বক্তা মূলতঃ উনি। অলক নির্বাক শ্রোতা। আমায় বাবার প্রশ্নের জবাব দিতে হয়। উনি অভিমত দেন। খন্ডন করেন। আমি প্রতিপ্রশ্ন তুলি। বহুদিন বাদে বুদ্ধি‌দীপ্ত আড্ডা‌য় চনমনে হয় মন। অলক ঠিক‌ই বলেছিলেন - বাবা বাঙ্গালী‌র গর্ব - বেশ আড্ডাবাজ। হাসি মুখে কথা‌ বলেন সুন্দর। কথায় আধ‍্যাত্মিকতা, জীবনবোধে‌র উপলব্ধি‌র ছোঁয়া। চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতা নেই। সহজভাবে আলোচনা করছেন এক অপরিচিত ব‍্যক্তির সাথে।

    কথাপ্রসঙ্গে বলি, মন্দিরে দর্শনের দীর্ঘ লাইন, সংকীর্ণ গর্ভগৃহে বিগ্ৰহ দর্শনের জন‍্য গুঁতোগুঁতি, মেনুকার্ডের মতো লাগানো কালসর্পদোষ খন্ডন, রুদ্রাভিষেকের রেটচার্ট এসব দেখে ভক্তি‌ভাব তো হয়‌ই না বরং বীতশ্রদ্ধ লাগে। অথচ আমি বহু ধর্মস্থানে যাই, যেতে ইচ্ছে করে, জনবিরল হলে আরো ভালো লাগে, কেন কে জানে। বাবা বলেন, ঠিক‌ই বলেছেন, যেখানেই আচার-উপাচারের বাহুল‍্য, লক্ষ‍্যের থেকে উপলক্ষ‍্যের ঢক্কানিনাদ, দানের হিস‍্যা নিয়ে খেয়োখেয়ি, দেবস্থানম বোর্ডের কর্তৃত্ব নিয়ে কামড়াকামড়ি সেখানে ভক্তি নেই।  ওসব হচ্ছে মানুষের অন্ধবিশ্বাসে ভর করে ফুলে ফেঁপে চলা লোভী মানুষের নির্লজ্জ কান্ডকারখানা।

    তবে জমিতে ভালো ফলন পেতে সার দিতে হয়, পাম্প চালিয়ে পাইপে করে জল দিতে হয়। ফলন বলতে আমি ঈশ্বরানুভূতি বলছি।  তা তো চাইলেই পাওয়া যায় না। গভীর বিশ্বাসে‌ই তা উপলব্ধি হতে পারে। একান্তে ইষ্টদেবতাকে স্মরণ, ব্রাহ্মমূহুর্তে ও সন্ধ্যায় ধ‍্যান, আহ্নিক, জপতপ প্রকৃত গুরুসন্ধান করে সমর্পণ - এ জাতীয় জীবনাচরণ‌ই হচ্ছে জলের পাইপের মতো লক্ষ‍্যে পৌছানোর মাধ‍্যম। ধর্মস্থানে হত‍্যে দিয়ে কিছু হয় না।  জানেন বোধহয় প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র, প্রচুর পড়াশোনা করা, যুক্তিবাদী, আধুনিক‌মনস্ক এক যুবক বন্ধুদের সাথে গেছিলেন খেটো ধুতি পড়া এক গেঁয়ো, নিরক্ষর পূজারী বামুনকে মাপতে। সে নাকি মা কালীকে দেখতে পায়, তার সাথে মেয়ের মতো তুই তোকারি করে কথা বলে। যত্তো সব ফেরেববাজী। অবশেষে কী হোলো? তাঁকেই গুরু মেনে, সন্ন‍্যাস নিয়ে হয়ে গেলেন স্বামী বিবেকানন্দ। অনায়াসে কিছু‌ হয় না। বরানগরের মঠে বিবেকানন্দ ও তাঁর গুরুভাইরা রাত তিনটেয় উঠে গভীর ধ‍্যানে বাহ‍্যজ্ঞানশূন‍্য হয়ে যেতেন। ঐকান্তিক সাধনা ছাড়া অবিশ্বাস ও যুক্তি‌বাদী মন নিয়ে সবকিছু কাটাছেঁড়া করে বিশ্লেষণ করে কিছু পাওয়া যায় না।

    বলি, আমার জিজ্ঞাসা‌র উত্তর কিন্তু পেলাম না। আচার অনুষ্ঠান অসার লাগলেও আমার ধর্মস্থানে যেতে ইচ্ছে করে কেন। উনি বলেন, আপনি সিভিল ইঞ্জিনিয়ার, হয়তো মন্দিরের নির্মাণ‌শৈলী, স্থাপত‍্যকলা আপনাকে বিস্মিত, মুগ্ধ করে। আপনার লেখালেখির শখ। ধর্মস্থানে বিভিন্ন মানুষের আচরণ পর্যবেক্ষণে আপনি লেখার উপাদান খুঁজে পান। আপনি সহজসরল জীবনযাপন করেন, ভাবুক মানুষ, তাই হয়তো প্রকৃতির মাঝে নির্জন ধর্মস্থান আপনাকে আকর্ষণ করে। অর্থাৎ আপনার ধর্মস্থানে যাওয়ার সাথে আধ‍্যাত্মিকতার কোনো সম্পর্ক নেই। আপনি ধর্মস্থানে, প্রাকৃতিক পরিবেশে বেড়াতে যান ইন্দ্রিয়‌গ্ৰাহ‍্য চেতনায় বাহ‍্যিক সৌন্দর্যের আকর্ষণে। ঐশ্বরিক উপলব্ধির স্বাদ আপনি পাননি। সেই তাগিদ‌ও আপনার নেই। আপনি সাংসারিক কর্তব্য‌পালন করে, উদ্দেশ্য‌হীন ভ্রমণে, লক্ষ‍্য‌হীন জীবন‌যাপনেও আনন্দে আছেন। এটা‌ও কিন্তু অনেকে পারে না। 

    বলি, এটা কী গর্হিত ব‍্যাপার? সবার জীবনে কী বিশেষ কিছু উদ্দেশ্য থাকতে‌ই হবে? অনেকে‌র‌ই আধ‍্যাত্ম‍্যভাব, সমাজকল্যাণে জীবন উৎসর্গ করার তাগিদ না‌ও থাকতে পারে। বাবা বলেন, মোটেই গর্হিত নয়। নিজের যোগ্যতা‌য় ভালো চাকরি করেছেন, মোটা আয়কর দিয়েছেন, গরীবের রক্ত চুষে বা ভেজাল ওষুধ বেচে বড়লোক হননি। আপনি আত্মকেন্দ্রিক মানুষ। নিজস্ব পছন্দের গন্ডীতে আবদ্ধ। আপনার মতো মানুষ সমাজের পক্ষে ভিটামিনের মতো উপকারী‌ নয় আবার ভাইরাসের মতো ক্ষতিকারক‌ও নয়। এমন জীবনযাপন‌ও সবার আসেনা। বোর হয়ে যায়। আমি‌ই বা এখানে বিশ বছর একান্ত‌বাসী হয়ে সমাজের কোনো উপকারে এসেছি? কিছু মানুষ আমায় ভালো‌বাসে, শ্রদ্ধা করে, আমার কাছে দুদন্ড বসে, দুটো মনের কথা বলে মানসিক শান্তি পায়। বাকি সময় আমি‌ ধ‍্যান, জপ নিয়ে‌ই থাকি। এতে সমাজের কোন উপকারটা হয়? 
     
    জানলাম বছর দশেক আগে উনি এখানে গাছতলায় প্লাস্টিকের তাবু খাটিয়ে বসেছিলেন। ক্রমে ওনার কিছু ভক্ত তৈরী হোলো। তারা চাঁদা তুলে বনদপ্তরের জমিতে এই ছোট্ট বাড়িটা তুলেছে। এসি, ফ্রিজ, রুম হীটার, টিভি, ওয়াশিং মেশিন, গ‍্যাস, মিক্সি - মানে জীবনযাপনের প্রয়োজনীয় উপকরণ দিয়ে ঘর সাজিয়ে‌ দিয়েছে। বাবা চাননি। বারণ‌ও করেন নি। বনদপ্তর তুলে দিলে আবার কোথাও গাছতলায় গিয়ে বসবেন। বাবার কোনো কাজের লোক নেই। উনি নিজে‌ই সব করেন। কিছু লোক নিয়মিত আসে। তারা কিছু কাজ করে দেয়। গত দশ বছরে কখনো অসুখ করেনি। হার্ট এ্যাটাক হলে দূরে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার আগে‌‌ই রাস্তা‌তে শেষ হয়ে যেতে পারেন। তবু এসব নিয়ে ভাবেন না। ইহলীলা সাঙ্গ হলে দুঃখ নেই। অনেক তো বাঁচলেন। পঙ্গু, চলৎশক্তি‌হীন হয়ে পড়ে থাকতে হলে ধরে নেবেন সেটা‌ও তাঁর ইষ্টদেবতার অভিরুচি।

    অলক কিচেনে চা বানাতে গেল। সেই ফাঁকে বলি, আমার আধ‍্যাত্মিকতা, ঈশ্বর‌ভক্তি এসবে আগ্ৰহ নেই কিন্তু অলকতো আপনার কাছে পাঁচ বছর ধরে আসছে, আপনার কাছে দীক্ষা নিতে চেয়েছে, তবু ওকেও তো আপনি কোনো দিশা দেখা‌ন নি? বাবা অদ্ভুত হেসে বলেন, আপনার কাছে এ নিয়ে অনুযোগ করেছে নাকি অলক? মানুষ‌টা মনের দিক থেকে ভালো। নাহলে স্রেফ বাঙ্গালী বলে এই ঠান্ডায়, জোলো ওয়েদারে কেউ অচেনা কাউকে বাইকে এতদুর আমার সাথে আলাপ করাতে নিয়ে আসে? তবে কী জানে‌ন, ছোলা সারারাত জলে ভিজিয়ে রাখলে সকালে খাওয়া যায়। আচার বহুদিন রোদে রাখলে তবেই তার স্বাদ আসে। সব জিনিসের‌ই একটা সময় আছে। আমি কাউকে দীক্ষা দেওয়ার যোগ‍্য কিনা তাও বুঝি না। বিশ বছরে হয়তো আট দশ জন নাছোড় বান্দাকে এড়াতে না পেরে কিছু বলেছি। অলককে আরো দেখতে হবে আমায়। শুধু বলেছি রোজ সন্ধ্যায় এক ঘন্টা ধ‍্যান করতে। 

    সাড়ে আটটা নাগাদ বাবা বলেন, অলক তুমি বরং এবার এসো। অনেকটা পথ। কুয়াশা পড়েছে। বৃষ্টি‌ও আসতে পারে। আর দেরী কোরো না। সচরাচর কারুর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করা আমার আসে না। ঘরে ঢুকে‌ তাই জোড়হাতে‌ নমস্কার করেছিলাম। আসার সময় হাত দুটো স্বেচ্ছায় নেমে এলো ওনার মোজা পড়া পায়ে। উনি উঠলেন না। থাক, থাক‌ও বললেন না। আরামকেদারায় বসে‌ই আমার মাথায় হাত ছুঁ‌ইয়ে নিঃশব্দে আশীর্বাদ করলেন শুধু।

    আসার পথে অলক বলে, কেমন লাগলো বাবাকে? বলি, ভালো, আপনার মতোই সোজা‌সাপ্টা। ঘন অন্ধকার রাস্তা। টিপটিপ বৃষ্টি শুরু হয়েছে। অলক বলে, এই পথে বছর দুয়েক আগে রাতে একটা লেপার্ড দেখেছি‌লাম। সেদিন বাইকের পিছনে আমার স্ত্রী‌ ছিলেন। লেপার্ড‌টা হেডলাইট দেখে ঘাবড়ে গিয়ে রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। আমি থামিনি সোজা চালিয়ে গেছিলাম। ভেবেছিলাম না সরলে মারবো বাইকের ধাক্কা। বলি, ভুল ভেবেছিলেন। লেপার্ড আপনার বাইকের গুঁতো খাওয়া‌র জন‍্য দাঁড়িয়ে থাকতো না। শেষ মূহুর্তে চকিতে সরে যেতো। তাতে হয়তো আপনি‌ই ভারসাম্য হারিয়ে উল্টে পড়তেন রাস্তায়। তখন সে ভয় পেয়ে হামলা‌ও করতে পারতো। আপনার উচিৎ ছিল ওকে দেখে পত্রপাঠ ইঞ্জিন বন্ধ না করে দাঁড়িয়ে পড়া। চলে গেলে একটু অপেক্ষা করে চলে যাওয়া। এসব জায়গা তো ওদের‌ই বিচরণক্ষেত্র, আমরাই বরং অনুপ্রবেশ‌কারী। 

    অলক বলে, ঠিক বলেছেন, পরে আমার‌ও মনে হয়েছিল ওটা গোঁয়ার্তুমি হয়ে গেছি‌ল। হঠাৎ চোখের সামনে লেপার্ড দেখে মাথার ঠিক ছিল না। আমি বলি, এখন বরং মাঝে মাঝে হর্ণ বাজান। আজকে‌ও যদি কোনো মক্কেল আশেপাশে থাকে তো হর্ণ শুনে সরে যাবে।
     
    লজে পৌঁছলাম সোয়া নটায়। বৃষ্টির তেজ বেড়েছে। দোকান‌পাট বন্ধ হয়ে গেছে। স্ট্রীটলাইট গুলো দাঁড়িয়ে ভিজছে। বাইক থেকে নেমে উঠি লজের বারান্দায়। জনহীন পথে বৃষ্টির মধ‍্যে মিলিয়ে যায় বড়সড় শরীরে খোলামেলা মনের এক ডাকাবুকো মাস্টার।

    পূনশ্চঃ- লেখাটি বাস্তব আধারিত। নৈতিক দায়বদ্ধতা‌য় জায়গা এবং চরিত্রের নাম রেখেছি কাল্পনিক।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ভ্রমণ | ২৫ অক্টোবর ২০২৩ | ১২৬৫ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Ranjan Roy | ২৫ অক্টোবর ২০২৩ ১৮:০২525149
  • আরো আরো প্রভু, আরো আরো! 
  • Arindam Basu | ২৬ অক্টোবর ২০২৩ ০২:২৩525153
  • বেজায় ভালো হয়েছে। 
    একটা ছোট্ট ব্যাপার,"ভাবি কলকাতা কী কিরিবাতি আইল‍্যান্ডের মতো দূরবর্তী ", ওটা "কিরিবাস" হবে | ইংরিজিতে পড়লে kiribati মনে হয় বটে, তবে উচ্চারণে  কিরিবাস |
    ;-)
  • kk | 2607:fb90:ea0c:cd31:7a6a:9d53:7567:***:*** | ২৬ অক্টোবর ২০২৩ ০২:৪৬525154
  • ভালো লাগলো। বিশেষ করে শর্মাজীর বাড়িতে ডিনারের মেনুটা তো খুব পছন্দ হলো। ভাবছি কাল পরশুর মধ্যেই এই ডিনার বানিয়ে খাবো।
  • &/ | 151.14.***.*** | ২৬ অক্টোবর ২০২৩ ০৩:৩৭525155
  • কিরিবাতি কথাটা এত সুন্দর, কিরিবাস হলেও কিরিবাতিই বলব। এটা শুনলেই মজা লাগে। প্রথম পেয়েছিলাম দানিকেনের বইতে। অনুবাদে পড়তাম। সেখানে তিনি তো কিছুতেই খুঁজে পান না কিরিবাতি কোথায়। বিরাট ম্যাপ ঝোলানো, কিন্তু কেউ বলতে পারে না কিরিবাতি কোথায়। না জানলে যাবেন কী করে? অনেক পরে জানতে পারলেন, তখন গেলেন। ঃ-)
  • Amit | 163.116.***.*** | ২৬ অক্টোবর ২০২৩ ০৫:২৪525156
  • সুন্দর আতিথেয়তার গল্প। কিন্তু এই লাইন টা "আপনি ব্রাহ্মণ। আমি‌ও তাই। আপত্তি না থাকলে রাতে গরীবের ঘরে ডিনারে আসবেন?" - এইটা চোখে লাগলো। এটা হিন্দুধর্মের বা ভারতের একটা মস্ত সমস্যা। এখনো লোকে ভালো কি মন্দ বা কাকে ঘরে খেতে ডাকা যায় তার প্রথম শর্টলিস্টিং হয় জাত বা কাস্ট দিয়ে। 

    সাউথে বেশ কিছু বছর কাটিয়েছি কর্মসূত্রে। কারোর সাথে আলাপে নাম আর কোথায় কাজ করি এর খানিক পরেই মোটামুটি প্রশ্ন আসতো কি কাস্ট। কলকাতার বাঙালি কালচারে প্রথমে বেশ কানে লাগতো। পরে দেখি কোনো লাভ নেই। এই থিংকিং প্রসেস টা এতটাই গভীরে- কয়েকজন প্রতিবাদ করলে যাওয়ার নয়। বরং সোশালি আইসোলেটেড হয়ে যাওয়ার ঝামেলা। 
     
  • সমরেশ মুখার্জী | ২৬ অক্টোবর ২০২৩ ১২:২০525162
  • @ রঞ্জনদা - ধন‍্যবাদ, আসবে ... আরো আসবে ...
     
    @অরিন্দম বসু - ধন‍্যবাদ। এটা জানা ছিল‌না। আমি ফোনেটিক‍্যালি যা মনে হয়েছে লিখেছি। কিছু শব্দের সঠিক উচ্চারণ জানা না থাকলে, ফোনেটিক‍্যালি লিখলে এই বিচ‍্যুতি হতে পারে। যেমন San Jose (হোসে) বা Mojave Desert (মোহাভে)। তবে গুরুতে লিখলে কেউ না কেউ সঠিক উচ্চারণ বলে দেন। এটা এখানে লেখা‌র প্রাপ্তি।

    @&/ - আমি‌ও কিরিবাতি (কিরিবাস) আইল‍্যান্ডের কথা প্রথম পড়েছি‌লাম দুর অতীতে দানিকেনের ব‌ইতে - অজিত দত্তর অনুবাদে।

    @kk - সেদিন অচেনা মানুষের আন্তরিক‌তা মাখা রান্না সত্যি‌ই বেশ লেগেছিল।

    @ অমিত - এটা সত্যিই দুঃখজনক তবে বাস্তব‌কে অস্বীকার করিনি বলে অলক মাস্টার যা বলেছিলেন হুবহু রেখেছি। মোহিনী ধূবেলা লেখাতেও দরগাহ‌র চাচা মুবারক আলী‌র পুত্র আহাদ এসে বলেছিল - "আমি ঘর থেকে আপনার জন‍্য কিছু খাবার আনতে পারতাম কিন্তু …।" 
     
    কাছাখোলা একাকী ভ্রমণে নানা বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়েছে। সেসব শেয়ার করার তাগিদে এসব লিখছি। 
    একবার উত্তরাখণ্ডে এক নামী মন্দিরের কর্মকর্তা "একা যাত্রীকে ঘর দেওয়া যাবে না" বলে আমায় খেদিয়ে দিয়েছিলেন। তখন সেই মন্দিরের ঝাড়ু‌দার আমায় বলেছিল, "বাবুজী, চাইলে রাতটা আমার ঘরে কাটাতে পারেন, কিন্তু আপনি উচ্চ বর্ণের ব্রাহ্মণ, আমি বাল্মীকি …." । এক রাত তার ঝোপড়া‌য় দিব‍্যি কাটিয়েছি। 

    লং ড্রাইভ পছন্দ বলে নিজের, কোম্পানির, বন্ধু‌র গাড়িতে বেড়ানোর মজাও নিয়েছি অনেকবার। তবে তখন এই সব অভিজ্ঞতা হয় না। এর মজা এমন গোত্রের যা কারুর সাথে শেয়ার করার নয়। তাই বছরে অন্তত একবার মাস দুয়েকের জন‍্য একা বেরোতে মন চায় - এখনো। 
    জাতপাত নিয়ে বহুদিনের সংস্কার সহজে যাবে না। এসব নিয়ে ভাবলে মন খারাপ হয়। আমি পলায়নবাদী। তাই বিশেষ ভাবি না। বাকি কটা বছর মনের আনন্দে কাটিয়ে দিতে চাই।

    সবাইকে, বিজয়ার শুভেচ্ছা জানাই। ভালো থাকুন সবাই।
  • Amit | 163.116.***.*** | ২৬ অক্টোবর ২০২৩ ১২:২৯525164
  • না না আপনি লিখে যান। খুব সুন্দর লাগছে আপনার ট্রাভেলগ গুলো। ওটা আপনাকে বলিনি একেবারেই, প্লেন স্বগতোক্তি বলতে পারেন। এই ইস্যুটা নিয়ে জাস্ট নিজের কিছু অভিজ্ঞতা মনে পড়ে গেল। 
  • সমরেশ মুখার্জী | ২৬ অক্টোবর ২০২৩ ১৩:৪২525173
  • সেদিন এক হরিদাস পালের সাথে কথা হচ্ছিল। তিনি গুরুতে শুরু থেকে আছে‌ন। অনেক নিকের আসল নাম ও প্রেক্ষাপট জানেন। তিনি বললেন, একদা গুরুর এক Admin তাঁকে বলেছিলেন - গুরুচণ্ডা৯ Admin নিয়ন্ত্রণ‌হীন ওপেন ফোরাম বলে কিছু লোক নিজেরা কিছু লেখে না তবে নিকের আড়াল থেকে স্বনামে লেখা লেখককে অবাঞ্ছিত আঙ্গিকে মন্তব্য করে আলোচনা লেখা‌র বিষয়বস্তু থেকে সম্পূর্ণ অন‍্য দিশায় নিয়ে চলে যায়। এটাই তাদের হবি। তিনি তাঁকে পরামর্শ দিয়েছিলেন - এদের মন্তব্যের জবাব  না দেওয়ায়‌ই বাঞ্ছনীয়। কথাটা মনে পড়ে গেল। মনে রাখতে হবে।
  • ধুসস | 2405:8100:8000:5ca1::3a2:***:*** | ২৬ অক্টোবর ২০২৩ ১৫:০২525179
  • ক্যাংলাদেশ বরিশালের এই কাটুয়াটা সেই ফারাবি নাকি ফারাবির ভাই বেরাদর হবে। খামোখা গুরুর অ্যাডমিনের সাথে জড়াচ্ছে কেন সমরেশ?
  • যোষিতা | ২৭ অক্টোবর ২০২৩ ০৪:৪৩525213
  • চমৎকার লেখা। একটানা পড়ে ফেললাম। আরো লিখুন।
  • শিবাংশু | ২৮ অক্টোবর ২০২৩ ১০:৪২525262
  • আপনার শারীরিক সহিষ্ণুতা ঈর্ষিত করছে, 
  • reeta bandyopadhyay | ০১ নভেম্বর ২০২৩ ২২:২২525422
  • মন্ত্রমুগ্দ্ধ হয়ে পড়ছি লেখাটা ।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ক্যাবাত বা দুচ্ছাই প্রতিক্রিয়া দিন