আকাশের হিম নেমে আসা থেমে গেছে অনেকদিন। ভোরের বাতাসে যমুনা থেকে ইঠে আসা ঠান্ডা বাতাস দিক বদলেছে বেশ আগেই। ভাদুড়ী বাড়ির জংলা বাগানে ঝুলে থাকা মহুয়া ফুলের ঘ্রাণ বাতাসে ভাসা শুরু হতেই চিলতে উঠোনে জমতে শুরু হয়েছে জাম ফুলের রেণু। ক-দিন পরেই এই গাছে বাসা বাঁধবে ঘুঘু পাখি। ঘুঘুর ডাকে বারবেলার রোদে জমবে তাপ—তপ্ত বেলার অবিশ্রান্ত তাপ।
তবে তাই বলে যে এখন দিনের গায়ে তাপ জমে না—তা বলা মনে হয় ভুল হবে। ভোরের বাতাসেও সে তাপ একটু আধটু জেঁকে বসতে শুরু করেছে ক-দিন হল। তাই মা আকাশের অন্ধকারেই দুয়ারে জলের ছিটা দিয়ে কলতলায় গিয়ে ঢোকে। স্নান সেরে তুলসীঝাড়ের সামনে লেপেমুছে সাদা টগরের অর্ঘ্য দিয়েই কেরোসিনের স্টোভে আঁচ দেয়। আজ তাতে চায়ের জল বসিয়ে মা ভাদুড়ী বাগানে চলে গিয়েছে আকাশ সাদা হতে না হতেই। সেই জংলা বাগানে হিঞ্চে শাক, নটে শাক, শুষনি শাক আগাছা হয়ে মাটি জড়িয়ে পড়ে থাকে। দু-একটা প্রজাপতি আর ঘাসফড়িং ঘুরে বেড়ায় তাদের গায়ে। তবে দুই পাখা ঝাপটে উড়ে যেতে চাইলেই শিল্পী আপার মুঠোয় বন্দি হতে হয় ঘাসফড়িং-দের। মুঠোবদল হয়ে তারা আমার কাছে আসলে, আঙুলের ফাঁক গলিয়ে পালিয়ে যায়। তবে তাতে আমার মন খারাপ হয় না মোটেও। বরং আমার মুঠো শূন্য করে ওদের উড়ে যাওয়া দেখতেই বেশি আনন্দ হয়।
শিল্পী আপা বলেছে—এবার মুঠোয় নয়, ঘাসফড়িঙের লেজে সুতো বেঁধে আমার হাতে ঝুলিয়ে দেবে। আমি অবাক হই। ঘাসফড়িংকে কেউ বেঁধে রাখে?
আমার এসব প্রশ্ন মনের ভেতর আরও জটলা পাকার আগেই মা চলে আসে পাঁচশাক নিয়ে। কেরোসিনের স্টোভে ফুটছে চায়ের জল। জলে চায়ের পাতা পড়তেই আজকের আকাশের লালচে রঙটুকু এসে জড়ো হল চায়ের কেটলিতে।
খুব কাছে হওয়ায়, আমলাপাড়ার মানুষগুলো কারণে-অকারণে ছুটে যায় যমুনার কাছে। আর তিথি-সংক্রান্তিতে তো নদীর বুকে ডুব দিয়েই এ পাড়ার সকলের ভোর হয়। আজ তাই শিখা দিদিদের বাড়ি থেকে সবাই নদী থেকে স্নান করে ফেরার পথে আমাদের ফটকে থামলো। এক ঘড়া জল তুলসী ঝাড়ের সামনে রেখে গলা চড়ালো,
হলুদ আর নিমপাতা ঘড়ার জলে মিশিয়ে মনির মাথায় ঢেলো, অসুখবিসুখ চলে যাবে।
শিখা দিদির মা—জানি না কেন—আমার শরীর স্বাস্থ্যের খারাপ খবর পেলেই ছুটে আসে, এটা-ওটা টোটকা বলে দেয়। আর মা ওষুধ-পথ্যির পাশে এইসব টোটকায় চোখ বন্ধ করে আস্থাও রাখে। এজন্যই ঠাকুমার কাছ থেকে আসা চিরতার জলের সাথে আজকাল নিমপাতা থেঁতলানো রসও আমার সকালের টোটকায় যুক্ত হয়েছে। শিখা দিদির মা বাসার উঠোন ছাড়ার আগেই আমার হাতে কাপের তলায় পড়ে থাকা নিমপাতার রস চলে এল।
আর এরপরেই মা হাতে ধরিয়ে দিল একটা তিলের কটকটি। বাড়ি থেকে সেই কবে ঠাকুমা পাঠিয়েছিলো এগুলো। মুড়ির টিনের ভেতর মা রেখে দিয়েছে বলে এখনো এমন কটকট করছে। তিলের কটকটি হাতে পেয়েই আমি ঠাকুমার কথা বলার ছুতো হাতড়ে বেড়াই,
মা, আজ নীল ঠাকুরের পাট বের হবে ঋষি কালিবাড়ি থেকে, তাই না? বাড়ির উঠানে লেপ পড়েছে মনে হয় গোবরজলের, তাই না? আচ্ছা, ঠাকুমা কি আজ ধুতরা ফুল আনতে থানাঘাটে গেছে, মা?
আমার প্রশ্নের উত্তর আসে মুসার মায়ের কাছ থেকে,
বাড়ির কথা কতি কতি মুখখান শুকোয়ে যায় ক্যান আপা…
শেষ চৈত্রের বাতাসে আলগোছে মিশে যায় আমার বুক থেকে উঠে আসা দীর্ঘশ্বাস। তবে মায়ের তাড়াহুড়ায় আচমকাই মন চলে গেল উঠোনে। শহরের সংক্রান্তিতে আনকোরা আমার মা আজ উঠোনের ঠিক মাঝখান ভোর থাকতেই লেপেমুছে নিয়েছে। পাটঠাকুর নাকি শহরের উঠোনে আসে না। আসে না অস্টক গানের দলও। তবে কালিবাড়ির মন্দিরে সন্ধ্যায় প্রদীপ জ্বলবে নীলঠাকুরের জন্য। তবে সারাদিন পর একটু প্রদীপ জ্বালালেই হবে নাকি? তাই মা ভাদুড়ী বাড়ির জংলা বাগান থেকে খুঁজে খুঁজে কয়েকটা অপরাজিতা ফুলও নিয়ে এসেছে। আর এনেছে পাতাসহ বেলগাছের একটা ডাল।
আজ যবের ছাতু দিয়ে মেখে মুড়ি খেতে হবে সকালের খাবারে। আর দুপুরে থাকবে একটা হলেও তেতোর পদ। তবে সংক্রান্তির এই দিনে আমার সবচেয়ে ভালো লাগে পাঁচশাক। আর বাবার পছন্দ ডাল সুক্তো।
সকালের রোদে আগবেলার আঁচ ভালোভাবে জেঁকে বসার আগেই আজ দুপুরের উনুন জ্বলে উঠেছে বারান্দায়। উনুন বলতে ওই কেরোসিনের স্টোভ। সেই স্টোভেই বসেছে ডালের জল। তাতে পড়বে ভাজা মাসকলাই ডাল।
মা আজ উপোসী। তাই বেলা চড়ার আগেই আঁচের কাজ সেরে ফেলতে চাইছে।
বাবা আজ বড় বাজারে গিয়েছিলো। বাসা থেকে বড় বাজার বেশ খানিকটা পথ। বড় বাজারে গেলেই ব্যাগ ভরে যায় নানারকম ফলমূলে। তবে আজ তা হয়নি। ক-খানা শাখ আলু, শশা, অদিনের বাতাবিলেবু এসেছে ব্যাগে চড়ে আজ। আর এসেছে কচি পুঁই লতা।
কড়াইয়ের জল ফুটে উঠতেই তাতে মা দিয়ে দিল মাসকলাইয়ের ডাল। সঙ্গে খানিকটা লবণ মিশিয়ে ঢাকনা দিল কড়াইয়ে। পুঁইয়ের লতা বেছে কেটে ধুয়ে নিল মা। মুসার মা আজ তাড়াহুড়ো করে কাজ সেরে গিয়ে উঠেছে মসজিদের মাঠে। সেখানে গুড়ের শিন্নি। রান্না করতে হবে তাকে। বড়দাদীর বাড়ি থেকে পাঠানো হয়েছে ডেকচি ভরা গুড়, চালের গুঁড়া আর নারিকেল কুরোনো। আসরের নামাজের পর মসজিদের মাঠে কলাপাতায় বিলানো হবে শিন্নি।
সেসব নিয়ে মুসার মা ব্যস্ত আজ। তাই মা একাই করে নিচ্ছে সব কাজ। শিলপাটায় আদা বাটতে বাটতে মা এক ফাঁকে কড়াইয়ের সেদ্ধ ডালে কাটা দিল। এরপর তাতে হলুদ গুড়া আর মুঠোভরা কাঁচামরিচ দিয়ে দিল। মাসকলাই ডালে ঘ্রাণ ছুটলো। বাতাসে মিশে সেই ঘ্রাণ বাসার চিলতে উঠোনে এদিকওদিক ঘুরে বেড়াতে লাগলো।
আমি তুলসী ঝাড়ের পাশ দিয়ে ফটকের সামনে গিয়ে দাঁড়াই। আজ মসজিদের মাঠে মেলা মেলা ভাব। সবাই ব্যতিব্যস্ত। কেউ টিউবওয়েল চেপে জল ভরছে, কেউ বড় হাঁড়ির তলায় মাটি লেপছে, আবার কেউ বড় উনুনের চারপাশে ইট যোগাচ্ছে। এমনকিছু মসজিদের মাঠে আমি আজই প্রথম দেখলাম।
আগবেলা গিয়ে ঠেকেছে বারবেলায়। এবার সেদ্ধ ঘন ডালে পড়ল সবুজ পুঁইপাতা। ডালে পড়তেই জল ছেড়ে শাকের সবুজ গাঢ় হল আরোও খানিক। আবার ঢাকনা পড়লো কড়াইয়ে। বেলার আঁচ বাড়ছে আস্তে আস্তে, তা গিয়ে মিশছে কেরোসিনের নীলচে আঁচে। উপোসী মায়ের চোখেমুখে সেই আঁচ একটু একটু ক্লান্তির এঁকে দিচ্ছে। মা এবার অল্প করে রাঁধুনি বেটে নিল।
পুঁইশাক মজে আসতেই ডালও খানিক ঘন হয়ে উঠেছে। সেই ঘন ডালে আদা বাটা আর রাঁধুনি বাটা মিশিয়ে দিল মা। সঙ্গে সঙ্গে ঢাকনা পড়ে গেল ডালসুক্তোর কড়াইয়ে। আর স্টোভের নীলচে আঁচ নব ঘুরিয়ে নিভু নিভু করে দিল মা।
মসজিদের মাঠ থেকে ভেসে আসছে গুড়ের শিন্নির ঘ্রাণ। এই ঘ্রাণ আমার খুব চেনা। আমেনা চাচী আর আইনুল চাচার কথা মনে হতেই আমার মনটা হু হু করে ওঠে। শিন্নির ঘ্রাণ ফেলে মন খুঁজতে থাকে মাদলা গ্রামের সর্ষেফুলের ক্ষেত। কবে যাবো আমি সেই গ্রামে, কবে আমেনা চাচীর দুয়ারে বসে শিন্নি খাবো?
আনমনা আমি মায়ের ডাকে সাড়া দিতেই ভুলে গেছি।
দুপুরের পাত পড়েছে আজ কলাপাতায়। পাঁচশাক, তেতো ভাজা, ডালসুক্তো আর শুকনো বরইয়ের টক। আর শেষ পাতে টক দই আর গুড়।
আজ দুপুরে মুসার মা আসেনি। মসজিদের মাঠে শুরু হওয়া পার্বণ রেখে আজ তাঁর আসার সময় নেই।
বেলা পড়ে এসেছে। লেপে রাখা উঠোনে মা পুঁতে দিলো বেলপাতার ডাল। আতপ চালের পিটুলিতে আঁকলো পদ্মপাতা। সামনে কলার মাইজে ফল প্রসাদ। শেষ চৈত্রের বেলা পড়তেই চায় না। গাছের মাথায় রোদ রেখেই মা ষষ্ঠীপূজায় বসে। পাঁচপ্রদীপ আর ধূপের ধোঁয়া চিলতে উঠোনে জায়গা করে নিতেই মাঠের মসজিদ থেকে ভেসে আসে আছরের আজান,
আল্লাহু আকবর
আশ্হাদু-আল্ লা-ইলাহা ইল্লালাহ…
এরপরেই শুরু হবে মোনাজাত। মুসার মা বলেছে খড়া কেটে বান নামার জন্য আজ সবাই দু-হাত তুলবে। তারপর কলাপাতায় গুড়ের শিন্নি বিলানো হবে সবাইকে।
আমি জানি সেখান থেকে কলাপাতায় চড়ে আমার জন্যও গুড়ের শিন্নি আসবে। তাই আমিও মনে মনে বলি,
বৃষ্টি নামুক, বান নামুক, বিলের জলে ডিঙি ভাসিয়ে আইনুল চাচার বাড়ি যাবো…
উঠোনে পুঁতে রাখা বেলপাতার ডালে মা দুধ ঢালে, জল ঢালে, মধু ঢালে। সেই দুধজল শুকনো উঠোনের মাটি নিমেষে শুষে নিতেই মা বিড়বিড় করে বলা শুরু করলো,
খরা কাটুক জল নামুক…..