কখন ভোর আসছে আর কখন সন্ধ্যা হচ্ছে – বোঝার উপায় নেই। আকাশে মেঘ জমার যেমন বিরাম নেই, তেমনই বিরাম নেই বৃষ্টিরও। আর ওদিকে জোয়ারে-মেঘের টানে উথলে উঠছে নদী। চারপাশ এ-কদিনে এমনিতেই জল জল হয়ে গেছে, আর তার সঙ্গে যমুনার এই পাড়ভাঙা ঢেউ। জলের সাথে যে শহরের মানুষগুলোর আজীবনের মিতালী, তারাও আজ কেমন যেন আশঙ্কায় আঁতকে উঠছে,
এর’ম বর্ষা কুনুদিন দেখিনি গো…
রহিম চাচার কন্ঠের এই সুর আমার খুব অচেনা। এমনিতে খুব নিরীহ মানুষ রহিম চাচা। প্রয়োজন ছাড়া মুখে একটিও বাড়তি কথা নেই। এমনকি রহিম চাচাকে কখনও ঠিকঠাক হাসতে বা রাগতেও দেখিনি আমি। নির্লিপ্ত এই মানুষটির চোখমুখের আতঙ্ক আজ ঠিক ফুটে উঠলো তার কথায়। প্রায় সাতদিন হতে চললো এই বিরামহীন বৃষ্টির। শুরু হবার দু-দিন পর থেকেই শহরের নিচু এলাকায় জল জমতে শুরু হয়েছে। আর জলজমা মানেই মানুষের ঘরবন্দি হয়ে যাওয়া। তাই রহিম চাচার রিকশাও প্যাডেল থামিয়ে ঘরে বন্দি হয়ে গেছে। এখন তো শহরের প্রায় সব পাড়াতেই জল জমে গেছে। তাই কাজহীন রহিম চাচা সারাদিন ওই মসজিদের বারান্দায় বসে থাকে। আজও তাই ছিল। জল যতই জমুক, উনুনের আঁচে তো বিরাম নেই। রহিম চাচার অবধারিত ডাক পড়লো আমাদের বাসায়। তবে রিকশা নিয়ে নয়, কলাগাছের ভেলা নিয়ে মসজিদের মাঠ পেরিয়ে এলো আজ রহিম চাচা,
যমুনাত কালা মেঘ ভাঙি পড়তিছে কুন সময় যে পাড় ভাঙি ভাসায় নিবি সব আল্লাহ্ জানে…
-ও রহিম চাচা, নদী কি ভাঙতে ভাঙতে আমলাপাড়ায় চলে আসবে?
এমন নদী, এমন জল আমার কাছে খুব নতুন। তাই যতটুকু ভয়, তারচেয়ে বেশি রোমাঞ্চ আমার বান নিয়ে। আমি ভাবি, আচ্ছা নদীর সব মাছ কি তখন সবার উঠোনে চলে আসবে? নাকি ভেসে ভেসে ওরা চলে যাবে শহর ছেড়ে? আর নদীর পাড়ে ওই যে ছোট ছোট ঘরগুলো আর সে ঘরের মানুষগুলো – ওদের কী হবে? ওরা কি সব ভাসতে ভাসতে আমাদের পাড়ায় চলে আসবে? তবে সব প্রশ্ন দূরে ঠেলে আমি এখন রহিম চাচাকে দেখছি। এ-কদিনে রহিম চাচার মুখটা কেমন শুকিয়ে গেছে।
বারান্দায় বসে আছে রহিম চাচা। মা নিজের নিয়ম মেনেই রহিম চাচাকে চা মুড়ি দিলো। সঙ্গে ক-টা নাড়ুও। ফেলেছেড়ে খায় রহিম। কেমন একটা অসহজ ভাব রহিম চাচার চোখেমুখে। শুনেছে রতনকান্দির দিকে নদী ভাঙা শুরু হয়ে গেছে। ছোটো মেয়েটাকে সেখানেই বিয়ে দিয়েছে রহিম চাচা। কখন কার কী খবর আসে--তা নিয়ে এই বয়স্ক লোকটার চেহারায় এখন চরম দুশ্চিন্তা।
চলো রহিম…
বাবা আর রহিম চাচা কলাগাছের ভেলা নিয়ে বেরিয়ে পড়লো।
এই বৃষ্টিতে আমার অবশ্য খুব সুবিধা হয়েছে। স্কুল নেই, টিউশন নেই, গানের দিদি নেই। কেমন যেন অলস আনন্দ এই কয়দিন। আকাশ আবার কালো হয়ে উঠলো। ফিসফিসানি বৃষ্টি খানিক পরেই ঝমঝম করে পড়তে শুরু করবে। আমি বারান্দা থেকে ঘরে ঢুকলাম। হঠাৎ মনে পড়লো--কাল চিঠি এসেছিলো। আমি টেবিলের কাছে এসে টেবল-ক্লথটা সরালাম। না, এখানে তো কালকের চিঠিটা নেই। নতুন চিঠিটা ছাড়া সব পুরোনো চিঠি এখানে উঁকি মারছে। কোথায় সেই চিঠি আর কে-ইবা লিখেছে? প্রশ্নটা মাকে করতে যাবো, তখনই উঠোনে মুসার মায়ের আওয়াজ,
ঘরের ভিতর পানিত বিছানাপত্তর সব ভিজি গ্যাছে, গেঁদাক নিয়ি আর থাকা যাবিনা ওই খানটাত…
কাকভেজা হয়ে উঠোনের জলে দাঁড়িয়ে আছে মুসার মা। সঙ্গে পেট টিঙটিঙে বড় বড় চোখের মুসাও। ভিজেনেয়ে একাকার মুসাকে দেখে আমার কেমন মায়া লাগলো আজ।
ঘরখান নদীত ভাঙি পড়বো আজই মনে কয়, যমুনার এমুন ঢেঊ দেখলি ডর লাগে বড় আম্মা…
বড় দাদীই এখন এই দুনিয়ায় মুসার মায়ের অভিভাবক। একটা ছোট টিনের ট্রাংক আমাদের বারান্দায় রেখেছে মুসার মা। স্কুলঘরে চলে যাবে আজ ওরা। নদীর পাড়ের সবাই ওখানে গিয়েই উঠেছে,
বড় আম্মা, এই বাকশো খান রাখি যাবো আপনার জিম্মায়, কবে বাড়িত ফিরতি পারবো কইব্যার পারি না…
জল না হয় ঘর নিয়েছে, তাই বলে কি এই শহরে উদ্বাস্তু হয়ে যাবে মুসার মা? বড়দাদী থাকতে তা কী করে হয়?
ছেলে নিয়ে আমার বাড়িতে থাক তুই, স্কুলঘরে যাবার কী দরকার?
তবে আজই প্রথম আমি মুসার মাকে বড়দাদীর অবাধ্য হতে দেখলাম,
স্কুলঘরে না থাকলি রিলিফ পাবো নানে বড় আম্মা, সকাল বিকাল আসবনি আপনের বাড়িত কাজ করতি…
আচ্ছা, সে তো পরে যা হবার হবে কিন্তু এখন এভাবে কেন ভিজতে হবে?
বড়দাদীর ধমকে মুসার মা শুকনো কাপড়ের জন্য বড়দাদীরই পিছু নিলো।
বৃষ্টির দমক বাড়লো। কলঘরের সামনে জামরুল গাছের তলায় এখন হাঁটুজল। সেই জমা জলে অনবরত আলোড়ন তুলছে ঝমঝম বৃষ্টির ফোঁটা। সেই গাছেরই নীচু একটা ডালে বেনেবউ পাখিটা সেই কখন থেকে ভিজে চলেছে। পালকে জমা জলের ভারে কেমন জড়োসড়ো হয়ে আছে ও। আচ্ছা, পাখিটা নিজের ঘরে ফিরছে না কেন? কথাটা ভাবতেই আমার বাড়ির কথা মনে পড়ে। বাড়িতেও কি এমন বৃষ্টি হচ্ছে? বাইরবাড়ির ছোট্ট পুস্করিণী কি জল উপচে তাঁতঘরে ঢুকে পড়ছে?
প্রশ্নগুলো মাথায় নিয়ে আমি মায়ের ঘরে আসি,
মা, বাড়ির উঠানে কি জল জমছে এমন?
মা আমাদের নতুন টেলিভেশনের জন্য কভার সেলাই করছে। হ্যাঁ, ক-দিন আগেই বাবা ঢাকা থেকে প্যানাভিশন টিভি কিনে এসেছে। সেই টিভিতে সবাইকে অন্যরকম দেখায়। বাড়িতে বাঘকাকুর কেনা টিভিতে সবাইকে সাদা দেখা যেত। কিন্তু বাবার কেনা এই টিভিতে সবাই খুব রঙিন। এজন্যই তো বড়দাদী নিজের টিভি রেখে মঙ্গলবার রাতে আমাদের ঘরে ‘ঢাকায় থাকি’ নাটক দেখতে আসে। শুধু কি বড়দাদী? শিখা দির মা, রহিম চাচার বঊ, শিল্পী আপারা সবাই আসে আমাদের বাসায়। সবাই মিলে আমরা দেখি ‘সংসপ্তপক’, দেখি ‘এইসব দিনরাত্রি’, দেখি ‘ঢাকায় থাকি’।
সেই টিভির কভারে সুঁই-সুতোর টিয়েপাখি আঁকতে ব্যস্ত মা আমার প্রশ্নের উত্তরে শুধু ছোট্ট করে ‘হ্যাঁ’ বলে।
মা, ঠাকুমা কি এই বৃষ্টিতে ভিজে…
আমার কথা শেষ করার সুযোগ না দিয়ে মা সেলাইয়ের কাজ ফেলে উঠে পড়ে,
মনি, একটু পড়তে বসো মা। স্কুল কবে খুলবে তার তো ঠিক নেই।
টেবিল থেকে খাতা বই হাতে নিতেই আমার গতকালের চিঠির কথা মনে পড়ে,
মা, কাল কার চিঠি এলো?
প্রশ্নটা হাওয়াইয় ভাসাতেই বাড়ির উঠোনে এসে থামলো রহিম চাচার ভেলা। শহরের সব বাজার ঘুরে প্রায় খালি হাতেই ফিরে এসেছে বাবা। এই তুফানে নদীতে কোনো মাছ ধরার নৌকা নেই। আর মাছের এক ট্রেন অন্যশহর থেকে এলেও, তা ছিল প্রায় মাছশূন্য। তাই অল্পকিছু তাপসী মাছ জুটেছে আমাদের আজকের বাজারের ব্যাগে। সেখান থেকেই বাবা কিছু মাছ দিয়ে দিলো রহিম চাচাকে।
আজ দুর্যোগের দিনে এই মাছেই উনুনেই মান রাখতে হবে। তাই আমার প্রশ্নটা অনুত্তর রেখেই মা স্টোভের সলতেয় আগুন দিতে উঠে পড়লো। সেই আগুনের আঁচে বসলো ভাতের হাঁড়ি। সেই হাঁড়িতে মা দুটো আলুও ফেলে দিলো। এক পদে নাকি খেতে নেই। তাই মাছের ঝোলের আগে পাতে পড়লো ঘি দিয়ে মাখা আলু সেদ্ধ।
কিন্তু, বড়দাদীর ভাষায়, রিজিকে যা আছে তা জুটে যাবেই। তাই আজ এই দু-পদের সাথে যুক্ত হলো মাছ সুক্তোও। আর এই পদের যোগানদার – স্বয়ং মুসা। এমনিতে স্কুলে যাবার কথা শুনলে মুসা পালিয়ে যায়। কিন্তু আজ কোন ফাঁকে চলে গেছে স্কুলের উঁচু মাঠে – তা কারো জানা নেই। সেখান থেকে তুলে এনেছে এক গোছা বথুয়া শাক। আর এনেই বড়দাদীর কাছে বায়না ধরেছে বিক্রির। বড়দাদীও কম বোদ্ধা ক্রেতা না। বড়দাদী দরদাম করে এক টাকার বথুয়া শাক তিরিশ পয়সায় কিনেছে মুসার কাছ থেকে। সেই শাকই ভাগযোগ হলো বড়বাড়ির দুই ঘরে।
তা মুসা, এই তিরিশ পয়সায় কী কিনবি তুই?
উত্তরে মুসা হাতের কড় গুনে বলতে শুরু করলো,
দশ পয়সা দিয়ি ঝুড়ি ভাজা কিনতি হবি, দশ পয়সায় নই খামু মায়ের জন্যি পাউডার কিনমু, একখান নয়া লাটিম কিনমু…
মুসার হাতের কড় কম পড়ে যায়, ওর ইচ্ছের ফর্দি বানাতে বানাতে। জলমেঘের এমন মনমরা দিনেও সবাই খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে মুসার এই ফর্দির বহর দেখে।
আমাদের তরকারির ঝুড়িতে বথুয়া শাকগুলো পড়তেই মা মাছসুক্তোর জোগাড়যান্তি শুরু করলো। ভাড়ার ঘরের তাক থেকে নামলো সবুজ রঙের মৌরি। এই মৌরি সাদা খোলায় ভেজে গুঁড়ো করে নিতে হবে। আর লাগবে চন্দনের মতো মিহি আদা বাটা। সঙ্গের ফোড়নে পড়বে কাঁচামরিচ আর রাঁধুনি। তবে সবার আগে মুসার মা তাপসী মাছগুলো কুটে বেছে দিলো। মা কেটে নিলো বথুয়া শাক কুচি করে।
জোলো বাতাসে এখন ঝিরঝিরে বৃষ্টি। একঘেয়েমি বৃষ্টির এই দিন দেখে বোঝার উপায় নেই বেলার বয়স। আগবেলা আর বারবেলায় খেই হারানো এই বর্ষাদিনের শুধু একটাই সহজ হিসেব দিন আর রাতের, সেখানে না আছে বিকেল, না আছে সন্ধ্যা। এমনকি ভরদুপুরও নেই। রোদহীন বেলার গায়ে ছায়াহীন সময় দেখে ঠাওর করার উপায় নেই প্রহরের। তাই তো মা হাত চালিয়ে সবকিছু করে নিচ্ছে এখন। কারণ, বর্ষাদিনের অন্যথা যতই ঘটুক, আমাদের দুপুরের পাত কিন্তু পড়বে অন্যদিনের মতোই – বাবার সময় মেনে।
হলুদ আর লবণ মাখিয়ে মা তাপসী মাছগুলো ভেজে নিলো সর্ষের তেলে সবার আগে। এরপর কড়াইয়ের তেলে পড়লো রাঁধুনি আর বুকচেরা কয়েকটা কাঁচামরিচ। ফোড়ন ফুটফাট ফোটা শুরু করতেই তাতে কেটে রাখা শাক দিয়ে দিলো মা। ছিটিয়ে দিলো লবণ। নেড়েচেড়ে ঢাকনা পড়লো তাতে।
খানিক পরেই ঢাকনা উপচে শাকের সবুজ জল জানান দিলো – বথুয়া শাকগুলো খুব কচি। ঢাকনা তুলে সেদ্ধ হয়ে আসা শাকে মা মিশিয়ে দিলো আদাবাটা। নেড়েচেড়ে তাতে দিয়ে দিলো ভাজা তাপসী মাছ। স্টোভের আঁচ বাড়িয়ে দিলো মা। শাকের জল আরেকটু শুকোতে হবে যে!
বারান্দায় পড়লো লোহার হামানদিস্তা। তাতে মা কুটে নিলো ঢেলে রাখা মৌরি। স্টোভের আঁচে ফুটছে মাছসুক্তো। আদা আর বথুয়া শাকের ঘ্রাণ মিলেমিশে বৃষ্টির ভারী বাতাসে উড়তে শুরু করেছে এখন। এই ঘ্রাণটা আমার খুব পরিচিত। পিসিঠাকুমা বাড়িতে এলে আমি এই ঘ্রাণ পেতাম। ভাইয়ের জন্য এটা-ওটার ফাঁকে সময় করে পিসিঠাকুমা এই মাছসুক্তোও রান্না করতো শঙ্কর জ্যাঠার মাঠ থেকে বথুয়া শাক তুলে এনে।
স্টোভের আঁচ এবার মা কমিয়ে দিলো। মাছসুক্তোর জল অনেকটা শুকিয়ে এসেছে এর মধ্যে। আতপচালের গুঁড়ো এবার মা জলে গুলিয়ে নিলো। পিটুলি মিশিয়ে দিলো সুক্তোয়, আর মেশাতেই, জলজলে ঝোল থকথকে হয়ে উঠলো। আর দেরি করলো না মা। হামানদিস্তায় করা মৌরি-গুঁড়ো ছড়িয়ে দিয়ে মাছসুক্তোর কড়াই নামিয়ে নিলো আঁচ থেকে।
উঠোনের জল বাড়ছে একটু একটু করে। এর মধ্যে তুলসীর ঝাড় অনেকটাই তলিয়ে গেছে। উঠোনের জল আরেকটু বৃষ্টি পেলেই সদর্পে উঠে আসবে আমাদের বারান্দায়। কালচে মেঘের আকাশ দেখে করার উপায় নেই সময় গুণতি। এখনও হচ্ছে বিরামহীন ঝিরঝিরে বৃষ্টি। জামরুল গাছে বসে থাকা বেনেবউ পাখিটা ডানা ঝাপটে জল ঝরাচ্ছে, অল্প সময় পরেই আবার জল জমে ওর ডানা ভারী হয়ে উঠছে।
দুপুরের পাত পড়লো ঘরের মেঝেয়। বাবার পাশে আমার পাত। ভাতের পাশে মাছসুক্তো থেকে এখনো ধোঁয়া উঠছে। সেই ধোঁয়ায় মিশে থাকা ঘ্রাণ আমার ক্ষিদের সঙ্গে লোভও বাড়িয়ে দিলো। আমি মাছসুক্তো তুলে মুখে দিই। ঠিক তখনি আবার কালকের চিঠিটার কথা মনে পড়ে,
মা, কাল কার চিঠি এলো?
আমার প্রশ্নে মায়ের মুখটা কি উদাস হয়ে উঠলো? কী জানি, সেদিকে খেয়াল করার আগেই বাইরে ঝমঝম করে বৃষ্টিজল পড়তে শুরু হলো। আর সকাল থেকে জামরুল গাছে বসে থাকা বেনেবউ পাখিটা ডাল ছেড়ে উড়ে গেলো হুট করেই।